প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭৬
নভেম্বর ৩, ২০২০
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
“জলের ভিতরে যেন পাথর এবং নুড়ি-
তোমার ভিতরে ভেসে থাকে-
হাজার হাজার প্রতিক্ষা তোমার,
তুমি আসছো না, তুমি আসছোনা,
কত লক্ষ বছর লাগবে আসতে??”
আসলেই আবুল হাসানের কবিতার মতনই লক্ষ বছরতো লেগেই গেল, এঁদের দেখতে। জীবনে কত কি দেখেছি, কত কি যে দেখিনি তার আর হিসাব এই অবেলায় নাই বা করলাম। পা দুটো টেনে টেনে এবারে বেশ কিছুটা ঘুর পথে এলাম অন্য আর একটি আলোকিত কক্ষে। এখানে অপেক্ষমান ছিলেন বিখ্যাত পেইন্টার এবং মূলত যার খ্যাতি ছিলো, ল্যান্ডস্কেপে। এবং অবশ্যই ইনিও একজন ইপ্রেশনিষ্ট পেইন্টার আলফ্রেড সিস্লে। আলফ্রেড সিস্লে’র জীবনের বেশীর ভাগ সময়টাই কাটিয়েছিলেন ফ্রান্সে। যদিও মাঝখানে অনেকটা সময় উনি ব্রিটেনে কাটিয়েছিলেন পড়াশুনার জন্য। প্রথমে তাকে ব্রিটেনে পাঠানো হয় বিবিএ’র উপর পড়াশুনা করার জন্য। চার বছর তিনি পড়েছেন বিজনেস এর উপর। কিন্তু যার হৃদয়ের পরতে পরতে রয়েছে এক জাগ্রত শিল্পমন, সে কি ভাবে বিজনেস এর উপর বসত করতে পারে? তার শিল্প সত্ত্বার প্রতিটি শিরা উপশিরায় তাকে ডাকছিলো প্যারিস এবং পেইন্টিং। অবশ্য ততোদিনে সিস্লে লন্ডনের সিটিজেন হয়ে গেছেন। তবু সেই সিটিজেনশীপ তাকে বাঁধতে পারলো না লন্ডনে। সেই তার চিরকালিন শিল্প নগরী তাকে ডাকছিলো বারম্বার। অতএব, আবারো ১৮৬২ সালে আলফ্রেড সিস্লে আর্টের উপর আরো তাত্বিকভাবে জানার মানসে আর্ট কলেজে ভর্তি হন।
আলফ্রেড সিস্লে প্রথম থেকেই মারাত্মক ভক্ত ছিলেন Claude Monet এবং Pierre-Auguste Renoir এর। শুধু ভক্তই ছিলেন না সিস্লে, রীতিমত তাঁদের অনুসারি ছিলেন। তাইতো বাকি জীবনটা তিনি নিজের দেশেই কাটিয়ে দেন তার প্রখ্যাত সব পেইন্টিং এর মাঝে।
আলফ্রেড সিস্লে জন্মগ্রহণ করেন অক্টোবর ৩০, ১৯৩৯ সালে (প্যারিস, ফ্রান্সে)। এবং মৃত্যুবরণ করেন জানুয়ারী ২৯, ১৮৯৯ সালে। বেশ অল্প বয়সেই আলফ্রেড সিস্লে মৃত্যুবরণ করেন। কিছুকাল থেকেই উনি থ্রট ক্যান্সারে ভুগছিলেন। আর এমতাবস্থায় হঠাৎ করে তাঁর স্ত্রী মারা যা। স্ত্রীর মৃত্যুতে সিস্লে আরো বিষন্ন হয়ে পড়েন। আর স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েকমাস পর সিস্লে মৃত্যুবরণ করেন। এত কঠিন সময়েও সিস্লে পুনরায় লন্ডন গমন করেননি। যদিও উনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ব্রিটেনের সিটিজেন ছিলেন। তাঁকে ব্রিটেনে পাঠানোর হয়ত এটাও একটা কারণ ছিলো যে তার বাবা মা দুজনেই ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। যদিও তার দাদী ছিলেন পিওর ফ্রেঞ্চ। তার বাবা মার চেষ্টার অন্ত ছিল না তাকে লন্ডনেই সেটেল্ড করবার। কিন্তু সিস্লে’র দাদী অর্থাৎ প্যারিস-ই তাকে বারবার টেনেছে। হৃদয়ের মধ্যে যার প্রগাঢ় শিল্প সত্ত্বা তাকে বিজনেসের দুনিয়া কি ভাবে আকৃষ্ট করবে?
Monet তাকে ছেলেবেলা থেকেই প্রবল ভাবে আকর্ষণ করতো। যদিও তাকে ইমপ্রেশন্সিট ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার বলা হতো। সিস্লে’র মারাত্মক মনোযোগ ছিল মূলত : ল্যান্ডস্কেপে। তার ল্যান্ডস্কেপ গুলো দেখলে মনে হয় ঐ সময়ের ঠিক ঐ জায়গাতে চলে গিয়েছি।
সময়ের অভাবের জন্যই এবারে একটু তাড়া করেই পাশের কক্ষে চলে গেলাম। কারণ ভ্যান গগ এর এক্সিবিশন শুরু হবার সাথে সাথে ওখানে যেতে চাচ্ছি। কারণ এখানকার স্থানীয়রা জানে যে, কবে কোন এক্সিবিশন হয়ে থাকে। তাই ভ্যান গগ এর এক্সিবিশন এ প্রচন্ড ভিড় হবে বলা বাহুল্য। আমাকে এটাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমার স্বামী। কারণ সে জানে আমি তাঁর পেইন্টিং কতটা পছন্দ করি। ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত আর্ট গ্যালারিতে তাঁর কিছু সংখ্যক পেইন্টিং দেখেই মাথা খারাপ হবার অবস্থা।
এখন পাশের কক্ষে অপেক্ষা করছেন ফ্রান্সের একজন প্রখ্যাত পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট আর্টিস্ট Eugène Henri Paul Gauguin. ইনারও কিছু পেইন্টিং আমি লন্ডন এবং ক্যালিফোর্নিয়াতে দেখেছিলাম। Gauguin এর বিশেষত্ব ছিল, কোনভাবেই কোন জোয়ারে উনি তাঁর চিন্তাভাবনাকে ভাসিয়ে দেননি। মজার ব্যাপার হলো Gauguin রং নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে খুব ভালবাসতেন। রীতিমত তাকে একজন কালার বিশেষজ্ঞ বলা হয়। যদিও উনিও একজন ইমপ্রেশনিস্ট পেইন্টার, তথাপি উনার তুলির আঁচর এবং রঙের তারতম্য আমাকে যথেষ্ট অবাক করলো। দেখলাম Gauguin গাঢ় রঙের উপর দারুন ভাবে অনুরক্ত ছিলেন। যার জন্য তার পেইন্টস এর প্রতিটি সেড, একটা বাচ্চা পর্যন্ত বুঝতে পারবে। এবং উনি পেইন্টিং এর মাধ্যমে কখন কোন মেসেজ দিতে চেয়েছিলেন, সেটাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। উনার এই রঙ্রে চমৎকারিত্বের জন্য অন্যদের থেকে তাকে সহজেই আলাদা করা সম্ভব। যদিও Gauguin এর জন্ম প্যারিসে। বেড়ে ওঠা প্যারিসে। পড়াশুনা সব কিছুই প্যারিসে হলেও, জীবনের শেষ দিকটাতে উনি ফ্রান্সের ‘ Polynessia’র প্রেমে পড়েন। এখানে উনি প্রচুর এঁকেছেন। জীবনের শেষ ১০টি বছর তিনি Polynessia-তেই থেকেছেন। তাই না ফেরার দেশে চলেও যান এখান থেকেই।
Paul Gauguin এর জন্ম জুন মাসের ৭ তারিখে, ১৮৪৮ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে। এবং মৃত্যুবরণ করেন মে মাসের ৮ তারিখে ১৯০৩ সালে ফ্রান্সের Polynessia শহরে।
Gauguin একজন পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট হলেও উনি মডার্ন আর্টের খুবই অনুরক্ত ছিলেন। এবং আর্টের ব্যাপকতাকে উনি খুব বেশী প্রশ্রয় দেননি। বরং পেইন্টিং এর মধ্যে সিম্বলিজম-কে দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যার জন্য উনাকে মানুষ সিনথেটিজম আর্টিস্টও বলে থাকে। বেশীর ভাগ মানুষেরই উনার আর্ট বুঝতে কিছুটা হলেও কষ্ট হতে পারে। প্রকৃতির অনেক পেইন্টিং এ দেখলাম, উনি অসাধারণ সিম্বল ব্যবহার করেছেন। উনার তুলির আঁচড় ও খুব অদ্ভুত ধরনের। বেশীর ভাগ আর্টেই উনি খুবই গাঢ় রঙ ব্যবহার করেছেন। একটা নারীর পেইন্টিং দেখে আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন, আমাদের সাউথ এশিয়ান কোন আর্টিস্ট এর করা। আমি যামিনি রায়ের একটি পেইন্টিং দেখেছিলাম দিল্লী আর্ট গ্যালারিতে। মনে হচ্ছে, এ যেন সেই মেয়েটি, প্যারিসে এস বসেছে। কিন্তু এতো সেই শাওতাল রমনী নয়। এ একজন ফরাসী রমনী। কিন্তু তার গাত্র বর্ণ গাঢ়, অর্থাৎ আমাদের গভীর শ্যামবর্ণ। কি আশ্চর্য। আমাদের শ্যাম বর্ণ এর সাথে ফরাসী রমনীর চোখ আর চুল, কি অসাধারণ কম্বিনেশন। Paul Gauguin এর প্রায় প্রতিটি পেইন্টিংএ আমার কিছু না কিছু বিষ্ময় ছিল।
তাঁর এই সিম্বলিক পেইন্ট, এবং রঙে’র এই আশ্চার্য ব্যবহার এতটাই আধুনিক ছিলো যে, পরবর্তী আর্টিস্টদের মধ্যেও দারুন প্রভাব বিস্তার করেছিল। এমন কি পৃথিবীর ৪/৫ জন বিখ্যাত আর্টিস্টদের মধ্যেও তার এই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তার মধ্যে যেমন দেখা যায় Henri matisse এবং প্রখ্যাত আর্টিস্ট Pablo Picasso.
মজার ব্যাপার Paul Gauguin এর পেইন্টিংগুলো যতোটা না তাঁর বেঁচে থাকতে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশী জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পেইন্টিং সম্ভার নিয়ে একটি এক্সিবিশন এর আয়োজন করা হয়। এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, এই এক্সিবিশন পৃথিবীর আজ পর্যন্ত ২/৩ টি জনপ্রিয় এক্সিবিশন এর একটি বলা হয়। Paul Gauguin শুধুমাত্র তাঁর পেইন্টিং এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না।
উনি অসাধারণ একজন স্কাল্পচারও ছিলেন। এবং ভাস্কর্যে Paul Gauguin একাধারে কাঠ এবং সিরামিক ব্যাবহার করেছেন। মনে মনে বলছিলাম, বাবা Gauguin তুমি কোনখানে ছিলে না? তবে এটাও সত্যি যে আরো বিষ্ময় অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। শেষ জীবনে উনি প্রচুর লেখালেখিও করেছেন। কারণ Gauguin এর বাবা ছিলেন একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক। সেই রক্ত তো তাঁর ধমনিতেও ছিল। তাই অবশেষে উনি লেখালেখিতেও মনোনিবেশ করেছেন। সাহিত্য থেকে পেইন্টিং এর উপরও উনি প্রচুর লেখালেখি করেছেন। সেগুলো তার পরবর্তী প্রজন্মদের প্রভূত উপকারে এসেছে।
Paul Gauguin একজন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। উনার মাতৃকূল ছিলো সম্পূর্ণভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। আর পিতৃকূল ছিলো লেখক, সাংবাদিক ইত্যাদি। Gauguin নিজের মতই চলতে পছন্দ করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে উনি নেভী’র কো-পাইলট হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২ বছর পাইলট হিসাবেও উনি নেভীতে সার্ভিস করেন। কিন্তু এতে উনার মন না বসাতে চাকরী ছেড়ে বিজনেসে মনোনিবেশ করেন। বিজনেসে উনার দারুন প্রতিপত্তি হয়। আর সেই সময় উনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। একজন ডেনিস কন্যার পানি গ্রহণ করেন। Mette Sophie Gad. যদিও উনি ডেনিস ভাষায় কথা বলতেন না। ৫ সন্তানের জনক ছিলেন তিনি।
জীবনের শেষ দশটি বছরে উনি এতটাই আর্টের উপর মত্ত হয়ে যান যে, এই সব কিছু থেকেই নিজেকে আড়াল করে কেবলমাত্র আর্টের সমুদ্রে অবগাহন করেছেন। এমনটি উনি প্যারিস সব পরিচিত অঙ্গন, কোলাহল, সবকিছু ছেড়ে সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে নিজের মধ্যে ফিরে পেতে Polynessia-তে গমন করেন। এবং এই Polynessia-তেই উনার জীবনের শ্রেষ্ঠ সবকিছু আমাদের জন্য রেখে যান। তার পেইন্টিং-ভাস্কর্য, লেখালেখি সব।
এবং Polynessia-তে Gauguin এর জীবনাবসন হয়। রেখে যান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তাঁর বহুল আলোচিত কীর্তি। (চলবে)
রীনা গুলশান।
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com