করোনার দিনগুলো
কোভিড পুনরায় পুরোমাত্রায় জাঁকিয়ে বসেছে পৃথিবীতে!
জসিম মল্লিক
গত সংখ্যায় যা আশঙ্কা করেছিলাম বস্তুতঃ তাই হয়েছে। কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ এখন পুরোমাত্রায় শুরু হয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন কানাডায় আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং মৃতের সংখ্যা দশ হাজারে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রভিন্সের সিটি ডেঞ্জার জোন ও হাই এলার্ট ঘোষণা করেছে। কানাডার আলবার্টার ক্যালগেরিতে কোভি-১৯ পজিটিভ বৃদ্ধির কারণে শহরটিকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আলবার্টার স্বাস্থ্য বিষয়ক চিফ মেডিকেল অফিসার সতর্ক করে বলেছেন, ভাইরাসের বিস্তার রোধে প্রদেশটিকে ডেঞ্জার জোন প্রদেশের সাথে কঠোর জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিধিনিষেধের জন্য আলবার্টা তার ট্রিগার দোড়গোড়ায় পৌঁছেছে। অন্যদিকে টরন্টোতে কোভিড -১৯ টেষ্টে পজিটিভ হার ৪.৪ শতাংশে ছুঁয়েছে এবং প্রদেশের দ্বারা উদ্বৃত উচ্চ সতর্কতা প্রান্তিকের দ্বিগুণ হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে পজিটিভিটির হারটি কেবলমাত্র একটি সূচক হলেও তার সাম্প্রতিক খাড়া বৃদ্ধি উদ্বেগের কারণ বিশেষত যখন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে এবং হাসপাতালে ভর্তির হারের পাশাপাশি বিবেচনা করা হচ্ছে। তারপরও জীবন সচল আছে। এখন শুধু অপেক্ষা একটি কাঙ্খিত ভ্যাকসিনের জন্য।
এদিকে কানাডায় বিভিন্ন শহরে ১৩০ টির মতো উগ্র ডানপন্থী গ্রুপ সক্রিয় বলে জানা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ৬.৬০০ গ্রুপ, পেজ এবং একাউন্ট থেকে ছড়ানো হচ্ছে উগ্র মতবাদ। যা খুবই উদ্বেগজনক। এই গ্রুপগুলোর অধিকাংশই তৎপর রয়েছে বিভিন্ন ধর্ম বা গোত্র এবং অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি বা প্রাউড বয় নামের নানা গোষ্ঠির সহিংসত ও হুমকির তথ্য সংবাদ মাধ্যমেও আলোচিত হয়েছে হেইট ক্রাইম হিসাবে। তাহলে কি কানাডায় বর্ণবাদি সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে?
এবার অন্যান্য প্রসঙ্গঃ অরিত্রি বেশি কথার মানুষ না। কম কথার মানুষ। আমার মতোই অরিত্রি। আমার স্বভাবের সাথে অনেক মিল। আমাদের পরিবারে যা কিছু কথা জেসমিন একলা বলে। সে বলে আমরা শুনি। জেসমিন অর্ক’র সাথে অনেক গল্প করে। অর্ক অসীম ধৈর্য্য নিয়ে মায়ের সব কথা শোনে। সেই তুলনায় অরিত্রি কম কথা বলে চালায়। অরিত্রির সাথে আমার যেটুকু কথা হয় তার বেশিরভাগ আমি গায়ে পড়ে বলি। অর্ক’র সাথে খুব দরকারি কথা ছাড়া তেমন কথা হয় না আমার। জেসমিনের সাথে থাকি বলে আমাকে বাধ্য হয়ে কথা বলতে হয়। তবে একটু পরই আমার ভুল ধরতে শুরু করে। যেনো ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আমার ভুলত্রুটিগুলো খুঁজে বেড়ানো। আমিও এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই যথাসম্ভব কম কথা বলার চেষ্টা করি। বোবার কোনো শত্রু নাই।
গত কয়েকদিন থেকে অরিত্রি মহা বিজি। তেমন কথা হয় না। ম্যাসেজ দিলে উত্তর দেয় শুধু। এদিকে কোভিড আবার তার দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু করেছে। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। স্বাভাবিক জীবনে আবার ছন্দপতন। পরশু দিন অরিত্রির ডাউন টাউনের বাসায় খাবার দিতে গেছিলাম। বাসা চেঞ্জ করছে। কারণ অরিত্রির অফিস চেঞ্জ হয়েছে। এখনও হোম অফিস করছে যদিও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সম্ভবত আর পাঁচদিন অফিসে যেতে হবে না। একদিন বা দু’দিন যেতে হবে সপ্তাহে। কিন্তু অরিত্রি কোথায় থাকবে তাও পরিষ্কার বলেনি। আমাকে শুধু একদিন বলেছে, আমার রুমে একটা টেবিল লাগবে। অরিত্রির রুমে সব আগের মতোই আছে। কিছুই চেঞ্জ হয় নাই।
আমি মনে মনে খুব খুশী যে অরিত্রি সাময়িকভাবে হলেও আমাদের কাছে থাকবে কিছুদিন। হয়ত নতুন ঠিকানার সন্ধানে আছে। সবকিছু খুলে বলবে না সহজে আগে ভাগে। যাইহোক অন্ততঃ সকালে ঘুম ভেঙ্গে অরিত্রির জন্য চা বানাতে তো পারব! অনেকদিন অরিত্রি বলে না, বাবা চা বানাও। অরিত্রি থাকলে ঘরটা খালি মনে হয় না। অরিত্রি পুরো ঘর জুড়ে থাকে। কন্যারা সবসময় বাবাদের আনন্দের উৎস। তারা সেটা প্রকাশ করতে পারে না ঠিকই কিন্তু তাদের মনের বাতিটা উজ্জল হয়ে ওঠে। পৃথিবীর সব কন্যারা ভাল থাকুক। সবার জন্য ভালবাসা।
আমার আঠারো বছরের বিদেশ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আঠারো বছরে আঠারো বারের বেশি আমি বাংলাদেশে গিয়েছি। আমি বছরান্তে একবার দেশে যাই। টাকার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিপদে দুনিয়ার সব মানুষই। আমি নিজেও। এই সমস্যার কথা ভেবেই হয়ত যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন ‘অল ইওর ওর্থ: দ্য আল্টিমেট লাইফটাইম মানি প্ল্যান’ নামের একটি বই লিখেছেন, যেখানে তিনি আয় বণ্টনের একটা নীতি দিয়েছেন। এটা মেনে চললে টাকা বাঁচানোর নাকি পথ পাওয়া যাবে।
কানাডা থেকে দেশে যাওয়া যথেষ্ঠ ব্যায়বহুল। টাকা বাঁচানোর কোনো সূত্র জানা নাই আমার। চাকরির আয় থেকে যা উদ্বৃত্ত থাকে তা চ্যারটি করে, কাপড় চোপর কিনে এবং পথে পথে চলে যায়। দেশে আমার তেমন কোনো সম্পদ নাই, ব্যবসা বাণিজ্য নাই, অন্য কোনো ধান্দা নাই, টাকা পাচার বা মানব পাচারের কোনো অভিপ্রায় নাই, এমনকি আমি কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজক না যে লোকজনকে ইনভাইট করব।
কানাডা সরকারকে ট্যাক্স দেই (ফাঁকির কোনো সুযোগ জানা নাই)। যতবারই দেশে যাই প্রায় প্রতিবার টিকিট চেঞ্জ করি। এজন্য দু’একবার চাকরি হারিয়েছি। কিন্তু আবার কানাডা ফিরে আসি। ফিরে আসতে হয়। এই যে এতোকিছু ঘটে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত- হত্যা, ধর্ষণ (এটা মোটামুটি ডালভাত ব্যাপার), গুম, খুন, ক্রসফায়ার (ওসি প্রদীপ দাশ নাকি পাখির মতো মানুষ মারত!) দূর্নীতি (কোভিডের মতো মহামারি আকারে ছড়িয়ে গেছে) ব্যাংকলুট (ব্যাংকে আমার কয়েক হাজার টাকা আছে তাই আমি চিন্তিত!) হচ্ছে তাও আমার দেশ ভাললাগে। দেশের মাটির আলাদা একটা গন্ধ আছে। জন্মভূমি বলে কথা! শুধু তাই না, আমি বইমেলা মিস করতে চাই না। প্রতিবছর আমার বই প্রকাশিত হয়। তখন আমার লেখক বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, আমার পাঠকদের সাথে দেখা হয়। এই আনন্দের কোনো তুলনা নাই।
দেশে গেলে আমার যেমন ফিরতে ইচ্ছে করে না তেমনি ফিরে এসেই আবার মনে হয় চলে যাই। জেসমিন ঝগড়া করলে চলে যেতে ইচ্ছা করে। অসুস্থ্য হলে চলে যেতে ইচ্ছা করে। অথচ বিনা চিকিৎসায় বা ভুল চিকিৎসায় বা চিকিৎসার খরচ যোগাড় করতে না পারলে (হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টের নামে আটকে রেখে বিল আদায় করার ভুরি ভুরি নজির আছে) সরাসরি আজিমপুর কবরস্থানে চলে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভবনা আছে। এই যে কানাডার মতো একটা দেশ, মানবিক দেশ, বাক স্বাধীনতার দেশ (জাষ্টিন ট্রুডোর কড়া সমালোচনা করলেও ডিজিটাল আইনে মামলা হওয়ার কোনো সম্ভবনা নাই বা কোনো বাহিনী ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাবে না), নিরাপত্তা, চিকিৎসা সুবিধা, ওয়ার্ল্ডক্লাস লেখাপড়া (বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম এশিয়ার পাঁচশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও নেই), চাকরি না থাকলে সরকারের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, নিন্ম আয়ের মানুষদের সাবসিডাইজ বাড়ির সুবিধা, নারী ও শিশুদের সুরক্ষা- তা সত্ত্বেও আমি দেশ দেশ করি বলে জেসমিন আমার উপর খুব বিরক্ত। আমি নাকি অকৃতজ্ঞ। এদেশের সব নাগরিক সুবিধা উপভোগ এনজয় করি আর বাংলাদেশ নিয়ে মাতম করি। হিপোক্রেসি কাকে বলে!
একবারের একটা ঘটনা বলি। ২০১৪ সালে আমার মেয়ে অরিত্রি বাংলাদেশে গিয়েছিল ব্রাকে ইন্টার্ণ করতে। তখন মাত্র সে টড়ভঞ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন থেকে। অরিত্রির সাথে জেসমিনও গেলো গার্ড হিসাবে। যতদিন অরিত্রি ইন্টার্ণ করবে জেসমিন সাথে থাকবে। সম্ভবতঃ দুই মাসের প্রোগ্রাম ছিল। জেসমিন তার চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে গেলো। অরিত্রি একদিন মহাখালি ব্রাক সেন্টারে গেলো সুপারভাইজারের সাথে দেখা করতে। সুপারভাইজারের সাথে কথা বলে এসে আমাকে ফোন করল,
বাবা আমি ব্রাকে ইন্টার্ণ করতে চাই না।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কেনো আম্মু। কোনো সমস্যা!
অরিত্রি কেঁদে দিয়ে বলল,
আমি করতে চাই না, সরি বাবা, রাগ করো না।
আমি হেসে বললাম, করতে না চাইলে করো না, কোনো ব্যাপার না। দেশে এনজয় করো।
দু’দিন যেতে না যেতেই বলল, বাবা আমার টিকিট চেঞ্জ করো, আমি চলে আসব কনাডায়। আমার একটা ইন্টারভিউ আছে।
আমি আনন্দের সাথে টিকিট চেঞ্জ করলাম। অরিত্রি ফেরার পর জানলাম, ব্রাকের সুপারভাইজার নাকি ওর সাথে রুডভাবে কথা বলেছে, শুধু তাই না, কথা ছিল ঢাকার অফিসে বসবে কিন্তু বলছে ময়মনসিংহ যেতে হবে এবং সাথে কেউ যেতে পারবে না। কি ভয়াবহ কথা! তাই অরিত্রি ইন্টার্ণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর যে কথাটা বলল, সেটা আমি আশাই করিনি, বলল, ইধনধ, ঃযধহশং ভড়ৎ ঃধশরহম ঁং ঃড় ঈধহধফধ.
আমরা যারা প্রবাসে থাকি আমরা প্রত্যেকে মাথায় ডাবল প্রেসার নিয়ে থাকি। প্রত্যেকের না হলেও আমার মতো কিছু বোকাদের থাকে। কিছু মানুষ আছে যারা দেশ নিয়ে একদম মাথা ঘামায় না। বিদেশে সুখে শান্তিতে আছে। তারা কালে ভদ্রে দেশে যায়। আমার এক বন্ধু তেইশ বছরে একবারও যায়নি। কখনো যাবে বলেও মনে হয় না। পুরনো স্মৃতি আকড়ে সুখেই আছে। শুধু আমি সুখ খুঁজে পাই না। কোথায় যে সুখ কে জানে! আমি যেমন কানাডা নিয়ে মাথা ঘামাই তেমনি বাংলাদেশ নিয়েও মাথা ঘামাই। প্রতিক্রিয়া দেখাই। ভাল কিছু দেখলে আনন্দে চোখে পানি আসে, খারাপ কিছু দেখলে ক্ষোভ হয়। বাংলাদেশে আমার ঘনিষ্ট যারা আছে তারা বেশিরভাগই দেশের ঘটনা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। প্রতিবাদ করে না বা প্রতিক্রিয়া দেখায় না। নির্বিকার থাকে। আসলে ভয় পায়। লেখক কবিতা লেখে, ছড়া লেখে, উপন্যাস লেখে, সাংবাদিক রিপোর্ট লেখে, শিল্পী ছবি আঁকে, জনগন মজার মজার পোষ্ট দেয়, জন্মদিন আর মৃত্যু দিবস নিয়ে মেতে থাকে। যেনো খুন ধর্ষণ হওয়াটাই স্বভাবিক!
যাউকগা। আমি যে সবকিছুতে প্রতিক্রিয়া দেখাই তাতে কারো কিছু যায় আসে না। এসব কেউ থোরাই কেয়ার করে। বরং লোকজন আমাকে স্টুপিড ভাবে। গাধা ভাবে। আমি একদম অন্যদের মতো হতে পারি না। হতে পারলে ভাল হতো। তবুও আমি বাংলাদেশ নিয়ে গর্বিত, স্বপ্ন দেখি এমন একদিন আসবে যেদিন দূর্নীতি থাকবে না, সন্ত্রাস, ধর্ষণ থাকবে না। সেই পথেই আছে বাংলাদেশ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি একাতো আর সব করে দেবেন না! এজন্য আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আইনের শাসন মজবুত করতে হবে। আমি নিশ্চিত একদিন বাংলাদেশ আমেরিকা কানাডার মতো হবে। আমি সেদিনের অপেক্ষায়। আমি আমার জন্মস্থান বরিশালে ফিরে যাব একদিন। আমি সেখানকার সবকিছু মিস করি। বরিশালের মাটি, বাড়িঘর, তার আনাচ কানাচ, মা বাবা, ভাই বোনের কবর, প্রতিটি ধূলিকনা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি, শহরের অলি গলি, রাস্তা ঘাট, আমার বন্ধুরা, আমার আত্মীয় সবকিছু মিস করি..।
আমি ছোটবেলা থেকেই একটু বোকা টাইপ ছিলাম। অনেক হাস্যকর বোকামী করেছি। সে সব মনে পড়লে হাসিতো পায়ই, একটু লজ্জাও করে এখনও। মানুষ এমন বোকা হয়! বোকার হদ্দ যাকে বলে। বিভিন্ন সময়ে সেইসব মোটা দাগের বোকামির কথা অনেকবার লিখেছিও। অথচ আমার চারপাশে অসংখ্য চালাক মানুষ। অতি চালক মানুষও আছে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাদের কান্ড কারখানা দেখি। তখন নিজেকে বোকার দাদা মনে হয়। মানুষের বুদ্ধিমত্তা দেখে আমি টাসকি খাইয়া যাই। আমি মাঝে মাঝে আমার ছেলে মেয়ের বুদ্ধিমত্তা দেখেও আমার এমন লাগে। এতো প্রাকটিক্যাল কিভাবে হয় এই বয়সে! আমিতো এই প্রায় ষাটেও আবেগ দিয়ে চলি, আর বোকামী করি। বোকার মতো কথা বলি, বোকার মতো মানুষকে বিশ্বাস করি। বোকার মতো সিদ্ধান্ত নেই। যেখানে যা বলা দরকার তা বলি না, যখন যেটা বলা উচিত তখন সেটা মনে পড়ে না। জেসমিন মনে করে আমার চেয়ে ওর বুদ্ধি বেশি। সব স্ত্রীরাই তাই অবশ্য। জেসমিন যে নিজেকে আমার চেয়ে বুদ্ধিমান ভাবে তাতে আমি মাইন্ড করি না। আমি হ্যাপি।
যাইহোক প্রসঙ্গ এটা না। প্রসঙ্গ হচ্ছে বোকাদের নিয়ে। বোকাদের একটা প্লাটফর্ম থাকা দরকার। তিন বছর আগেও এরকম একটা আহবান রেখে ছিলাম এবং যথেষ্ট সাড়াও পেয়েছিলাম। এই ভেবে অনেক ভাল লেগেছিল যে আমার মতো বোকা লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয় চারপাশে। তারা নিজেকে তুলে ধরতে পারে না বলে আমরা তাদের সম্পর্কে জানি না। তাদের জন্যই একটা মঞ্চ থাকা দরকার। সেই ক্লাবে কোনো চালাকদের জায়গা নাই। সেখানে কোনো সাহিত্য হবে না, গান বাজনা হবে না, খেলাধূলা হবে না, জুয়া হবে না, মদ্যপান হবে না। পৃথিবীতে অনেক ক্লাব আছে। এই টরন্টোতেই একবার একটা ক্লাবে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর সাথে, নাম স্পোক ক্লাব। সেই ক্লাবের মেম্বারশীপের জন্য আবেদন করতেই নাকি বছরে পাঁচশ হাজার ডলার ইনকাম থাকতে হবে। ঢাকার একটি অভিজাত ক্লাব নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে সেটা হচ্ছে, উৎসাহী মেম্বারদের গাড়ির চাবির নাকি লটারি হয়, যেদিন যার ভাগ্যে যে চাবি পড়বে সে রাতে গাড়ির সাথে স্ত্রীও যাবে। সত্য মিথ্যা জানি না।
আমাদের ক্লাবের নাম হবে বোকা ক্লাব। সেখানে যত রকমের বোকামি আছে সে সব নিয়ে কথা হবে শুধু। কে কে আছেন হাত তুলুন..!
আমার প্রায়ই একলা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। একলা বাঁচতে ইচ্ছা করে। অনেক বছর একলা বাঁচিনা। শৈশব এবং কৈশোরের দিনগুলো খুব ভাল ছিল। তখন আমি একলা বেঁচেছিলাম। তখন মাঝে মাঝে আমার ভিতর থেকে আর একটা আমি বেড়িয়ে আসত। সেই আমিকে কেউ চিনত না। সে একলা কাঁদত, একলা হাসত, একলা বেড়াত, একলা বাঁচত। আমার মাও সেই আমিকে চিনতে পারেনি কখনো। সেই আমিকে আবার আমি ফিরে পেতে চাই। আমার অনেক একলা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। চারিদিকে এতো মানুষের ভীড়ে, এতো দ্বায়িত্বের বোঝ বয়ে আমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। একত্রিশ বছর ধরে প্রেমে, স্নেহে, আহ্লাদে, আশ্লেষে, মমতায়, শাসনে, ভাষনে, কন্ট্রোলে, যুদ্ধে, শান্তিতে, জয়ে-পরাজয়ে, আপোষে, স্ট্রেসে, আশায়, নিরাশায়, ভালবাসায়, ঘৃণায়, অসুস্থ্যতায়, সুখে দুঃখে বেঁচে আছি। যার নাম সংসার!
এইভাবে বাঁচার মধ্যে একঘেয়েমি আছে। এসব একঘেয়েমি থেকে পরিত্রাণ দরকার। একলা বাঁচা দরকার। সবারই একলা বাঁচার দরকার আছে। নিজের মতো করে বাঁচার দরকার আছে। নিজেকে চেনার দরকার আছে। নিজের মুখোমুখি হওয়ার দরকার আছে। কারো আজ্ঞাবহ হয়ে নয়, কারো অধীনে নয়, হিংসায় নয়, ঈর্ষায় নয়, ঘৃণায় নয়, অবহেলা আর অবজ্ঞায় নয়, প্রতিযোগতিায় নয়, প্রতিহিংসায় নয় শুধু নিজের মতো একলা বাঁচা, মৌনতায় বাঁচা, নিরবতায় অবগাহন করে বাঁচা। যখনই অনেক বেশি চাওয়া থাকবে, প্রত্যাশা থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে, দেখানেপনা থাকবে তখনই জীবন হয়ে উঠবে যন্ত্রণার। কারো না কারো অধীনস্ত হতে হবে, কেউ না কেউ আপনাকে কন্ট্রোল করতে চাইবে, আপনি অন্যের অধীন হয়ে যাবেন। আপনার স্বাধীনতা, আপনার স্বাতন্ত্র ধুলোয় লুটোপুটি খাবে। অন্ততঃ একবার হলেও চেষ্টা করুন নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদা করে ফেলতে। নিজের অস্তিত্বকে স্বাতন্ত্র দিতে। নিজেকে বুঝতে।
জেনে রাখুন দিন শেষে আপনি একলা। খুউব একলা। আপনার কেউ নেই। এই যে চারিদিকে এতো কিছু দেখি, আপনজনের মতো মনে হয়, তারা কেউ আপন নয়, তারা প্রত্যেকে যার যার। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা ভাই-বোন বন্ধু-পরিজন, এঁদের সাথে মায়ায়, স্নেহে, ভালবাসায় জড়িয়ে থাকি ঠিকই কিন্তু এরা কেউই আপনার নয়। আপনি একা। আপানার কেউ নাই। সংসার একটা শৃঙ্খল। আপনি সত্যি গভীরভাবে একবার ভাবুন, গভীর রাতে ভাবুন, নির্জনে ভাবুন, নিরবতায় ভাবুন। আপনি একজন একক মানুষ, একক সত্ত্বা। আপনি একজন অনন্য মানুষ। অনেকের মধ্যে থেকেও আপনি একলা। তাই প্রতিটি মানুষের একবার হলেও একাকী বাঁচার দরকার আছে। আপনি যদি একা না হতে পারেন তাহলে আপনার আত্মার অবমাননা হবে। নিজেকে নিজে আপনি অপমানিত করবেন। জেনে রাখুন পৃথিবীতে কেউ কারো নয়।
মাঝে মাঝে কানাডায় আমার খুব বোরিং লাগে। মাঝে মাঝে না প্রায়ই এ রকম লাগে। একলা লাগে, নিসঙ্গতায় পেয়ে বসে। পরিজনহীন একলা একটা গাছের মতো লাগে। বৈচিত্রহীন মনে হয় সবকিছু। এ রকম মনে হওয়ার কোনো কারণ নাই তাও মনে হয় প্রতিদিন একই রকম। প্রতিটা মাস একই রকম। মাস ঘুরে বছর আসে তাও একই রকম। যেনো এভাবেই সাজানো সবকিছু। জীবন যেনো একটা ঘড়ির কাঁটা। মাস শেষে দুটো পে চেক, তারপর খরচের পালা। বাড়ির মর্টগেজ, ক্রেডিট কার্ডের বিল, গাড়ির ইন্সুরেন্স, ফোন বিল, ইন্টারনেট বিল এইসব নানা কিছু। সামানে কোথাও বেড়ানো, অনুষ্ঠানাদি, দাওয়াত দেওয়া নেওয়া। উইন্টারে ঘরবন্দী জীবন, স্নো পরিষ্কার করা, গাড়িতে উইন্টার টায়ার লাগানো, গাদা গাদা শীতের কাপড় কেনা, জ্যাকেট, হ্যান্ডগ্লভস, কান টুপি, স্নো বুট ইত্যাদি। প্রবাসে নতুন নতুন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং যথারীতি ভেঙ্গে যায়। প্রেম এবং বিচ্ছেদ পাশাপাশি চলে। সবার সমান স্টাটাস। কেউ কারো চেয়ে বড়ও না ছোটও না। সবার সমান স্বাধীনতা, সমান অধিকার। কিন্তু আমার মন কেবল পিছু টানে। শুধু পিছু টানে।
এর কারণ হতে পারে কানাডায় আমার শিকড় প্রোথিত হয়নি। এদেশে আমি জন্মাইনি বা বড়ও হইনি বলে। আমি ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এসেছি এই দেশে। এখনও অনেক কিছুর সাথে একাত্ম হয়ে উঠতে পারিনি। আমার ছেলে মেয়েরা এখানে বেড়ে উঠেছে, পড়াশুনা করেছে এবং চাকরি করে। তাই ওদের আর আমার আবেগের মধ্যে অনেক ফারাক। এটাই ওদের দেশ। এই দেশকে আপন করে নিয়েছে। স্কুল থেকেই এমনভাবে মাথায় কানাডা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে ওদের ভাবনায় আর কিছু কাজ করে না। কানাডা নিয়ে কোনো নগেটিভ ধারণা নাই ওদের। অরিত্রি যখন খুব ছোট একবার জেসমিন বলেছিল, ওই কালো মেয়েটা তোমার বন্ধু! অরিত্রি তখন খুব মাইন্ড করেছিল, বলেছিল ইউ আর রেসিষ্ট মা! জেসমিনও কানাডাকে ভালবেসে ফেলেছে। এখানকার সবকিছু ওর পছন্দ। এর কারণ পরিষ্কার। এখানে মেয়েদের অধিকার, মেয়েদের নিরাপত্তা এবং আইনের শাসন। আমিও এই দেশটাকে ভালবাসি কিন্তু তাও মন ছুটে যায় বারবার নিজের জন্মস্থানে।
কানাডার চেয়ে বাংলাদেশকে আমার বেশি বৈচিত্রপূর্ণ মনে হয়। বেশি ইন্টারেষ্টিং মনে হয়। আমি যেখানে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি সেই জায়গায় ঘ্রাণই আলাদা। পৃথিবীর আর কোথাও সেই স্বাদ আমি পাব না। ওই মাটির কাছে আমার অনেক ঋন আছে। জন্মস্থানের ঋন। বাবা মায়ের ঋন। দেশটা অনেক বৈচিত্রে ভরা। খাওয়া দাওয়া অনেক স্বাদের। মাছ, তরকারির স্বাদ এখানে কোনোদিন ওইভাবে পাব না। তাছাড়া প্রতিনিয়ত নানা কিছু ঘটে সেখানে যা পৃথিবীর অন্যকোথাও ঘটে না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তাই দেখে আসছি। এমন না যে এটা নতুন কিছু। এতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি। দেখেছি নানা ঝড় ঝঞ্ঝা, রাজনৈতক পালাপাদল, হিংসার রাজনীতি, খুনের রাজনীতি। ১৫ আগষ্ট দেখেছি, স্বৈরশাসন দেখেছি, আন্দোলন সংগ্রাম দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি।
দেশের সাথে আমার যোগাযোগ নিবিড়। দেশে রয়েছে আমার আপন জনরা। আমার বন্ধু, আত্মীয়, লেখক, সাংবাদিক যাদের সাথে আমার ওঠবস। খ্যাতিমানদের সবাইকে কমবেশি চিনি জানি। ইতিহাস পড়েছি। দেশ আমার কাছে এক আবেগের নাম। কি না হয় দেশটায়! সবই হয়। খুন, ধর্ষণ, গুম, ক্রসফায়ার, ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা, লুটপাট, ঘুষ, দূর্নীতি, টাকা পাচার, মিথ্যাচার, চরিত্রহনন, প্রশ্নপত্র ফাঁস, অযোগ্যদের দাপট, ভেজাল, চিকিৎসার নামে ব্যবসা, ব্যাংক লুট, শেয়ার বাজার লুট, প্রতিশোধপরায়নতা, ক্ষমতার দাপট, মতবিরোধ। তারপরও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবন মানের উন্নতি ঘটছে। এমন দিন আসবে যখন আমেরিকা কানাডার মতো হয়ে যাবে দেশ। এই স্বপ্ন দেখি আমি।
কানাডার সরকার যে এতোকিছু করছে মানুষের জন্য- উন্নত জীবন, উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা, উন্নত নির্বাচনী ব্যবস্থা, উন্নত বিচার ব্যবস্থা, ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসা, আবাসন, পড়াশুনা, নিরাপত্ত্বা, চাকরির সংস্থান, মানবাধিকার, মানুষের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার। এতোসব সত্ত্বেও সরকার প্রধান সবসময় বলে থাকেন, আমাদের আরো অনেক কিছু করার আছে। কখনো বলেন না, ’আমি এই করেছি, সেই করেছি’। সবসময় বলেন, কানাডার নাগরিকদের উন্নত জীবন সবার আগে। আমরা এজন্যই কাজ করে যাচ্ছি। কখনো বলেন না, আমি সব করছি। সমালোচনাকে শ্রদ্ধা করেন, তাদের কথা শোনেন। দমন করার কথা বলেন না। অনেক উন্নয়ন হয় এদেশে। টেরও পাওয়া যায় না কখন হচ্ছে। চুরি বা কমিশনের কোনো ব্যাপার নাই। বড় বড় হাইওয়ে হচ্ছে, বাইপাস হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে, হাসপাতাল হচ্ছে, ব্রিজ কালভার্ট হচ্ছে, রেল লাইন হচ্ছে, আন্ডারগ্রাউন্ড হচ্ছে, এয়ারপোর্ট হচ্ছে, বড় বড় ব্রিজ হচ্ছে। নেক্সট্ একশ বছরের প্লান করে সবকিছু হয়। তাও যে কেনো মন বসে না এখানে! বরিশালের পথ ঘাট, অলিগলি, আনাচ কানাচ সব আমাকে টানে, কেবল টানে..।
জসিম মল্লিক
টরন্টো ২২ অক্টোবর ২০২০