প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭৭

ডিসেম্বর ৩, ২০২০

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

কিছুই থাকেনা হাতে

ছুঁয়ে থাকা যায় না কিছুই

আকাংখায় ডেকে এনে শুধু তারে অতীতে হারানো

যেইখানে শুরু তার,

শেষ তার সেখানেই – !!

নিকোলের সময় সীমা দ্রুতলয়ে গড়িয়ে চলছে সামনে। আমি পেইন্টিং এর এই অপার ভান্ডারে এসে ক্রমাগত অথৈ জলে ডুবে মরছি। এখন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে, দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে রুদ্র গোস্বামীর কবিতাটি ভাবছিলাম।

ভিনসেন্ট ভ্যান গগ এর এক্সিবিশন আজ। গোটা প্যারিস শহর এবং প্যারিসে আসা টুরিস্টরাও তা জেনে গেছে। এবং মজার ব্যাপার পরিলক্ষিত হলো, খুউব বেশী ভীড়, সম্ভবত কৃর্তপক্ষ এড়াতে চায়। তাই সিকিওরিটিরা ঠিক মত বলছে না, ঠিক কোন সাইডে বা কোন রুমে। আমি পর পর তাদের নির্দেশনায় কথিত স্থানে গিয়ে দেখলাম, সেখানে মোটেই ভ্যান গগের এক্সিবিশন হচ্ছে না। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। অতএব, আমার স্বামী আমাকে আর্ট গ্যালারীর ঠিক মাঝখানে যেখানে প্রদর্শিত হয় সবার ভাস্কর্য্যগুলো, সেখানে আমাকে রেখে সে খুঁজতে বের হলো। এবং প্রতিবার তারা নাকি এটা করে। স্থানীয় একজন বৃদ্ধাও আমাকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে বললেন। আমি যারপর নাই বিস্মিত এবং বিরক্ত হচ্ছিলাম। আমি বললাম, কর্তৃপক্ষ কেন এটা করে? বৃদ্ধা মহিলা যা বললেন, তার সারমর্ম হলো, যারা পাবলিকলি বেশী ফেমাস, সেই দিনটাতে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। আর এক্সিবিশনের দিনটাতে দর্শনার্থীরা অন্য রুমটাতে না গিয়ে ওখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

আমি নিজেও দুইবার ভাঙ্গা ‘পা’ নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরলাম। যাইহোক, একটু পর একজনকে ফলো করে, কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছালাম। কতগুলো বেলুন হার্টের মধ্যে ভ্যান গগের ছবি দিয়ে সাজানো।

ভিনসেন্ট ভ্যান গগ এর আর্ট । ছবি : লেখক

দ্রুত পায়ে ওখানে পৌঁছালাম। ভেতরে ঢুকে মনে হচ্ছিল, খুব ছোটবেলার কোন বন্ধুর সাথে দেখা হলো। বহু বছর পর। হারিয়ে গিয়েছিল কোন অজানায়। হয়ত তার উপর হালকা পাতলা একটা দুর্বলতা ছিল। যাকে দেখলে হৃদয়ের গহিনে একটা সুখের অনুভূতি ছড়াতো। কথা বলতে গেলে, কপোলে হালকা লালিমায় ভরে যেত। হঠাৎ আমার হাসি পেয়ে গেলে। এরকম কেউ ছিল নাকি? মনে তো পড়ছে না। আমিতো মেয়েলি স্বভাবের কন্যাই ছিলাম না। অতএব ওরকম অনুভূতি হবার কথা নয়। তবে ভ্যান গগের এই বিশাল কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে আজ এই অনুভূতি হলো।

বহুকাল ধরে যখন থেকে ভ্যান গগ এর জীবন কাল সম্পর্কে জেনে ছিলাম, তখন থেকেই তাঁর প্রতি ছিলো আমার আপত্য ভালবাসা। আর কেন জানি বারবার আমি ভ্যান গগের সাথে, জীবনানন্দ দাশের একটা অদ্ভূত মিল খুঁজে পেতাম। যদিও শিল্পের আলয়ে দুজন দুই পথের পথিক। তবু কি এক আশ্চর্য রকমের মিল। একজন দক্ষিণ এশিয়া অন্যজন দক্ষিণ ইউরোপ। একজন তুলি শিল্পী, অন্যজন কলম শিল্পী। আর দুজন-ই ছিল জনম দুঃখী। অবাক করা ঘটনা, দুজন-ই বেঁচে থাকতে তাদের কর্মের প্রাপ্তি বা ভালবাসা পায়নি। মানুষের হৃদয় আলোকিত করেছে, তাদের মৃত্যুর পর। ব্যক্তিগত জীবনে এরা দুজনই খুব বেশী অসুখী অথবা অতৃপ্ত মানুষ ছিলেন। হয়তবা এই দুঃখ বোধের হেতু অথবা আদলের কিছুটা এদিক, ওদিক ছিলো। তাতে কিছুই আসে যায়না। তারা যে অসম্ভব অসুখী ছিলেন সেটা তাদের দুজনেরই শিল্প কর্মেই সমুজ্জল। এবং অত্যন্ত আশ্চর্য, যা আমার হৃদয় রীতিমত বিদির্ন করেছে, তাদের দুজনের অপমৃত্যু হয়েছে। আমি যখন জেনেছিলাম বিস্ময়ের বেদনায় স্তব্দ হয়েছিলাম।

এই দুজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ এর কথা ভাবতে ভাবতেই কখন জানি এক্সিবিশনের ভিতরে প্রবেশ করলাম। এটা একটা হলরূম। বিশাল ৫/৬ রূমের আদলে একটি কক্ষ বা হলরূম এর চারপাশে ভ্যান গগের ছবি দেয়ালে টাঙ্গানো। আবার মাঝখানে প্রচুর ছবি স্ট্যান্ড করে রাখা আছে।

ভ্যান গগের মজার দিক হলো আগেই বলেছি, তার নিজের বিভিন্ন সময়ের প্রতিকৃতি তিনি নিজেই এঁকেছেন। নিজের প্রতিকৃতি Falon এর পর সম্ভবত দ্বিতীয় স্থানেই ভ্যান গগের।

ইমপ্রেশনিষ্ট এর পরের দিকের আর্টিস্ট ছিলেন প্রখ্যাত এই কিংবদন্তী ভ্যান গগ। তার জন্ম হয়েছিল ন্যাদারল্যান্ডের দক্ষিণ জুনডার্ট এ। তার মৃত্যু হয়েছিল ফ্রান্সের অভর-সু-আইস এ। ভ্যান গগ নিজেই নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

এ কথাটি লিখতেই আমার বুকটি ভেঙ্গে যাচ্ছে। বেঁচে থাকতে তিনি এতটাই হতাশায় নিমজ্জিত ছিলেন যে, প্রথমত নিজেকে এই লাইম লাইট থেকে অর্থাৎ প্যারিস থেকে সরিয়ে নিয়ে যান অনেক দূরে। এক যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মানুষ আবার নিজের একটি বলয় তৈরী করতে চেয়েছিলেন। তাই প্যারিসের এতদিনের শেকড় উঠিয়ে, ফ্রান্সের অন্য একটি প্রভিন্স অভর এর সু-অইস এ চলে যান। এখানে উনি নিজের মত করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। তাও পারলেন না। যন্ত্রণায় দগ্ধ শিল্পী, নিজেকেই নিজে গুলি করে না ফেরার দেশে চলে যান। সেখানে হয়ত প্রিয় ভ্যান গগ শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন।

যখন ভ্যান গগ নিজেকেই নিজে জানতে পারেননি, সেই তখন-ই বেশ অল্প বয়সেই উনি জীবনের প্রথম চাকরী নেন একটি আন্তর্জাতিক আর্ট ডিলিং কোম্পানীতে। উনি নিজেই যে একজন আর্ট এর আঁধার, সেটা আবিস্কার করেন আরো অনেক পরে। যদিও টুকটাক উনি পেইন্ট যে করতেন না তা নয়। তবু একজন পেস্টরের সন্তান হিসেবে নিজেকে হয়তো বা একজন চিত্রকর হিসেবে ভাবেন নি। উনার বাবা খ্রীষ্ট ধর্মীয় একজন নেতা ছিলেন।

ভ্যান গগের তিন বোন এবং দুই ভাই ছিলো। তবে ছোট ভাইয়ের সাথে তার সখ্যতা বেশী ছিল। এ দুজন একসাথে ছোটখাট ব্যবসাতেও জাড়িয়ে ছিলেন। যদিও খুব বেশী দূরে সেটা এগোই নি। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব বেশী স্বচ্ছল না হওয়াতে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তাকে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। এবং তার আঙ্কেলের একটা ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ডিলারশীপে চাকরী নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ জন্য একদিকে যেমন ছিল মনোকষ্ট, আবার তার ভেতরে চেপে থাকা আর্টিস্ট ভ্যান গগ এই চাকরী করার সময়ই বের হয়ে আসে এবং এই চাকরী সুবাদে তার অনেক উপকারও হয়। কেবল মাত্র আর্থিক স্বচ্ছলতাই আসেনি। যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ডিলারশীপ এটা, তাই প্রচুর বিদেশীদের সঙ্গে তাকে ডিলিং করতে হতো। আর সেই সময়ই কেবলমাত্র ডাচ ভাষী ভ্যান গগ ফ্রেন্স, জার্মান এবং ইংরেজী ভাষা রপ্ত করে ফেলেন। খুব দ্রুত এই ভাষা তিনটিতে দক্ষতাও লাভ করেন। মজার ব্যাপার যে এতটা উনি ভাষাগুলোতে দক্ষাতা অর্জন করেন যে পরবর্তীতে উনি এর শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন।

আমরা যে ভ্যান গগ কে চিনি অর্থাৎ একজন প্রখ্যাত পেইন্টার ভ্যান গগ, সেটাতে উনি এসেছিলেন ধরতে গেলে জীবনের শেষ ভাগে। আশ্চর্য হলেও এটা সত্যি। কারণ আর কিছু না, পারিবারিক দারিদ্রতা। তাকে একের পর এক প্রফেশন চেঞ্জ করতে হয়েছে। আর্ট ডিলার, ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার, লে প্রিসার, এমনকি মিশনারী ওয়ার্কার হিসাবেও উনি কাজ করেছেন।

যার জন্য নিজের ভতেরের জীবন্ত প্রতিভা, বা নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দেবার জন্য জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে গেলেন। তার এই সুপ্ত প্রতিভা এসেছিলো কিন্তু তার মা, কর্নেলিয়া’র কাছ থেকে। তার মা আঁকতে খুব ভালবাসতেন। তার সেই

ভালবাসা তার প্রথম (বা দ্বিতীয়, কর্নেলিয়ার প্রথম সন্তান জন্মানোর কিছু আগেই পেটের মধ্যেই বা জন্মানোর সাথেই মৃত্যু বরণ করেন, তার নামও ভিনসেন্ট রাখা হয়। পরবর্তীতে ভ্যান গগ এর জন্মের পর, তার নামও ভিনসেন্ট রাখা হয়। সাথে জুড়ে দেওয়া হয় ভ্যান গগ) পুত্রের মধ্যেও ছড়িয়ে দেন তাঁর মা। সেই হিসাবে আর্টের প্রথম শিক্ষা গুরু তার মা কর্নেলিয়া। উনি ছিলেন জন্ম আর্টিস্ট। মা-ই তাকে আর্টর প্রকৃত কলা শিখিয়ে ছিলেন। এরপর উনি নিজে নিজেই আঁকতে থাকেন। ছোট বেলায় এবং কৈশর কাল পর্যন্ত উনি প্রচুর এঁকেছেন।

সেই অঙ্কন যত্রতত্র নষ্ট হয়েছে। তারপর প্রথম পুত্র হিসাবে সংসারের দায়ভার না চাইতেও তার কাঁধে বর্তেছিল। যার জন্য পড়াশুনাটাও ঠিক মত করতে পারলেন না। ঐ বয়সেই সংসারের দায়িত্ব যে ছেলেকে নিতে হয়, তার নিজের প্রতিভাকে প্রাধান্য দেবার সময় কোথায় তার? নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছার কোন সুযোগই তার ছিল না। অথচ উনার ভেতরের যে ভ্যান গগ তাকে বারবার প্রলুব্ধ করতো, বরেন্য সব আর্টিস্টদের পেইন্টিং গুলোর দিকে। তাইতো এই চেয়েও না পাওয়াটা, তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। একরাশ বেদনা, বিরক্তি তাকে ক্ষুব্দ করে তুলছিল। দিনে দিনে ভ্যান গগ পরিচিত মহলে একজন অত্যন্ত রাগী পুরুষ হিসেবে পরিচিত হতে থাকলেন। অত্যন্ত রাগী গয়ে পড়েছিলেন।

তবু জীবনের শেষ দশটি বছর নিজেকে সমর্পন করতে পেরেছিলেন নিজের ইচ্ছার কাছে। তার সুপ্ত প্রতিভার কাছে। (চলবে)

রীনা গুলশান।

টরন্টো। gulshanararina@gmail.com