শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরাও সন্ত্রাসী

কানাডার ফেডারেল সরকার প্রাউড বয়েস সহ মোট ১৩টি চরমপন্থী গ্রুপকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।। ছবি : সিবিসি

কানাডার ফেডারেল সরকার গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রাউড বয়েস সহ মোট ১৩টি চরমপন্থী গ্রুপকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১৩ টি সন্ত্রাসী সংগঠন এর মধ্যে শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদে বিশ^াসী দল রয়েছে চারটি। এগুলো হলো- The Proud Boys, Atomwaffen Division, the Base এবং Russian Imperial Movement। কানাডার এই উদ্যোগ আদর্শিকভাবে অনুপ্রাণিত চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ আসলে নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের কারণে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। উপনিবেশকাল শেষ হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি ইত্যাদির ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতির ফলে সেটা অনেকটাই কমে আসে। তবে এক শ্রেণীর শ্বেতাঙ্গদের মনে ও বাসনায় তা বরাবরই সুপ্ত ছিল এবং এখনো আছে। গত কয়েক বছরে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া জুড়ে জনতুষ্টিবাদ বা লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় উগ্র এবং কোন কোন ক্ষেত্রে জঙ্গী শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অবকাশ পায়। ২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণ করে নির্বাচিত হলে সে দেশে নানা শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম এডরোপা, প্যাট্রিয়ট ফ্রন্ট, এ্যাটমওয়াফেন ডিভিশন, ডেইলি স্টর্মার, ভ্যানগার্ড আমেরিকা, আমেরিকান রেনেসাঁসহ আরও কয়েকটি ছোট-বড় দল ও সংগঠন। কানাডায় Proud Boys, La Meute এবং Soldiers of Odin এর মত কিছু উগ্র শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠনের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এই সংগঠনগুলো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও নব্য নাৎসিবাদের সমর্থক। তারা বর্ণবাদী, এ্যান্টি সেমেটিক তথা ইহুদী বিদ্বেষী এবং সর্বোপরি মুসলিম ও অভিভাসন বিরোধী। গত ৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা এ্যান্টি ডিফেমেশন লিগ (এডিএল) নামের একটি সংগঠনের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের উস্কানিতে ১ হাজার ১৮৭টি হিংসা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪২১টি। অর্থাৎ, এক বছরে বেড়েছে ১৮২ ভাগ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে নরওয়ে, সুইডেন, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানিসহ অন্যান্য আরো কয়েকটি দেশে। এর সর্বশেষ উদাহরণ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদ ঘিরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। যেখানে প্রায় অর্ধশত মুসলিমের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। উল্লেখ্য, এই ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন ব্রেন্টন টেরান্টকে হাতকড়া পরা অবস্থায় যখন রিমান্ডের জন্য আদালতে হাজির করা হয়, তখন তার মুখে ছিল হাসি এবং হাতের আঙ্গুলের ইশারায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের প্রতীক।
বিশ্বখ্যাত জিনবিজ্ঞানী নোবেল জয়ী জেমস ওয়াটসন কিছুদিন আগে জিনগতভাবে শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকানদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দাবী করে রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তবে তাঁর এই বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয় এবং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীরাই তা প্রত্যাখ্যান করেন। পৃথিবীতে কোন জাতি বা ধর্ম শ্রেষ্ঠ এই বিতর্ক অর্বাচীন ও অর্থহীন। সব ধর্ম ও জাতিতেই ভাল-মন্দ আছে। শিক্ষা-সভ্যতা ও সংস্কৃতি একটি দেশ, জাতি ও ধর্মকে বুদ্ধিদীপ্ত ও শাণিত করে ক্রমশ। সেই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ইসলাম নামধারী এক শ্রেণীর জঙ্গীরা যেমন মনবতার জন্য হুমকী সৃষ্টি করেছে তেমনি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও নব্য নাৎসিবাদীরাও ক্রমান্বয়ে বিশ্বের বহুত্ববাদের সংস্কৃতির জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। অতএব সময় থাকতে সাবধান। সন্ত্রাসীদের কোন জাত ধর্ম নেই। বিশে^র সার্বিক মানব কল্যাণের জন্য এদেরকে সময় থাকতে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে।