কানাডায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ : দায়ী কারা?
খুরশিদ আলম
জানুয়ারী ৬, ২০২১
কানাডায় কিছু মানুষের কান্ডজ্ঞানহীন আচরণের কারণে এখানে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের হার অনেকগুন বেশী হয়ে দেখা দিয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অচিরেই কানাডায় প্রতিদিন আরো অনেক বেশী লোক আক্রান্ত হতে পারেন। সবাই যদি এখনি সতর্ক না হন তবে আগামী জানুয়ারীতে প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজারে গিয়ে দাড়াতে পারে! চিকিৎসকদের ভবিষ্যতবাণী এটি। আর এর জন্য প্রধানত দায়ী হবেন কান্ডজ্ঞানহীন কিছু লোক যাদেরকে কেউ কেউ ‘কভিডিয়ট’ (Covidiot) বলে আখ্যায়িত করছেন। অর্থাৎ কভিড + ইডিয়ট। যারা কভিড-১৯ এর এই মহামারীকালে জেনেশুনে নির্বোধ বা বোকার মত আচরণ করছেন তাদেরকেই কভিডিয়ট বলা হচ্ছে।
আরেক দল আছেন যারা সজ্ঞানে এবং সচেতনভাবেই কভিড-১৯ সংক্রান্ত আইন ভাঙ্গছেন বা বলা ভালো বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছেন। এদেরই একজন হলেন টরন্টোর নিকটবর্তী ইটবিকোক এর এক বারবিকিউ রেস্টুরেন্ট এর মালিক এ্যাডাম স্কেলী। শে^তাঙ্গ এই যুবক লাইসেন্স ছাড়াই ইটোবিকোক এ বারবিকিউর এক রেস্টুরেন্ট চালু করেন এবং লকডাউন আইন ভঙ্গ করে তিনি তার রেস্টুরেন্ট এর ভিতরে বসে খাবার খাওয়ার জন্য কাস্টমারদের প্রতি আমন্ত্রণ জানান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই আমন্ত্রণ জানানোর পর সেই কভিডিয়ট’দের অনেকেই দল বেধে তার রেস্টুরেন্টে হাজির হন!
পুলিশ অবশ্য অনেক নাটকীয়তার পর তাকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে চার্চও গঠন করা হয় বেশ কয়েকটি। কিন্তু পরের দিনই তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয় একাধিক শর্তে এবং তার রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতিও দেওয়া হয়। অবশ্য তার আগে তাকে লাইসেন্স নিতে হবে। এবং লকডাউনের আইন মেনে রেস্টুরেন্ট চালাতে হবে।
টিভি নিউজে সম্প্রচারিত হয়েছিল এ্যাডাম স্কেলী’র ঐ সব কান্ডকীর্তি। মাস্তানের ন্যায় তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল কানাডায় আইনশৃংখলা বলে কিছু নেই। যার যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন এখানে। তিনি টিভি সাংবাদিকদেরও হুকমী দেন প্রকাশ্যেই যেটা সংবাদ প্রচারে সময় লক্ষ্য করা গেছে। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, পুলিশ তার সঙ্গে অত্যন্ত বিনয়ী আচরণ করেছে শুরু থেকেই। প্রথম দিন তাকে রেস্টুরেন্ট বন্ধের নোটিশ দেয়া হলেও পরের দিন তিনি আবার রেস্টুরেন্ট খুলেন। আবারো নোটিশ দেয়া হয়। পরের দিন তিনি আবারো রেস্টুরেন্ট খুলেন। এভাবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর পুলিশ শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করে। ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন এই বলে যে, এ্যাডাম যদি শে^তাঙ্গ না হয়ে কৃষ্ণাঙ্গ বা বাদামী বর্ণের কেউ হতেন তবে কি পুলিশ এতটা ভদ্র আচরণ করতো? করতো না। কানাডায় সিস্টেমিক বর্ণবাদের এ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কভিড-১৯ কোন হেলাফেলার রোগ নয়। মানুষের জীবন-মরণের সমস্যা জড়িত এই ভাইরাসের সঙ্গে। অনেক আগেই একে মহামারী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর এর গুরুত্ব বিবেচনা করে কিছুদিন আগে অন্টারিওর টরন্টোসহ আরো কয়েকটি শহরে সরকারীভাবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ এ্যাডাম স্কেলী সেই লকডাউনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে তার অবৈধ রেস্টুরেন্টে লোকজনকে আমন্ত্রণ জানান। এবং বেশ কিছু লোক তার সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে রেস্টুরেন্টে হাজিরও হন! শুধু হাজির হওয়া নয়, পুলিশ এসে যখন বিনয়ের সঙ্গে এ্যাডামের অবৈধ রেস্টুরেন্ট ও অবৈধ কর্মকান্ড বন্ধ করার চেষ্টা করছিল তখন এই কভিডিয়েট’রা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন এবং বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন! পুলিশ এই প্রতিবাদকারীদের সঙ্গেও অতি ভদ্র ব্যবহার করেছে।
অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড অবশ্য প্রচন্ড বিরক্তি প্রকাশ করেন এ্যাডম এর এই ধরনের আচরণের কারণে। এদিকে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার কারণে গত ২৫ ডিসেম্বর রাত থেকে সমগ্র অন্টারিওতেই লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
আমরা দেখেছি ইতিপূর্বে গ্রেটার টরন্টোতে লকডাউন বা রেডজোনের আইন ভেঙ্গে কয়েকটি বড় ধরনের পার্টি বা সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। ঐ সব ঘটনায়ও ড্যাগ ফোর্ড বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার সেই বিরক্তির ম্যাসেজ কভিডিয়েটদের কাছে ঠিকমত পৌঁছায়নি। আর গ্রেটার টরন্টোতে এ্যাডামের মতো লোকের সংখ্যা কম নয়। তারা লকডাউনের আইন, মাস্ক পরার আইনকে থোরাই কেয়ার করেন। তারা পার্লামেন্ট ভবনের সামনে মাস্ক পরার বিরুদ্ধে সভাসমাবেশ করেন। ওয়ালমার্ট বা এরকম অন্যান্য বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে বা অন্যকোন পাবলিক প্লেসে গিয়ে মাস্ক না পরে ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টা করেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তার উপর হামলে পড়েন। মারধরও করেন। গত অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ড্যানফোর্থ ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় অবস্থিত এ্যালকোহলের স্টোর LCBO’র ভিতর সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন দুই যুবক। সেই বিবাদ কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপ নেয় মর্মান্তিক এক খুনের ঘটনায়। মাইকেল রাবার্টস নামের এক যুবক জ্যাকুব সুডমেরিকি নামের এক যুবককে স্টোর থেকে বের হওয়ার পর পার্কিং লটে গুলি করে হত্যা করেন। পুলিশ পরে মাইকেলকে গ্রেফতার করে।
আগেই বলেছি করোনা কোন হেলাফেলার রোগ নয়। এর রোগের ভাইরাস গোটা দুনিয়াকে অচল করে দিয়েছে। এ কলাম যখন লেখা হয় তখনকার হিসাব অনুয়ায়ী (ডিসেম্বর ৩১) করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালে কানাডায় মৃত্যুবরণ করেছেন ১৫,৬০০ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখ ৭৯ হাজার। আর বিশ^জুড়ে ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৮ লাখের উপর। আক্রান্ত হয়েছেন ৮ কোটি ২৪ লাখের উপর। (সূত্র: গ্লোবাল নিউজ।) আর এই সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। থামার কোন লক্ষণ নেই। কদিন আগে উদযাপিত হয়ে গেল খ্রীস্টানদের বড় দিনের উৎসব। চিকিৎসকগণ আগে থেকেই জনগণকে সতর্ক করে আসছিলেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে। কিন্তু তাতে কতটা কাজ হয়েছে তা এখনি বলা সম্ভব হচ্ছে না। সপ্তাহ দুই পার হলে বোঝা যাবে করোনা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, চিকিৎসকদের সতর্কবানী উচ্চারণ সত্বেও গত অক্টোবরে কানাডায় থ্যাংকস গিভিং ডে উদযাপনের সময় লোকজনের মধ্যে মেলামেশা বৃদ্ধি পেয়েছিল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পিছনে এই থ্যাংকস গিভিং ডে’র মেলামেশাও একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অনেকে। বড়দিনের মেলামেশাটা থ্যাংকস গিভিং ডে’র তুলনায় আরো অনেক বেশী মাত্রায় হয়েছে সন্দেহ নেই। এখন তার প্রভাবে আক্রান্তের সংখ্যা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো কয়েকটি দিন ।
উল্লেখ্য যে, গত নভেম্বর মাসে পরিচালিত Angus Reid এবং Cardus এর এক যৌথ জরিপে অংশগ্রহণকারী কানাডার এক তৃতীয়াংশ নাগরিক বলেছিলেন, বড়দিন উপলক্ষে তারা তাদের আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে স্বশরীরে দেখা করবেন। আর শতকরা ১০ জন বলেছিলেন তারা দূরে বা অন্য প্রভিন্সেও বেড়াতে যেতে পারেন। যদিও তখন কানাডার পাবালিক হেলথ এজেন্সির ভবিষ্যতবাণী ছিল এরকম যে, যদি লোকজনের মধ্যে মেলামেশার হার বৃদ্ধি পায় তবে দিনে ৬০ হাজার নতুন সংক্রমণের ঘটনাও ঘটতে পারে জানুয়ারীর দিকে। সিটিভি নিউজ এ খবর প্রকাশ করে।
আমরা দেখেছি, কানাডায় করোনার বিপদ সম্পর্কে লোকজনকে সতর্ক করার জন্য কম প্রচারণা চালানো হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। আর টিভি নিউজে এবং ন্যাশনাল বা স্থানীয় মেইনস্ট্রিম পত্রপত্রিকায় সারাক্ষণই প্রচারিত হচ্ছে করোনার খবর। প্রতিদিন কত লোক এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, কত লোক মারা যাচ্ছেন এসব খবর বিরামহীনভাবে প্রচারিত হচ্ছে। ঘন ঘন হাত ধোয়া, পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে অহরহ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কিছু লোক সেই সতর্কবাণীকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। সামাজিক মেলামেশার ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যে আইন ঘোষণা করা হয়েছে তা তাদের কাছে ছেলেখেলা বলে মনে হয়েছে। কেউ কেউ আবার এই আইনকে তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন। কিন্তু একবারও তারা ভাবেননি যে, তাদের এই বালখিল্যতা দেশে প্রতিদিন করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির পিছনে অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর শুধুই কি সংখ্যা বৃদ্ধি? প্রতিদিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। অন্টারিওতে দিনে ২০ থেকে ৪০ বা তারো বেশী পরিবারকে ফিউনারেল এর আয়োজন করতে হচ্ছে। এই ফিউনারেল এর আয়োজন যে কতটা মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক তা কেবল ভুক্তভোগি পরিবারই জানে। অন্যদিকে করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সরকারের চিকিৎসা ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে বিপুলভাবে। এই ব্যয়ভার তো শেষপর্যন্ত গিয়ে টেক্সপেয়ারদেরকেই বহন করতে হয়। অন্যদিকে সরকারী বেসরকারী বাণিজ্যে নেমে এসেছে চরম স্থবিরতা। শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা থেকে, বঞ্চিত হচ্ছে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো থেকে। এই স্বর্ণালী সময়তো তারা আর কোনদিন ফিরে পাবেনা।
দেখা গেছে এই সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখার কারণে টরন্টোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। টরন্টো পাবলিক হেলথ এর বরাত দিয়ে সিটিভি নিউজ জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজন কোন না কোন আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন যেখানে ১০ জন বা তারও কম সংখ্যক লোক ছিলো, অথবা ঐ আত্মীয়-বন্ধুদের কেউ না কেউ তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন যার মাধ্যমে তারা সংক্রমিত হয়েছেন।
টরন্টো পাবলিক হেলথ সূত্রে আরো জানা যায়, সিংহভাগ লোকের ক্ষেত্রে করোনার সংক্রমণ ঘটেছে স্বামী-স্ত্রী/গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের মাধ্যমে (২১%), সাধারণ বন্ধুদের মাধ্যমে (১৬%) এবং সহকর্মীদের মাধ্যমে (১৬%)। সার্বিকভাবে ৩৫% সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে নিজ পরিবারের বাইরের লোকদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে মেলামেশার কারণে। টরন্টোর প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ ডি ভিলা বলেন, এই তথ্য থেকেই বুঝা যায় নিজ পরিবারের সদস্য ছাড়া বাইরের লোকদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব কতখানি।
আগে ভাবা হতো করোনা শুধু বয়স্ক লোকদের আক্রমণ করে। কিন্তু এখন সেই ধারণা পাল্টে গেছে। কারণ দেখা যাচ্ছে করোনা কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। ডিসেম্বরের শুরুতে প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে টরন্টোতে সংক্রমিতদের ৫৭% জনের বয়সই ২০ থেকে ৪৯ এর মধ্যে।
লক্ষ্যনীয় যে, শুরুতে করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভয়টা কাজ করছিল পরবর্তীতে তা অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। বিশেষ করে অল্পবয়সীদের মধ্যে যাদের বয়স পঞ্চাশের নিচে। আর এ কারণে নিষেধাজ্ঞা সত্যেও তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত সামারে টরন্টোর ট্রিনিটি পার্কে এবং ওডবাইন বিচে এই যুবা বয়সী লোকদের ব্যাপক মেলামেশা দেখে চমকে গিয়েছিলেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিকগণ। ব্যাপক সমালোচনার মুখমুখী হয়েছিলন যারা সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে ঐ সময় আউটডোরে মেলামেশা করছিলেন। পরবর্তীতে এই ব্যাপক মেলামেশার উন্মত্ততা কিছুটা কমে আসলেও থেকে থেকেই লোকজনের আইন ভাঙ্গার খবর আসছিল মিডিয়াতে। বাড়িতে ২০০ জন অতিথির উপস্থিতে পার্টির আয়োজন, রেস্টুরেন্টের প্রবেশদ্বার বন্ধ রেখে ভিতরে বহু লোকের উপস্থিতিতে পার্টির আয়োজন, Wasaga Beach এ শতাধিক গাড়ি আর কয়েকশত লোকের উপস্থিতিতে ‘কার র্যালী’র আয়োজন এ সব খবর আমরা দেখেছি মিডিয়াতে। এসব আয়োজন চলে আসছে করোনার ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে এবং করোনা সংক্রান্ত সরকারী আইন ভঙ্গ করে। আর মিডিয়াতে আসছে না যে খবর তা হলো, অনেকেই এই লকডাউনের মাঝেও বাড়িতে আত্মীয়-বন্ধুদের ডেকে এনে লাঞ্চ বা ডিনার এর আয়োজন করছেন!
এদিকে কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন ব্যবহার শুরু হওয়ার কারণেও লোকজনের মধ্যে সাহস বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন আর ভয় নেই। ভ্যাকসিন সব ঠিক করে দিবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভ্যাকসিন ব্যবহার শুরু হলেও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখনি রিলাক্স হওয়ার সময় আসেনি। আরো সময় লাগবে। সেটা এক বা দেড় বছরও হতে পারে। তাই মাস্ক ব্যবহার আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে আরো অনেক দিন। আর সবাইকে ভ্যাকসিনের আওতায় আসতেও আরো বেশ কয়েক মাস লেগে যাবে।
এদিকে নতুন এক করোনা ভাইরাস নিয়ে শুরু হয়েছে আরেক উদ্বেগ। সম্প্রতি বৃটেনে করোনার রূপান্তরিত এক নুতন ভাইরাস এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে যেটা কভিড-১৯ এর তুলনা ৭০ শতাংশ বেশী সংক্রামক এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত দুরূহ। ফলে নতুন করে আবার আরেক আতঙ্ক শুরু হয়েছে বিশে^। ইতিমধ্যে এই ভাইরাস বৃটেনের বাইরেও বিস্তার লাভ করেছে। কানাডাসহ অনেক দেশই এখন বৃটেনের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
সুইজারল্যান্ডের বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবিজ্ঞানী ও মিউটেশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিচার্ড নেহার বলেন, বৃটেনে রূপান্তরিত করোনাভাইরাসটি কয়েক মাস ধরেই সক্রিয় ছিল। করোনাভাইরাস নিয়ে নিবিড় ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের সময় গত ২০ সেপ্টেম্বর এটি আবিষ্কৃত হয়, যা গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকটি অংশে ছড়িয়ে পড়েছে।
অবশ্য কিছুটা আশার বাণী শুনিয়েছেন জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েস স্পান। তিনি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কভিড-১৯ এর জন্য আবিস্কৃত নতুন ভ্যাকসিন কার্যকর। কিন্তু মন্ত্রীর এ আশার বাণী কতটা নির্ভরযোগ্য তা নিশ্চিত হতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বিশ^বাসীকে।
মূলত কানাডাসহ বিশে^র অন্যান্য দেশে এই সামাজিক দূরত্ব যথাযথভাবে বজায় না রাখার কারণেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এতটা বিস্তৃতি লাভ করেছে। এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের বয়স্ক জনগোষ্ঠিকে চরম বিপদের মধ্যে নিক্ষেপ করছি। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি অন্টারিওতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশী মাত্রায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন বয়স্ক ব্যক্তিরা। বিভিন্ন লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে ব্যাপক সংখ্যক বয়স্ক লোকের মৃত্যু ঘটেছে এই করোনায় আক্রান্ত হয়ে।
অর্থাৎ আমরা আমাদের খামখেয়ালীর কারণে নিজেদের জীবনে যেমন ডেকে আনছি বিপদ, তেমনি অপরের জীবনে ডেকে আনছি ভয়াবহ পরিনতি। আমরা যদি এই মহামারীকালে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না মানি, সরকারী আইন না মানি তবে করোনার আরো ভয়াবহ বিস্তার কেউ ঠেকাতে পারবে না। আর সেই ভয়াবহ বিস্তারের অর্থ হলো, আরো বেশী সংখ্যক মানুষের মৃত্যু, অর্থনীতিতে আরো চরম অচলাবস্থার সৃষ্টি, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের আরো অবনতি।
এখন সিদ্ধান্ত আমাদের। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা তাদের সতর্কবাণী শুনিয়েছেন, রাজনীতিকরা তাদের আইন প্রণয়ন করেছেন। আমরা সেই সতর্কবাণী শুনব কি শুনব না, সেই আইন মানবো কি মানবো না তার উপর নির্ভর করছে করোনা নিয়ন্ত্রণের ভবিষ্যত। মনে রাখতে হবে, শুধু ভ্যাকসিনে এই মহামারী থামবে না।
পাদটীকা :
অন্টারিও’র অর্থ মন্ত্রী রড ফিলিপস লকডাউনের মধ্যেই ছুটি উপভোগ করার জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন প্রমোদভ্রমণে! আর এ জন্য তিনি সেরা কভিডিয়ড নির্বাচিত হয়েছেন। পুরষ্কার হিসাবে পেয়েছেন মন্ত্রিত্ব থেকে বহিষ্কারাদেশ।
গোটা দেশ যেখানে মহামারীর বিরুদ্ধে কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত সেখানে তিনি গিয়েছেন প্রমোদভ্রমণে!
এরকম দায়িত্বহীনতার পুরষ্কার আর কি হতে পারে?
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ