প্রবাসে পরহিতকর্ম -৭২
ইউরোপের পথে পথে
রীনা গুলশান
বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। আমরা দুজন আইফেল টাওয়ারের ভেতরে ঢুকে সেই ডানদিক বরাবর এসে দাঁড়িয়ে আছি। যদিও বসবার অনেক জায়গা আছে। জেমিমা আর তার বয়ফ্রেন্ড এক ছুটে খাবারের স্টলের দিকে গেল। ১০ মিনিটের মধ্যেই দেখলাম তাদের হাতে চলে এসেছে ডাবল বারগার। এটা দেখলেই আমার ভয় হয়। এত বড় বারগার দেখলেই আমার ক্ষুধা মরে যায়।
এখন উপরে যাবার পালা। সেখানেও যন্ত্রণা। উপরে যেতে গেলে, এলিভেটর ধরে যেতে হবে। এলিভেটরের সামনেও বিশাল লাইন। আমাদের হাত ইশারা করে ডাক দিলো নিকোল। এখানে লাইন দিতেই হবে। যেমন আমাদের টরন্টোর ‘সিএন টাওয়ার’এ বা দুবাইয়ের ‘বুর্জ খলিফা’তেও দিতে হয়।
তবে এখানে লাইন দেবার একটি মজা হলো, একেকবারে অনেক মানুষ দেখলাম ঢুকে যাচ্ছে। কারণটা পেছন থেকে বুঝতে পারছিলাম না। তবে বেশ অনেকটা সময় পরে আবার এলিভেটরটা নেমে আসে। যাইহোক, তৃতীয় বারে উঠবার সৌভাগ্য হলো। ওরা জানে ঠিক কতজন ওঠাতে হবে। ভেতরে ঢুকলাম বেশ খানিকটা বিস্ময় নিয়ে। দেখলাম এলিভেটরের ভেতরেই একজন ড্রাইভার, এক কর্নারে। একটু ঘেরা মত দেওয়া। যাতে তার খুব কাছে কেউ না যায়। তবু বেশ অনেকেই আমরা উঠেছি। নিকোল আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিঞ্চিত ভয় পাই এলিভেটরে। সিএন টাউয়ারের এলিভেটরে তো আমি পুরা সময়টা চোখ বন্ধ করে, দোয়া ইউনুস পড়ি। এত জোরে সাঁই সাঁই করে উপরে উঠতে থাকে যে, মনে হয় এই বোধ হয় আকাশ হতে ভূমিতলে ধপাম করে নিপোতিত হবো। ভয়াবহ লাগে ঐ সময়টুকু। নিকোল আগেই শুনেছিল আমার এলিভেটর ভীতির কথা। তাই পুরা সময়টুকু আমার হাত খুব শক্ত করে ধরে রইলো। মেয়েটার ভেতরে মাতৃভাবটা প্রবল। ঐ একদিনের মধ্যেই আমি নিকোলের প্রতি ভালবাসায় আবদ্ধ হলাম। উঠছিতো উঠছিই। প্রায় আকাশ সমান উচুতে আমাদেরকে উঠাতে শুরু করেছে।
আমি এদিকে ভাবতে শুরু করেছি এর উচ্চতা। আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা ৩০০ মিটার। তবে এর অগ্রভাগ পর্যন্ত ৩২৪ মিটার। ঐ ২৪ মিটার এলিভেটরে উঠা যাবে না। তবে প্রায় কাছাকাছি আবার তার সিঁড়ির ব্যবস্থা রেখেছে। যারা আকাশ ছুঁতে চায়, তারা উঠতেই পারে। আমি জানিনা; আমি আকাশ ছুঁতে চাই কিনা? এই জীবনে অমি কখনোই খুব বেশী কিছু চাইনি। তবু রাব্বুল আলামিন আমাকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। শুকর আলহামদুলিল্লাহ।
ভাবতে খুব ভালো লাগছে, এই আকাশ ছোঁয়া আইফেল টাওয়ার একজন ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্নের স্থাপত্য। গুসটেভ আইফেল। উনি যাই-ই করেছেন সবই আকাশ ছোঁয়া। সবই আশ্চর্যতম। উনার স্বপ্ন গুলো সব আকাশ ছোঁয়া ছিল। গুসটেভ আইফেল সম্ভবত উনার কল্পনার আকাশটাকেও ছুঁতে পেরেছিলেন। আইফেল টাওয়ার শেষ করার পর পরই গুসটেভ স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। মানুষটার স্বপ্ন এবং মানসিক বলিয়ানের ব্যাপারে কোন প্রশ্নই তোলা যাবে না।
যখন উনি ভাবছিলেন, উনি একটি উচ্চতর টাওয়ার নির্মান করবেন, উনি নিজেও বোধহয় ভাবতে পারেননি খুব শিঘ্র্রি এটা আকাশ ছুঁতে যাচ্ছে। পরবর্তীতে মানুষ আইফেল টাওয়ারে উচ্চতাকেও অতিক্রম করেছে। কিন্তু তাতে কিছুই আসে যায় না। এই টাওয়ারের মর্যাদা আজো এতটুকুনও ম্লান হয়নি। কারণ,গুসটেভ যখন এই টাওয়ারের পরিকল্পনা করেছিলেন তখন তার সামনে কিন্তু সিএন টাওয়ার বা বুর্জ খলিফা কিছুই ছিল না। তাই আজ পর্যন্ত গুসটেভকে কেউই অতিক্রম করতে পারেন নি। পরিকল্পনা কখন থেকে তার মস্তিস্কে শুরু হয়েছিল জানিনা; তবে বাস্তবায়ন শুরু করেন ১৮৮৭ সালের জানুয়ারী মাসের ২৮ তারিখ থেকে। শেষ করেন ১৮৮৯ সালে। মাত্র ২ বছর ২ মাস ৫ দিনের মাথায় আকাশ ছোঁয়া টাওয়ার শেষ করেন গুসটেভ। যা আজ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের বিস্ময় হয়ে আছে!
“আকাশ ঘুমিয়ে আছে, আকাশের নীল বিছানায়,
বাতাস হারিয়ে গেছে, যেখানে সবাই যেতে চায়-
আমাকে শিকল দাও, তুমি চাঁপাফুলগুলি নেবে??”
এবারে আমাদের এলিভেটর আস্তে আস্তে উঠা শুরু করেছে। খুব ইন্টারেস্টিং ভাবে। ঘটাং ঘটাং করে শব্দ হয়। আমার বেশ খানিকটা ভয় ভয় করছিলো। সিএন টাওয়ারে তো সাঁই সাঁই করে উঠেছি। আর এখন অত উপরে উঠছি। তবে এলিভেটরে অনেক মানুষ, তাই ভয় কিছুটা কম। নিকোল আমার হাত ধরেই ছিল, মায়ের মত। মেয়েদের ভেতরে যে মাতৃভাব থাকে, এবং সেটা তাদের জন্মগত ভাবে; নিকোলকে দেখে সেটা বোঝা গেল। সে আমার হাত একটা মুহূর্তের জন্যও ছাড়লো না। আমরা প্রায় আইফেল টাওয়ারের শেষ মাথায় চলে এলাম। অন্তত আমার তাই মনে হলো। অবশেষে একটি চাতালের ভেতরে প্রবেশ করলাম। অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো ফ্লোরটি। কেমন শূণ্যতায় ভরা। সুনসান। অথচ প্রচুর মানুষ। একদল উঠলাম। এক দল নামছে। তবু সুনসান। রহস্য কি? নিকোল আমাকে সামনের বেলকোনিতে নিয়ে গেল। ওহ্! ওয়াও! আমার সমস্ত শরীর এক অজানিত আনন্দে থরথর করে কেঁপে উঠলো। এই ‘চাঁদ ছোঁয়া’ আনন্দ এর আগে আমার কখনোই হয়নি। আমার স্বামী কাজিম খন্দকার-তো রীতিমত ছুটোছুটি শুরু করেছে। চারপাশেই। আমি সেটা করলাম না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গোটা প্যারিস শহরকে দেখছি। মূলত গোটা ফ্রান্সকে দেখছি। কারণ, নিকোল আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। প্যারিস শহর মোট ৭টি আইল্যান্ড নিয়ে নির্মিত। আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ৭ আইল্যান্ডের ব্রীজ গুলোই দেখালো। নাম বললো প্রতিটির। আমি আবার মুহূর্তের মধ্যে সেটা ভুলেও গেলাম। আমি ভাবছি নাম দিয়ে কাম কি? দেখা নিয়ে কথা! নয়ন সার্থক করা?? হায় আল্লাহ! আজ বুঝলাম প্রথম, নয়নের সার্থকতা কাকে বলে! তিনটার মত ব্রীজ একদম কাছ থেকে আমরা দেখেছিলাম, নৌ ভ্রমণের সময়। বাকী গুলো দেখলাম দূর থেকে। অপরূপ। মনে হচ্ছে, প্যারিসের ঐ সব বিখ্যাত আর্কিটেক্টরা নিপূন হাতে গোটা প্যারিসকে নিপূন তুলির আঁচড়ে রাঙ্গিয়েছে।
এরপর নিকোল দেখালো ‘নেপোলিয়ানের প্রাসাদ’। একটু পাহাড়ের উপর। আমাকে আগেই বলা হয়েছিল এটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত। এবং এর ভিতরে কোন গাড়ি যেতে দেয় না। সবাইকে পায়ে হেটে এবং পারমিশন নিয়ে যেতে হয়। অতএব আমিতো যেতে পারবো না। তাই দূর থেকে খুব ভাল করে, দূরবীনের সাহায্যে যতটুকু সম্ভব দেখলাম। তার বেশী উৎসাহ আমার এমনিতেই ছিলো না। যদিও আমার ভাই, বেনজীর আলম, বারবার বলেছিলো, এটা দেখার জন্য। অসাধারণ নাকি। এবারের মত ক্ষান্ত দিলাম। নেপোলিয়ান তো মরে ভূত হয়েছে। তার প্রাসাদ মরার চিন্তা নাই। তাই যদি কখনো আবার আসি, তখন দেখা যাবে।
খুব বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারিনা। তাই ভেতরে ‘রেস্টুরেন্ট’ এ গিয়ে একটিু বসলাম। বসে বসে এদের মেনু পড়ছিলাম আর দাম দেখছিলাম। আর একা একা হাসছিলাম। ছয় কোর্সের একেক জনের ডিনারের দাম দেখলাম ২৫০ ডলার না (ইউরো?)। তিনি কোর্সের একটা ডিনার একটু সস্তা, সেটা আবার কেবল মাত্র উইকডেস এ দেয়। তবু এক কাপ কাফি নিলাম। ১০ ইউরো। মানে প্রায় ২৫ ডলার কানাডিয়ান। আমার মোটেই ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু আমার স্বামী জোর করে দিল। কিন্তু, নিকোলকে হাজারবার বলা সত্তে¡ও সে কফি নিল না। কি জানি, হয়তো বা তার আত্ম সন্মানের ব্যাপার আছে। অনেকে ব্রাঞ্চ বা ফুল কোর্স খাবার খাচ্ছে। কিন্তু কোন কোলাহল নাই। জাগতিক সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, সবাই নীচে ফেলে এসেছে। এখানে এই আকাশ ছোঁয়া শুন্যতায় সবাই এক ধরণের শান্তি এবং স্বস্তির তৃপ্তিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকেই সিঁড়ি দিয়ে বাকিটুকু উপরে উঠলো। ৩ আশমান নাকি ৭ আশমান ছুঁয়ে এলো।
অতপর: আমাদেরকে নিকোল একত্রিত করে নীচে নামার জন্য আহ্বান করলো। এবারে নীচে নেমে আবারো আইফেল টাওয়ারের প্রতিটি কর্নার হাত দিয়ে ‘বুড়ি ছোঁয়া’ দিয়ে এলাম বাচ্চাদের মত। ছবি তুললাম।
এরপর আবার আমাদের গাড়িতে উঠলাম। মনে মনে বললাম, বিদায় আইফেল টাওয়ার। কোনদিন তোমাকে ছুঁতে পারবো, জানতাম না। আজ তোমাকে ছুঁয়ে গেলাম। আবার যদি ছুঁতে না পাই কোন দুঃখ নাই। ক্রমশ দূর থেকে দূরত্বের ব্যবধানে এলাম। এবারে আবার আমার স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার দেখতে পেলাম। এতক্ষণ ছুঁয়ে ছিলাম। তার ভেতরের স্থাপত্য, খানাখন্দ সব দেখছিলাম জাগতিক দুঃখ, বেদনার মত।
সব বৃহৎ কিছুই দূর থেকে অতিব সুন্দর। চাঁদের মত। কারণ কাছে গেলেইতো তার মানচিত্র বেরিয়ে যায়। দূর থেকে, সমস্ত স্বপ্নের সৌন্দর্য নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। কি অপরূপ, মোহনীয় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, স্থির, অচঞ্চল – আমার কল্পনার আইফেল টাওয়ার। (চলবে)
রীনা গুলশান।
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com