প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭৫
৮ অক্টোবর, ২০২০
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
আহা বারবার মনটা ব্যাথিত হয়ে পড়ছে। এখন মনে হচ্ছে, ইউরোপের পথে পথে না ঘুরে, এই গোটা সময়টা, আর্ট গ্যালারীতে কেন কাটাইনা? পর মূহুর্তে মনের ভেতরে আরো একটি ভাবনার উদয় হলো, এ সব তো মানুষের সৃষ্টি। সৃষ্টি কর্তার এই অপার মহিমা, তার কিই বা দেখেছি আমি? জীবনের ভূভাগ তো কেটে গেল না জানি কোন বিপথে? কি জানি তার কতটুকু পেয়েছি?? আবার ভাবলাম! তাইতো, এই অবেলায় এসে সেইসব ভেবে কাজ কি? তার থেকে এই দিনটির প্রতিটি মুহুর্ত কাজে লাগাই। এখনও তো অনেক গুলো প্রিয় মানুষ যাদের কীর্তি সামনে অপেক্ষমান।
দুটো কক্ষ জুড়ে আগাষ্টা রেনিঅরের চিত্রঙ্কন। কোনটা রেখে কোনটা দেখবো? দেখলাম, স্থানীয় জনগোষ্ঠি যারা এখানে ভিজিট করছেন, তারা ভীষণ ভাবে রিনিঅরের ভক্ত।
তবে আমার স্বামী বললো, অন্যদেরও দেখতে হবে। তারপর ফিসফিস করে বললো, এখন অন্যদের দেখি, চলো। আবার আসিবো ফিরে, এই মুসে ডি অরসি’তে। আমার কুলকুল করে হাসি পেল। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি নিয়ে অন্য রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
এই রুমে প্রবেশ করেতো আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। সব প্রায় নাচের ছবি। মনে হচ্ছে যেন একটা সময়ের বলরুমে ঢুকে পড়েছি। একদম সিনেমার মত।
এখানে সব Edgar Degas এর আর্ট। এডগার ডিগাসের খুব আশ্চার্য ধরনের পেইন্টিং এর সম্ভার। উনার জীবনের সমস্ত আর্টের অর্ধেকেরও বেশী নৃত্যের উপর। সম্ভবত উনি ড্যান্সের খুব ভক্ত ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের ড্যান্সের ছবি। ঘরোয় আড্ডায়, ক্লাবে, পার্টিতে বিভিন্ন ভঙ্গিমার ড্যান্সের ছবি। তবে একটি ড্যান্সের ছবি আমাকে আপ্লুত করে দিল। একটি পার্টিতে, একটি মেয়ে নাচছে। সবাই মনে হচ্ছে সবার মত নৃত্য করছে। একটি মেয়ে সবার মধ্যে থেকেও নিজেকে যেন আলাদা করে ফেলেছে। নৃত্য যে একটা শিল্প; সেই শিল্পের মধ্যে মেয়েটি শতভাগ ডুবে আছে। আপন আনন্দে সে নাচছে। কেউ যে তাকে দেখছে, বা কে কি করছে তার কোনই হুঁস নাই। সে নেচেই যাচ্ছে। এই পেইন্টিংটা আমাকে মুগ্ধ করলো। এবং সেই সময় যে সব ড্যান্স হতো বিশেষ করে ব্যালে ড্যান্স বা যে কোন ধরনের ড্যান্স, রীতিমত প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এখন যেটা মিউজিকে দেওয়া হয়। এবং একজন প্রশিক্ষক তাদেরকে পরিচালনা করতো। কাগজে কলমে। এবং মিউজিকের মত; ড্যান্সেরও বিশেষ করিকুলাম এবং ভাষা ছিল। সেটা দেখেই প্রশিক্ষক মেয়েদেরকে ড্যান্স শিখাতো। সেটার পরেও একটা পেইন্টিং দেখলাম। একটা চিত্রের মধ্যে সব বুঝিযে দিয়েছেন ডিগাস। এডগার ডিগাস শুধুমাত্র পেস্টাল আর্টেই ফেমাস ছিলেন তা নয়, উনি পেন্সিল স্কেচেও বিখ্যাত ছিলেন। তবে তার কিছু স্থাপত্য শিল্পে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তার একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি দেখে আমি বিমোহিত হলাম। উনি ১৯ জুলাই ১৮৩৪ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেপ্টেম্বর ২৭, ১৯১৭ সালে ফ্রান্সের প্যারিসেই মৃত্যুবরণ করেন।
সম্ভবত উনি যতোটা পেইন্টার ছিলেন, তার থেকে অনেক বেশী একজন ড্যান্সার ছিলেন। অথবা বলা চলে ড্যান্সের অনুরাগী ছিলেন। যার জন্য তার শিল্প কর্মের তিনভাগই ড্যান্সের উপর করা। সেই মডার্ন আর্টের সময়ে তার আর্ট আর একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ডিগাসের মডার্ন আর্টের পরিভাষায় ছিল একটা নতুন মাত্রা। উনি নিজের মধ্যেই থাকতে ভালবাসতেন। অন্যান্য পেইন্টাররা যেমন বাইরে অথবা বিভিন্ন প্রকিৃতির কাছে যে আর্ট করতে পছন্দ করতেন। উনি সেটা করতেন না। সাহিত্যের উপর গ্রাজুয়েশন করে উনি নিজের বাড়িতেই একটি স্টুডিও রূম করেন। এবং সেখানেই ডিগাস তার জীবনের ভূ-ভাগ কাটিয়েছেন। নিজের ভেতরে মগ্ন থাকতে ভালবাসতেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন। সেই থেকে বাবা এবং ব্যাচেলর মামা-চাচাদের কাছে বড় হয়েছেন। উনি অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং তার উপরই পেইন্ট করতে ভালবাসতেন। এরপর মেয়েদের স্নানরত ন্যুডিজমও তাকে আকর্ষণ করতো। উনার পেইন্ট, স্কেচ, ভাস্কর্য সবার থেকে যথেষ্ট আলাদা ছিল। যেমনটি ছিল তার ব্যক্তিগত জীবন, তার ব্যবহার এবং তার নিজস্ব চিন্তা ধারা। খুব ছোট বেলায় মাকে হারিয়ে জীবনটা বেশ বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিল। প্রফেশনাল লাইফ যথেষ্ট পরিমানে বিশৃঙ্খল ছিলো। কারো সাথেই তার বনাবনি হতো না। অত্যন্ত একরোখা এবং বেশ কিছুটা অহঙ্কারী ধরনের ছিলেন। এবং প্রচন্ড তার্কিক ধরনের ছিলেন। যার জন্য তার বন্ধু সংখ্যা ক্রমশ কমতে কমতে শেষ পর্যন্ত জিরোতে চলে গিয়েছিল। এমনকি তিনি জীবনে বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হননি। ডিগাস তার ব্যক্তিগত জীবন সন্তর্পনে রাখতেই ভালবাসতেন।
এরপর আমরা অন্য কক্ষে গেলাম যেখানে বিরজমান ছিলেন Paul Cezanne এর জগতটা। সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগত। ১৯ শতকের একজন সম্পূর্ন আলাদা ধরনের বিষয় নিয়ে উনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। Paul Cezanne জন্মেছিলেন ফ্রান্সে ১৯ জানুয়ারী ১৮৩৯ সালে। মৃত্যুবরণ করেন ২২ অক্টোবর, ১৯৩৯ সালে। সাধারণত উনাকে ইম্প্রেশনিস্ট আর্টের পরবর্তী যুগের একজন আইডল হিসাবে ধরা হয়। শুধু তাই নয়, মডার্ন আর্টে তাকে একজন অন্যতম প্রধান বলা হয়।
মজার ব্যাপার, ঐ সময়ের প্রায় সব আর্টিস্টরাই নিজের পোট্রেট করতেন। এমন কি ভ্যান গগ-ও। তবে সেজান এ ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে আছেন। যদিও নিজেকে আঁকার ব্যাপারে পৃথিবীতে সব থেকে এগিয়ে আছেলন ‘ফ্যালোন’। কিন্তু সেজান ও দেখলাম নিজেকে নানা ভঙ্গিমায় এঁকেছেন। ফ্রান্সের ‘এ্যাক্স’ প্রভিন্সে সেজানের জন্ম হলেও পড়াশুনা সেজান প্যারিসেই করেছেন। জীবনের প্রথম দিকে সেজান দারুন ভাবে রোমান্টিক এবং ক্ল্যাসিক্যাল আর্টের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মজার ব্যাপার টেবিলে ফল বা খাবারের ছবির যে পেইন্টিং এবং আলোকচিত্রটা আমরা মোটামুটি সবাই দেখে দেখে বড় হয়েছি, সেটা সেজানেরই সৃষ্টি। সেটার অরিজিনাল কপিটা দেখে আমি খুবই চমকে গিয়েছিলাম। এবং আমার কিঞ্চিত হাসিও পাচ্ছিল। কারণ ঐ টেবিলের উপর আপেল এবং চায়ের পটের ছবিটা অজস্রবার দেখেছি, কিন্তু কোথাও তার নাম মেনশন করা ছিল না। তাই আমরা জানতেও পারিনি এই বহু বার দেখা ছবিটি Paul Cezanne এর।
একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম সেজান এর গাঢ় রঙের প্রতি ভালবাসা। এবং উনার ব্রাশের ব্যবহার। এত নিখুঁত চিন্তাই করা যায় না। প্রতিটি আঁচড় সেজান খুবই ধীর স্থির ভাবে করেছেন। যারা একটু আর্ট বোঝেন তারা একবার দেখলেই বুঝে যাবেন, সেজানের তুলির প্রতিটি আঁচড় যেন কথা বলছে। আশ্চর্য জীবন্ত! মনে হচ্ছে আমি তার পেইন্টিংটা করতে স্বচক্ষে দেখছি।
এদের পেইন্টিং দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এই যে দর্শনার্থীর বেশীর ভাগ মানুষ কিন্তু আর্টিস্ট নন। এরা কেউ একটা তুলির আঁচড়ও দিতে পারেন না। যেমন আমি পারি না। তবুও দেখে যাই। বুঝে ফেলি এবং হৃদয়ঙ্গম করি ঐ সময়ে, ঐ আর্টিস্টের মনে কি চলছিলো। একেই বোধ হয় ভালবাসা বলে? আর্টের প্রতি। গানের প্রতি। মানুষের প্রতি। ভালবাসা গভীর না হলে, কাউকে এবং কোন কিছুকেই বোঝা যায় না। বুঝে নেবার, স্পর্শের সীমানায় তাকে আনতে হয়। (চলবে)
রীনা গুলশান।
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com