করোনার দিনগুলো

শুরু হয়েছে করোনা ভ্যাকসিন, বিশ্বজুড়ে স্বস্তি ও শঙ্কা

জানুয়ারী ৬, ২০২১

কানাডায় ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার করোনার টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর দেশটিতে ফাইজারের টিকার প্রয়োগ শুরু হয়। এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার আগেই মডার্নার টিকার প্রয়োগও শুরু হবে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও এস্ট্রোজেনেকার টিকারও অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী স্বস্তি হয়ে এসেছে এসব খবর। ফাইজারের টিকা প্রয়োগের দিনটি ছিল কানাডাবাসীর জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনার টিকার প্রয়োগ শুরু করে কানাডা। কানাডা ছাড়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, চিলি, কোষ্টারিকা প্রভৃতি দেশ ইতিমধ্যে এই টিকার প্রয়োগ শুরু করেছে। টিকা প্রয়োগের সাথে সাথে এই মহামারিতে আক্রান্তের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। বৃটেনে নতুন করোনা শনাক্ত হয়েছে। বৃটেন এখন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন বলা যায়। নতুন করে লকডাউন ও বেশি বেশি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

টরন্টোর একটি অলাভজনক নার্সিং হোমের এক কর্মী অনিতা কুইডানজেন দেশটিতে টিকা পাওয়া প্রথম কয়েকজনের একজন। তাঁকে টিকা দেওয়ার দৃশ্য টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। অনিতা টিকা নেওয়ার পর উপস্থিতি সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অনিতা বলেন, প্রথমে টিকা নিতে পেরে তিনি উত্তেজিত। তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন। টিকার প্রয়োগ শুরু হওয়া প্রসঙ্গে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, ‘এটা একটা বড় স্বস্তি।’ তবে ট্রুডো তাঁর ডোজ এখনই নিচ্ছেন না। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের প্রাধান্য দিতে হবে।’

ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনার টিকার প্রথম চালান গত ১৩ ডিসেম্বর কানাডায় পৌঁছায়। ২৪ ডিসেম্বর পৌঁছায় মডার্নার টিকা। এর আগে ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হেলথ কানাডা। তারা জানায়, টিকাটি নিরাপদ, কার্যকর ও ভালো মানের বলে প্রমাণ পাওয়ায় তা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কানাডা সরকার ইতিমধ্যে এই টিকার দুই কোটি ডোজের ক্রয়াদেশ দিয়ে রেখেছে। কানাডা মডার্নার টিকাও সংগ্রহ করছে। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ প্রায় দুই লাখ ডোজ টিকা পাবে কানাডা। জানুয়ারিতে আরো সাড়ে সাত লাখ ডোজ ফাইজারের টিকা আসবে। প্রয়োজনে তারা আরও টিকা কিনবে। কানাডার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কানাডার সবাই টিকা পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার পর মডার্নার টিকাও জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ১৫ ডিসেম্বর দেশটির খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) বলেছে, মডার্নার টিকা নিরাপদ এবং এটির কার্যকারিতা ৯৪ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির এই মূল্যায়ন মডার্নার টিকার ব্যবহারের পথকে উন্মুক্ত করেছে। ফাইজারের পর মডার্নার টিকা অনুমোদন পাওয়ায় মানুষের মনে এখন আশার সঞ্চার হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর এফডিএর বিজ্ঞানীরা মডার্নার টিকাকে কার্যকর ও নিরাপদ বলে ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার দুই দিন আগে টিকাটির জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন নিয়ে প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা পর্ষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ওই উপদেষ্টা পর্ষদ ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকাটির জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। পরের দিন ওই টিকার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় এফডিএ। এরপর সারা দেশে সীমিত আকারে শুরু হয়েছে টিকাদান কার্যক্রম।

মডার্নার টিকাটিতে বিশেষ কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। মারাত্মক ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। টিকাটির কার্যকারিতা ৩০ হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। সেখানে ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ কার্যকারিতার তথ্য পাওয়া গেছে। মডার্না বলেছে, অনুমোদন পেলে ‘ব্যাপক পরিমাণে’ টিকা তৈরি করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসভিত্তিক জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মডার্না। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন পর্যন্ত তাদের কোনো পণ্যই এফডিএ অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু বহুল কাঙ্ক্ষিত করোনা টিকা উদ্ভাবনের কারণে বিশ্ব পরিমণ্ডলের সামনে চলে আসে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে প্রতিষ্ঠানটি এখন ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই বছর এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার প্রায় ৭০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মডার্না আর ফাইজার-বায়োএনটেক টিকার মধ্যে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মডার্নার টিকাটি সাধারণ ফ্রিজে (মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) রাখা যাবে। কিন্তু ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকাটি মাইনাস ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে হবে। ফাইজারের টিকাটি জার্মানি, বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশে তৈরি করা হচ্ছে।

এদিকে যুক্তরাজ্যে করোনার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা। তারা দেশটির মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার রেগুলেটরি এজেন্সির (এমএইচআরএ) কাছে এই আবেদন করেছে। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক ২৩ ডিসেম্বর এ তথ্য জানিয়েছেন। দিয়ে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ জানায়, এমএইচআরএ ২৮ বা ২৯ ডিসেম্বর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার অনুমোদন দিতে পারে। যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা অনুমোদন পেলে তা ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে ভূমিকা নেবে। কারণ, ফাইজার-বায়োএনটেকের তুলনায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সংরক্ষণ, পরিবহন ও প্রদান অনেক বেশি সহজ হবে।

যুক্তরাজ্য সরকার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ১০০ মিলিয়ন ডোজের অর্ডার করে রেখেছে। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। অন্যদিকে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সাধারণ রেফ্রিজারেটরেই সংরক্ষণ করা যাবে। ফাইজারের মতো অক্সফোর্ডের টিকারও দুটি করে ডোজ নিতে হবে। ফাইজারের ক্ষেত্রে দুই ডোজের মধ্যে ব্যবধান তিন সপ্তাহ। অক্সফোর্ডের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান চার সপ্তাহ। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ বলেছে, অক্সফোর্ডের টিকা অনুমোদন পেলে তা করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বের অনেক দেশকে আত্মবিশ্বাস জোগাবে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ভারতে উৎপাদন করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন চেয়ে ইতিমধ্যে ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেছে সেরাম ইনস্টিটিউট। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা ভারতে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেলে তা বাংলাদেশের মানুষও পাবে। দুটি দেশের (বাংলাদেশ ও ভারত) বাজারে একই সময়ে টিকা দেওয়ার ব্যাপারে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে।

অন্যান্য কথা

এক জীবনে অনেক মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। গুনেও শেষ করা যাবে না সেই সংখ্যা। অনেক সম্পর্ক পথে গড়ে উঠে পথেই মিলিয়ে যায়। বাঁক ঘুরতেই ভুলে যাই আমরা। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে পরিচয়ের সংখ্যা বেড়েছে। শত, হাজার ছাড়িয়ে লক্ষে পৌঁছেছে। ফলোয়ার বেড়েছে, অনুরাগী বেড়েছে, বন্ধু বেড়েছে। পাবলিক ফীগার বা সেলিব্রেটি তকমা লেগেছে। নীল ব্যাজ জুড়েছে নামের সাথে। ভেরিফায়েড। গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিত্ব! প্রতাপশালী। আমার ধারণা মানুষ একসাথে অনেক সম্পর্ক মেইনটেইন করতে পারে না। সেটা করতে গেলে কারো সাথেই সঠিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। যেমন সংসারের পাঁচজনকে সমান খুশী করা যায় না। সবাইকে সমান খুশী করতে গেলে কাউকেই খুশী করা হয় না। হাতের পাঁচটি আঙ্গুল যেমন সমান না। সম্পর্কের নামে যেটা গড়ে উঠছে সেটা একটা ফানুষ। কচুপাতার পানি। একদিন হয়ত আবেগমাখা কথা হয়েছে দুদিন পর ভুলে যায় যে কি কথা হয়েছিল। সোশ্যাল মিডয়ার সম্পর্ক এমনই আলগা। এই আছে এই নাই।

মনে আছে যখন পত্রমিতালী করতাম তখন একটা চিঠির জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কখন ডাকপিয়ন আসবে! পথের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ডিকপিয়নের সাইকেলের ঘন্টি শুনলে বুকের মধ্যে একশটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠত। একটা সুগন্ধি মাখা চিঠির আবেদন ছিল অনেক তীব্র। একদিন কাঙ্খিত চিঠি না আসলে মন বিষন্ন থাকত। খাওয়া দাওয়া ভুলে যেতাম। ডিভোর্স হয়ে গেলেও মনে হয় আজকাল মানুষের এতো মন খারাপ হয় না। যত বেশি বেশি সম্পর্ক গড়ে উঠছে তত ভাঙ্গন বাড়ছে। আমার ফেসবুকের বন্ধুদের অনেকেই ব্রেকআপের কষ্টে ভুগছে। অনেক স্বপ্নের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে। ব্যাক্তি স্বাধীনতার নামে হুট হাট সংসার ভেঙ্গে দেওয়ার পরিণতি খুব ভাল হচ্ছে না। সাফারিং হচ্ছে দুই পক্ষেরই। একলা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। আবার সম্পর্কের মধ্যে থেকেও অনেক দম্পতি একলা। শরীরে একলা মনেও একলা। দুটি পাখী একটি ছোট্ট নীড়ে কেউতো কারো পানে চায় না ফিরে টাইপ। এই ধরনের সম্পর্ক আরো দুঃসহ, আরো ভয়াবহ। এক ছাদের নিচে কিন্তু কেউ কারো না।

কথায় আছে পরিচিতি হই কোটিক বন্ধু হই গুটিক। সবাই বন্ধু হয় না। হবে না। হওয়া উচিতও না। প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠা এতো সহজ না। তাই আমি মনে করি হাজারজন পরিচিত থাকুক কিন্তু বন্ধু হবে গুটিকয়; যাদের প্রতি মনোযোগী হতে পারবেন। যাদের সাথে শেয়ারিং থাকবে। যার দুঃখে ব্যাথিত হবেন, চোখের পানি ফেলবেন। সাফল্যে বুকে টেনে নেবেন, যাকে সম্মান করবেন, ভালবাসবেন, সবসময় কিছু পাওয়ার আশায় থাকবেন না। আজকাল এমন হয়েছে যে মানুষ শুধু পেতে চায়, দেওয়ার মানসকিতা তৈরী করতে হবে। দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ সেটা যে দিতে জানে সেই বোঝে। চেয়ে নেয়ার মতো গ্ল­ানিকর আর কিছু নাই। একজন ভাল বন্ধু আপনাকে অনেক কিছু দিতে পারে। একটা ভাল সম্পর্ক স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। সম্পর্কের প্রতি বিশ্বস্ত থাকুন। আমি নিজে সম্পর্ককে অনেক মূল্য দেই। আমি অল্পে সন্তুষ্ট একজন মানুষ। বন্ধুত্বে সুপিয়ারিটি কমপ্লেক্স থাকা সুন্দর দেখায় না। আমি বন্ধুদের কাছে খোলা কাগজের মতো। আমার মধ্যে লুকোচুরির কোনো ব্যাপার নাই। আমার লেখাতেও তাই। ভলবাসাই আমার কাছে মূলকথা।

নারীদের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা কে না জানে। অনেক ঘটনা আছে আমার জীবনে যেখানে নারী মূল ভূমিকায়। আমার প্রতি নারীদের আনুকল্যের ঘটনাও কম না। আমার কৈশোর কাল থেকেই এমন দেখে আসছি। ছোটবেলায় আমি দেখতে বেশ ভাল ছিলাম। নাদুস টাইপ ছিলাম। একবার কয়েকজন মিলে আমাকে মেয়ে সাজিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে গেলো। এটার নেতৃত্বে ছিল রুবি। আমরা সবাই প্রায় সমবয়সী। খেলার সাথী। আমাদের বিশাল বড় পরিবার। সেখানে গন্ডায় গন্ডায় ছেলে মেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি আমরা। বলতে দ্বিধা নেই আমাদের বাড়ির মেয়েরা সবাই খুব রুপসী। আমাকে দেখে মা চিনতেই পারেন নি। মাকে ভাল বোকা বানানো গেছিল।

স্কুলে পড়ার সময়ও অনেক মেয়ে আমাকে দেখে মুখ লুকিয়ে হাসত। কেনো কে জানে। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল খাল। সেখানে আমরা দলবেঁধে সাঁতার কাটতাম। খালের পাশ ঘেষেই রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে একদল মেয়ে স্কুলে যেতো প্রতিদিন। তারমধ্যে একটা মেয়ে ছিল অতিশয় রুপসী। যেনো একটা লাউডগা দুলে দুলে যাচ্ছে। বরিশাল সদর গার্লস স্কুলের ড্রেস ছিল গোলাপী রঙের। সাদা চুড়িদার, গোলাপী জামা আর সাদা ওড়নায় দারুণ ফুটে উঠত ফুলের মতো মেয়েগুলো। যেনো এক একটা গোলাপ ফুল হেঁটে যাচ্ছে। লাউডগার সাথে আমার প্রায় চোখাচোখি হতো!

যখন বিএম কলেজে পড়ি তখন এক আধটু লেখালেখি শুরু করেছি। বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব করি। একদল ছেলে মেয়ে নিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড করি। কলেজের ম্যাগাজিনে লিখি। আমার সঙ্গী ছিল বুকভিলার রুপক, পান্না সহ আরো অনেকে। একদল মেয়েও ছিল। সবসবময় আমাকে ঘিরে থাকত মেয়েগুলো। তারমধ্যে দু’ একজনের আমার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। আমারও কি ছিল না! ছিল। একজন আমাকে সবসময় বই দিত পড়তে, পত্রিকা থেকে লেখার কাটিং এনে দিত। সবসময় বলত, আমি যেনো ভাল কিছু লেখার চেষ্টা করি। শুধু চিঠি পত্রের মধ্যে যেনো সীমাদ্ধ না থাকি। যেনো গল্প উপন্যাস লিখি।

আর একটি মেয়ে সবসময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমিও তাকাতাম। লোকচক্ষুর আড়ালে আমাকে বড় বড় চিঠি দিত, চমৎকার বাক্য, শব্দ চয়ন আর সাহিত্যে ভরা চিঠি। সেসব চিঠিতে কখনো প্রেম ভালবাসার কথা থাকত না। আমি রিপ্লাই দিতাম। ততদিনে আমাদের বাড়িতে ফোন এসে গেছে। মেয়েটি বেশ দাপুটে ছিল। পয়সাওয়ালার মেয়ে। ডাক্তার কন্যা। কলেজের পর আমার সাথে তার ফোনে কথা হতো খুউব। কেউ কেউ হুটহাট বাড়িতেও চলে আসত। মা তাদের পরম যত্নে আপ্যায়ন করত।

তারপর একদিন আমি খুউব আকস্মিক ঢাকা চলে আসলাম। আমি লেখক হতে চাই এই দুর্নিবার নেশা আমাকে টেনে নিয়ে আসল ঢাকা। বরিশালের বন্ধু, একদল প্রেমিক, মা, ভাই বোন আর বাড়ির খেলার সাথীদের ছেড়ে চলে আসলাম ঢাকায়। এক অনিশ্চিত জগতে পা রাখলাম। ঢাকায় এসেও অনেক নারীর সহযোগিতা পেয়েছি। নাজমা খালা, বানী আপা ছিলেন তাদের অন্যতম। ১৯৮৪ সালে আমি একটি কবিতার গ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলাম। সেটির প্রকাশনার সব খরচ দিয়েছিলেন বানী আপা। অথচ বানী আপা ছিলেন আমার একজন ছাত্রীর মা। আমি একটা টিউশানি করতাম গোপীবাগে। একবার একটা সাহিত্য পত্রিকা করলাম। নাজমা খালা তখন বিটপিতে চাকরি করেন। তিনি কয়েকটি বিজ্ঞাপন যোগাড় করে দিয়েছিলেন। আমার বেশ কয়েকজন নারী পত্রবন্ধু ছিল তখন। বিচিত্রায় লেখার কল্যানে অনেকের সাথেই সখ্যতা গড়ে উঠেছে ততদিনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও একদল মেয়ে বন্ধু আমাকে ঘিরে থাকত, যেমনটা ছিল বরিশালে। পড়া শুনার চেয়েও হাকিম চত্বর আর টিএসসিতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম। সাহিত্য নিয়ে কচকচানি হতো। দু একজন মেয়ে বন্ধুর সাথে আলাদা হয়ে যেতাম। গল্প করতাম। বয়সটাই ওরকম। ক্যাম্পাসে নারী বন্ধুদের মধ্যে হঠাৎ একদিন জেসমিন নামে একটি মেয়ে আমার মন জয় করে ফেলল।

বিদেশে আসার পরও আমি নারীদের অনেক ভালবাসা আর আনুকল্য পেয়েছি। আমার লেখার পাঠক বা আমার বইয়ের ক্রেতা নারীরাই বেশি। কি দেশে কি বিদেশে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার প্রতি সমব্যাথিও নারীরা বেশি। তারাই বেশি রেসপন্স করে। আমার নারী আত্মীয়রা আমার খুব অনুরক্ত। আমিও তাদেরকে ভালবাসি। তাদের যে কোনো প্রয়োজনে পাশে থাকি।

আমার বোন সাজুর সবচেয়ে অহংকারের নাম ছিলাম আমি। আমার মা ছিল আমার পৃথিবী। এখনও আমার মেয়ে অরিত্রি কখন আসবে সেজন্য সপ্তাহ জুড়ে আমি অপেক্ষা করি। জেসমিন যতই সারাক্ষন আমার ভুল ধরুক, যন্ত্রণা দিক আমি তার উপর একশতভাগ ডিপেনডেন্ট। নারী ব্যতীত জীবন অচল। আবার নারী কর্তৃক আমি যেমন অনেক কষ্ট পেয়েছি, তেমনি কষ্ট দিয়েছিও। তা সত্বেও নারীদের যে কোনো অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেই। কোনো ক্ষোভ পুষে রাখিনা।

আবুল হাসানের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি,

”এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া

তোমার ওখানে যাব, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছে,

তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’, শুদ্ধ হবো

কালিমা রাখব না”

এবং প্রসঙ্গ পদ্মা সেতু

বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। হাসিনা সরকার পুরো দেশকে এক সুতোয় বাঁধতে চাইছেন। একটা সমন্বিত নেটওয়ার্ক তৈরী করায় মনোনিবেশ করেছেন। কে না জানে যে একটা দেশের উন্নতি বা অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি অনেকটাই নির্ভর করে সে দেশের সুষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর। তাইতো উন্নত দেশগুলোর প্রথম নজর থাকে যোগাযোগের উপর। আমেরিকা, কানাডার মতো দেশগুলো রাস্তাঘাট তৈরী করে পরবর্তী দুইশত বছরের চিন্তা মাথায় রেখে। কানাডা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কিন্তু মানুষ মাত্র তিন কোটি সত্তুর লাখ। কিন্তু পুরো দেশ জুড়ে সুতোর মতো নেটওয়ার্ক। কানাডায় যত রাস্তা আছে তা একত্র করলে চাঁদে যাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকার কয়েক দফায় ক্ষমতায় থাকার সুফল জনগন পেতে শুরু করেছে। তার উৎকৃষ্ট উদাহরন পদ্মা সেতু। স্বপ্নের পদ্মা সেতু। অনেক চ্যালেঞ্জের পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনাকে স্যালুট জানাই। তার দৃঢ়চেতা মনোবলের কারণেই পদ্মা সেতু আজ বাস্তব রুপ পেতে চলেছে। পদ্মা সেতু যখনই চালু হোক না কেনো ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়া যাবে মাত্র তিন ঘন্টায়। ভাবা যায়!

বরিশাল যেতে কত ঝক্কি না পোহাতে হতো। একটা ঘটনা বলি। সেটা ১৯৯৪ সাল। একবার ঈদে আমার ছোট ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে বরিশাল রওয়ানা হয়েছি। সদরঘাট পর্যন্ত আসতেই অবস্থা কেরোসিন। টু স্ট্রোক অটো রিক্সা ছিল তখন। তার ভট ভট আওয়াজ আর বিকট ধোঁয়ায় অর্ক বমি টমি করে অস্থির। মহাখালি থেকে লঞ্চঘাট পৌছতেই সেদিন লেগেছিল তিন ঘন্টা। সদরঘাট পৌঁছে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। অর্কর বয়স তখন তিন বছর। মানুষের মাথা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। এদিকে লঞ্চগুলো মানুষের চাপ এড়াতে নদীর মাঝখানে নোঙ্গর করে রেখেছে। সেখানে পৌঁছানোও বিরাট ঝুঁকি।

আমি বললাম, জেসমিন চলো ফিরে যাই।

জেসমিন দুঃখিত কন্ঠে বলল, এতো কষ্ট করে এসেছি ফিরে যাবো! বরিশালে ঈদ করা হবে না! দেখোনা কিছু করা যায় কিনা।

আমরা অবশেষে একটা ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় উঠলাম। হুর হুর আরো কয়েকজন উঠে পড়লো। নদীল মাঝখানে গিয়ে নৌকা দুলছে মানুষের চাপে। যে কোনো সময় ডুবে যাবে! মনে হচ্ছিল আজই সলিল সমাধি ঘটবে। জেসমিন ভয়ে চিৎকার করছে। এদিকে ঘাটেই কুলিদের টানাটানিতে একটা বাক্স খুলে কাপড় চোপড় ছয়লাব হয়ে গেছে। এমন সময় আমাদের বিপদ দেখে কোষ্ট গার্ডের একজন তরুণ অফিসার ছুটে আসলো ইঞ্জিন বোট নিয়ে। আমাদের রক্ষা করল এবং লঞ্চে উঠিয়ে দিল। সেই অফিসারের কথা আজও মনে পড়ে।

এরপর থেকে সবসময় রকেট স্টিমারে বরিশাল যাওয়া শুরু করলাম। এক সময় দিনে স্টিমার সার্ভিস ছিল। অপূর্ব ছিল সেই জার্নি। সকাল ১১টায় সদরঘাট থেকে ছাড়ত সন্ধ্যা ছয়টায় বরিশাল পৌঁছত। তারপর দিনের সার্ভিস হয়ে গেলো রাতে। কেনো হলো কে জানে। সন্ধ্যা ছয়টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে সকাল ছয়টায় বরিশাল পৌঁছে যায়। বারো ঘন্টার জর্নি । সদরঘাট পর্যন্ত পৌঁছানোর ঝক্কিতো আছেই। আবার বরিশাল থেকে সন্ধ্যা ছয়টায় ছেড়ে সকাল ছয়টায় ঢাকা পৌঁছায়। ঢাকা বরিশাল যাওয়া যেনো এক যুদ্ধ এবং ব্যয়বহুল। শুধু তাই না, যারা প্রথম শ্রেনিতে জার্নি করতে চান তাদের জন্য টিকিট পাওয়া আকাশের চাঁদ পাওয়ার সমান। মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিসির অফিস। সেখান থেকে ফার্ষ্টক্লাসের কিকিট কিনতে হয়।

একবারের একটা ঘটনা বলি. সেটা ১৯৯৬ সাল।

আলাউদ্দিন নামে একজন টিকিট ক্লার্ক ছিলেন তখন। তাকে গিয়ে বললাম ভাই, টিকিট লাগবে। একটা ডাবল কেবিন রিটার্ন সহ দেন।

টিকেটতো নাই ভাই।

কেনো নাই!

বোঝেনইতো ঈদের সময় ক্রাইসিস থাকে।

কিন্তু আমার টিকিট চাই।

দিতে পারব না।

আমি একটু জেদি এটা সবাই জানে। লিগ্যাল ব্যাপারে জেদি।

রোজার শুরুতে আসলাম তাও বলছেন টিকিট নাই!

জানেনই তো নানা কোটা। আর্মির কোটা, মন্ত্রী, এমপি, ডিসি সাহেবদের কোটা!

আমি রেগে বললাম, হ্যাং ইয়োর মন্ত্রী!

কি বললেন!

টিকিট দেন।

আপনি বরং চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যান। তাকে বলেন। আমি টিকিট দিলে আমার চাকরি চলে যাবে।

আমি চারতলায় চেয়ারম্যান সাহেবের রুমে গেলাম। প্রথমে আমাকে তার পিএ পাত্তাই দিল না। আমার দিকে তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত। টাইপ রাইটারে টাইপ করছে আর কথা বলছে,

স্যার বিজি আছেন, দেখা হবে না।

আমার যে তার সাথে দেখা করতে হবে।

কি ব্যাপারে বলেন।

আপনাকে বলা যাবে না।

তাহলেতো দেখা হবে না।

আমি লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম আপনি ভিতরে গিয়ে বলেন, যে একজন দেখা করতে চায়। দেখা করা তার দ্বায়িত্ব। সাথে আমার ভিসিটিং কার্ডটা দেবেন।

এতে কাজ হলো। একটু পরই চেয়ারম্যান সাহেব তার রুমে ডাকলেন আমাকে। বসতে বললেন। চা অফার করলেন, কিছু খাজুরে গল্পও হলো এবং ইন্টারকমে আলাউদ্দিনকে ফোন করে বললেন, টিকিট দিতে। সেই থেকে আর কখনো টিকেটের সমস্যা হয়নি। আমি মাঝে মাঝে আলাউদ্দিনকে টাকা সাহায্য করতাম। তার স্ত্রী ছিল চির অসুস্থ্য। তার চিকিৎসার জন্য দিতাম। লঞ্চের টিকিট পাওয়াও ছিল এক কঠিন কাজ। আজও। সব বড় সাবদের জন্য রিজার্ভ থাকে ভিআইপি কেবিনগুলো। এখানেও কোটা। লঞ্চ মালিকদের আমি কাউকে চিনি না। একবার ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছি প্লেনে। আমার পাশের সীটে বসেছে সুরভি লঞ্চ মালিকের ছেলে। তিনি বললেন, যখনই কেবিনের দরকার হবে ফোন দেবেন। আমার দরকার হয়নি

অবশ্য। লঞ্চের সেই অভিজ্ঞার পর আমি লঞ্চে খুব একটা জার্নি করি না। কখনো করলেও বরিশালে আমার বন্ধু রুপক বা পান্না টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়। কানাডা আসার পরও আমি বরিশাল যাই প্রতিবছর এক দুই বার। বেশিরভাগই প্লেনে যাই।

সামনে নতুন দিন। নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন উচ্ছাস, নতুন আবেগ। আর হয়ত স্টিমার বা লঞ্চে যেতে হবে না। লঞ্চ মালিকদের খামখেয়ালির দিন শেষ। আর কারো কাছে ধর্না ধরতে হবে টিকিটের জন্য। বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের পিএর উপেক্ষা সহ্য করতে হবে না বা আলাউদ্দিনদের মতো কেরানিকে তোয়াজ করতে হবে না। মন্ত্রী এমপি সাহেবরা যত খুশী কোটা উপভোগ করুক আমার কিছু যায় আসে না। আমি বরিশাল চলে যাব পদ্মা সেতু দিয়ে। এমনকি আমি নিজ ড্রাইভ করেও চলে যেতে পারি। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার পার হলে হয়ে পোস্তগোলা থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ধরব আমি।

চার লেনের চমৎকার এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে কনভার্টেবল গাড়ি চালিয়ে তিন ঘন্টায় পৌঁছে যাব বরিশাল। পাশে বসে থাকবে আমার প্রেমিক। বাতাসে চুল উড়বে তার। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখব। আহা এই দৃশ্য এখন আর কল্পনা না, বাস্তবেই এমনটা ঘটবে। এদিকে মাওয়া প্রান্ত থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেনের রাস্তা হবে। বরিশালে একদিন ট্রেনও যাবে! ট্রেনের লাক্সারি কোচে যেতে যেতে আমি আর জেসমিন স্মৃতিচারন করব। একবার বুড়িগঙ্গায় ডুবে যেতে নিয়েছিলাম সেই গল্প করব।

জসিম মল্লিক, সাংবাদিক ও লেখক। টরন্টো

টরন্টো