বর্ণবাদবিরোধী লড়াই শুরু হয় ঘর থেকেই
সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০
মীরা এস্ত্রাদা
শিশুরা জন্মগতভাবে বর্ণবাদী নয়। বর্ণবাদ এমন এক জিনিস যা শিখতে হয়। আর শিশুদের বর্ণবাদী হওয়া রোধের দায়িত্ব বাবা-মায়ের ওপরেই বর্তায়।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ দেখতে পাচ্ছি যাতে এই কানাডাসহ সর্বত্র পদ্ধতিগত বর্ণবাদের অবসান ঘটানোর দাবি জানানো হচ্ছে।
এটি বাবা-মায়েদের চরম উদ্বেগের মধ্যে রেখেছে। দুর্ভাগ্যজনক যে, কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসী শিশুদের বাবা-মায়েদের মনে এই উদ্বেগ সব সময়ই সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তারা তাদের শিশুদের জীবন নিয়ে সত্যিকারের ভয়ের মধ্যে সময় কাটান।
কিন্তু বর্তমানে এই পাওনাগণ্ডা বুঝে নেবার সময়ে, সব বর্ণের শিশুদের বাবা-মায়েরাই এখন ভাবতে শুরু করেছেন, কীভাবে তারা তাদের সন্তানকে বর্ণবাদবিরোধী মানসিকতায় গড়ে তুলতে পারেন।
এমনকি মাত্র তিন মাসের শিশুও গায়ের রঙ দেখে মানুষের চেহারার পার্থক্য বুঝতে পারে। আর তিন বছর বয়স হতে হতে শিশুরা বর্ণগত শ্রেণি এমনকি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিন্যাসও পুরোপুরি ধরতে পারে।
বাচ্চারা শ্রেণিকরণের ভেতর দিয়েই শেখে এবং এর মধ্যে জাতিগত পরিচয়সহ শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানুষের শ্রেণিকরণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। এই শ্রেণিকরণ খুবই স্বাভাবিক বলে এটি মেনে নেয়া এবং এরপর এটিকে বর্ণবাদে রূপান্তরের হাত থেকে রক্ষা করা জরুরী।
আমার মনে আছে শৈশবে সূর্যস্নানের সময় এমন সতর্কবাণী শুনেছি যে, “রোদ থেকে দূরে থাকো, নাহলে খুব কালো হয়ে যাবে।” শৈশবের গ্রীষ্মকালগুলিতে আমার জীবনে বেশ কিছু নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছিল Ñ এটা সেই ভীতিকর সময় যখন “আমি আরও বেশি কালো হয়ে যাই।”
কিন্তু আমি আমার শরীরে কালো বর্ণের কারণ যে মেলানিন সেটিকে ভালোবাসতে শিখি এবং এখন অত্যন্ত সচেতন যে, আমার নিজের সন্তানদের জন্য কালো চামড়ার ইতিবাচক অনুষঙ্গ আছে। ‘রোদ গোসলের’ মধ্যে এক ধরণের আনুষ্ঠানিক উদযাপনের ব্যাপার আছে আর আমরা সেটা আনন্দের সঙ্গে জাহির করি এবং একদিন সূর্যস্নান করেই অন্যদের সঙ্গে নিজের চামড়ার রোদে পোড়া অংশের তুলনা করি।
কিন্তু যখন খেলার পুতুল, যেসব বই আমরা পড়ি এবং যেসব প্রদর্শনী ও ছায়াছবি আমরা দেখি সেসব বিষয় সামনে আসে, তখন আমি নিশ্চিত করার চেষ্টা করি যাতে এগুলোর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ও খয়েরি রঙের গাত্রবর্ণের চরিত্র থাকে। আমার দুটি বাচ্চাই ছবি রঙ করতে ভালোবাসে এবং অন্য অনেক শিশুর মতই তারাও শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে তাদের মনে ভাব প্রকাশ করে।
গত মাসে রঙিন পেন্সিল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ক্রেওলা তাদের “বিশ্বের রঙ” নামের ক্রেয়ন সেটের বিপণন শুরু করেছে যাতে ২৪ রঙের পেন্সিল আছে যা “মানুষের গায়ের রঙের পরিপূর্ণ বর্ণালি” তুলে ধরেছে।
কোভিড-১৯ মহামারি এবং বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যে ক্রেয়নের একটি বাক্স তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে মনে হবে না। কিন্তু এটি সত্যিই গুরুত্ব বহন করে। আমি যখন আমার বাচ্চাদেরকে ক্রেয়ন পেন্সিল দেখাই তারা রীতিমত রোমাঞ্চিত হয়।
আমার আট বছরের বাচ্চা চেঁচিয়ে ওঠে, “এটা তো দারুণ! আগে আমি সব মানুষের গায়ের রঙ করতাম হলুদ আর বাদামিতে, আর এখন আমি আমার প্রকৃত রঙ পেলাম। আমার মনে হয়, আমার গায়ের রঙ বাদামি। …আমি বিস্মিত, গভীর গোলাপি রঙ কাদের আছে? আমি কখনও গোলাপি রঙের মানুষ দেখিনি!”
আমার চার বছরের মেয়েটা খুবই খুশি হয়। সে বাস্তবসম্মত কণ্ঠে আমাকে জানিয়ে দেয়, “মা, এটা খুবই চৌকস। কারণ মানুষের গায়ের রঙ কেবল একটি নয়। এর আগে মানুষের মুখের ছবিতে শুধু একটিই রঙ ব্যবহার করেছি, খয়েরি। এখন আমরা প্রতিটি মানুষের গায়ের রঙ আঁকতে পারবো।”
বাচ্চারা যাতে তাদের গায়ের রঙের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করতে পারে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে তাদের মনে একাত্মতা ও গ্রহণযোগ্যতার বোধ তৈরি হয়। কারণ এখন তারা জানতে পারছে, তারা তাদের পরিবারের বা বন্ধুদের কারো ছবি আঁকতে চাইলে প্রত্যেকেরই গায়ের রঙ তুলে ধরতে পারবে।
আমাদের মুখের কথার চেয়েও বেশি কিছু বলে দেয় আমাদের কাজ। বিচিত্র ধরণের বন্ধু থাকা এবং এসব সম্পর্কের মধ্য দিয়ে শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার সুদূরপ্রসারি সুফল রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বন্ধুত্ব থাকার মধ্যে তাদের সন্তানেরা কোন্ ধরণের জাতিগত মন-মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠবে তারই ইঙ্গিত থাকে। আপনার যদি জাতিগতভাবে একই ধরণের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকে তাহলে আপনার সন্তান হয়তো বিভিন্ন জাতিগত বিষয়ে সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে বড় হবে- আর কর্মস্থলে একজন কৃষ্ণাঙ্গ সহকর্মীর সঙ্গে প্রতীকি বন্ধুত্ব থাকলে তাতে কোনও কাজ হবে না।
মৌখিক ভাষার বাইরে আমাদের আভাস-ইঙ্গিতও শিশুদের জন্য দিক-নির্দেশনা দিতে পারে। আমাদের শারীরিক ভাষা বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ শিশুদের বলে দেয়, কোন বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করছি। এমনকি অচেতনভাবেও এটি ঘটতে পারে।
যে মুহূর্তে আমি প্রথমবার ডিয়েট্রিক হ্যাডনের (যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় সঙ্গীত গায়ক) গান “আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না” শুনি তখন গানের সেই কথাগুলো আমার মর্মে গেঁথে যায়, “জানি আমি এক বলবান কৃষ্ণাঙ্গ, কিন্তু আমি যা করছি তা দেখে ভয় পেয়ো না।”
আমার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ বন্ধুদের সবাই আমাকে বলেছে যে, তারা যখন কোনও দোকানে ঢোকে তখন প্রায়শই তারা বিক্রেতাদের চোখেমুখে ঘৃণা ও অমূলক ভীতি দেখতে পান। সামাজিকভাবে আরোপিত অপরাধ বোধে ভুগে আমরা জীবনের প্রতিটি দিন কাটাবো এটা আমি কল্পনাও করতে পারি না।
হ্যাঁ, আমি নিজেও বৈষম্য ও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির অভিজ্ঞতা পেয়েছি। কিন্তু কোনও দোকানে ঢোকার সময় তারা আমাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখছে এমনটা কখনই অনুভব করিনি। আমার সন্তানরাও কখনও শুধু গায়ের রঙের কারণে কারও প্রতি ঘৃণা পোষণ করবে সেটি আমি চাই না।
রাতারাতি পরিবর্তন ঘটবে তা নয়, তবে আমরা যদি সত্যিই পরিবর্তন চাই তাহলে সেটি ঘটানো সম্ভব। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদের যে শক্তিমত্তা দেখতে পাচ্ছি সেটাই এর প্রমাণ। কিন্তু এর অর্থ হলো, আমাদের সবাইকে মনে গভীরে বিদ্যমান পক্ষপাতিত্ব খতিয়ে দেখতে হবে এবং আমাদের আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন আনার জন্য সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমাদের শিশুরা প্রতিদিন, এমনকি খাবার সময়ও যে কূট অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে সেটিও আমাদের মনে রাখতে হবে।
পেপসিকো ইনক তাদের ‘আন্ট জেমিমা’ প্যানকেক মিক্স ও সিরাপের নাম পাল্টে ফেলছে। আর আমি বর্ণবাদী ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের ‘মাসকট’ও পাল্টে ফেলার সুপারিশ করি। তাদের লোগো তৈরি হয়েছে ১৯ শতকের মিনস্ট্রেল শোয়ের একটি চরিত্রের নামে। এতে যে আপত্তিকর ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করা হয়েছে তার শেকড় হলো একজন বন্ধুভাবাপন্ন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে, যে নারীটি একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবারে চাকরানি বা ন্যানী হিসাবে কাজ করে।
পেপসিকো আরও বলেছে, তারা আগামী পাঁচ বছর ধরে কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটিকে সহায়তার জন্য ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করবে এবং প্রতিষ্ঠানে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীর সংখ্যা বাড়াবে।
অতীতে যে বর্ণবাদী ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে চলমান তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে আঙ্কল বেন’স রাইস এবং মেসার্স বাটারওয়ার্থ’স সিরাপ প্রস্তুতকারীরাও তাদের দীর্ঘদিনের ব্রান্ডচিত্র পাল্টানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আমি ভাবি সেইসব বিষয়ে যেগুলো আমরা দৈনন্দিন জীবনে “স্বাভাবিক” করে নিয়েছি। আমি যখন স্কুলে পড়া শিশু তখন আমরা দিন শুরু করতাম জাতীয় সঙ্গীত এবং প্রভুর স্তুতিগান গেয়ে। এখন আমার বাচ্চারা ল্যান্ড অ্যাকনলেজমেন্টস শোনে।
আদিবাসী জনগণের দুর্দশা, আবাসিক স্কুল, নিখোঁজ ও খুন হয়ে যাওয়া আদিবাসী নারীদের বিষয়ে আমরা যে আলোচনা করেছি প্রতিদিনের এই কার্যক্রম হয়তো সেই বিষয়ে তথ্য জানার ব্যাপারে সহায়ক হবে।
বাবা-মা হিসাবে আমরাই আমাদের শিশুদের প্রথম শিক্ষক। তাই আসুন আরও বেশি খোলামেলাভাবে আলোচনা করি। আসুন অবিচার দেখলেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়াই এবং আমাদের সন্তানদেরও এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করি।
আসুন আমরা কৌতুহলকে বুকে তুলে নিই। শিশুদের কৌতুহলী মন আছে। আমরা যেন মানুষে মানুষে পার্থক্য বিষয়ে তাদের প্রশ্ন লজ্জায় এড়িয়ে না যাই। কারণ এধরণের প্রশ্ন আমাদের জন্য অস্বস্তিকর।
কিছুটা অস্বাচ্ছন্দ্য নিয়েও হলেও আমাদের আলোচনায় বসার এখনই সময়। আমাদের অনেক কিছু শেখার এবং না শেখার আছে। আসুন আমরা বর্ণবাদ নির্মূলে একসঙ্গে কাজ করি এবং পরবর্তী প্রজন্মের বর্ণবাদী হওয়া রোধ করি।
-সৌজন্যে : গ্লোবাল নিউজ (মীরা এস্ত্রাদা সাংস্কৃতিক বিষয়ক ভাষ্যকার এবং টরন্টোর গ্লোবাল রেডিও ৬৪০তে শঁষঃঁৎ’উ! অনুষ্ঠানের সহ-আয়োজক।)