প্রবাসে পরহিতকর্ম -৬৬
জানুয়ারী ৭, ২০২০
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
লন্ডনে আজ আলোকিত সকাল। সকাল থেকেই বেশ সাজ সাজ রব আমার অতি নরম মনের, মায়ের মত বোনটির। হু! কাল রাতেই আমার স্বামী ড.কাজিম অতি কষ্টে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে আয়াত দুলাভাইকে আমাদের সাথে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যাবার জন্য। সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে যে মানুষটি সেই মানুষটা আজ কেবল-ই মসজিদ থেকে ঘর আর ঘর থেকে মসজিদ। এটাই তার পরিধি। কিন্তু, মাজেদা আপা, সেতো চিরকালিন এক সাধারণ বাধ্য স্ত্রী হওয়া সত্তে¡ও তার হৃদয়ের ভিতরে বসত করে অন্য এক রমনী। খুব রোমান্টিক এবং অতি সাহিত্য প্রেমী। উনি বিভিন্ন জায়গাতে ঘুরতে ভালবাসে। আমরা বলার সাথে সাথে একদম নেচে উঠলো। সকালে উঠেই আমাদের নাস্তা খাইয়ে উনি বিভিন্ন রকমের খাবার রেডী করা শুরু করলেন। স্যান্ডউইচ, পিঠা, বিভিন্ন রকমের ফল, জুস পানি। মনে হলো আমরা সপ্তাহের জন্য কোথাও ট্যুরে যাচ্ছি। এদিকে আজ আবার আমার ভাইপো আহসান আহমেদ রুশদীর একমাত্র শালী সানজীদা আক্তারের দেখা করার কথা আমাদের সাথে। লন্ডনেই তার বিয়ে হয়েছিল ৬ বছর আগে। স্বামী ওমরকে নিয়ে সে লন্ডনেই সুখেই ঘরকন্না করছে। আমি লন্ডনে আসবো শুনেই আমার আপার বাসায় ক্রমাগত যোগাযোগ করে যাচ্ছিল। আজ আমরা মিউজিয়াম দেখতে যাবে শুনে বলেছে সেও আপার বাসায় আসবে।
এদিকে ‘কুয়েট’ এ থাকা কালীন ড. কাজিম এর এক সাবেক কলিগ এর কন্যা সাইফা খান লোপা-ও বর্তমানে লন্ডনে স্বামী ও পুত্র নিয়ে বসবাস করছে। তার অবশ্য আগের দিন ওয়েস্টফিল্ড মলে দেখা করার কথা ছিল। পুত্রের অসুস্থতার কারণে আসতে পারে নাই। তবে আজ ফোনে জানালো, সে সরাসরি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আসবে আমাদের সাথে দেখা করতে।
সাড়ে নটার মধ্যেই সানজিদা আমাদের সাথে দেখা করতে এলো মাজেদা আপার বাসায়। সুদর্শনা শ্যানআক্তার (সানজিদা আক্তারের সর্ট ফর্ম করেছে সে) খুব হাস্যমুখি। খানিকটা মুডি টাইপ। সুন্দর ব্যবহার দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করলো। অনেক্ষণ আড্ডা হলো। অবশেষে সাড়ে দশটার মধ্যেই আমরা মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমরা আমাদের কাঙ্খিত ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পৌছালাম। মেইন গেটের প্রায় ৮০ ভাগ একটা বেরিকেড দিয়ে রেখেছে। সেখানে আগত দর্শনার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তারপর এয়ারপোর্টের মত একটা ছোট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকাচ্ছে।
আমরাতো ভাবছি আমাদের খাবারের বিরাট বহর ফেলে দেয় নাকি? মাজেদা আপার এত সাধের খাবার দাবার। নাহ্। দেখলাম কিছু ফেললো না। তবে অন্য কোন দেশে মিউজিয়ামে এতটা কড়াকড়ি দেখিনি। এ হলো এমন যেন “চোরের মন পুলিশ পুলিশ”। সারা পৃথিবী থেকে অমূল্য দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে নিজেদের মিউজিয়ামকে অমূল্য রতন করেছে। আর তারই নাম ব্রিটিশ মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামের বিশালতা এর টপ টু বটম। অনেক বড় জায়গা নিয়ে এর ব্যপ্তি। এবং পরম্পরা সাজানো সবই। অতি চমৎকার ভাবে। যারা ইতিহাস পড়েনি অথবা যারা জানতে চান কোন দেশ কিসের জন্য বিখ্যাত, তাদের জন্য অবশ্যই প্রতিটি কক্ষেই আছে অতি চমক। মিউজিয়ামে এবং আর্ট গ্যালারিতে কোন রকম তাড়াহুড়া করা যাবে না। আস্তে ধীরে দেখতে হবে। কিছু জায়গাতে ছবি তোলা নিষেধ আছে। যার যেখানে আনন্দ, সেসব জায়গাতে গেলে অবশ্যই কতটা সময় চলে যাবে নিজেও বুঝতে পারবেন না। প্রথমেই মুদ্রার ঘরে গেলাম। প্রাচীন যত মুদ্রা সবই এই ঘরে পাবেন। হাজার হাজার বছর আগের। বেশীর ভাগই দেখলাম স্বর্নমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা। এমনকি মজার ব্যাপার, কড়ি যে মুদ্রা আকারে ব্যবহৃত হতো, তার নমুনাও ওখানে আছে।
এরপর একের পর এক দেখে চলেছি। দেখার এবং চমকানোর শেষ নাই। আগেই বলেছি, সমস্ত পৃথিবীর আশ্চর্যতম জিনিশের সব মাস্টারপিসের কিয়দংশ ওখানে পাবেন। মধ্যপ্রাচ্যের সব ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী এখানে আছে। এই ব্রিটিশ মিউজিয়াম ১৭৫৩ সালে নির্মিত। এটা পৃথিবীর প্রথম জাতীয় পাবলিক মিউজিয়াম। এটা পাবলিকদের জন্য ফ্রি। এটা পরিদর্শন করতে টাকা লাগে না। সেই জন্য ইদানিং (বিভিন্ন জায়গাতে টেররিজমের কারণেই বোধহয়) প্রবেশের পথে অত্যন্ত কড়াকড়ি করছে। আমি মনে করি এটা করাও উচিৎ। মিউজিয়ামটাতে প্রায় আট মিলিয়ন কালেকশন আছে।
যারা বিশেষ করে সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে একত্রে জানতে চান তাদের জন্য বিৃটিশ মিউজিয়ামের থেকে ভালো স্থান আর কোথাও নাই। মানে হলো সমগ্র পৃথিবীর প্রাচীন আমার হাতের মুঠোয়।
বিশেষ করে ৫ মহাদেশকে তারা বিভাজন করেছে। এশিয়ান প্রচীন সভ্যতাটাই আমার কাছে মারাত্মক গভীর এবং দর্শনীয় মনে হলো। এর ব্যাপ্তিটা এত বেশী যে পুরোটা দেখতে গেলে এক মাসেও সম্ভব হবে না। আর মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে মিশরীয় সভ্যতার চুম্বক অংশ (বেশ গুছিয়ে) তারা তুলে এনেছে। আর ইউরোপের বিখ্যাত স্থাপত্য আর্টের শৈলী। তার সবই এখানে পাবেন। চৈনিক সভ্যতাও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
সবথেকে বড় বিষ্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে; সেটা হলো ‘ইসলামিক ওয়ার্ল্ড’ গ্যালারী। এটা অত্যন্ত বড় গ্যালারী। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবই অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। এখানে আমাদের ইসলামিক বিশ্বের এত আশ্চার্যজনক কালেকশন আছে যা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। বহু বছর আগের কোরআন শরীফ আছে। যা অত্যন্ত বিস্ময়ের। একটি কোরআন শরীফ দেখলাম, যার সাইড বর্ডার সম্পূর্ণ স্বর্ণ খচিত। ভেতরে সম্পূর্ণ গ্লোসী পেপারের মধ্যে সোনা এবং কালো কালির মিশ্রনে হরফ। এটা ইস্তাম্বুল থেকে পাওয়া। AH (AD ১৮০৮). এবং ইয়েমেন থেকে পাওয়া সম্পূর্ণ তামা এবং সোনার প্লেটের উপর নির্মিত একটা ওয়াল বোর্ড (অনেকটা দরজার মত দেখতে) আছে, যার উপর কেটে কেটে লেখা আছে কলমা, আল্লাহু, মুহাম্মাদুন ইত্যাদি। এত সুন্দর দেখতে; কতক্ষণ যে দাড়িয়েছিলাম ওটার সামনে! ইসলামিক ওয়ার্ল্ড বিভাগটি পরিচালনা করে বোখারী ফাউন্ডেশন।
পেইন্টিং এর গ্যালারীতে গিয়ে তো চোখ ছানা বড়া। পৃথিবীর এমন কোন বিখ্যাত পেইন্টার নাই যার পেইন্টিং এখানে নাই। আমার প্রথম এবং শেষ আগ্রহ যদিও পেইন্টিং; তবুও এখানে আমি খুব বেশী সময় ব্যয় করতে আগ্রহী ছিলাম না। পৃথিবীর কয়েকটি প্রখ্যাত আর্ট গ্যালারী আমি দেখেছি; তার মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার ‘হানটিংটন লাইব্রেরীর আর্ট কালেকশন দেখা না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানো যাবেনা। আর পরদিন এই আর্টের রাজধানী তথা প্যারিসে যাচ্ছি এই আর্ট দেখতেই।
ইতিমধ্যে সাইকা খান লোপা চলে এসেছে। বহুকাল পর দেখা। চোখের উপর জন্ম এই লোপার। আজ সে একটি ৬/৭ বছর বয়সী পুত্রের মা। বিশ বছর পর দেখা। অনেক্ষন জড়িয়ে রইলাম একে অপরের। গভীর ভালবাসায় স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে।
দুপুরে সবাই মিউজিয়ামের রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসে আমাদের বয়ে আনা স্যান্ডউইচ, পিঠা এবং ফল খেলাম। আর রেস্টুরেন্ট থেকে কফি নিলাম।
হালকা বিশ্রাম নিয়ে আবার হন্টন, পরিদর্শনের জন্য।
চাইনিজ সংস্কৃতির ওখানে গেলাম। চায়নার সিরামিক এবং পোরসেলিনের সামগ্রী ২০০০ বছর আগের। তাদের সিরামিকের কালেকশন ১৭০০ এর মত আছে, যা দেখলে নিশ্বাস বন্ধ হবার মত হয়। একটা নীল সাদা পোরসেলিনের ভাস এর মত আছে যা দেখলে বিশ্বাসই হবে না আপনার যে একটা ১৩৫১ সালে নির্মিত।
এরপর আমাদের যেটা সব চেয়ে বেশী টানছিল, সেটা হলো মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতা। মধ্যপ্রাচ্যের সভ্যতার মধ্যে তুরস্ক, ইয়েমেন, পারস্য (ইরান), ইজিপশিয়ান তথা মিশরীও সভ্যতাই উল্লেখযোগ্য। আর এর মধ্যে মিশরীয় সভ্যতাই সব থেকে প্রাচীন সভ্যতা যা কিনা এখনও প্রখ্যাত বিজ্ঞান বিশারদদের কাছেও বিস্ময়কর। এই জন্য ইজিপশিয়ান গ্যালারী সব থেকে বড় গ্যালারী এখানে। ৩০০০ বছর বছরের পুরনো সভ্যতার নিদর্শন আছে। তাদের হাজার হাজার বছর আগের একজন প্রখ্যাত রাজার স্থাপত্য আছে যা কিনা মনে হচ্ছে আকাশ ছোঁয়া। অর সব থেকে বড়, পৃথিবীর সপ্তম (পুরানো) আশ্চার্যের একটি তাদের ‘মমি’ সেটাও এখানে একখানা আছে। আমি গভীর আগ্রহে দেখছিলাম। মনে মনে কল্পনা করছিলাম এই তাম্রনির্মিত মমির বক্সে স্বয়ং মিশরের প্রতাপ, রানী ক্লিউপেট্রা ঘুমিয়ে আছেন। ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
এর পর একে একে অন্যান্য গ্যালারী দেখলাম। সব থেকে বড় সিংহ মূর্তি দেখলাম। ওখানে কয়েক হাজার বিভিন্ন ধরণের পশু পক্ষী এবং মানুষের ভাস্কর্য আছে। যার প্রতিটিই আপনাকে চমক দিবে।
এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় বিষয় হলো, Rosetta Stone. এটা ১৯৬ BC এর। এই গ্যালারীতে প্রচন্ড ভীড়।
এত বড় মিউজিয়ামের প্রতিটি জিনিশের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। এগুলো চোখে দেখতে হয়। দেখতে দেখতে এতটাই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম যে শারীরিক ক্লান্তিও বুঝতে পারছিলাম না। মিউজিয়ামের সময় শেষ। আমাদের আবশেষে বের হতে হলো। বের হবার সময় বারবার মনে হচ্ছিল, ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’। তবু হৃদয়ের মধ্যে অন্য এক আনন্দের ঐক্যতান বাজছিলো। কারণ আগামী কাল খুব ভোরেই প্যারিন যাত্রা। সে আনন্দের মদিরতায় দু’চোখ ছেয়েছিল। (চলবে) রীনা গুলশান
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com