প্রবাসে পরহিতকর্ম -৬৫

ডিসেম্বর ৭, ২০১৯

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

কাল রাতেই রায়হান বলে রেখেছিল, আগামী কাল তার প্রিয় কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করবে, যারা আমারও খুব প্রিয়। বহুকাল ওদের দেখেছি। তারা আমাদের সাথেও দেখা করতে চাইছে। বিকালে কোন একটা সময় আমরা দেখা করবো। কারণ, আগামীকাল ভোরের ফ্লাইটে রায়হান চলে যাবে স্পেনে। নিউক্লিয়ার প্লান্ট অবজারভেশনে। তার অফিসিয়াল ডিউটি এটি। আটদিন ওখানে থাকবে সে। তারপর আমরা আবার মিট করবো ইউরোপের কোন একটা দেশে।

সকালে তাই আর কোথাও বের হলাম না। আমার আপার চার ছেলে-মেয়ে। কারো সাথে তেমন দেখাই হলো না। একমাত্র তার বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেন আর তার অসম্ভব ভালো মনের বউ ‘পিয়া’ ওরা বারবার আসছে। মাকে সাহায্য করছে। কারণ ওরা দু’ব্লক দূরেই থাকে। মা বাবার বাজার করা থেকে বিল দেওয়া সব সাজ্জাদ ওরফে ‘মুক্তি’ করে থাকে। আজ এমনিতেও খুব ক্লান্ত লাগছিল। একদিন খুব ঘোরাঘুরি হয়েছে। যখন ভালো ছিল পা দুটো তখনও মনে হয় এত হাটিনি।

আজ দুপুরটা আপার বাসাতেই থাকবো। বিকালেতো কোন একটা মলে আড্ডা। তাই বাসায় বেশ ধীরালসে আড্ডা চলছিল আমাদের চারজনের-আপা দুলাভাই, আমরা দুজন। দুলাভাই তার জীবনের দারুন সব অভিজ্ঞতার বর্ণনা করছিলো। সব থেকে লোমহর্শক ছিলো ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তখন তিনি ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেখানে কিসের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তারপর পাকিস্তানে, বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় উনি পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন। কি ভাবে পালিয়ে এসেছিলেন তারা চারটি পরিবার, শুনতে শুনতে চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিলো। দুলাভাই খুব ধীর গতিতে এবং খুবই ডিভোটেড ভাবে তার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করছিলেন। এর মধ্যে কলিং বেলের আওয়াজ। একটু পরেই সিঁড়িধেয়ে উঠে আসছিলো হৈ চৈ করতে করতে আপার বড় মেয়ে সাজেদা হোসেন মুন্নি। মুন্নি তার বাসায় আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল। আমি সবিনয়ে আমার সময়ের স্বল্পতার কথা জানিয়ে অপারাগতা জানিয়েছিলাম। তাই আজ এ বেলায় আমি থাকছি বলে (মুন্নি সিনিয়র স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক) এবং দিনটি রবিবার ছিলো বিধায় আমার সাথে নিজেই দেখা করতে চলে এসেছে। মুন্নি যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনি পড়ালেখায়। ডবল মেজর করা মাস্টার্স। অসম্ভব হাস্যময়ী এবং সুহাসিনি। সাথে ছিল মুন্নির প্রিয় মানুষ – ওর বেটার হাফ ‘অনুজ’। খুব হ্যান্ডসাম এবং মিষ্টভাষি। অনুজের মা-ও ছিলো সাথে। উনি ঢাকায় নামকরা একটি স্কুলের শিক্ষিকা। খুব আনন্দ হলো, আমাকে উনি দেখতে এসেছেন। আরো প্রীত হলাম, মুন্নির শাশুড়ী আমাকে একটা দারুণ উলেন শাল উপহার দিলেন। আমার গোটা ইউরোপ ট্যুরে শালটা অনেক কাজে লেগেছিল। কারণ আমি গলায় নিয়েছিলাম পাতলা পশমিনা। পরে সুইজারল্যান্ডে দেখলাম খুবই ঠান্ডা। তখন খুবই কাজে লেগে গেল শালটা। এখনও খুব আদর করে ব্যবহার করি। কেউ আমাকে কিছু উপহার দিলে আমি দারুণ এনজয় করি। এবং উপহারকে খুবই কদর করি। আমি মানুষকে খাওয়াতে এবং দিতে খুব ভালবাসি। তাই কেউ আমাকে ভালবেসে যাই-ই দিক না কেন, আমি সেটা মাথায় তুলে রাখি। দুপুরে সবাই মিলে খুব মজা করে খেলাম। রায়হান আসলো না। সেতো ওয়েস্ট হ্যাম এ হোটেল ‘ক্রাউন প্লাজা’য় আছে, বন্ধু পরিবৃত হয়ে। যেখানেই যাক না কেন, পৃথিবীর যে মাথায়, রায়হান তার বন্ধু জুটিয়ে ফেলে।

অবশেষে রায়হানের ফোন এলা, আমাদেরকে রওনা হবার জন্য বললো। আমরা বিকাল ৩টার দিকেই রওনা দিলাম। এটা লন্ডনের সব থেকে বড় মল। ‘ওয়েস্ট ফিল্ড’ মল। ওখানেই গেটের সামনে রায়হানের জাহানাবাদ ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের বেশ কিছু বন্ধুরা আসবে। কেউ কেউ আবার হোয়াইট চ্যাপেলে দেখা করে গেছে। খুব বেশীক্ষণ যে লাগলো তা নয়। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। দেখলাম গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জন, টিনা, তিথী। একমাত্র তিথী ওর ক্লাশমেট। অঞ্জন আর টিনা রায়হানের সিনিয়র। তিথীর কোলে তার ছোট্ট ছেলে বাবুটা। সাইকা সরকার লোপা এখনও আসেনি। সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কি যে আনন্দ লাগলো ওদের সাবাইকে দেখে। কত ছোট ছোট দেখেছি। চোখের উপর সব বড় হলো। ওদের বিয়ে হলো। এখন বাচ্চার মা-বাবা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত লোপা জানালো যে সে আসতে পারবে না। ওর ছেলেটাকে নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। বলেছে, আগামীকাল নাকি আমাদের সাথে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দেখা করবে। আগামীকাল গোটা দিনটাই রেখে দিয়েছি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের জন্য। লন্ডনে দেখার জিনিশ বলতেই ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম’ আমার মতে।

লন্ডনের ওয়েস্ট ফিল্ড মল এর ফুড কোর্টে লেখিকা ও তার আত্মীয়-স্বজন। ছবি:লেখিকা

ওয়েস্ট ফিল্ড মলটা বেশ বড়সড়-ই। সব থেকে বড় যেটা, সেটা হলো খুব ছিমছাম। সাজানো গুছানো। এমনিতেই মল দেখবার আমার আগ্রহ একেবারেই নাই। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মল ‘ইটন সেন্টার’ এ আজ ১৮ বছর ধরে কাজ করছি। তাই এই অনাগ্রহ। তাছাড়া লন্ডনে শপিং করবারও কিছু নাই। কানাডার সাথে তুলনা করে দেখলাম, কানাডাতেই সব কিছুর দাম কম। তাছাড়া ব্র্যান্ড নেমের দোকান সব একই। কিছু কিছু নিজস্ব দোকানও আছে।

বেশ খানিকটা ঘোরাঘুরি করে, অবশেষে আমরা ‘ফুড কোর্ট’ এ অবস্থান নিলাম। সব বন্ধুরা মিলে সাব্যস্থ

করে অবশেষে ‘সাউথ ইন্ডিয়ান’ এবং কিছুটা ইংলিশ ফুড অর্ডার করলো। এবারে অপেক্ষার পালা। সবাই মিলে হৈ চৈ করতে করতে ছবি তুললাম। তারপর সবাই মিলে স্মৃতির জাবড় কাটা। এর মধ্যেই মাগরীবের ওয়াক্ত হয়ে গেল। আমি সারাদিনই চেষ্টা করি অজু অবস্থায় থাকার। বিশেষ করে বাইরে কোথাও গেলেতো অবশ্যই অজু করেই বের হই। এখন ভাবছিলাম কোথায় মাগরীব এর নামাজটা পড়া যায়। এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি অঞ্জনের বৌ টিনা (টিনাও ক্যান্টনমেন্টের ছাত্রী ছিলো) আমাকে বললো-আন্টি নামাজ পড়বেন?

-হ্যা মা, অজু আছেই। শুধু একটু বসবার জায়গা পেলেই হতো।

-ওকে চলেন।

আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম ওয়েস্ট ফিল্ড মলে রীতিমত নামাজের জন্য আলাদা ঘর আছে। সুন্দর ব্যবস্থা। পরে জানলাম বর্তমানে লন্ডনে তিনজন মুসলিম এমপি আছেন। এমনকি এখানকার মেয়রও একজন মুসলিম। তারাই এসব সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছেন। আমার এত ভাল লাগলো। মহিলাদেরও বন্দবস্ত আছে। আমিতো চেয়ারও পেয়ে গেলাম। খুব আরাম করে নামাজ পড়লাম।

আবার ফুড কোর্টে। খুব মজা করে হৈ চৈ করে খেলাম। যতটুকু খেলাম, তার থেকে মজা করলাম শতগুন।

ফিরে এলাম। মনে হলো এক বুক কান্না নিয়ে। তিথীর জন্য খুব কান্না পাচ্ছিল। এত্ত মায়াকাড়া মেয়েটা। আর খুব স্পষ্টবাদী। এত সত্য কথা বলে মেয়ে যে রীতিমত চমকে যেতে হয়। আমাদের দেশের মানুষের মুখে খুব বেশী সত্য কথা বলতে শুনলে আমি যথার্থই আবাক হই। তিথীর বাবুটাও কি যে মিষ্টি হয়েছে। আসবার সময় মলে আমাকে জড়িয়ে ধরলো তিথী। বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো। মনে হলো লন্ডনে একটি মেয়েকে ফেলে এলাম।

পৃথিবীটাতে শুধুই মায়া ভরা। প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি দৃশ্য মায়াতে ভরা। এই মায়া কাটিয়ে উঠা বড়ই দুস্কর। যেদিন আমরা এই মায়া কাটাতে পারবো, সেদিন এই পৃথিবী থেকে, না ফেরার দেশে চলে যাওয়া অনেক সহজ হবে। (চলবে)

রীনা গুলশান

টরন্টো। gulshanararina@gmail.com