টরেটক্কা টরন্টো – সন্তান প্রতিপালন
নভেম্বর ৩, ২০২০
কাজী সাব্বির আহমেদ
এজ্যাক্স হাই স্কুল যে আমার ছেলের জন্য উপযুক্ত ছিল না, তার আরেকটি কারণ ছিল ‘বুলিইং’। নর্থ আমেরিকার স্কুলগুলিতে ‘বুলিইং’ একটি স্বীকৃত এবং চিহ্নিত সামাজিক সমস্যা। ফলে এই নিয়ে স্কুল বোর্ড সহ বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাগুলির বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে – রয়েছে ‘বুলিইং’-এর বিস্তারিত সংজ্ঞা, প্রকারভেদসহ নানাবিধ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। আমার এক প্রাক্তন সাদা এবং নায়েগ্রাতে বেড়ে উঠা সহকর্মী একবার আমাকে বলেছিল যে সে যখন হাইস্কুলে পড়ত তখন তাদের স্কুলে হঠাৎ করে একদল সোমালি রিফিউজি স্টুডেন্ট এসে ভর্তি হয়। লোকাল সাদা স্টুডেন্টরা যে সোমালি রিফিউজি স্টুডেন্টদেরকে গ্রহণ করতে পারেনি সেটা তারা প্রকাশ করত সেই সোমালিদের সাথে কোনরকম ইন্টারঅ্যাকশন না করে, অর্থাৎ তারা সোমালিদের উপস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে ইগনোর করত। এই ইগনোর করাটা যে এক ধরণের বড় রকমের ‘বুলিইং’ বা সামাজিক ডিসক্রিমিনেশন সেটা একবার দেখেছিলাম আমার আরেক কালো মহিলা কলিগের বেলায়। আমরা সবাই মিলে বাইরে লাঞ্চ করতে গিয়েছিলাম জাপানিজ এক ফ্রেঞ্চআইচ রেস্টুরেন্টে। সাদা ওয়েটার এক এক করে সবার অর্ডার নিচ্ছিল। কিন্তু কোন এক কারণে তাকে বাদ দিয়ে পরের জনের কাছে গেল। সেই মহিলা কলিগটি অবশ্য বেশ কড়াভাবেই সেই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল, ওয়েটারকে অনেকটা ধমকের সুরে বলেছিল, “কী ব্যাপার আমি কি তোমার চোখে ইনভিসিবল?”।
অতি সম্প্রতি পিকারিং শহরে ডুরহাম স্কুল বোর্ডের অধীনস্থ সেন্টমেরী ক্যাথলিক সেকেন্ডারী স্কুলের ‘ইয়ারবুক’ নিয়ে যে ‘বুলিইং’-এর ঘটনাটি ঘটেছে তা যে সিস্টেমিক রেসিজমের ফসল সেটা সহজেই অনুমেয়। কালো বর্ণের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট ‘জশুয়া টেলিম্যাক’ তার সদ্য প্রয়াত গ্র্যান্ডমা-কে স্মরণ করে ‘ইয়ারবুক’-এর জন্য লিখে ‘জওচ এৎধহফসধ. ঞযধহশ ুড়ঁ ভড়ৎ মঁরফরহম সব ঃযৎড়ঁময সু ভড়ঁৎ ুবধৎং ড়ভ যরময ংপযড়ড়ষ’। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে ইয়ারবুকে ছাপা হয় ‘জওচ ঐধৎধসনব উড়ড়মধ নড়ড়মধ.ঙ.’। ‘হারাম্বি’ হচ্ছে সিনসিনাটি চিড়িয়াখানার এক গরিলা যাকে ২০১৬ সালে কোন এক কারণে হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনাটি নিউজে আসার পর পুলিশ তদন্ত করতে নেমে দেখে যে এইটিই শুধু নয় এরকম আরো নয়টি মন্তব্য পরিবর্তন করা হয়েছে একই রকম রেসিয়াল আন্ডারটোন দিয়ে। প্রিন্সিপাল সুসান ডুয়ান অবশ্য সব স্টুডেন্টদেরকে অনুরোধ জানিয়েছেন তাদের ইয়ারবুকগুলো ফেরৎ দেয়ার জন্য তবে একই সাথে দাবী করেছেন যে এই পরিবর্তন স্কুল কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত ছিল না। পুলিশ যদিও এই ঘটনার পিছনে কারা দায়ী তা বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু স্কুলের প্রিন্সিপাল কি তার দায় এড়াতে পারেন? কারণ দিনশেষে এই ইয়ারবুকটি কিন্তু স্কুলেরই, যারাই এর প্রকাশনার পিছনে থেকে থাকুক না কেন।
আমার ছেলের ক্ষেত্রে ‘বুলিইং’টা হয়েছিল এজ্যাক্স হাই স্কুলের এক টিচারের কাছ থেকে যে কিছুতেই আমার ছেলের নাম শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করছিল না। আমি এই নিয়ে স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলেও কোন ফল পাইনি। ফলে নর্থ ইয়র্কের ‘জর্জ ভ্যানিয়ে হাই স্কুল’-এ এসে আমার ছেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু নর্থ ইয়র্কে এসে এজ্যাক্স হাই স্কুলের বেশ কিছু ক্লাসমেটকে সে মিস করতে শুরু করে। তার জন্য আমাদেরকে প্রায়ই এজ্যাক্স যেতে হত যাতে সে তার প্রিয় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারে।
নতুন স্কুলে এসে ‘এমএসসিসি (ম্যাথ, সায়েন্স, কম্পিউটার, কমিউনিকেশন)’ নামক এক বিশেষ প্রোগ্রামের অধীনে সে তার কোর্সগুলো নেয়। ফলে ম্যাথ এবং সায়েন্স কোর্সগুলি তাকে টিডিএসবি বোর্ডের রেগুলার কারিকুলামের বাইরেও বেশ কিছু টপিক পড়তে হয়েছিল। বাড়তি এই পড়ার চাপের কারণে ধীরে ধীরে তার ভেতরে এক ধরণের স্ট্রেস তৈরি হচ্ছিল যা আমরা টের পাচ্ছিলাম। পরিচিত এক ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের মাধ্যমে একজন অভিজ্ঞ প্রাইভেট টিউটর রাখা হলো সায়েন্স এবং ম্যাথ পড়ানোর জন্য। সাথে সাথেই এর ফল আমরা দেখতে পেলাম, তার স্বাভাবিক প্রাণবন্ত এবং কনফিডেন্ট ব্যক্তিত্ব আবার ফিরে এলো তার আচরণের মাঝে। এ সময় ‘বিল গেইটস’ তার মেয়ের হাইস্কুলের পড়াশুনার জন্য ‘খান একাডেমী’-এর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক সালমান খানকে লাইম লাইটে নিয়ে আসেন। আর আমরাও আমাদের ছেলেকে উৎসাহিত করি ‘খান একাডেমী’-এর ভিডিও টিউটরিয়ালগুলি থেকে তার সাবজেক্টগুলি ঝালিয়ে নিতে। আমি খান একাডেমীর কথা আমার কলিগদেরকেও বলেছি তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য এবং তাদের সবার কাছ থেকেই খান একাডেমীর ভূয়সী প্রশংসা শুনেছি।
এখানে উল্লেখ্য যে, টরন্টোর অনেক হাইস্কুলেই বোর্ড নির্ধারিত রেগুলার কারিকুলামের বাইরেও অন্যান্য কারিকুলাম বা প্রোগ্রাম নিয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এইসব প্রোগ্রামে পরীক্ষার মাধ্যমে সুযোগ পেতে হয়। ‘আইবি’ অর্থাৎ ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্যাকালরিয়েট’ হচ্ছে এইগুলির মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় কারিকুলাম। কিছু কিছু হাইস্কুল ‘আইবি’-এর বাইরেও তার নিজস্ব কিছু প্রোগ্রাম চালু করেছে, ‘এমএসসিসি’ হচ্ছে সেই রকম একটি প্রোগ্রাম। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ কোন কারিকুলাম কিংবা প্রোগ্রামের জন্য হাইস্কুলটি এমনই জনপ্রিয়তা পায় যে তার আসল নামটিই তখন চাপা পড়ে যায়। যেমন টরন্টোর স্কারবোরোর ‘পোর্টার কলেজিয়েট ইনস্টিটিউট’-টি ‘স্যাটেক’ হাইস্কুল হিসেবেই পরিচিত। আবার অনেক হাইস্কুলে ‘এপি’ (অ্যাডভান্স প্লেসমেন্ট) প্রোগ্রাম থাকে যেখানে হাইস্কুলেই ইউনিভার্সিটির কিছু কোর্স আগেভাগেই শেষ করে ফেলা যায়। কিছু হাইস্কুল আছে যেগুলো ইন্ডিপেনডেন্ট কিংবা প্রাইভেট, কিন্তু তাদের লেখাপড়ার মান যেমন অনেক উঁচু আবার সেখানে পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পাওয়াটাও তেমনি দুষ্কর, ‘ইউটিএস’ (ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো স্কুলস) হচ্ছে সে রকম একটি হাইস্কুল। আমি আমার এক চাইনিজ বংশোদ্ভূত এবং এক রাশিয়ান বংশোদ্ভূত কলিগকে তাদের ছেলে এবং মেয়েকে ‘ইউটিএস’-এর ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রায় দুই বছর আগে থেকেই প্রস্তুত করতে দেখেছি। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো হচ্ছে বিদেশী স্টুডেন্টদের জন্য এক মহা মিলনমেলা। বিদেশী স্টুডেন্টরা যারা এখানে পড়তে আগ্রহী কিন্তু যোগ্যতার বিচারে কিছুটা পিছিয়ে তাদের জন্য রয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুল’ নামক একটি হাইস্কুল। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর অধীনে পরিচালিত এই বিশেষ হাইস্কুলটিতে তারা কানাডার কারিকুলামে গ্রেড টুয়েলভ শেষ করে ইউনিভার্সিটির কোর্স শুরু করতে পারে। তবে ‘জর্জ ভ্যানিয়ে হাই স্কুল’-ও বেশ কিছু ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টকে পড়তে দেখেছি বিভিন্ন গ্রেডে। টিডিএসবি বোর্ডের হাইস্কুলেও যে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের পড়ার সুযোগ রয়েছে সেই ব্যাপারটা আমার আগে জানা ছিল না।
হাইস্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি বেশ কিছু এক্সট্রা কারিকুলাম একটিভিটিসে আমার ছেলেকে অংশ নিতে দেখেছি। তার মধ্যে অন্যতম ছিল খেলাধূলা। খেলাধূলার মধ্যে তাকে ক্রিকেট এবং ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখেছি স্কুলে। ব্যাডমিন্টন খেলায় তার বিশেষ আগ্রহ দেখে আমরা তাকে একজন কোচের অধীনে নিয়মিত অনুশীলনে ভর্তি করে দেই যিনি ছিলেন থাইল্যান্ডের জাতীয় দলের সাবেক কোচ। তবে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল প্রতি বছর শীতে ‘ক্যাম্প কারনী’-তে যাওয়া। বিভিন্ন গ্রেডের ছেলেমেয়েদের একটা দল একজন টিচারের তত্ত্বাবধানে স্কুল থেকে আয়োজিত একটা বাসে করে চারদিনের জন্য যেত এই ক্যাম্পে। ক্যাম্পের বিভিন্ন একটিভিটিস আমার ছেলে বেশ উপভোগ করত। ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে আবার পরের বছরে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকত সে। তার এই উৎসাহের জন্য আমরা নিজেরাই ফ্যামিলি সহ ব্লু-মাউন্টেইনে একবার সামারে এবং একবার শীতে যেতাম নিয়ম করে। শীতে ব্লু-মাউন্টেইনে স্কী করাটা ছিল আমার ছেলের কাছে খুবই উত্তেজনাকর একটি স্পোর্টস। আমি নিজেও বেইজিং-এ আন্ডারগ্রেড করার সময় নিয়মিত স্কেটিং করতাম। কিন্তু দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে সেই বিদ্যা যে কবেই নাশ হয়েছে সেটা ব্লু-মাউন্টেইনে একবার চেষ্টা করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।
হাইস্কুলে আমার ছেলে খুব উৎসাহের সাথে ‘স্টেম’ (ঝঞঊগ) ক্লাবে যোগ দিয়ে ‘আরডুইনো’ নামক মাইক্রোকন্ট্রোলার দিয়ে ইলেক্ট্রনিক সার্কিট বানানো শুরু করে। এই সার্কিট বানানো এক সময় তার হবিতে পরিণত হয় যা আজো তার অবসর সময়কে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। এই সময় এক গ্রেড সিনিয়র চীনা বংশোদ্ভূত ‘হেনরি’-এর সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। হেনরির আবার উৎসাহ ড্রোন আর রিমোট কন্ট্রোল প্লেনের প্রতি। ছুটির দিনে তারা আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে স্কুলের মাঠে ড্রোন আর রিমোট কন্ট্রোল প্লেন উড়ানো নিয়ে মেতে থাকত। তাদের সেই উৎসাহ এবং বন্ধুত্ব আজো সেই একই রকমভাবে বিদ্যমান। আজো তারা সময় পেলে ড্রোন আর প্লেন নিয়ে পেলে চলে যায় সানি ব্রুক পার্কে। নিত্য নতুন সার্কিট তৈরি করা আর কম্পিউটারে প্রোগ্রাম লিখে সেই সার্কিটকে কন্ট্রোল করা আমার ছেলের এমন নেশায় পরিণত হলো যে ইউনিভার্সিটিতে ‘ডিজাইন ক্লাব’-এ যোগ দিল যেখানে তারা রকেট ডিজাইনের মতন এক অ্যাম্বিশাস প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। প্রডাক্টিভ কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকাটা আসলে খুব জরুরী, যার শিক্ষা আমরা ছোট বেলাতেই পেয়েছিলাম -‘অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা’।
কোর্স ওয়ার্কের পাশাপাশি নিদেনপক্ষে চল্লিশ ঘণ্টার স্বেচ্ছাশ্রম (ভলিন্টিয়ারিং) হচ্ছে হাইস্কুল থেকে গ্রাজুয়েট হওয়ার একটি পূর্বশর্ত। তবে চল্লিশ ঘণ্টার চেয়ে অনেক বেশী স্বেচ্ছাশ্রম করাটাই যেন অনেকটা অলিখিত নিয়ম। কারণ অনেকে মনে করেন যে বেশী বেশী স্বেচ্ছাশ্রম-ঘণ্টা ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত কোন মন্তব্য নেই, তবে এই স্বেচ্ছাশ্রম অবশ্যই সন্দেহাতীতভাবে একটি ভালো এবং কার্যকরী অভিজ্ঞতা যা পরবর্তীতে পেশাগত জীবনের জন্য বিশেষ সহায়ক। এ সময় পড়াশুনার পাশাপাশি অনেক ছাত্রছাত্রীকে দেখেছি যে স্বেচ্ছাশ্রমের বাইরে রেগুলার কাজেও যোগ দেয় ‘সামার জব’ নিয়ে। অনেকে আবার সামারের ছুটির বাইরেও ‘পার্টটাইম জব’ করে। পার্টটাইম জবের কারণে লেখাপড়ার ক্ষতি হতে পারে এই চিন্তা থেকে আমরা আমাদের ছেলেকে হাইস্কুল গ্রাজুয়েটের আগে কোন পার্টটাইম জব নেয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করিনি। তবে অনেককেই লেখাপড়ার ক্ষতি না করে পার্টটাইম জব চালাতে দেখেছি। হাইস্কুল শেষ করার পর আমার ছেলে কিছুদিন ‘ডোমিনো পিজ্জা’-তে কিচেন হেল্পার হিসেবে কাজ করেছে। তারপর সে বিভিন্ন টিউটরিং সেন্টারে টিউটর হিসেবেও কাজ করেছে। টিউটর হিসেবে কাজ করাতেই সে সবচেয়ে বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ এবং সেই সাথে উপভোগও করেছে।
হাইস্কুলের শুরুতেই প্রত্যকের উচিৎ তার ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করার। আমাদের দেশে আমাদেরকে রচনা লিখতে হতো ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ অর্থাৎ ‘এইম ইন লাইফ’ নিয়ে। জীবনের লক্ষ্যকে দার্শনিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যদিও একটি জটিল বিষয়, তবে আমাদের রচনার মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের ক্যারিয়ার, অর্থাৎ আমরা বড় কী হতে চাই তা নিয়ে লিখতে হত। এই ‘কী হতে চাই’-এর লিস্টিটা অবশ্য খুব একটা দীর্ঘ ছিল না, সাধারণত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী বা ব্যরিস্টারের ভিতর সীমাবদ্ধ থাকত। এই জাতীয় রচনার অবশ্য মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরকে আমাদের পেশাগত ক্যারিয়ার সম্পর্কে সচেতন করে দেয়া। এখানকার স্কুলবোর্ডের শিক্ষাব্যবস্থায় এই কাজের জন্য একজন ‘গাইডেন্স কাউন্সিলর’ থাকেন যিনি ছাত্রছাত্রীদেরকে তাদের মেধা এবং সক্ষমতার ভিত্তিতে কোন কোন কোর্স এবং পরবর্তীতে কোন ধরণের ক্যারিয়ার তাদের জন্য উপযুক্ত হবে সেটার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কোন এক বিচিত্র কারণে এই গাইডেন্স কাউন্সিলরেরা ছাত্রছাত্রীদেরকে ‘ড্রীম বিগ’-এ উদ্বুদ্ধ করে না। তাই এই কাজটির ভার অভিভাবকদের নিজেদের হাতে তুলে নিতে হয়। একজন মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, তাই আমাদের সন্তানদেরকে সব সময়ই উৎসাহিত করতে হবে তাদের স্বপ্নকে বড় করার জন্য। তারা যেন নিজেকে অতিক্রম করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে নিরন্তর। একটা ভালো ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে একটা ভালো ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী থাকাটা যে একটা অত্যাবশ্যকীয় শর্ত তা কিন্তু না। তারপরও একটা ভালো ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করাটা একটা ভালো ক্যারিয়ার গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে কী কী যোগ্যতার দরকার সেই ব্যাপারে নিজেদেরকেই খোঁজ খবর নিতে হবে। স্কুলবোর্ড যদিও কিছু ‘ইনফরমেশন নাইট’ টাইপের সেমিনারের আয়োজন করে থাকে, তবে সেখান থেকে বেসিক ইনফরমেশনের বাইরে তেমন কিছু জানা যায় না। ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার ব্যাপারে গ্রেড এলেভেন এবং টুয়েলভ-এর সায়েন্স, ম্যাথ এবং ইংরেজীর মার্কস একটি বড় এবং প্রথম ফ্যাক্টর, তাই সচেষ্ট থাকতে হবে এই সাবজেক্টগুলোতে ভালো মার্কস পাওয়ার জন্য। অনেককে দেখেছি কোন কোন সাবজেক্টে স্কুলের পরীক্ষায় কোন কারণে আশানুরূপ মার্কস না পেয়ে পরে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করে নিতে। কারণ তারা জানে দিনশেষে এই মার্কসই হবে ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য ডিসাইডিং ফ্যাক্টর। আবার স্কুল ভেদে কিংবা টিচারভেদে পরীক্ষার প্রশ্ন এবং মার্কিং পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে। আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের দেশে যে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা হয় সেই ধাঁচের পরীক্ষা কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থায় চালু করলে স্কুল কিংবা টিচার ভিত্তিক মার্কসের এই বৈষম্য হয়ত অনেকটা দূর হত। এবং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপারে একটা ফেয়ার জাজমেন্ট সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হত। আমি চীনে দেখেছি সে দেশের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য সারা দেশব্যাপী একযোগে একই প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে। সেই কঠিন পরীক্ষার বৈতরণী পার হয়েই তাদেরকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে হয়। সে দেশে কিন্তু ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষে ড্রপ আউটের সংখ্যা নাই বললেই চলে, যা কি না এদেশে একটি সাধারণ বিষয়।
বলা হয়ে থাকে যে পড়ালেখার ব্যাপারে ইমিগ্র্যান্টরা তাদের সন্তানদেরকে বেশ চাপ দিয়ে থাকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি কথাটা অনেক ক্ষেত্রেই সত্যি। বিশেষ করে মেইনল্যান্ড চায়না থেকে আসা চাইনিজ ফ্যামিলিরা তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যাপারে অনেক বেশী সিরিয়াস। তারা তাদের সন্তানদেরকে বিভিন্ন আফটার স্কুল প্রোগ্রামে ভর্তি করে দেন যেখানে উইকএন্ডে তাদেরকে নিয়ে হাজির হন। টরন্টোর স্কারবোরো এলাকার কনজুমার রোডে অবস্থিত ‘অলিম্পিইয়াড স্কুল’ হচ্ছে এরকম একটি স্কুল যেখানে আমার ছেলে হাইস্কুলে থাকাকালীন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর একটি কোর্স করেছিল। এই স্কুলে আমি দেখেছি চাইনিজ ছাত্রছাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। এরা এখানে স্কুল বোর্ডের একাডেমিক কোর্সগুলোর বাইরেও বিভিন্ন কনটেষ্টের জন্য কোচ করায়। স্যাট, জিম্যাট ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য অনুশীলন করায়। এখানে পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের লক্ষ্যই থাকে আমেরিকার টপ ইউনিভার্সিটিগুলিতে স্কলারশীপ নিয়ে ভর্তি হওয়া, যা আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সচরাচর দেখা যায় না। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
টরন্টো