কানাডার সামার, করোনার দিনগুলো এবং কিছু শোকগাঁথা
জসিম মল্লিক
১
কানাডাতে এখন পুরাদমে সামার। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। মন ভাল করা নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি। প্রলম্বিত শীতের পরে আসে সামার। কাঙ্খিত সামার। সবার একটাই লক্ষ্য থাকে বেড়ানো। দূরে দূরে চলে যায় কানাডাবসী। বড় বড় ইভেন্ট হয়। বিয়ে, পিকনিক, নানা অনুষ্ঠান, খেলাধূলা, বইমেলা। কটেজে বেড়ানো। ছুটিতে ব্যাকহোমে চলে যাওয়া। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি সম্পূর্ন আলাদা। এ বছর সেসব কিছুই হয়নি। অন্টারিও প্রভিন্স যদিও স্টেজ থ্রীতে পদার্পন করেছে তারপর অনেক রেস্ট্রিকশন আছে। সোশ্যাল ডিসটান্সিং মেইনটেইন করতে হচ্ছে। জীবন বদলে গেছে পুরোপুরি। মানুষের অভ্যাস ও জীবন যাত্রা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। এখন পুরো বিশ্ববাসী অপেক্ষা করছে কবে একটি কাঙ্খিত ভ্যাকসিন আসবে। বলা হচ্ছে এ বছরের শেষ নাগাদ ভ্যাকসিন এসে যাবে। সেই অপেক্ষায় সবাই।
এ লেখা যখন প্রকাশিত হবে তখন সামার শেষ প্রায়। একটু একটু শীতের আবাহন শুরু হয়ে যাবে। হিমেল পরশ বইতে শুরু করবে। জ্যাকেটের দোকানে ভিড় বাড়বে। স্কুল খোলার প্রক্রিয়া চললেও অভিভাবকরা দ্বিধা দ্বন্দে আছেন তার সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন কিনা। অনেকেই অনলাইন ক্লাস করবেন। সত্যি এটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত। তবুও জীবন থেমে থাকে না। জীবন এগিয়ে যায় জীবনের নিয়মে। একদিন আবার সব স্বাভাবিক হবে সেই প্রত্যাশায় সবাই। নতুন এক পৃথিবী কেমন হবে সেটা দেখার অপেক্ষায়। কিন্তু ইতিমধ্যে আমরা অনেক আপনজন হারিয়েছি। অনেক চেনা মানুষের সাথে আর দেখা হবে না। লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী হারিয়েছি। কোভিড কেড়ে নিয়েছে অনেক বন্ধু পরিচিতজনকে। সবার জন্য আমার শোক।
অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাইছেন। ঘরোয়া অনুষ্ঠানাদি করছেন, বিয়ে শাদিও হচ্ছে। দীর্ঘ বন্দী জীবনে মানুষ ক্লান্ত হয়ে গেছে। অর্থনীতি সচল হচ্ছে। মানুষ কাজে ফিরছে। এয়ারলাইন্সগুলো চালু হচ্ছে ক্রমশঃ। যারা বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়েছিলেন তারা ফিরছেন, অনেকেই অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করে ফিরে এসেছেন। আশার কথা কানাডায় কোভিড নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। সরকারের প্রচেষ্টায় সবকিছু আবার সুন্দর স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। পর্কে, রাস্তা ঘাটে শপিং মলে ভীড় বাড়ছে। যদিও করোনা তার থাবা এখনও বিস্তার কওে চলেছে পৃথিবীজুড়ে। আমাদের এখনও সাবধাণতা অবলম্বন করতে হবে। দ্বিতী ওয়েভ যাতে হানা না দিতে পাওে সেই দিকে সবার নজর রাখতে হবে। সচেতন হতে হবে নাগরিকদের। সরকারের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে হবে।
যদিও আমি নিজে প্রায় দুই মাস থেকে ঘরবন্দী। আমার কোনো সামার নাই এবার। এই বন্দীত্ব কোভিডের জন্য না। কোভিড অধ্যায় কাটিয়ে উঠছে কানাডা। অন্টারিও প্রভিন্স স্টেজ থ্রি তে গ্রাজুয়েট করেছে আগেই উল্লেখ করেছি। মানুষ কাজে কর্মে ফিরছে। বাইরে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামার এনজয় করছে, ফিশিং করছে, কটেজে যাচ্ছে, বিচে যাচ্ছে, থিয়েটার খুলেছে, নায়াগ্রার উদ্দাম ফেনিল জলপ্রপাত দেখতে যাচ্ছে। আমিও কাজে ফিরেছিলাম কিন্তু আকস্মিক আবার ঘরবন্দী হয়ে পড়েছি। প্রতিটা দিন কষ্টকর এক অভিজ্ঞতা আমার। জেসমিন কাজে চলে গেলে আমি একলা ঘরে থাকি। নিঃসঙ্গতা আমাকে ঘিরে ধরে। একাকীত্বকে অনুভব করি। যেনো কবরের নিরবতা চারিদিকে। কখনো বিছানায় শুয়ে থাকি, কখনো কাউচে মাথার নিচে বালিশ দিয়ে বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনো একটু টিভির খবর দেখি। কখনো জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের সৌন্দর্য্য দেখি। সবুজ পত্র পল্লব চারিদিকে, পাখির কিচির শব্দ। প্রকৃতি অপরূপ সাজে সেজেছে। শিশুরা খেলা করে, উল্লাস কওে সেসব দেখি। জেসমিনের কাছে আমিও এক শিশু যেনো। এভাবে দিন যায়, রাত আসে।
কখনো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। কত মানুষ বাইরে যাচ্ছে, ঘরে ফিরছে। একটার পর একটা গাড়ি আসছে যাচ্ছে। শুধু আমার কোথাও যাওয়া নাই। বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। হঠাৎ হঠাৎ মাথা টলে যায়। সবকিছু ঘুরতে থাকে, অন্ধকার দেখি। কম্পিউটার , ফোন, টিভি কিছুই ভাল লাগে না। এই লেখাও লিখেছি অনেক কষ্ট করে। পড়তে পারি না। মাথা বন বন করে। কয়েকদিন ধরে রাতে ঘুম হয় না ঠিক মতো। এমন কখনো ছিল না। নির্ঘুম রাত অনেক কষ্টের। প্রকৃতি ঘুমিয়ে থাকে, সুন সান নিরবতা-তারমধ্যে আমি বিছানায় ছটফট করি। ভার্টিগোর মতোই কষ্টের না ঘুমানো। খাওয়ায় রুচি হয় না।
সবাই বলে ভাল হয়ে যাব, মনে জোর রাখতে।
ডাক্তার মজা করে বলেছে, এটা লাইফ এন্ড ডেথ প্রবলেম না।
রিটন ভাই আমার উদ্দেশে লিখেছেন, সাহসী মানুষ পরাজিত হয় না।
আমি আসলে অনেক দুর্বল। অসুখে মনের জোর হারিয়ে ফেলি। ওষুধ খাই, নামাজ পড়ি। হোয়াটসএপে ছেলে মেয়ে, আত্মীয়, দু’একজন ঘনিষ্ট বন্ধুর সাথে চ্যাট করি।
দোয়া পড়ি.. ’আল্লাহুম্মা আ’ইন্নি ‘আলা যিক্রিকা ওয়া শুক্রিকা ওয়া হুস্নি ’ইবাদাতিক’..।
টরন্টোর প্রিয় মুখ রুমানা চৌধুরীর জন্য শোক আমার। জানিনা এ কেমন চলে যাওয়া! রুমানা চৌধুরী আমাদের টরন্টো শহরের একজন অতি পরিচিত মানুষ। সবার প্রিয়জন। তিনি একজন সক্রিয় লেখক। বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষাতেই লেখেন, কাব্য চর্চা করেন। তার সাথে যখনই দেখা হয় অমায়িক হেসে কুশল জানতে চান। লেখালেখি নিয়ে কথা হয়। তার কন্যা ফারিয়া চৌধুরীকে দু’একটি অনুষ্ঠানে দেখেছি। প্রানবন্ত, হাসিখুশী একটি মেয়ে। এই প্রজন্মের হয়েও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি তার একটা টান ছিল। হঠাৎ ৮ জুলাই শুনি সে চলে গেছে পরলোকে! অবিশ্বাস্য! হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়ার মতো খবর। এইভাবে কেউ চলে যায়! কোনো মানে আছে! মা বাবা কেমন করে এই শোক সইবেন! সন্তানের লাশ মা বাবার কাছে যে কত ভারি! জানি সান্ত্বনা দেবার কোনো ভাষা নাই। শুধু বলব আল্লাহ আপনি এই পরিবারটিকে শোক সইবার ক্ষমতা দিন। মনীদ্র রায়ের কবিতার ভাষায় বলতে হয়,
”যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে/
দু’হাতের উল্টো পিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়।”
২
১ জুলাই এলেই স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে কানাডা আসার দিন। ২৮ জুন, ২০০৩। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ভোরের দিকে নেমেছিলাম টরন্টো পীয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। মনে আছে হিথরোতে ফ্লাইট ডিলে হয়েছিল কয়েক ঘন্টা। আমাদের নিতে এসেছিল অটোয়া থেকে আঙুর ভাই আর পীকারিং নামক এক জায়গা থেকে জিয়া ভাই। ফ্লাইট ডিলের কারনে তারা আবার ফিরে গিয়েছিলেন। আবার যথাসময়ে এসেছেন।
আমরা যখন এক সুন্দর ভোরে টরন্টো নামলাম তখন সবাই ক্লান্ত বিধ্বস্ত। ছোট্ট অরিত্রি ঘুমে ঢুলু ঢুলু। অর্ক নির্বিকার। ওর কাছে কানাডাও যা ঢাকাও তাই। যেনো কিছুই ঘটছে না জীবনে। টরন্টো থেকে দুটি গাড়িতে রওয়ানা হলাম অটোয়া। আরো চার ঘন্টার ড্রাইভ। তারপর দুইদিন ঘুমিয়েই কাটলো আঙুর ভাইর বেশোরের বাসায়। ১ জুলাই কানাডা ডে। জেসমিন আর আমি ঘুম ঘুম চোখে গেলাম ফায়ার ওয়ার্কস দেখতে। তাই এই দিনটি বিশেষভাবে স্মরনীয় আমাদের কাছে।
হজ্জের স্মৃতি
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়ালমুল্ক্, লা শারিকা লাকা।’.. ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার।’ হজ্জের সময় এই ধ্বনিতে মুখরিত হয় আরাফাতের ময়দান। অদ্ভুত এক ভাললাগায় শিহরিত হয় মন প্রাণ।
গত বছর ফেব্রুয়ারী মাস। আমি তখন ঢাকায়। জেসমিন একদিন ফোন দিয়ে বলল, এ বছর হজ্জে যেতে চাই, তুমি কি বলো!
আমি এক সেকেন্ড ভেবে বললাম, যাবা!
জেসমিন বলল, হ্যাঁ। তুমি তো আগেও বলেছিলা যেতে চাও।
আমি তৎক্ষনাৎ বললাম ওকে। কিভাবে যাবা! আমি তো ঢাকায়।
জেসমিন বলল, সমস্যা নাই, ভাল এজেন্সির খোঁজ পেয়েছি। এখনও সময় আছে রেজিষ্ট্রেশন করার। আল ফালাহ। ২৮ বছরের অভিজ্ঞতা তাদের।
আমি বললাম, যোগাযোগ করো।
তারপর সবকিছু সুন্দরভাবেই হতে লাগল। ছয় মাসের প্রস্তুতি শুরু হলো। মানসিক এবং অন্যান্য। আমরা তিন সপ্তাহের প্যাকেজের জন্য এপ্লাই করলাম। জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা, শ্রেষ্ঠ অর্জন হজ্জ পালন। অসাধারণ এক কর্মযজ্ঞ ছিল পবিত্র মক্কা এবং মদিনার দিনগুলো। ওখানে না গেলে কখনো এই অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব না। এখনও যখন কোনো কিছু নিয়ে আপসেট বা অসুস্থ্য হই তখন হজ্জের দিনগুলোর কথা মনে করে এক ধরনের প্রাশান্তি অনুভব করি, সাহস ও শান্তি পাই। মৃত্যুকে তুচ্ছ মনে হয়। সবাইকে ক্ষমা করে দেই। লোভ, ঘৃণা, খেদ, হতাশা দূর হয়ে যায়। এ বছর কোভিড১৯ এর জন্য বিদেশীরা হজ্জ করতে পারছেন না, এটা ভেবেও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয় যে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম।
গত বছর ঠিক এই দিনে টরন্টো থেকে কায়রো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে উঠেছিলাম। আজ ২৮ জুলাই এক বছর পূর্ণ হলো।
ভালবাসা ব্যাপারটা সর্বত্র্যই ছড়ানো ছিটানো থাকে। করোনা এবং অসুস্থ্যতার দিনগুলোতে যেনো সেটা আরো বেশি করে অনুভব করি আমি। পৃথিবী জুড়েই ভালবাসার জয়গান। পৃথিবীতে যত কবিতা রচিত হয়েছে, যত উপন্যাস, যত গল্প লেখা হয়েছে, যত নাটক, সিনেমা বানানো হয়েছে সবকিছুতেই ভালবাসার কথা বিধৃত হয়েছে। প্রকৃতিতে রয়েছে ভালবাসার আবাহন, পশুপাখির মধ্যে রয়েছে ভালবাসা। নদী, সমুদ্র আর পাহাড়ের ডাকে রয়েছে ভালবাসার সম্মোহনী। মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা চিরায়ত। অম্লান। ভালবাসা দিয়ে যে কাউকে, যে কোনো কিছুকে জয় করা সম্ভব। যুদ্ধ জয় করা যায়, হিংসা, বিদ্বেষকে জয় করা যায়। আমি সবসময় ভালবাসার গল্প বলি, ভালবাসার সিম্ফনী নিয়ে লিখি। দুঃখ- কষ্ট, রোগ-শোক-জ্বরা সবকিছুতে ভালবাসা হতে পারে অনুপ্রেরণার। একটি ভালবাসাময় শব্দ অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। রোগ শয্যা, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে প্রশান্তির। পৃথিবীতে ঘৃণার কোনো স্থান নেই। ঘৃণা দিয়ে কিছুই জয় করা যায় না। ঘৃণা শুধু ঘৃণাকে বাড়তে সাহায্য করে। তাই আসুন ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে থাকি। “When we love someone we experience the same positive thoughts and experiences as when we like a person. But we also experience a deep sense of care and commitment towards that person.”- Gery Karantzas।
৩
অনেকদিন পর ১৮ জুলাই বিকেলে বের হয়েছিলাম। এর আগেও ডাক্তারের পরামর্শে পর পর দু’দিন অল্প বিস্তর ড্রাইভ করেছি, হেঁটেছি। গ্রোসারি করতে গিয়েছি। আমি গাড়িতে বসে থাকি জেসমিন বাজার করে। কোভিডের কালেও এমনটা ঘটেছে নিয়মিত। জেসমিন আমাকে আগলে রেখে নিজেই সব করেছে। যেনো আমি একটা শিশু। বাইরে গিয়েছে দরকারে, নিজের চাকরিতো আছেই। তারপর ৪ জুলাই থেকে হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে পড়ায় পুরোটা সময় ঘরবন্দী হয়ে পড়েছিলাম। ভার্টিগো ব্যাপারটা আমাকে এতোটাই ভুগিয়েছে যে আমাকে জেসমিনের খাইয়ে পর্যন্ত দিতে হয়েছে।
মাঝে কয়েকবার হাসপাতাল আর ডাক্তার অফিসে গিয়েছি। একটানা প্রায় দেড়মাস এভাবে কেটেছে। এই সময়টায় তেমন কারো সাথে যোগাযোগ হয়নি। কয়েকদিন ফেসবুক ডিএক্টিভেট করেছিলাম। রিটন ভাই, মনসুর ভাই আর সিনা ছাড়া কোরো সাথে ফোনের যোগাযোগ ছিল না। তারা নিয়মিত আমার কুশল জানতে চেয়েছে। আমাকে উদ্দীপ্ত রেখেছে। ফেসবুকে দু’একজন ঘনিষ্ট বন্ধু ও আত্মীয় নিয়মতই খোঁজ খবর নিয়েছে। কখনো ফোনও করেছে। অসংখ্য বন্ধুরা দোয়া করেছে আমার জন্য। সেসব আমার অসুস্থ্যতার দিনগুলোতে যথেষ্ট সাহস আর আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছে। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহ অনেক বড়।
অসুখের দিনগুলোতে জেসমিন কাজে চলে গেলে আমার সময় কাটতেই চাইত না। সময় যেনো অনন্ত পাথরের মতো স্থির হয়ে থাকে। সারাদিনের আহা উহু জমা করে রাখি। জেসমিন ঘরে ফিরলে সে সব ডেলিভারি দেই। সব স্ট্রেস জেসমিনকে দেই। জেসমিনের সুন্দর মুখখানা কালো লাগে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। রান্না বান্না, কাপড় ধোয়া, ঘরদোর পরিস্কারের মধ্যেও আমার প্রতি খেয়াল থাকে ঈগলের চোখের মতো। ছেলে মেয়েদের সাথে বেশি একটা আহা উহু করি না। নিজের কষ্টকে ওদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই না। ওরা কোনো স্ট্রেস নিক তা চাই না। তাও জানি ওরা টেনশন করে। বুঝতে দেয় না আমাকে। অর্ক অরিত্রি প্রতিদিন তাদের মায়ের কাছে ফোন করে জানতে চায় বাবা আজকে কেমন আছে।
এখন অনেকটাই ভাল ফীল করছি। ডাক্তার বলেছে আস্তে আস্তে ভাল হবা। প্রতিদিন দুই তিন পার্সেণ্ট করে। ব্যাপার না। একদিন সুস্থ্যভাবে বাঁচাও বিধাতার বড় আশীর্বাদ। কাল বেশ অনেকটা পথ ড্রাইভ করলাম। ডাক্তার বলেছে ড্রাইভ করতে। বেশ ভালভাবেই ড্রাইভ করে সোহেলের মর্নিংসাইডের বাসায় গিয়েছিলাম। অনেকটা সময় সেখানে কাটালাম। শামীম মামা, নাদের মামু সবাই এসেছিল। নাদের মামুর সাথে দুই তিন কিলোমটিার হেঁটেছিও।
মনে করেছিলাম রাতে ড্রাইভ করতে সমস্যা হবে কিন্তু বেশ ভালভাবেই বাসায় ফিরেছি। জেসমিনকে ঘাবড়ে দেবার জন্য একবার বলি, জেসমিন খেয়াল রাইখো ঠিকমতো ড্রাইভং হচ্ছে কিনা!
জেসমিন আঁতকে ওঠে বলে, মানে কি! তোমার খারাপ লাগছে নাতো!
মাথাটা ভন ভন একটু করছে।
তাহলে আসলে কেনো! চলো ফিরে যাই।
আরে না। সমস্যা নাই। ড্রাইভিং ঠিক আছে! কোনো অস্বাভাবিকতা নাইতো!
সেটা তুমি ভালো বোঝো কেমন লাগছে।
না মানে তুমি তো সবসময় আমার ড্রাইভিংয়ের ভুল ধরো তাই।
হইছে। তাড়াহুড়োর দরকার নাই। আস্তে আস্তে চালাও। ওভারস্পীড করবা না।
আমি আস্বস্ত করে বলি, আইএম ওকে।
আসার সময় পথেই মিডল্যান্ড আর লরেন্সে অর্ক’র বাসার নিচে থামলাম। অর্ক নেমে এলো। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। জেসমিন অর্ক আর খাতিজার জন্য নানা পদের ফল নিয়ে এসেছিল। মায়েদের মন এমনই। সেসব দেওয়ার জন্যই অর্ক’র বাসার নিচে থামা। আমাকে ড্রাইভং সীটে দেখে অর্ক’র মুখটা উজ্জল হয়ে উঠল।
হাই বাবা, হাউ ইজ ড্রাইভং!
ভাল। কোনো সমস্যা ফীল করছি না।
হ্যাঁ একটু একটু বের হও। বেশি আবার ড্রাইভ করো না।
না। আজকেই একটু বের হলাম।
অর্ক বলল, কাল সন্ধ্যায় আসব তোমাদের বাসায়। উইকেন্ডে ব্যাস্ত থাকব। তাই আসতে পারে না।
জেসমিন বলল, আমার তো কালকে কাজ তোমাদের জন্য কিছু তো রান্নাও করতে পারব না।
অর্ক বলল, কিছু করতে হবে না তোমাকে। আমরা খাবার রান্না করে নিয়ে আসবনে।
জেসমিন বলল, তাহলে শুক্রবার বা সোমবার আসো। শুক্রবার অরিত্রিরও আসার কথা আছে।
অর্ক বলল, না কালকেই আসব। খাতিজা বাবার সাথে দেখা করবে তাই।
আমি বললাম, সমস্যা নাই আসো কালকে। এই বলে আমরা বাসায় চলে আসি।
তার আগে মর্নিংসাইড যাওয়ার সময়ই পথে অরিত্রির ফোন। তখন মাত্র অরিত্রির অফিস শেষ হয়েছে। অরিত্রি, সাদ এবং অর্ক তিনজনই এখনও হোম অফিস করছে। খাতিজাকে অফিসে যেতে হয়।
অরিত্রি সম্প্রতি ম্যাকডোনালস কানাডার কর্পোরেট অফিসে কমিনিউকেশন স্পেশালিষ্ট হিসাবে জয়েন করেছে। তাই একটু বেশি ব্যস্ত।
তোমরা কোথায়!
জেসমিন বলল, এই তো তোমার বাবা ড্রাইভ করছে। সোহেল আংকেলের বাসায় যাচ্ছি একটু।
ডাক্তার কি বাবাকে বলেছে ড্রাইভ করতে! বাবা কেনো ড্রাইভ করছে! অরিত্রি খুব উদ্বিংগ্ন।
সমস্যা হচ্ছে না তোমার বাবার। একটু বের হওয়ার দরকার আছে এখন। ডাক্তার বলেছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। ড্রাইভ করতেও বলেছে।
অরিত্রি গম্ভীরভাবে বলল, ওকে।
অর্ক যতখানি সফট, অরিত্রি ততটা না। কড়া শাসনে রাখে আমাদের। আমাদের খাবার দাবার, পোশাক আশাকের ব্যাপারেও অরিত্রি কনসার্ন। কখন ডিনার খেতে হবে, কখন লাঞ্চ, কখন বেডে যেতে হবে তাও। ইদানীং সেটা আরো বেড়েছে।
বাবা অনেক অনিয়ম করে। রাত জাগে। বাবার ডায়াবেটিস।
আমরা অরিত্রিকে যথেষ্ট কেয়ার করি। এমনকি অর্কও। অরিত্রি সিরিয়াস টাইপ মেয়ে।
অরিত্রি বলল, শুক্রবার তোমাদের বাসায় আসব।
জেসমিন বলল, আসো।
আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গেই একটা আনন্দের সংবাদ পেলাম ঢাকা থেকে। বাংলা একাডেমি আমাকে জীবন সদস্য পদ দিয়েছে। তাই আজ মন ভাল।
এইভাবে দিন যায় দিন আসে..।
৪
প্রথম আলো অফিস থেকে মাসুক হেলালকে পিক করে আমি আর রিটন ভাই চলে গেলাম মিরপুরে মাসুক হেলালের বাসায়। সরাসরি তার স্টুডিয়োতে নিয়ে গেলেন। একটু অগোছালো ঘরদোর। ছড়ানো ছিটানো বই পত্র। কেউতো নাই গুছিয়ে রাখার! নিজের একমাত্র আদরের কন্যা, একটি বিড়াল আর ছবি আঁকার ঘর এই নিয়ে তার সংসার। মাসুক হেলাল একজন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী। পোট্রেট আঁকায় যার কোনো জুড়ি নেই। অলকেশ ঘোষ আর শেখ আফজালের পরই মাসুক হেলাল। আমি ছবির কিছুই বুঝি না তবুও আমার তাই মনে হয়। মাসুক হেলাল নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অলকেশ ঘোষ এবং মাসুক হেলালকে আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি। শেখ আফজালের স্টুডিওতেও আমি কয়েকবার গিয়েছি। অলকেশ ঘোষ এবং মাসুক হেলাল আমার দীর্ঘদিনের চেনা জানা। বিচিত্রা আর দৈনিক বাংলার সুবাদে চেনা। কাজ করেছি একসাথে। অলকেশ ঘোষের সাথে তখন থেকেই একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
মাসুক হেলাল তার প্রিয় মানুষদের প্রোট্রেট এঁকে চমকে দিতে পছন্দ করেন। শিল্পীরা সব সময় একটু খেয়ালী স্বভাবের হয়। অলকেশ ঘোষ ছিলেন তেমনি একজন খেয়ালী টাইপ শিল্পী। আমি যখন মুন্নুতে চাকরি করি তখন তাঁকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছিলাম। যখন মুড ভাল থাকত দ্রুত কাজ করতেন, যখন ইচ্ছা হতো না করতেন না। আমি তার পিছন পিছন ঘুরতাম। কখন শেষ হবে কাজ। ১৯৯২ সালে একদিন হঠাৎ অলকেশ ঘোষ আমাকে চমকে দিলেন! ময়মনসিংহের পটভূমিতে আঁকা অসাধারণ একটা ল্যান্ডস্কেপ উপহার দিলেন আমাকে। সম্ভবত জলরঙে আঁকা। আমি এতোটাই খুশী হয়েছিলাম যে সেই ছবি আমি যেখানেই যাই নিয়ে সাথে সাথে নিয়ে যাই। কানাডাতেও আমার ঘরে সেই ছবি শোভা পাচ্ছে।
তখন থেকেই আমি এইসব মানুষদের বুঝতে পারি। মৃণাল হকের সাথেও আমার সখ্যতা হয়েছিল একসময়। ক্রিয়েটিভ মানুষরা এমনই হয়। মাসুক হেলালও তাই। অনেকদিন থেকে গোপন অপেক্ষা মাসুক আমার একটা প্রোট্রেট এঁকে দেবেন। বছর দুই আগে আমার কয়েকটা ছবিও পাঠিয়েছিলাম। এবার ঢাকায় গিয়ে বেশ কয়েকবার আমাদের দেখা হয়েছে। মূলতঃ রিটন ভাই-ই তাঁকে পিক করতেন। রিটন ভাইর এটা একটা চমৎকার গুন। প্রিয় মানুষদের খুঁজে খুঁজে বের করা। এবার কয়েকদিন একসাথে থাকায় সেটা দেখেছি। বইমেলা থেকে ফেরার পথে আমরা প্রায়ই ডিনার খেতাম স্টার কাবাবে। প্রথম আলোর উল্টোদিকে স্টার কাবাব। মাসুক হেলাল রাস্তা পার হয়ে চলে আসত। যতই আমরা একসাথে ডিনার করি না কেনো, চাইনিজ বা ডাবের পানি খাই না কেনো মাসুক হেলাল আমার প্রেট্রেট আর এঁকে দেয় না। হয়ত তার মাথায়ই নাই।
অলকেশ ঘোষের দেওয়া উপহারটি ছিল আমার পাওয়া খুবই মূল্যবান একটি উপহার। শিল্পীরা যে চমকে দিতে ভালবাসেন তার প্রমান আবার পেলাম। সে রাতে মাসুক হেলাল আমাকে নতুন করে চমকে দিলো! আবেগে আপ্লুত হলাম। আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। আমার প্রোট্রেট এঁকে না দেওয়ার অভিমান ভুলে গেলাম মুহূর্তে। সে রাতে উপহার পেলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই পোট্রেট। ১৫ আগষ্ট। এই শোকার্ত দিনে আপনাকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করি হে মহান নেতা।
কাজী জহিরুল ইসলামের ’বঙ্গবন্ধু’ কবিতার দুটি লাইন দিয়ে শেষ করছি..
বাংলাদেশের জল-কাদা-ধূলিকণা
জপমন্ত্রধ্বনি তোলে
হাজার সালের সেরা বাঙালি বঙ্গবন্ধু বলে
ওরা বঙ্গবন্ধু বলে
জসিম মল্লিক
টরন্টো ২৮ জুলাই ২০২০