কোভিড -১৯, বাচ্চাদের স্কুল আর উদ্বিগ্ন অভিভাবক

আগস্ট ১৮, ২০২০

শিরীন আহমেদ

কোভিড -১৯ পৃথিবীকে এক কঠিন সত্যের মুখে ফেলে দিয়েছে। কেমন যেন সবকিছুর একটা ছন্দপতন ঘটেছে। মানুষ না চাইলেও অনেক কিছু করতে হচ্ছে , আবার চাইলেও অনেক কিছু করতে পারছে না । এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি সবাই । সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে আছে। এর ভিতর কানাডার কথা বলি।
এখন আগস্ট মাসের মাঝামাঝি , তার মানে সেপ্টেম্বর আসতে চলেছে। আর সেপ্টেম্বর মানে কানাডিয়ানদের নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু । গতবছরের ঠিক এই সময়টিতে তাকালে দেখা যাবে অভিভাবকবৃন্দ বাচ্চাদের নতুন শিক্ষাবর্ষ উপলক্ষে কেনাকাটা নিয়ে ব্যাস্ত ছিলেন। ছোট থেকে বড় সবার মধ্যে কেমন যেন একটা ঈদ ঈদ আনন্দ থাকে। কেনাকাটার ধুম পড়ে যায় । এমনও অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চার জন্য কিছু কেনাকাটার দরকার নেই তবুও , কিনতে হয়। মার্ক্সের ভাষায় বলা যায় “ফলস নিড” তৈরী হয়। কারণ পুঁজিবাদী পণ্য গুলো তাক করে থাকে।
অনেক বাবা মা বিশ্বাস করেন বাচ্চার জন্য নতুন বছর উপলক্ষে কিছু কিনবেন না এ বছর । কারণ দু’মাস আগে তিনি অনেক কিছু কিনে ফেলেছেন । কিন্তু কি আর করা , শেষ মেস এরকম সময় কিছু না কিছু একটা কিনতেই হয় । কারণ স্কুল খুললে সবাই যখন ব্র্যান্ড নিউ জিনিস দেখাবে একজন আরেক জনকে তখন তার বাচ্চাটা কিছু না দেখাতে পারলে বাবা মায়ের মান যায় । যাইহোক , একরকম অদৃশ্য শক্তির কাছে পিতামাতা পরাজিত হয়ে যায় ।
অনেকে আছেন আবার বাহারি বিজ্ঞাপনের বলি হয়, না বুঝে । ক্রেডিট কার্ড সোসাইটি। নতুন শিক্ষাবর্ষ উপলক্ষে এতো এতো ছাড় চলে যে, কিনতেই থাকে, কিনতেই থাকে। শেষ মেশ ক্রেডিট কার্ড জিরোতে গিয়ে ঠেকে। এরকমই চিত্র চলে এইসময়টাতে। তারপরও মোটামুটি ভাবে একটা খুশির চিত্র এটি।
কিন্তু এবছর কি সেরকমটা চলছে না কি অন্যরকম? অভিভাবকবৃন্দ কেমন যেন একটা অনিশ্চয়তা আর উদ্বিগ্ন পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে । এতো দিন তো বাচ্চাকে আগলে রেখেছে। স্কুল খুললে কি করবে ? পারবে কি তার বাচ্চাকে নিরাপত্তা দিতে? যদি তার বচ্চা অসুস্থ হয়ে যায় স্কুল কর্তৃপক্ষ কি করবে? সরকারের লোকজনই বা কি করবে? এরকম হাজার প্রশ্ন জমা হচ্ছে তাদের ভিতর। সন্তানদের স্কুল যাওয়া নিয়ে তারা কি ভাবছেন এরকম কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়ে ছিল আমার।
কিছুদিন আগে টুসি রায় নামে (ছদ্দনাম ) একজন মায়ের সাথে কথা হচ্ছিলো যার বাচ্চা এ বছর জুনিয়র কিন্ডারগার্টেন এ যাবে। কিন্তু সে বাচ্চাকে স্কুল এ দিতে চায় , কারণ তার বাচ্চাটা গতবছর থেকে স্কুল এ যেতে চায়। সে তার মায়ের সাথে প্রতিদিন গ্রেড – থ্রীতে পড়ুয়া ভাইকে স্কুল এ ড্রপ অফ এবং পিক আপ করতে যেত । ছোট মেয়েটিকে মা বলে এসেছে নেক্সট ইয়ার সে ভাইয়ার এই স্কুলে যেতে পারবে। এখন সেই বছর , কিন্তু ৪ বছর বয়সের একটি বাচ্চাকে কোভিড -১৯ ,ভাইরাস কি সেটাই তো ভালো করে বোঝানো যায় না । আর এতো এতো নিয়মকানুন আদৌ সে কি মানতে পারবে?
আরিফ জামান নামে (ছদ্দনাম ) আরেকজন বাবার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো , তার ছেলে গ্রেড – সিক্স এ পড়ে। তবুও ছেলেকে স্কুল এ দিতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ স্কুল যাওয়ার পরে যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তখন তো জীবন থেমে যাবে। এই চিন্তা করে উনি বাচ্চাকে স্কুল দিবেন না । এদিকে এতদিন বাদে স্কুল খুলবে। তাই বাচ্চা স্কুলএ যাওয়ার জন্য অনেক এক্সসাইটেড ।

বিশেষজ্ঞদের মতে আবার সেকেন্ড ওয়েভ আসবে। বাচ্চাগুলো এক্সপোসড হলে প্রতিটি পরিবার এক্সপোসড হবে। – ছবি : সাটারস্টক/হাফপয়েন্ট

নিসা বিনোদ নামে (ছদ্দনাম ) আরেকজন মায়ের সাথে কথা হচ্ছিলো , উনার বাচ্চা হাই স্কুল এ পড়ে । টিটিসি (পাবলিক ট্রানজিট ) ব্যবহার করে স্কুলএ যায়। সাবওয়ে বাস পাবলিক ট্রান্সপোর্ট গুলো তে যাওয়া তো সেফ হবে না। তাই উনিও ভাবতে পারছেন না কি করবেন। বললেন , এবছর বাচ্চাকে স্কুলএ দিবেন না।
নিউজ এ দেখলাম একজন মা টিডিএসবি স্কুল শিক্ষক , তার নিজের বাচ্চাকে তিনি স্কুল এ দিচ্ছেন না। কিন্তু তিনি কাজে ব্যাক করছেন। চাকরিটা তো টিকিয়ে রাখতে হবে।
অবিভাবক বৃন্দ , সবাই উদ্বিগ্ন। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন কেন সরকার এধরণের ঝুঁকি নিচ্ছেন ? সরকারের লোক বলছেন , ফান্ড কম, ক্লাস সাইজও ছোট করা সম্ভব না। অনেকে ভাবছেন , সরকার জেনেশুনে কি তাদের এক কঠিন বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন? বিশেষজ্ঞদের মতে আবার সেকেন্ড ওয়েভ আসবে। বাচ্চাগুলো এক্সপোসড হলে প্রতিটি পরিবার এক্সপোসড হবে। একটি পরিবার এক্সপোসড হলে সেই পরিবারের ছোট থেকে বড় সব সদস্যই এক্সপোসড হবে। তখন তো সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। এমনিতেই তখন স্বাভাবিক জীবন থেমে যাবে। সরকারের কি তাহলে উচিত হচ্ছে তার নাগরিকদের এরকম একটি বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া?
আমার নিজের দুটি বাচ্চা। একজন এবছর গ্রেড-টুতে তে যাবে, আরেকজন জুনিয়র কিন্ডারগার্টেন এ । আমিও উদ্বিগ্ন। কারণ অন্য সব পিতামাতার মতো আমিও আমার বাচ্চাকে খুব ভালোবাসি। আমি চাই আমার বচ্চা সুস্থ থাকুক , ভালো থাকুক। স্কুল এ গিয়ে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন কি হবে । এই টেনশন এ সদ্য গ্রাজুয়েট হওয়া সত্ত্বেও কাজে ফেরার চিন্তা না করে বাচ্চাকে হোম স্কুলিং করার চিন্তা পাকা করে ফেলেছি। কি করবো , সন্তানের সুস্থতা আমার কাছে একমাত্র চাওয়া। আমি ফোর্ড সরকারের কাছে প্রশ্ন করতে চাই , আজ আমার বাচ্চা যদি স্কুল এ গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে, সরকার তখন কি করবে? আমি মা , আমি জানি আমার সন্তানের সুস্থ থাকাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ।তাই আমি আমার অন্য সব কাজ পাশ কাটিয়ে বাচ্চাদেরকে হোম স্কুলিং করার এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
অনলাইন ফ্লায়ার এ দেখতে পাচ্ছি নানাধরণের পণ্যের সমাহার। একাডেমিক বর্ষ শুরু হচ্ছে , কেনাকাটার মিছিলে কেউ সামিল হউক বা না হউক, বিপনী বিতান গুলো ঠিকই প্রলোভন দেখিয়ে চলেছে । “ফলস নিড” তৈরির নেশায় ব্যস্ত তারা। সত্যি , এবার “ফলস নিড” তৈরী হচ্ছে না । বাচ্চাকে আমরা নিরাপদে স্কুলএ দিতে পারছি না! কি দরকার এখন এইসব আজগুবি আড়ম্বরের ?
শিরীন আহমেদ
টরন্টো