কমলার জয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ ও বৈষম্য অবসানে কতটা অবদান রাখবে?
ডিসেম্বর ৩, ২০২০
খুরশিদ আলম
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হয়েছেন কমলা দেবী হ্যারিস। আগামী ২০ জানুয়ারী তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিবেন আর এর মাধ্যমে তিনি হতে চলেছেন দেশটির ২০০ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট।
কমলা হ্যারিস নির্বাচনে জয়ী হয়ে সৃষ্টি করেছেন আরো কয়েকটি ইতিহাস। সেই ইতিহাস নারীর অগ্রযাত্রার ইতিহাস, ইমিগ্রেন্টদের অগ্রযাত্রার ইতিহাস, বর্ণবাদীদের পরাজিত করে জয়ী হওয়ার ইতিহাস।
এর আগে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ বারাক ওবামা-ও নির্বাচনে জয়ী হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন যা ছিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক ঘটনা। তবে ওবামাকে শতভাগ কৃষ্ণাঙ্গ বলার সুযোগ নেই। কারণ তার মা ছিলেন শে^তাঙ্গিনী। কিন্তু তবু লোকজন তাকে কৃষ্ণাঙ্গ বলেই বিবেচনা করেন। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। ওবামার বাবা কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন, তাই তিনিও কৃষ্ণাঙ্গ এমনি মনোভাব সকলের। এখানে মায়ের পরিচিতিকে গৌন অথবা একেবারেই অবজ্ঞা করা হচ্ছে!
একইভাবে কমলাকেও শতভাগ কৃষ্ণাঙ্গ বা শতভাগ ভারতীয় বলার সুযোগ নেই। কারণ তার বাবা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গ এবং মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত তামিল। তবে কমলার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মিডিয়াতে কমলার বাবার তুলনায় তার মায়ের পরিচিতিটা বেশী প্রকাশ পাচ্ছে। এর একটা কারণ হতে পারে এই যে, কমলার জীবনে তার মায়ের ভূমিকা বা প্রভাব বেশী ছিল এমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে কমলার বিভিন্ন বক্তব্যে।
আমরা জানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বর্ণবাদ এক প্রবল শক্তি নিয়ে বহু কাল ধরেই বিদ্যামন। এই বর্ণবাদ সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে, আদিবাসী জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে, এশিয়াসহ বিশে^র অন্যান্য দারিদ্রপীড়িত অঞ্চল থেকে আসা জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে, বিভিন্ন সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। বর্ণবাদের পাশাপাশি আছে বৈষম্য। চরম বৈষম্যের শিকার এই দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আছে কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী, সাউথ আমেরিকান ও এশীয় জনগোষ্ঠি।
কমলা হ্যারিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের শিকার এই জনগোষ্ঠিরই প্রতিনিধি। তিনি বর্ণবাদসহ নানান প্রতিকুলতা ও প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙ্গিয়ে দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তার এই জয় আরো বেশী গুরুত্ব বহন করে এই কারণে যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সংখ্যক বর্ণবাদী মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতেছেন। এই বর্ণবাদী মানুষের সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক!
ভাবতে অবাক লাগে বর্তমানে বিশে^ ক্ষমতায়, অর্থবলে এবং আরো কিছু বিষয়ে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ ভাবা এই দেশটির প্রায় অর্ধেক ভোটারই (৪৭.২৬%) ভোট দিয়েছেন চরম বর্ণবাদী, মিথ্যাবাদী ও মানুষকে অসম্মানকারী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে! নারী কেলেঙ্কারী, অর্থ কেলেঙ্কারী, পরের নিন্দা করা যার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং নির্বাচনে হেরেও যিনি বেহায়ার মত এখনো বলে বেড়াচ্ছেন তিনিই জয়ী হয়েছেন সেই ব্যক্তিকেই তারা তাদের দীক্ষাগুরু বা মনিব বলে মেনে নিয়ে ভোট দিয়েছেন!
বাংলাদেশে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান খেতাব দিয়েছিলেন বিশ^ বেহায়া হিসাবে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে সেই এরশাদতো একেবারেই শিশু। আমার মনে হয়, ট্রাম্পকে খেতাব দেয়া যেতে পারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ^ বেহায়া হিসাবে। তাতেও বোধকরি সবটা বলা হবে না।
আর এরকম একজন ব্যক্তি ও তার বিশাল সমর্থকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে কমলা হ্যারিস তার নেতা জো বাইডেন-সহ বিজয়ী হয়েছেন তা যে কোন বিচারেই অসাধারণ এক অর্জন। তার এই অসাধারণ অর্জনে উদ্দিপ্ত ও খুশি হয়েছেন কানাডার ইমিগ্রেন্টরাও। কারণ, কমলার মাঝে তারা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন।
কমলার বিজয়কে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন ভাবে বিশ্লেষন করছেন। তবে সবচেয়ে বেশী যে বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য সেটি হলো, কামলার এই সাফ্যল মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিজয়। আর এখানেই লুকিয়ে আছে কানাডিয়ান ইমিগ্রেন্টদের খুশী হওয়ার কারণ। হোক না তা আরেক দেশ। কিন্তু মিল তো আছে অনেক। সেদেশে ইমিগ্রেন্টরা যেমন বর্ণবাদ ও বৈষম্যের শিকার, এদেশেও তাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ যেমন কৃষ্ণাঙ্গদের উপর কারণে অকারণে চড়াও হয়, এ দেশেও তাই হয়।
দেখা গেছে, টরন্টোর পুলিশ আমেরিকান পুলিশের চেয়ে কম সাম্প্রদায়িক এমন একটি ধারণা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু অন্টারিও মানবাধিকার কমিশনের (OHRC) প্রধানের মতে তা নিছক ‘জনশ্রুতি’। OHRC’র রিপোর্টে দেখা গেছে, টরন্টোর কৃষ্ণাঙ্গ লোকেদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনী “অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে” গ্রেফতার, অভিযোগ দায়ের এবং বলপ্রয়োগ করে থাকে। গত ১০ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে OHRC’র অন্তর্র্বতী প্রধান কমিশনার এনা চাধা বলেন, “টরন্টোতে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে পুলিশ কর্তৃক গুলি করার সম্ভাবনা গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনও শহরে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর সম্ভাবনার মতই অত্যধিক।” এ তথ্য প্রকাশ করে দি কানাডিয়ান প্রেস।
কমিশনের রিপোর্টে আরো দেখা গেছে, “টরন্টোতে কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রেফতার, অভিযুক্ত করা, বলপ্রয়োগ, আঘাত করা, গুলি করা বা হত্যা করার সম্ভাবনা অনেক বেশি।”
এতে বলা হয়, কৃষ্ণাঙ্গরা নগরীর জনসংখ্যার মাত্র ৮.৮ শতাংশ হলেও মোট অভিযোগের তালিকার এক-তৃতীয়াংশই তাদের বিরুদ্ধে।
এরপর আছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষী মনোভাব ও আক্রমণের ঘটনা। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন হচ্ছে তেমনি হচ্ছে কানাডায়ও।
এইতো গত ১২ সেপ্টেম্বর এর একটি ঘটনা। টরন্টোর নিকটবর্তী ইটবিকোকে এক মসজিদের সামনে ঐদিন এক মুসল্লিকে মারাত্মকভাবে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। হত্যার নায়ক ফন নিউটিজেম নামের এক শে^তাঙ্গ যুবক। কোনরকম উস্কানী ছাড়াই ৫৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ আসলিম জাসিফকে হত্যা করেন এই শে^তাঙ্গ যুবকটি যার বয়স ৩৪। শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপের সঙ্গে ঐ যুবকের যোগাযোগ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই ঘটনার পর কানাডায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপগুলো ভেঙ্গে দেয়ার জন্য জাস্টিন ট্রুডোর সরকারকে পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানায় স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো। যে সংগঠনগুলো ট্রুডোর কাছে খোলা চিঠি লিখেছে তারা বলেছে, ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা রোধে সরকারের সক্রিয় হওয়ার দরকার আছে।
তারা লিখেছে, “আমরা কানাডীয়রা, সে আদিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিম, ইহুদি, শিখ, খ্রিস্টান বা অন্য কোন ধর্মের এবং অশ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের যা-ই হই না কেন, আমরা আক্রান্ত হচ্ছি, আমাদের ঘরে, আমাদের উপাসনালয়ে এবং আমাদের সমাবেশে। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠনের হাতে আমরা হামলার শিকার হচ্ছি।”
চিঠিতে স্বাক্ষরকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস, ওয়ার্ল্ড শিখ অরগানাইজেশন, দ্য সেন্টার ফর ইসরায়েল অ্যান্ড জুইশ অ্যাফেয়ার্স, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং দ্য কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্ক।
এর আগে টরন্টোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মসজিদ টরন্টোতে গত তিন মাসে ছয় দফা হামলা চালানো হয়েছে। দুটি মসজিদে তিন বার করে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলার মধ্যে আছে মসজিদের ভেতরে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারা, জানালা ভেঙ্গে ফেলা এবং জানালা ও দেয়ালে বর্ণবাদী চিত্র এঁকে রাখা।
আর কুইবেক সিটির ঘটনাতো এখনো অশ্রু ঝড়াচ্ছে অনেকের চোখে। ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী সন্ধ্যায় ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মুসল্লিরা যখন মাগরিবের নামাজ আদায় করছিলেন তখন আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক নিয়ে হামলা চালায়। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন।
এভাবে দেখা যায়, কানাডায়ও কৃষ্ণাঙ্গসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা বর্ণবাদ, বৈষম্য, অবহেলা ইত্যাদির শিকার হচ্ছেন।
উল্লেখ্য যে, গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য মিনেসোটায় জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে শ^াসরোধ করে হত্যা করা হয়। আর ঐ হত্যাকান্ডের নায়ক হলেন এক শে^তাঙ্গ পুলিশ। হত্যাকান্ডের বিষয়টি ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমে ছড়িয়ে দেন প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা। এর পরই শুরু হয় বিক্ষোভ। প্রথম দিকে প্রতিবাদের ভাষা ছিল রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল ও স্লোগান দেওয়ার মধ্যে। তবে করোনার এই মহামারী কালেও যুক্তরাষ্ট্রের মাটি ছাপিয়ে এই আন্দোলনের বাতাস যখন কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোতে লাগে তখন এটি আরও বেগবান হয়। এরপর সেই আন্দোলন শুধু ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বা ‘আই কান্ট ব্রিদ’ লেখা প্ল্যাকার্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই আন্দোলন রূপ নিয়েছে বর্ণবাদবিরোধী কঠিন আন্দোলনে। বিভিন্ন শহরে বর্ণবাদের সঙ্গে জড়িত বিখ্যাত মানুষের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সড়কের নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে। আর সেই ঢেউয়ের আঘাত এসে লেগেছে কানাডায়ও। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ এর আন্দোলনের মুখে বর্ণবাদীদের ভাস্কর্য ভাংচুর বা সরিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে কানাডাতেও। আন্দোলন ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠেছে এই দাবীতে যে, অতীতে যারা বর্ণবাদী ছিলেন অথবা বর্ণবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন সেই সকল ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের ভাস্কর্য কানাডার বিভিন্ন স্থান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এর মধ্যে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি হলেন কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড। ম্যাকডোনাল্ডকে কানাডার জাতির পিতাও বলা হয়ে থাকে। টিএনসি নিউজের এক খবরে বলা হয়, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলকারীরা দাবী করছেন, কানাডার মন্ট্রিয়লে অবস্থিত ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্যটি-সহ অন্যান্য আরো কিছু ভাস্কর্য বর্ণবাদের প্রতীক এবং একই সাথে অতীতের গণহত্যারও প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই এগুলোকে স্তম্ভের পাদভূমি থেকে সরাতে হবে। এক অনলাইন পিটিশনের মাধ্যমে তারা কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্য সরানোর আহ্বান জানান মন্ট্রিয়লের মেয়র এবং সিটি কাউন্সিলের প্রতি। আন্দোলনকারীদের দাবী, ম্যাকডোনাল্ড কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি ছিলেন প্রচন্ড ভাবে বর্ণবাদী! তিনি কানাডার আদিবাসীদের দেখতে পারতেন না। কানাডার আদিবাসীদের সনন্তানদের জোর করে ধরে এনে বিতর্কিত আবাসিক স্কুলে ভর্তি করানোর পিছনেও তার ভূমিকা ছিল জোরালো। সেই স্কুলে আদিবাসী শিশুদের উপর চালানো হয়েছিল নির্মম অত্যাচার। যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়েছিল ঐ শিশুরা।
ম্যাকগিল ইউসিভার্সিটির আর্ট ইতিহাসের অধ্যাপক চার্মাইন নেলশন বলেন, এই ভাস্কর্য বা স্মৃতিস্তম্ভগুলো অর্থহীন, তুচ্ছ জড় পদার্থ নয়। বরং এই ভাস্কর্যগুলো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা কৌশলগতভাবে বর্ণবিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য একটি তাবিজ হিসাবে ব্যবহার করছেন।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলকারীরা শুধু ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্য সরানো দাবীতেই সীমাবদ্ধ নন। তারা চিহ্নিত আরেক বর্ণবাদী রায়ারসন এর ভাস্কর্য সরানোর দাবীও করছেন। টরন্টোতে যারা থাকেন তারা সবাই রায়ারসন নামটার সঙ্গে পরিচিত। তার পুরো নাম এগারটন রায়ারসন। টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত রায়ারসন ইউনিভার্সিটি তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে। আর এই ইউনিভার্সিটির চত্ত্বরে রয়েছে তার একটি ভাস্কর্য। কিন্তু এই রায়ারসন যে শুধু একজন বর্ণবাদী ব্যক্তি ছিলেন তাই নয়, নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষেয়েও এই রায়ারসন সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন চলা কালে টরন্টোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম বদল করার দাবীও উঠেছে। সড়কটির নাম ‘ডান্ডাজ স্ট্রিট’। ডান্ডাজ এর পুরো নাম হ্যানরি ডান্ডাজ। তিনি ছিলেন একজন বৃটিশ রাজনীতিবিদ। ডান্ডাজ একসময় বৃটেনের ‘হোম সেক্রেটারী’ ছিলেন। ‘সেক্রেটারী অব ওয়ার’ এর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় তিনি প্রায় সাড়ে ছয় লাখ দাস এর স্বাধীনতা প্রদানের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তার এই ভূমিকার কারণে বৃটেনে দাস ব্যবসা বন্ধ হতে অতিরিক্ত আরো ১৫ বছর সময় লাগে। তিনি সে সময় দাসদের বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছিলেন মহা অত্যাচারী এক ব্যক্তি।
দাবী উঠে বৃটেনের এককালের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিল এর ভাস্কর্য অপসারনেরও। টরন্টো-সহ কানাডার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে চার্চিলের ভাস্কর্য। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ এর একজন সদস্য টিএনসি নিউজকে বলেন, বৃটিশ সাম্রাজ্য ধর্ষণ, গণহত্যা, শ্বেত আধিপত্যবাদ এবং দাস ব্যবসা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বর্ণবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে কানাডায় আরো যাদের ভাস্কর্য অপসারণের দাবী উঠেছে তাদের মধ্যে আছেন ক্যাপ্টেন জর্জ ভেঙ্গুভার, স্যামুয়েল ডি চ্যাপলেইন, জেমস ম্যাকগিল ও কুইন ইসাবেলা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুগ যুগ ধরে প্রায় দেবত্বের আসনে বসিয়ে এই বর্ণবাদী, দাস ব্যবসায়ী আর গণহত্যা পরিচালনাকারীদের জন্মদিন- মৃত্যুদিন পালন করা হয়ে আসছে। এদেরকে ‘জাতীয় বীর’ বা ‘মহানায়ক’ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় স্থান দেয়া হয়েছে, এদের ‘অবদান’-কে মূর্ত্যমান করার জন্য মূর্তি বা ভাষ্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে!
এই ‘মহানায়ক’রা তাদের ‘স্বর্ণযুগে’ মানুষের পায়ে বেড়ি পরিয়েছিলেন, মানুষকে পণ্য বানিয়েছিলেন, দাস বানিয়ে বিক্রি করেছিলেন, মহিলা দাসদের ধর্ষণ করেছিলেন, মানুষের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি এমন কি দেশ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিলেন, দখলের জন্য প্রয়োজনে গণহত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছেন। মানুষের বর্ণের জন্য তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন, তাদেরকে ঘৃণা করেছেন।
কমলা হ্যারিসও শিকার হয়েছিলেন বর্ণবাদের। তার বাবা মা দুজনেই ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ছিলেন। ছিলেন অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। এরকম হাই প্রোফাইল বাবা মা’র ঘরে জন্ম নেয়ায় জীবনে আর্থিক টানাপোড়েন তেমন না দেখলেও কৃষ্ণাঙ্গ বলে সমাজের বহু বৈপরীত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন তিনি। কৃষ্ণাঙ্গ বলে প্রতিবেশীদের কাছে থেকে পেয়েছেন দূরত্ব আর অবহেলা। তিনি নিজেই জানান, তার কর্মজীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বর্ণগত বৈষম্যের মোকবিলা।
নির্বাচনের আগে কমলার বর্ণপরিচয় নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল ট্রাম্প সমর্থকেরা। যেমন রেডিও হোস্ট মার্ক লেভিন বলেছিলেন, কমলা মোটেই আফ্রিকান-আমেরিকান নন, তিনি একদিকে ভারতীয় ও অন্যদিকে জ্যামাইকান। ট্রাম্পের আরেক সমর্থক কট্টর বর্ণবাদী দিনেশ ডি সুজা বলেছেন, কমলার মা-বাবা কেউ দাস বা দাস বংশোদ্ভূত নয়। ফলে তাঁকে কৃষ্ণাঙ্গ বলা যায় না। তবে কমলা নিজে বলেছেন, ‘আমি একজন কালো মানুষ, এটাই শেষ কথা। আমার জন্ম কালো মানুষ হিসেবে, আমার মৃত্যুও হবে কালো মানুষ হিসেবে। যারা আমার জন্ম-পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তারা আসলে বিভক্তি ও বিদ্বেষ ছড়াতে চায়।
সেই কমলা হ্যারিস আজ যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এমনটা মনে করার কারণ নেই যে, কমলা নির্বাচিত হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বর্ণবাদ এখনই দূর হয়ে যাবে। এই বর্ণবাদের শিকড় দেশটির এত গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে যে তা নির্মূল হতে হয়তো আরো বহু যুগ লেগে যাবে। আর শতভাগ নির্মূল হবে সে কথা বলার অবকাশও নেই। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা কেন, এই বর্ণবাদ ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর সব দেশে, সব সমাজেই। ভারতে কথাই বলা যাক। সেখানে বর্ণপ্রথা আরো ভয়াবহরকমে বিরাজ করছে।
মানুষ আসলে বর্ণবাদী হয়ে জন্মায় না। জন্মের পর মানব শিশুর মনের মধ্যে বর্ণবাদের বিষবৃক্ষ রোপন করেন তার পিতা-মাতা, অভিভাবক, আত্মীয়-পরিজন এবং সমাজ। পরবর্তীতে সেই বৃষবৃক্ষ বিশাল আকার ধারণ করে অনেকের মধ্যেই, যেমনটা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে।
একমাত্র শিক্ষাই পারে এই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানুষের মনে আলো ছড়াতে। সেই শিক্ষা মানুষকে মানবিক হওয়ার সুশিক্ষা। অন্যকে সম্মান জানানোর সুশিক্ষা।
লক্ষ্যনীয় যে, অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি যে বর্বর আচরণ করা হয়েছে, তাদেরকে যে ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে তা থেকে আজকের পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নত একথা স্বীকার করতেই হবে। তবে তা একদিনে হয়নি। কয়েক শতাব্দী লেগে গেছে। এবং সেটা সম্ভব হয়েছে ক্রমাগত আন্দোলন আর দাবী পেশের মাধ্যমে। আর সেই সাথে সুশিক্ষা প্রদান। সুশিক্ষার কারণে অতিতের তুলনায় আজকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বর্ণবাদ অনেকগুনে হ্রাস পেয়েছে। আগামীতে আরো হ্রাস পাবে এমনটা আশা করা-ই যেতে পারে। সেদিন জর্জ ফ্লয়েডের মতো কাউকে আর এমন নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে হবে না। কৃষ্ণাঙ্গসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে চরম বৈষম্যের শিকার হতে হবে না। আমরা নেতৃত্বে বারাক ওবামা, কমলা হ্যারিসের মতো আরো কৃষ্ণাঙ্গ বা সংখ্যালঘু অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে দেখতে পাবো। দেখতে পাবো সমাজ থেকে দূর হয়েছে বর্ণবাদ ও বৈষম্য এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাম্য।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ