করোনার দিনগুলো
কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ কী সত্যি সত্যি এসে গলো!
জসিম মল্লিক
(সপ্তম পর্ব)
১. বিশ্বজুড়ে আবার কোভিড জেঁকে বসছে। এ লেখা যখন ছাপা হবে তখনকার পরিস্থিতি কি হবে জানা নাই। তবে যখন এই লেখা লিখছি তখন কানাডা জুড়ে আবার বেড়ে গেছে আক্রান্তের সংখ্যা। অন্টারিও প্রভিন্স বিশেষকরে টরন্টো এবং তার পাশ্ববর্তী রিজিয়ণগুলোতে হু হু করে বাড়ছে। প্রথম ওয়েভে বেশিরভাগ আক্রান্ত ছিল বয়ষ্করা এবং মারাও গেছেন তারা বেশি কিন্তু এখন প্রায় ৭০ সতাংশ আক্রান্ত হচ্ছে তরুণরা যাদের বয়স চল্লিশের নিচে। এটা খুবই একটা আতংকের কথা। তরুণদের কারণে আবার কোভিড দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে সচেতনতা। তরুণদের মধ্যে একটা ডেসপারেট ভাব চলে এসেছিল। তারা মনে করেছিল কোভিড বোধহয় শুধু বৃদ্ধদের আক্রান্ত করে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কোভিড তার আচরণ ক্ষনে ক্ষনে বদলাচ্ছে। তরা তরুণদেরও রেহাই দিচ্ছে না। সামনে প্রলম্বিত শীত আসছে। আগামী মাস থেকেই কানাডা জুড়ে ফ্লু শট দেওয়া হবে বলে হেলথ কানাডা জানিয়েছে। ফ্লুর সাথে কোভিড বাড়ার আশংকা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
আমি আমার আগের লেখায়ই আশংকা প্রকাশ করেছিলাম যে স্কুল খুলে যাচ্ছে। সেখানে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পক্ষে সোশ্যাল ডিসটান্স মেইনটেইন করা কঠিন হবে। হয়েছেও তাই। লোকজন দলে দলে পর্কে গেছে, বিয়ের অনুষ্ঠান করেছে, জন্মদিন করেছে, কটেজে গেছে, সিনেমা হলে যাচ্ছে, ঘরোয়া গ্যাদারিং করেছে যা কোভিড বাড়ার অন্যতম কারণ। বিশেষকরে তরুণরা মাস্ক ব্যবহার করছে না। অনেক এপার্টমেন্টে তরুণরা মাস্ক ব্যবহার করে না। আইনকে তোয়াক্কা করছে না। স্কুলের শিক্ষার্থী এবং ডে কেয়ার সেন্টারগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ইউরোপেও আবার আতংকজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে কোভিড।
বাংলাদেেশও লোকজন একদম সচেতন না, বিশেষকরে মফস্বল এবং গ্রাম গঞ্জে লোকজন একদমই মাস্ক ব্যবহার করে না। বাংলাদেশে ঘরে ঘরে আক্রান্ত হচ্ছে লোকজন। অনেকেই হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে যায় না। ঘরেই নিজের চিকিৎসা করছে। যারা বাইরে থেকে আসছে তারা কোয়ারেনটাইন মানছে না। মফস্বলে যথাযথ চিকিৎসাও নেই। সবকিছুই ঢাকা কেন্দ্রিক। সরকারিভাবে যেটুকু প্রচার হচ্ছে বাস্তবে তার কয়েকগুন আক্রান্ত হচ্ছে বা মারা হচ্ছে। কোভিড এখন সাধারণ সর্দিকাশির পর্যায়ে চলে গেছে বাংলাদেশে। ইতিমধ্যে আগামী শীতে কোভিড আরো বাড়বে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু নতুন করে আবার লক ডাউনের কোনো সম্ভাবনা নাই বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। বালাদেশের মতো দেশে দীর্ঘ লক ডাউন সম্ভব না। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে মানুষকে কাজে ফিরতেই হবে।
বইমেলা এবং প্রবাসীকন্ঠ প্রসঙ্গঃ
এ বছর বই মেলায় আমার দুটি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি উপন্যাস, নাম স্পর্শ, অন্যটি ভালবাসার চাষাবাদ, এটি একটি স্মৃতিকথা। প্রকাশক অনন্যা, প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। কোভিডের জন্য এ বছর নিউইয়র্ক এবং টরন্টো বইমেলা স্থগিত হয়েছে। তাই টরন্টো এবং নিউইয়র্কের পাঠকেরা বই দুটি সংগ্রহ করতে পারেন নি। নিউইয়র্ক বইমেলা ভার্চুয়ালী হবে আগামী মাসে। টরন্টো বইমেলার দিন তারিখ ঘোষনা করা হতে পারে। একটি উপন্যাস যদি সর্বোচ্চ এক হাজার কপিও বিক্রী হয় তাহলে হাইয়েষ্ট ১৫ হাজার টাকার বেশি রয়্যালটি পাওয়ার সম্ভবনা নাই। এটা হচ্ছে সাধারণ হিসাব। কিন্তু বেশিরভাগ লেখকই রয়্যালটি পান না। প্রবাসে বসবাসরত যে কয়জন লেখক রয়্যালটি বা থোক সম্মানী পান, আমিও সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। মাত্র তিরিশ ভাগ লেখক রয়্যালটি পান!
কিন্তু সেজন্য প্রবাসে বসবাসরত একজন লেখককে অনেক মূল্য দিতে হয়। যেমন আমি প্রতিবছর বইমেলায় যাই। আমাকে কাজ থেকে ছুটি নিতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উইথাউট পে হয়। টরন্টো থেকে ইকোনমি ক্লাসে প্লেন ফেয়ার নূন্যতমপক্ষে ১৬০০ থেকে ২০০০ ডলার পর্যন্ত। প্রতিদিন মহাখালি এলাকা থেকে বইমেলায় আসা যাওয়ার উবার ভাড়া, চা, নাস্তা বা মাঝে মাঝে হোটেলে খাওয়া। প্রতিবছর অন্ততঃ একবার ঢাকা থেকে বরিশালে প্লেনে বা লঞ্চের ফার্ষ্টক্লাসে যাওয়া আসা, বরিশাল ক্লাবের গেষ্ট হাউজে দুই তিন রাত থাকা। ভাই বোন, আত্মীয়, বন্ধুর বাড়িতে মিষ্টি আর গিফট নেওয়া। গরীব মানুষদের সাহায্য দেওয়া, মসজিদ মাদ্রাসায় ডোনেশন। প্রায় প্রতি বছর কোলকাতা বইমেলায় যাওয়া, হোটেলে থাকা, জেসমিনের জন্য শাড়ি এবং আমার জন্য পাঞ্জাবী কেনা! মেলার সময় লেখক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন, বিভিন্ন পত্রিকা বা পোর্টালে নিউজ করান, টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দেন, প্রতিদিন ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে মনে করিয়ে দেই যে বই প্রকাশিত হয়েছে। ফেরার সময় নিজের কিছু বই বহন করে নিয়ে আসি। নিউইয়র্ক এবং টরন্টো বইমেলায় অংশ নেই। সেখানে আমার বই থাকে। নিউইয়র্কে চার পাঁচ দিন থাকলে প্লেন ফেয়ার ছাড়াও মিনিমাম দেড় দুই হাজার ডলার খরচ হয়। এতো কিছুর পরও লেখক কেনো লেখে! কেনো বইমেলায় ছুটে যায়! এরচেয়ে অন্য কিছু করলেও তো পারত। কিন্তু লেখক না লিখে পারেন না। একটি বইয়ের প্রতিটা অক্ষরে লেখকের কষ্টের রক্ত আর ঘাম জড়ানো থাকে।
অথচ পত্রিকায় লেখালেখি অনেক সহজ কাজ। আমি জনপ্রিয় মাসিক ম্যাগজিন প্রবাসীকন্ঠে গত ছয় মাস একটানা করোনা দিন শিরোনামে লিখছি। প্রতি সংখ্যায় আমার জন্য মোটামুটি আড়াই হাজার শব্দ বরাদ্দ থাকে। এরমধ্যে আমার বাসার ঠিকানায় একটা বড় হলুদ খাম আসে কানাডা পোষ্টের মাধ্যমে। খুলে দেখি পত্রিকার ছয়টি সংখ্যা এবং একটি সাদা এনভেলাপে পাঁচশ ডলার সম্মানীর চেক! উপন্যাস লেখার চেয়ে ভাল না! অনেক ভাল। তবুও লেখক উপন্যাস লেখে! না লিখে পারে না! আগামী বইমেলায়ও কানাডার জীভন যাপনের উপর উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছি। প্রকাশকের কাছে নভেম্বও পর্যন্ত সময় চেয়েছি। অসুস্থ্যতার জন্য যথসময়ে লিখতে বসতে পারিনি। তাছাড়া আাগামী বছর বইমেলা কোন পর্যায়ে হবে তাও এখনও নিশ্চিত নয়। এবছর নিউইয়র্ক বইমেলা যেমন ভার্চুয়াল হয়েছে, টরন্টো বইমেলাও ভার্চুয়াল হবে নভেম্বরে।
২
গত বছর নিউইয়র্ক বইমেলায় যেতে পারিনি। গত বছর ছিল ২৮তম বইমেলা। ২০০৩ সালে কানাডায় আসার পর খুব একটা নিউইয়র্ক বইমেলা মিস করিনি। ২০১৯ এর বইমেলায় যেতে পারিনি তার কারণ গত বছর বইমেলার সময়টায় আমি হজ্জে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয় মূলতঃ বইমেলাকে কেন্দ্র করেই। অন্য সময় আমি খুব একটা নিউইয়র্ক যেতে পারি না সময়াভাবে। ধীরে ধীরে একসময় আমিও নিউইয়র্ক বইমেলার অংশ হয়ে গেছি। বইমেলার কয়দিন লেখক, পকাশক আর পঠকের একটা মহামিলিন ঘটে। যেনো একটা ক্ষুদ্র বাংলাদেশ। একুশের গ্রন্থমেলার পর দেশের বাইরে এতো বড় আয়োজন আর কোথায় হয় না। নিউইয়র্ক আমার প্রিয় শহর, ভালবাসার শহর। নানা কারণে স্মৃতির শহরও বটে। নিউইয়র্কে আমি অনেক স্বাচ্ছন্দবোধ করি। ওই শহরে আমার অনেক বন্ধু, আত্মীয় বসবাস করে। নিউইয়র্কের রাস্তায় পা দিলে মনে হয় এটা আমার নিজের শহর।
২০২০ সালটা পৃথিবীর মানুষের জন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতার বছর। এমন ক্রান্তিকাল মানব জীবনে আর আসেনি। একটা মহামারির সময় পার করছি আমরা। সবকিছু স্থবির হয়ে গিয়েছিল, মুখ থুবড়ে পড়েছিল সব আয়োজন। ইতিমধ্যে আমরা অনেক আপনজন হারিয়েছি। অনেক লেখক সাংবাদিক হারিয়েছি। নিউইয়র্কেরই অনেক চেনা মানুষ হারিয়েছি। যাদের সাথে দেখা হয়েছে সবসময় আর তাদের সাথে দেখা হবে না। করোনা কেড়ে নিয়েছে অনেক আপনজনকে। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। মানুষের শক্তি অসীম। তাই সব প্রতিকুলতাকে পরাভূত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। এ বছর নিউইয়র্ক বইমেলার ২৯ তম বছর। বইমেলার পুরো আয়োজন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে। কিন্তু করোনার জন্য পাল্টে গেছে সব পরিকল্পনা, সব আয়োজন। কিন্তু বন্ধ করতে পারেনি উদ্যম।
তাই এ বছর প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয়েছে ভার্চুয়াল বইমেলা। দশ দিনব্যাপী এই বইমেলা ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলেছে। ’যত বই তত প্রান’ এই সেøাগানে অনুষ্ঠিত বইমেলা জাতির পিতাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজন করেছে এই বইমেলা। ১৯৯২ সালে বাঙালি চেতনা মঞ্চ নামে কিছু তরুণ শুরু করেছিল নিউইয়র্কের এই বইমেলা। আজ তা সারা বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর এর নেপথ্যের মানুষটি হচ্ছে বিশ্বজিৎ সাহা। সাথে আছেন একঝাঁক সাহিত্য আর সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ।
মাঝে মাঝে এমন একটা অনভূতি হয় আমার! ঘুমের ঘোরে কি একটা যেনো ঘটে চলে। হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে চিনতে পারি না! টের পাই চোখ ভিজা। কখনো নিজেকে খুব হালকা লাগে। অদ্ভুত এক আলোকরশ্মি আমাকে ঘিরে থাকে। আলোর নাচন শরীরে ভর করে। একটা শিহরন টের পাই। ভাললাগার শিহরন। কোথা থেকে আসে আবার কোথায় চলে যায়। নিজের শরীরে নিজে চিমটি কেটে অনুভব করার চেষ্টা করি এই আমি কে! কোথা থেকে এসেছি! কি আমার পরিচয়! কোথায় চলে যাব একদিন! এই আমি কি সত্যিকার আমি! এ রকম একটা অনুভূতি আমাকে অদৃশলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর তখন হালকা হয়ে যায় মন প্রান। পাখী হয়ে যায় প্রাণ। তখন মনে হয় এই পৃথিবীতে আয়ূ বেশিদিন নাই আর। পৃথিবীর রুপ রস অনেক ভোগ করেছি। এবার যাওয়ার জন্য অপেক্ষা। শুধু কখন সেটাই জানা নাই। তবে সেই যাওয়াটা সুন্দর হোক এই ভাবনা সবসময় মাথার মধ্যে থাকে। যতটুকু সম্ভব সুগন্ধ ছড়িয়ে বিদায় নেওয়া। চলে যাওয়া এমন কোনো ঘটনা না।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকা দিনগুলোতে অনেক অন্যায় করেছি, ভুল করেছি, কষ্ট দিয়েছি মানুষকে সে সব মনে করে মন ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে। যাদের কষ্ট দিয়েছি, যাদের সাথে অন্যায় করেছি সবাইকে তো খুঁজে পাব না। জানা অজানা মানুষেরা কে কোথায় হারিয়েছে জানি না। তাই তাদের উদ্দেশ্যে সবসময় বলি তোমাদের সবার কাছে ক্ষমা চাই। আত্মীয়, বন্ধু, পরিবার, মা-বাবা, ভাই-বোন, চেনা-অচেনা, পরিচিত, অল্প পরিচিত সবার কাছে। ক্ষমা করো। আমিও সবাইকে ক্ষমা করে দেই প্রতিদিন। প্রতিদিন ভোর পাঁচটার দিকে আমার ঘুম ভাঙ্গে প্রতিদিন। এলার্ম ছাড়াই ঘুম ভাঙ্গে। ভোরের নৈশব্দ আর ঘুম ভাঙ্গা পাখীদের ডাকের মধ্যে আমি ফজরের নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে ইসতেগফার করে আমি সবার জন্য প্রার্থনা করি। মানুষের মঙ্গল কামনা করি। আমার সকল চেনা মানুষ, বন্ধু, আত্মীয়, ছেলে- মেয়ে- স্ত্রী সবার মঙ্গল কামনা করি। তখন কোথা থেকে একটা শিহরন এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়। একটা পারলৌকিক অনুভূতি টের পাই। কখনো জাগরনে, কখনো অবচেতনে কখনো ঘুমের মধ্যে। তখন চোখ ভিজে যায় জলে..।
৩
ভীতুরাই বোকার মতো সাহসী কাজ করে। যেমন আমি। আমি জীবনে অনেক সাহসী কাজ করেছি। যেমন একদিন কিছু না বুঝেই বরিশাল ছেড়ে ঢাকা পারি জমিয়েছিলাম। জানি কয়েকদিন পরেই আবার ফিরে যেতে হবে। কিন্তু না। ফিরিনি। সাহস করে ঢাকায় থেকে গিয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। পকেটে চলার মতো পয়সা নাই কারণ বাড়ি থেকে টাকা পয়সা নেই না। সাহস করে একদিন বিচিত্রার মতো ডাঁক সাইটে এক পত্রিকা অফিসে ঢুকে পড়লাম। বোকা না হলে মফস্বল থেকে আসা কোনো ভীতু যুবকের ওই অফিসে ঢোকার কথা না। সেখানে কাজের সুযোগ হলো। কারণ লেখালেখির অভ্যাস আমার আগে থেকেই ছিল।
তারপর একদিন জেসমিন নামে এক রুপসী কন্যার সাথে ক্যাম্পাসে সখ্যতা হয়ে গেলো। সেই কাহিনী সিনেমাতেই সম্ভব। সাহস করে একদিন বিয়ের পিঁড়িতেও বসলাম, তখন আয় ইনকাম নাই। বিয়ে করেছি টাকা পয়সা ধার করে। স্ত্রীকে কিছুই তেমন দিতে পারিনি বিয়েতে। কম দামী দুইটা শাড়ী, একটা আংটি। দুই সন্তানের পিতাও হলাম একদিন। অসাধারণ দুই সন্তান। তারপর একদিন সাহসে ভর করে চাকরি বাকরি ছেড়ে কানাডায় পারি জমালাম। ছেলে মেয়ে পড়াশুনা শেষ করে চাকরি, ঘটা করে বিয়ে শাদি করল। এখন আবার সাহস করে ফিরতে চাই যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ভীতু হলেও এ রকম সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে না। আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। পরবর্তীতে মনে হয়েছে আমি হারিয়ে যাব। ভয়ে তটস্থ থাকি। ভয় ডরের মধ্যেই আমার বসবাস। এসব আমি এনজয় করি। অসুখের দিনে এইসব এলেবেলে ভাবনা আমাকে আত্মবিশ্বাস যোগায়।
জীবনের সবটুকু দুঃখের না, জীবনের সবটুকু সুখেরও না। তবে জীবনে সুখের ভাগটাই বেশি, সুখের স্মৃতিও বেশি। দুঃখ বা কষ্ট যেটুকু আছে সেটুকু সুখের স্মৃতি দিয়ে ঢেকে দিলেই হয়। অনেক সুখস্মৃতি মানুষের জীবনে আছে। তাই দুঃখ কষ্ট নিয়ে এতো আদিখ্যেতা করারই বা কি আছে! সুখ যেমন অন্যকে আন্দোলিত করে তেমনি দুঃখ অন্যকে বিচলিত করে। আবার সুখ যেমন প্রয়োজন আছে, দুঃখেরও প্রয়োজন আছে। দুঃখ জীবনের উত্তাল তরঙ্গকে স্তিমিত করতে পারে না। তাই হাসার স্বাধীনতা যেমন থাকতে হয় তেমনি কান্নার স্বাধীনতাও থাকতে হয়। রাত ছাড়া কি দিনের আলো ভালো লাগে, তেমনি অন্ধকার ছাড়া সূর্য!
আমি লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষ। আমি জানি জীবনের প্রতি পদক্ষেপে লড়াই থাকে, সংগ্রাম থাকে। বাঁচার জন্য লড়াই, সংসারের জন্য লড়াই, প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই, সাফল্য লাভের জন্য লড়াই। তেমনি দুঃখ কষ্টের সাথে লড়াই, অসুখে বিসুখের সাথে লড়াই। আমি আমার শৈশবকাল থেকেই লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষ। যদিও আমি একটু দুর্বল চিত্তের। কিন্তু বাস্তবে আমি সমুদ্রে সাতাঁর কেটে তীরে ওঠা মানুষ। আমার লড়াইটা তেমন দৃশ্যমান নয়। ওটাকে আমি জীবনের অংশ বলে মনে করি তাই জীবনের সুখ যতটুকু আমাকে আন্দোলিত করে দুঃখও ঠিক ততটুকু বিচলিত করে। আমি আবেগপ্রবন বলে কষ্টটাকে অন্যের সাথে শেয়ার করি। কিন্তু সুখটাকে একটু ঢেকে রাখি। আমি আসলে ভালবাসার কাঙাল। মনে রাখুন জীবন অনেক সুন্দর। জীবনে যেটুকু সুখ পেয়েছেন, যেটুকু দুঃখ পেয়েছেন, যেটুকু অসুখে ভুগেছেন ততটুকুই পাওয়ার কথা ছিল। এর বেশিও না, কমও না। তাই ওসব নিয়ে বিচলিত না হয়ে সহজভাবে নেওয়াই ভাল। মৃত্যু একবারই হবে। একটি মহান ঘুম এর বেশি কিছু না। আমি আমার কষ্টের দিনগুলোতে প্রতিবার অনুভব করি পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই ভাল, অনন্য। মানুষের কোনো তুলনা নাই। তাই আসুন ভালবাসায় বাঁচি।
মানুষের জীবনে অনেক কঠিন সময় আসে। কারো জানা নাই কখন সেই কঠিন সময় আসবে। অপ্রত্যাশিতভাবে হামলে পড়ে কঠিন সেই সব মহূর্ত। জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। তছনছ করে দেয় অনেক স্বপ্ন, আশা। অনেক মানুষ আছে যারা কঠিন পরিস্থিতিকে একদম সামাল দিতে পারে না, ভেঙ্গে পড়ে, ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায়। নিজের প্রতি বিশ্বাস, আস্থা হারিয়ে ফেলে। ভাবে তার জীবন শেষ হয়ে গেছে। সে আর কখনো বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবে না। দুর্বল মনের মানুষরাই বেশি ভোগে। ভয় ও শঙ্কা তাদেরকে ছেড়ে যায় না সহজে। আবার অনেক মানুষ আছে যে কেনো অবস্থায় শান্ত থাকতে পারে, যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে। দুঃখকে লুকিয়ে হাসিমুখে মানুষের সামনে হাজির হতে পারে। কখনোই নিজের কষ্টের কথা অন্যকে বলে ভারাক্রান্ত করে না। প্রতিটা মানুষের রয়েছে কিছু অজানা কষ্ট, দুঃখ আর শোক। তাই নিজের কষ্টের কথা অন্যকে বলে তাকেও শোকগ্রস্থ করতে চায় না। মানুষ নিজের কষ্টকে শেয়ার করতে চায়। নিজেকে তুলে ধরতে চায়। আমিও চাই।
অন্যদের মতো আমার জীবনেও অনেকবার কঠিন কঠিন সময় এসেছে। এমন সব অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত যা সামাল দেওয়া আমার জন্য কঠিন ছিল। সে সব মহূর্তে আমি ভিতরে ভিতরে অনেক ভেঙ্গে পড়েছি। একা একা কষ্ট ভোগ করেছি। সবসময় সব কথা শেয়ার করিনি অন্যের সাথে। কষ্ট একা একা ভোগ করতে হয়। সবাই কষ্টের অংশীদার হতে পারে না। হতে চায় না। সুখের অংশীদার আছে, দুঃখের নাই। দুঃখ কষ্টে যারা পাশে থাকে তারাই প্রকৃত মানুষ। আমি আসলে আবেগী মানুষ, দুর্বল চিত্তের মানুষ। এই ধরণের মানুষেরা সহজেই ভুল করে এবং সেই ভুলের জন্য তাদের খেসারত দিতে হয়। মানসিক বিপর্যয় ঘটে। পরিস্থিতিকে সহজে সামাল দিতে পারে না। পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে না। অনিশ্চিত শঙ্কার কথা ভেবে আতঙ্কগ্রস্থ হয়। তেমনি রোগে শোকেও ভেঙ্গে পড়ে, আস্থাহীনতায় ভোগে। রোগ শোক থেকে পরিত্রানের বড় উপায় হচ্ছে মনোবল। সেটা অনেকের থাকে না। অসুখে আমি ভেঙ্গে পড়ি। কাঁদি।
জীবনে কঠিন সময় আসে আবার এক সময় চলেও যায়। কিছুই নিরবচ্ছিন্ন নয় জীবনে। না সুখ, না দুঃখ। এটাই জীবন। মানুষ হয়ে জন্মানোর এটাই বৈশিষ্ট্য। মানুষকেই সব দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা, রোগ, শোক সহ্য করে বাঁচতে হয়। প্রতিটা মানুষ আলাদা, বৈশিষ্ট্য আলাদা, বর্ণ বিভায় আলাদা। প্রতিটা মানুষ এক একটা ভিন্ন একক। মানুষ এক অনন্য ক্ষমতার অধিকারী। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের রয়েছে অসীম ক্ষমতা। যে কোনো দৈব দূর্বিপাকে মানুষই টিকে থাকে। লড়াই করে টিকে থাকে যা সাগর পারি দেওয়ার সমান। সাফল্য, ব্যর্থতা, সুখ দুঃখ সবই মানুষের জন্য। মানুষই ভালবাসে কাছে টেনে নেয়, মানুষই একে অপরকে সাহস যোগায়, অনুপ্রাণিত করে। মানুষের সাহচর্য্য হচ্ছে স্বর্গীয় সুখের মতো। মানুষের সান্নিধ্যের চেয়ে মধুর আর কিছু হতে পারে না। মানুষ কষ্টকে জয় করতে পারে, দুঃখকে জয় করতে পারতে। রোগ শোক থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে তার প্রবল ইচ্ছা শক্তি দিয়ে। একজন যিনি আছেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী তিনি সব জানেন মানুষের ভাগ্য কোথায় কিভাবে নিহীত রয়েছে। সবকিছু তিনি নির্ধারণ করেন। সেই করুণাময়ের প্রতি নতজানু হয়েই সবকিছুকে জয় করা সম্ভব। দুঃখকে করা জয় সম্ভব, জ্বরাগ্রস্থতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা, শ্রদ্ধা, সহমর্মীতা এসবও অটুট আছে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। মানবজাতির এই দুর্যোগ, এই বিপর্যয় সাময়িক। পৃথিবীতে এর আগেও বড় বড় বিপর্যয় এসেছে। সে সব প্রতিকুলতার মধ্য দিয়েই মানব সভ্যতা এগিয়েছে। এবারও মানুষের জয় হবে। কিছু মানুষ থাকবে না এটা সত্যি। পৃথিবীর বাকী মানুষ ভালবাসায়, মমতায় বাঁচুক। কোনো দূর্বিপাকেই মানুষের শক্তিকে পরাভুত করা যায় না। মানুষেরই জয় হবে।
জসিম মল্লিক
টরন্টো, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০