টরেটক্কা টরন্টো – সন্তান প্রতিপালন
সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০
কাজী সাব্বির আহমেদ
আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন বিভাগ ভিত্তক শিক্ষাবোর্ড আছে, তেমনি এদেশে আছে ‘স্কুল ডিস্ট্রিক’ ভিত্তিক শিক্ষা বোর্ড। টরন্টো শহরের স্কুলগুলির জন্য রয়েছে ‘টরন্টো ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ড’ যাকে সংক্ষেপে ‘টিডিএসবি’ বলা হয়ে থাকে। টরন্টো শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত পিকারিং, এজ্যাক্স, উইটবি এবং অশোয়া শহরের স্কুলগুলির জন্য রয়েছে ‘ডুরহাম ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ড’ বা ‘ডিডিএসবি’। আবার পশ্চিমের মিসিসগা এবং ব্রামটন শহরের স্কুলগুলির জন্য ‘পীল ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ড’ বা ‘পিডিএসবি’। আবার এই শহরগুলির বেশ কিছু স্কুল রয়েছে ‘ক্যাথলিক ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ড’ বা ‘সিডিএসবি’-এর অধীনে। কানাডার সমস্ত ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ডগুলি পরিচালিত হয়ে থাকে পাবলিক ফান্ডের অর্থায়নে, এমনকি ক্যাথলিক স্কুল বোর্ডগুলিও। এই সমস্ত স্কুল বোর্ডগুলির অধীনে পরিচালিত স্কুলগুলিকে পাবলিক স্কুল বলা হয়ে থাকে যেখানে এলিমেন্টারী থেকে গ্রেড টুয়েলভ পর্যন্ত বিনা বেতনে শিক্ষা দেয়া হয়। তবে ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে এই সব পাবলিক স্কুলগুলিতে বেশ মোটা অংকের বেতনের বিনিময়ে বিদেশী ছাত্রদের ভর্তি করা হচ্ছে। এই বিদেশী ছাত্রদের ভিতর চীন থেকে আগত ছাত্রদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতন। বাংলাদেশের শিক্ষাবোর্ডের কার্য্যক্রমের সাথে এখানকার স্কুলবোর্ডের একটি প্রধান পার্থক্য হচ্ছে এখানে স্কুলবোর্ডের অধীনে এসএসসি কিংবা এইচএসসি-এর মতন কোন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় না। এখানে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা অনেকটা বৃটিশ সিস্টেমের ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পরীক্ষার সমমানের ধরা হয়ে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের অনেক ছাত্রই দেশে বসেই ‘ইংলিশ মিডিয়াম’ স্কুলে লেখাপড়া করে ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পরীক্ষা দিয়ে থাকে। কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুলের ক্লাশ টিচারের নেয়া পরীক্ষার ফলাফলই চূড়ান্ত হিসেবে গণনা করা হয়ে থাকে এবং সেই ফলাফলের ভিত্তিতেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগও নির্ধারিত হয়ে থাকে।
পাবলিক স্কুলে পড়ার জন্য টাকা পয়সা না লাগলেও, কানাডার ইউনিভার্সিটিগুলো কিন্তু বেশ ব্যয়বহুল। তাই আগে থেকেই সন্তানের পড়ার খরচ জমানোটা অবশ্যই একটা বুদ্ধিমানের কাজ। সরকার ‘আরইএসপি’ নামক এক স্কিমের মাধ্যমে এই খরচ জমানোর জন্য সবাইকে উৎসাহিত করে থাকে। বাংলাদেশে লাইফ ইনসুরেন্স পলিসি বিক্রির জন্য এজেন্টরা যেমন তৎপর থাকত এক সময়, একইভাবে এই ‘আরইএসপি’ স্কিমে সাইনআপ করানোর জন্য ফিন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজাররা সদা তৎপর। আপনি হয়ত ব্যাংকে গিয়েছেন টাকা ডিপোজিট করতে, সে হয়ত আপনাকে ব্যাংকের অন্যান্য প্রডাক্ট সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবে। এই অন্যান্য প্রডাক্টের মধ্যে ‘আরইএসপি’ অন্যতম। ব্যাংকের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজীর ভাষায় একে বলে ‘আপ সেলিং’। আবার আমাদের সহ বিভিন্ন কমিউনিটির ভেতর অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন ফিন্যান্সিয়াল প্রডাক্টের এজেন্ট। তারাও বেশ তৎপর। শুনেছি কারো বাচ্চা হবে শুনলেও তারা ‘আরইএসপি’-এর পলিসি বিক্রির জন্য নড়াচড়া শুরু করে দেন। এরকম একজন পরিচিত এজেন্টের সাথে আমাদের এই ‘আরইএসপি’ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়। ‘আরইএসপি’-এর সবচেয়ে বড় ‘ক্যাচ’ হলো সরকার আপনার জমানো টাকার সাথে কিছু টাকা যোগ করে ‘গ্র্যান্ট’ হিসেবে। কেউ যদি তার সন্তানের জন্মের পর থেকে টারসারি এডুকেশনের আগ পর্যন্ত এই স্কিমে টাকা রাখে তবে সরকার থেকে সর্বোচ্চ চৌদ্দ হাজার পাওয়া যাবে গ্র্যান্ট হিসেবে (সেই সময়ের হিসেব অনুযায়ী)। আমাদের সন্তানের বয়স যেহেতু সাত বছর, এজেন্ট হিসেব করে জানাল যে আমাদের ক্ষেত্রে গ্র্যান্ট পাওয়া যাবে অর্ধেক। যেহেতু এই ‘আরইএসপি’ ছাড়াও সরকারের ‘ওসাপ’ নামক প্রোগ্রামের আওতায় বিনা সুদে ছাত্র-ঋণের সুবিধা রয়েছে, তাই আমাদের কাছে ‘আরইএসপি’ আর তেমন আকর্ষণীয় মনে হয়নি।
টরন্টোতে আমাদের ছেলের স্কুল শুরু হয় গ্রেড টু থেকে টিডিএসবি-এর অধীনস্থ ‘ট্যামো-শেনটার জুনিয়র পাবলিক স্কুল’-এ। সাধারণত নতুন ইমিগ্রান্ট ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অন্যান্য বিষয়ের বাইরেও ইএসএল (ইংলিশ অ্যাজ আ সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ) কোর্স নিতে হয়। আমাদের ছেলেকে অবশ্য এই কোর্স নিতে হয়নি কারণ তার জন্ম এবং বেড়ে উঠা সিঙ্গাপুরে যেখানে ইংলিশ হচ্ছে অফিসিয়াল ভাষা। তবে এই ইএসএল কোর্সটি খুবই কার্যকরী বিশেষ করে ইংলিশের প্রচলন নেই এমন সব দেশ থেকে আসা ইমিগ্রান্ট বাচ্চাদের জন্য। ইমিগ্রান্ট ফ্যামিলির বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাসায় তাদের বাবা-মার সাথে মাতৃভাষাতে কথা বললেও, স্কুলে যাওয়ার পর থেকে তারা কানাডিয়ান উচ্চারণে ইংলিশে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে এবং একসময় এতেই তারা স্বচ্ছন্দ বোধ করা শুরু করে। আর বাসায় আরও ভাইবোন থাকলে তো কথাই নেই, তখন তারা নিজেদের ভিতর সাধারণত আর কখনই মাতৃভাষায় কথা বলে না। আমাদের ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্টের বাচ্চারা যখন গ্রেড ফোর কিংবা ফাইভে উঠে, তখন তারা ইচ্ছে করে নিজেদের মধ্যে ইন্ডিয়ান এক্সেন্টে ইংলিশ বলে মজা করে যা তারা তাদের বাবা মা এবং কমিউনিটির লোকদের বলতে শুনে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের এই মজা করার বিপক্ষে নই, তবে তারা যেন একসময় বুঝতে পারে যে এই এক্সেন্ট থাকাটা দোষের কিছু নয়। আর তারা যেন কখনই মনে না করে যে তাদের বাবা মা কিংবা কমিউনিটির লোকেরা এই এক্সেন্ট থাকার জন্য এদেশের জন্য আনফিট। তারা হয়ত তাদের বাবা, মা কিংবা কমিউনিটির লোকদের প্রিকারিয়াস জব করতে দেখে বড় হয় এবং একটা সময় তাদের বাবা, মা কিংবা কমিউনিটির লোকদের যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে। এই মানসিকতার ফলে তাদের ভিতর জন্ম নিতে পারে হীনমন্যতার। আমরা তখন এদেশে মাত্র এসেছি, কথা প্রসঙ্গে এখানে জন্ম নেয়া এবং বড় হওয়া একজন বাংলাদেশী কানাডিয়ান তরুণী আমাদেরকে তাদের প্রজন্মের এই হীনমন্যতার কথা বলেছিল। তাই আমরা আমাদের সন্তানকে যেন এই হীনমন্যতা গ্রাস করতে না পারে সে জন্য সবসময়ই বিশেষ সতর্ক থাকতাম। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ধর্ম সম্পর্কে তাকে নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও সঠিক জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা সব সময়ই করেছি। আর সে জন্য তাকে আমরা আমাদের ইতিহাসকে পড়তে বিশেষ উৎসাহ যুগিয়েছি। ফলে ইতিহাস হয়ে উঠেছে তার একটি প্রিয় বিষয়, স্কুলে মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ইতিহাসের পাশাপাশি সে নিজের উৎসাহে পড়েছিল মোঘল এবং অটোমানদের ইতিহাস। ইসলাম ধর্মতত্ত্বের উপরও তার জন্মেছে অগাধ আগ্রহ, যা পরবর্তীতে তাকে সাহায্য করেছে আজকের বিশ্ব রাজনীতির যে জটিল রূপ তার প্রেক্ষাপটকে অনুধাবন করতে। আমার ছেলে আমাকে একসময় বলেছিল যে গ্রেড ইলেভেনে তাদের হিস্ট্রি টিচার ক্লাসে নাকি বলেছিল, মনে রেখ যারা একসেন্ট সহ ইংলিশ বলে তারা কিন্তু সবাই কমপক্ষে বাই-লিঙ্গুয়াল, তোমাদের চেয়ে অন্তত একটি ভাষা বেশী জানে। আমরা আমাদের ছেলের সাথে বাসাতে সব সময় বাংলাতে কথা বলা চালু রেখেছিলাম। যাতে সে এই ভাষাটাকে ভুলে না যায়। সিঙ্গাপুরে থাকতে বাংলা ভাষার অক্ষরজ্ঞানে তার হাতেখড়ি যদিও হয়েছিল, কিন্তু অনুশীলনের অভাবে সে এখন সামান্যই বাংলা পড়তে পারে। কিন্তু সে স্বচ্ছন্দে বাংলাতে কথোপকথন চালাতে পারে। সেই হিসেবে কিছুটা হলেও সে নিজেকে বাই-লিঙ্গুয়াল বলে দাবী করতেই পারে। তবে এই মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে মেইনল্যান্ড চাইনিজরা ছিল বেশ তৎপর। ছুটির দিনে ‘ট্যামো-শেনটার জুনিয়র পাবলিক স্কুল’-এর ক্লাসরুমগুলোতে চাইনিজরা তাদের নিজের বাচ্চাদের জন্য চাইনিজ শেখার কোর্স চালু করতে দেখেছি। দল বেঁধে চাইনিজ বাচ্চারা যেত তাদের মাতৃভাষায় পড়া ও লিখা শিখতে। তবে এখানে বড় হওয়া আমার অনেক চাইনিজ কলিগদের কাছ থেকে জেনেছি যে ছোটবেলার সেই শিক্ষা তারা গুলিয়ে খেয়েছে অনভ্যাসের কারণে। তারা এখন শুধু কাজ চালানোর মতন চাইনিজ বলতে পারে আর সেই কাজের ভিতর একটি হচ্ছে তাদের গ্র্যান্ড প্যারেন্টদের সাথে কথাবার্তা চালানো। এখানে উল্লেখ্য যে অধিকাংশ চাইনিজ ইমিগ্র্যান্ট ফ্যামিলি তাদের বাবা মা এবং শ্বশুর শ্বাশুড়িকে ইমিগ্র্যান্ট করে নিয়ে আসে। এতে সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে তাদের অনেক সুবিধা হয়।
ছেলে নতুন দেশের নতুন স্কুলে যাচ্ছে, তাই আমরা স্কুলের বিভিন্ন নিয়মকানুন কিংবা প্রোগ্রামগুলি খতিয়ে দেখা শুরু করলাম। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে সরকার কিংবা স্কুল বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত বেশ কিছু ইন্টারেষ্টিং প্রোগ্রাম রয়েছে যার কিছু একাডেমিক আবার কিছু সামাজিক কল্যাণমূলক। এই সাথে এটাও লক্ষ্য করলাম যে একাডেমিক প্রোগ্রামগুলো আবার শুধু মাত্র কিছু কিছু স্কুলে চালু আছে, অধিকাংশ স্কুলেই তা নেই। তবে সামাজিক কল্যানমূলক প্রোগ্রামগুলি আবার মোটামুটিভাবে সব স্কুলেই থাকে। যেমন, ব্রেকফাস্ট প্রোগ্রাম। একেক স্কুলে একেক বছরে একেক নাম দিয়ে এই প্রোগ্রাম চালু করা হয় বছরের নির্দিষ্ট কিছু মাসের জন্য, যেখানে বাচ্চারা স্কুল শুরু করার আগে স্বাস্থ্য সম্মত নাস্তা খেতে পাবে। যদিও অল্প কিছু ফি-এর বিনিময়ে এই প্রোগ্রামে বাচ্চাদেরকে এনরোল করাতে হয়, কিন্তু যাদের আর্থিক অবস্থা নাজুক তাদের জন্য রয়েছে বিনা ফি-তে এনরোল করার সুযোগ। তবে আপনাকে স্কুলে থাকা স্যোসাল ওয়ার্কারের সাথে
যোগাযোগ করতে হবে এই বিনা ফি-তে এনরোল করার সুযোগ নিতে। আমরা আমাদের ছেলেকে এই ব্রেকফাস্ট প্রোগ্রামে এনরোল করার সময় লক্ষ্য করলাম যে ‘ফুড রেষ্ট্রিকশন’ নামক একটি সেকশন রয়েছে ফর্মে যেখানে আমরা ‘হালাল’ ঘরে টিক বসিয়ে দিলাম। এখানে লক্ষ্যনীয় যে মুসলিমরা যে কোন ধরণের ক্যাটাগরাইজড ফুড অর্থাৎ ভেজেটারিয়ান, কোসের (যখন হালাল অপশন না থাকবে) কিংবা হালাল ফুড খেতে পারে, যত সমস্যা নন-ক্যাটাগরাইজড ফুডের ব্যাপারে। স্কুল থেকে আবার মাঝে মাঝে অল্প ফি-এর বিনিময়ে পিজা লাঞ্চের আয়োজন করা হত। বাচ্চারা বেশ আনন্দেই সেই লাঞ্চ উপভোগ করত। প্রতিটি জুনিয়র পাবলিক স্কুলে থাকে স্যোসাল ওয়ার্কার যাদের কাজ হচ্ছে বাচ্চাদের সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করা। ধরুন আপনার বাচ্চা খেলতে গিয়ে হাতে কিংবা পায়ে ব্যথা পেয়েছে যা সহজেই চোখে পড়ছে। আপনি যদি ক্লাস টিচারকে ঘটনাটি না বলেন তবে সে আপনার বাচ্চাকে স্যোসাল ওয়ার্কারের কাছে পাঠাবে। স্যোসাল ওয়ার্কার তখন বাচ্চার কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করবে সে ‘ডোমেষ্টিক ভায়োলেন্স’-এর শিকার কিনা। ‘সেলফ ডিফেন্স’ মেকানিজমের অংশ হিসেবে বাচ্চাদেরকে জানানো হয় যে তারা যদি কোন কারণে ইনসিকিউরড ফিল করে তবে তারা ৯১১ নাম্বারে কল করতে পারে। পুলিশ আসবে তাদেরকে সাহায্য করার জন্য। পুলিশ ডাকার এই মন্ত্র আবার বিপত্তিও সৃষ্টি করতে পারে। খেলাচ্ছলে বাচ্চারা অনেক সময় এই নাম্বারে কল দিয়ে ফেলে। যাই হোক বাচ্চাদের তুচ্ছ কারণে, কিংবা স্বামী-স্ত্রীর তুচ্ছ দাম্পত্য কলহের জেরে এই পুলিশ ডাকার ঘটনা কিন্তু ‘চিল্ড্রেন এইড সোসাইটি’ পর্যন্ত গড়াতে পারে। যারা কিনা আপনার সন্তানকে তাদের সেফ কাষ্টডিতে নিয়ে নিতে পারে যদি মনে করে বাচ্চার সামাজিক অধিকার রক্ষা হচ্ছে না।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এই স্যোসাল ওয়ার্কারদের বেশীর ভাগই থাকে ইমিগ্রান্ট, কারণ নতুন ইমিগ্রান্টরা যাতে তাদের সাথে কথা বলতে ভাষাগত কোন সমস্যায় না পড়ে। আবার দেখা গেছে যে এই স্যোসাল ওয়ার্কাররা নিজেদের চাকরীর প্রয়োজনে আগবাড়িয়ে যেটা হয়ত কোন সমস্যাই নয় সেটাকেও সমস্যায় পরিণত করে ফেলে। নতুন ইমিগ্রান্টদের জন্য নতুন দেশে এসে একটা নতুন ক্যারিয়ার গড়াটা অতটা সোজা নয়, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সংসারে দেখা দেয় অভাব অনটন যেটার সাথে হয়ত তারা কখনই পরিচিত ছিলেন না। আর কথায় বলে, ‘অভাব যখন দরজাতে এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’। আর ভালোবাসা যখন অনুপস্থিত, দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কে তখন ফাটল তো ধরতেই পারে। আর সেই ফাটলের সুযোগ নিয়ে স্যোসাল ওয়ার্কাররা খুব সহজেই চিরস্থায়ী ভাঙন ধরিয়ে দিতে পারে। তাই নিজ পরিবারের ভিতর সমঝোতার ভিত শক্ত রাখাটা খুব জরুরী। আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে ব্রোকেন কিংবা ডিসফাংশনাল পারিবারিক কাঠামো আমাদের সন্তানদের সুষ্ঠ মানসিক বিকাশের প্রধান অন্তরায়। দরকার হলে যারা এ বিষয়ে দক্ষ অর্থাৎ প্রফেশনাল তাদের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য ফেইথ বেইজড কাউন্সেলিং মেইন ষ্ট্রীম কাউন্সেলিং-এর চেয়ে বেশী কার্যকর।
‘আফটার স্কুল প্রোগ্রাম’ হচ্ছে একটি কার্যকরী প্রোগ্রাম যা কর্মজীবি মায়েদের জন্য বিশেষ উপকারী। এই প্রোগ্রামের আওতায় ছুটির পর বাচ্চারা আরও ঘণ্টা দু’য়েকের জন্য স্কুলে থাকে, যাতে তাদের বাবা কিংবা মা কাজের শেষে তাদেরকে বাসায় নিতে পারেন। একজন সুপারভাইজারের তত্ত্বাবধানে বাচ্চারা এই সময়ে বই পড়া কিংবা ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমাদের ছেলেকে অবশ্য এই আফটার স্কুল প্রোগ্রামে যেতে হয়নি কখনও। প্রতি টার্মের শেষে ফটো সেশনের একটা ব্যাপার থাকে সেটাও বেশ মজার। নোটিশ পাঠানো হয় ফটো সেশনের জন্য নির্ধারিত দিনটি জানিয়ে যাতে সেদিন বাচ্চারা তাদের পছন্দের ড্রেসটি পরে যেতে পারে। স্কুলের বাইরে থেকে আসা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর একক ছবি তুলে বিনা পয়সায়। বিভিন্ন পোজে তোলা সেই ছবির নমুনা কপিও পাঠানো হয় বাসায় বিনা পয়সায়। পছন্দ হলে পয়সার বিনিময়ে আসল কপি কিনতে হয়। এই নমুনা কপিগুলোও সংগ্রহের জন্য নেহাত মন্দ নয়। এইভাবে স্কুলের সিস্টেমের সাথে পরিচিত হতে হতেই আমাদের ছেলে গ্রেড থ্রি-তে উঠে গেল। তার নতুন গ্রেডের ক্লাস টিচার হলেন মিস্টার লাউ, চাইনিজ বংশোদ্ভূত ক্যানাডিয়ান, হংকং থেকে আসা।
মিস্টার লাউ-এর বিশেষ উৎসাহ দেখেছি বাচ্চাদেরকে বিভিন্ন ধরণের ‘এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস’-এ সম্পৃক্ত করতে। কিন্তু সেই অ্যাক্টিভিটিসগুলি ছিল মূলত চাইনিজ কালচারাল হেরিটেজ সংক্রান্ত। যেমন চাইনিজ ফ্লুইট বাজানো কিংবা ড্রাগন ডান্স নাচা। তার ক্লাসের অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রী ছিল মেইনল্যান্ড চায়না থেকে আসা। ফলে তাদের জন্য সেই অ্যাক্টিভিটিসগুলি প্রযোজ্য হলেও নন-চাইনিজ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সেটা যে প্রযোজ্য নয় সেটা স্কুল কর্তৃপক্ষ কেন যে দেখেনি সেই প্রশ্নের জবাব আমি আজও মেলাতে পারিনি। ইদানিং বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের শিক্ষাখাতে চাইনিজ এসপিওনাজের খবর বিভিন্ন মেইনস্ট্রীম সংবাদ মাধ্যমে আসা শুরু হয়েছে। জানি না সেই ‘ড্রাগন ডান্স’ চাইনিজ সরকারের কোন মিশনের অংশ ছিল কিনা। মিস্টার লাউ সম্পর্কে আমাদের প্রথম টনক নড়ে যখন একদিন আমাদের ছেলে আমাদেরকে বলল, ‘ইউ নো উই অল হ্যাভ টু ডাই ওয়ান ডে’। তাকে জেরা করে জানতে পারলাম যে একথা সে মিস্টার লাউ-এর কাছ থেকে শিখেছে। আমরা বুঝতে পারলাম যে মিস্টার লাউ ক্লাসরুমে ক্রিশ্চিয়ানিটি প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে আমরা জরুরি ভিত্তিতে প্রিন্সিপাল মিস্টার হার্ভি-এর সাথে কথা বললাম। মিস্টার হার্ভি আমাদের কথা দিলেন যে পরের বছর আমাদের ছেলের ক্লাস টিচার মিস্টার লাউ-এর পরিবর্তে অন্য কেউ হবে। গ্রেড ফোর-এ যদিও মিস্টার লাউ আমাদের ছেলের ক্লাস টিচার হয় নি, কিন্তু গ্রেড ফাইভে আবার হয়েছিল। আর গ্রেড থ্রি-তে ‘গিফটেট প্রোগ্রাম’-এর জন্য টিচারের যে নমিনেশন লাগে, আমার ছেলে কিন্তু মিস্টার লাউ-এর কাছ থেকে সেটা পায়নি। গ্রেড টু-এর ক্লাস টিচার মিসেস বোস তাতে বেশ হতবাকই হয়েছিলেন। (চলবে)
(পরবর্তী পর্বে ‘গিফটেট প্রোগ্রাম’ সহ ওন্টারিও স্কুল বোর্ড গুলির অন্যান্য অ্যাকাডেমিক স্ট্রিমিং প্রোগ্রাম নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা থাকবে)
সাব্বির কাজী
টরন্টো