টরেটক্কা টরন্টো – ইসলামোফোবিইয়া এবং সমকালীন বিশ্ব

জুন ১৯, ২০২০

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সিঙ্গাপুর ছেড়ে টরন্টো আসার প্রাক্কালে কানাডাতে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা আমার নজরে পড়ে। কিছুদিন পরে অভিবাসী হয়ে টরন্টোতে চলে যাচ্ছি বলেই বোধহয় সেই ঘটনাগুলো আমার বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। সেই ঘটনাগুলোর ভেতর দু’টোর কথা এখানে উল্লেখ করব। প্রথম ঘটনাটি বেশ উদ্বেগজনক যা ‘টরন্টো এইটিন’ নামে প্রচার পায় মিডিয়াতে। ২০০৬ সালের ২রা জুন গ্রেটার টরন্টো এরিয়া থেকে জঙ্গি তৎপরতামূলক পরিকল্পনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে চৌদ্দ জন পূর্ণ বয়স্ক যুবক ও চার জন কিশোর সহ মোট আঠারো জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের ঘটনার সাথে আমি কোথায় যেন সিঙ্গাপুর সরকারের ‘জেমা ইসলামিয়া’ গ্রুপের তেরো জন মালেয় সদস্যের গ্রেফতারের মিল খুঁজে পেলাম।
তবে দ্বিতীয় ঘটনাটি বেশ অভিনব। দ্বিতীয় ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েই শুরু করা যাক। নাইন ইলেভেনের পর দুনিয়া জুড়ে ইসলাম বিদ্বেষী সেন্টিমেন্ট যখন চরমে, ঠিক তখনই কানাডার ওন্টারিও প্রদেশের সরকার মুসলিমদের জন্য আলাদাভাবে শরীয়াহ আইন এবং শরীয়াহ ব্যাংকিং চালু করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য আলোচনার সূত্রপাত করে। এই আলোচনায় বিভিন্ন মুসলিম প্রতিনিধির মাঝে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হাসান মাহমুদের নাম দেখে কিছুটা অবাক হই। কারণ হাসান মাহমুদ ওরফে ‘ফতেহ মোল্লা’-কে আমি চিনি ‘মুক্তমনা’ প্ল্যাটফর্মের একজন লেখক হিসেবে। তিনি যে ‘মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেস’ নামক একটি সংগঠনের শরীয়াহ আইন বিশেষজ্ঞ সেটা আমার জানা ছিলো না। ২০০১ সালের নাইন ইলেভেনের ঘটনার পর পাকিস্থানী বংশোদ্ভূত তারিক ফাতাহ সমমনা আরও কয়েকজন কানাডিয়ান ‘লিবারেল’ এবং ‘সেকুলার’ মুসলিমকে নিয়ে গঠন করেন ‘মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেস’ যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে যে সরকার যাতে সকল রকম রাষ্ট্রীয় পলিসি থেকে ধর্মকে আলাদা করে রাখে সে ব্যাপারে নজর রাখা। স্বাভাবিকভাবেই এই গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে হাসান মাহমুদ ওন্টারিও সরকারের আয়োজিত এই আলোচনাতে শরীয়াহ আইনের বিপক্ষে তার জোরালো বক্তব্য রাখেন।
‘মুক্তমনা’ গ্রুপের লেখকেরা নিজেদেরকে নাস্তিক বলে জাহির করলেও ‘ফতেহ মোল্লা’ কখনও নিজেকে নাস্তিক বলে ঘোষণা দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে নাস্তিকতা প্রচারের আড়ালে মুক্তমনাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইসলাম ধর্মকে আক্রমণ করা। মনে হওয়ার সংগত কারণও অবশ্য রয়েছে। আমি যখন সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে ‘রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে কর্মরত তখন সেই ডিপার্টমেন্টে মাস্টার্স করতে আসা অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার পরিচয় হয়। তারপর আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই অভিজিৎ তার সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘মুক্তমনা’ নামক ই-মেইল গ্রুপে আমাকে যোগ করে নেয়। ফলে আমি ‘মুক্তমনা’র সদস্যদের আলোচনা আমার ই-মেইলে পেতে শুরু করি। স্বীকার করতে বাঁধা নেই যে এর আগে ধর্ম নিয়ে আমার তেমন কোন মাথা ব্যথা ছিল না। কিন্তু মুক্তমনাদের আলোচনা আমাকে আমার নিজ ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে জানার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে। আমি কোনভাবেই তাদের সাথে একমত হতে পারছিলাম না যে ইসলাম একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং এর অনুশাসন সমাজের জন্য বিষাক্ত। তখন একটি ঘটনা ঘটে যা আমাকে অভিজিৎ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পেতে সাহায্য করে। ঘটনাটি হলো, সেই সময় আমরা খবর পেলাম যে অভিজিতের স্ত্রী সাততলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। পুলিশী ঝামেলা মিটে যাওয়ার পর অভিজিৎ লাশ নিয়ে দেশে ফিরবে। স্ত্রীর লাশকে হিন্দু শাস্ত্রমতে সৎকার করার উপযোগী করে সে যখন দেশে যাচ্ছে, আমার কাছে ব্যাপারটা ঠিক পরিস্কার হচ্ছিল না। জিজ্ঞেস করাতে সে জবাব দিয়েছিল, ‘সে তো হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ছিল’। আমি অভিজিৎকে বলেছিলাম, ‘তুমি তোমার নিজের হিন্দু স্ত্রীকে নাস্তিক বানাতে পারোনি, অথচ মুসলমান ছেলেপেলেদের নাস্তিক বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছো, ব্যাপারটা কী?’ – সেদিন সে নিরুত্তর ছিলো, তবে মুক্তমনার মিশন সম্পর্কে আমার সংশয় কেটে গিয়েছিল তার সেই নীরবতায়। আমি তখন ‘সদালাপ’ নামক এক ওয়েব জার্নালে টুকটাক লেখালেখি শুরু করি এবং বিভিন্ন সময়ে মুক্তমনাদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ি। সেই মুক্তমনাতেই ‘ফতেহ মোল্লা’-র সাথে আমার প্রথম পরিচয় তার লেখার মাধ্যমে। তাই তার নতুন পরিচয় পেয়ে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। এবং একই সাথে অবাক হয়েছিলাম কানাডার মতন দেশের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার বক্তব্যের গুরুত্বের কথা চিন্তা করে। তবে সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছিলাম কানাডার মতন দেশে কেন মুসলমানদের জন্য আলাদাভাবে শরীয়াহ আইন চালু করার আলাপ শুরু হলো। আর শরীয়াহ আইন এবং শরীয়াহ ব্যাংকিং কেনই বা জরুরী?
২০০৬ সালের জুলাইয়ে টরন্টোতে এসে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়ে যখন চারিপাশের পৃথিবীর খবর নেয়া শুরু করেছি, দেখি নাইন-ইলেভেনের পাঁচ বছর পূর্তির দিনক্ষণ প্রায় সমাগত। সেই উপলক্ষ্যে প্রায় প্রতিদিনই টিভিতে বিশেষ আলোচনা কিংবা নিউজ পেপারে বিশেষ প্রতিবেদন চোখে পড়ছিল। পশ্চিমা বিশ্বের মূলস্রোতধারায় ইসলামকে সঠিকভাবে তুলে ধরাটাই একটি চ্যালেঞ্জ ছিল সেই সময়টায়। আর সেই কাজটাকে আরও বেশী চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছিল বেশ কিছু বিতর্কিত মুসলিম ব্যক্তিত্ব। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সালাউদ্দিন মসজিদের মিসরীয় বংশোদ্ভূত ইমাম আলী হিন্দি যার বিরুদ্ধে আইন বহির্ভূতভাবে ৩০টিরও বেশী ‘বহুবিবাহ’ পরিচালনার অভিযোগ ছিল। এছাড়াও তাঁর সাথে ওমর ক্বাদর পরিবারের বন্ধুত্বও তাঁকে বিতর্কিত করে তুলেছিল। ফলে ইমাম আলী হিন্দি যখন শরীয়াহ আইন প্রবর্তনের পক্ষে বক্তব্য দেন, সেটাকে অনেকেই ‘বহুবিবাহ’ প্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার প্রাথমিক ধাপ বলে ধরে নেন। আবার অন্যদিকে ‘মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ডিরেক্টর তারেক ফাতাহ-এর মতন ব্যক্তিত্ব যখন এই শরীয়াহ আইনের বিরোধিতা করেন, তখন অনেকেই ধরে নেন যে এই সুযোগে তিনি ইসলাম যে পশ্চিমা বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অচল ধর্ম সেটা প্রচার করার মিশনে নেমেছেন। অর্থাৎ শরীয়াহ আইনের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে সবারই কিছু এজেন্ডা ছিল। আর তাদের সেই এজেন্ডার সাথে সাধারণ কানাডিয়ান মুসলমান জনমতের সামঞ্জস্য ছিল কিনা সেই বিষয়ে আমি যথেষ্টই সন্দিহান ছিলাম এবং আজো আছি। তবে কানাডাতে কিছু সময় অতিবাহিত করার পর বুঝতে পেরেছিলাম যে শরিয়াহ আইন নয় বরং শরীয়াহ ব্যাংকিং-এর প্রবর্তন ছিল বেশী জরুরী। কারণ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এর যথাযথ রেগুলেশন না থাকায় এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী ‘হালাল মর্টগেজ’ কিংবা ‘হালাল ইনভেস্টমেন্ট’-এর নাম দিয়ে অনেক ধর্মপ্রাণ নিরীহ মুসলমানদের পথে বসিয়েছে। ২০০৮ সালের জানুয়ারীতে টরন্টো স্টার পত্রিকায় দেয়া এক ইন্টারভিউতে তারেক ফাতাহ শরীয়াহ ব্যাংকিং-কে ‘কন জব’ বলে অভিহিত করেন। তবে মজার ব্যাপার এই যে অচিরেই ‘দইউ এম ফাইন্যান্সিয়াল’ নামক একটি শরীয়াহ ভিত্তিক ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানী তার এই মন্তব্যকে সত্য প্রমাণ করে। এই কোম্পানী আগাম কোন ঘোষণা না দিয়েই তাদের হাজার হাজার গ্রাহককে পথে বসিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। কোম্পানীর সিইও ওমর কাহলিয়ার এবং প্রধান মুফতি পাঞ্চভাই-কে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে ভরলেও কানাডার প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত করা যায়নি বিধায় তারা পরবর্তীতে হাসতে হাসতে জেল থেকে বেড়িয়ে আসেন। তারা জেল থেকে ছাড়া পেলেও ‘ইসলাম’-কে দাঁড়াতে হয় কাঠগড়ায়। পশ্চিমা বিশ্বে কিভাবে সুদ বিহীন ব্যাংকিং সম্ভব তার কৈফিয়ত দেয়ার জন্য। একেক মুফতির একেক ফতোয়ার জেরে বিষয়টা এমনই জটিল আকার ধারণ করে যে এ ব্যাপারে অদ্যাবধি কোন ডেফিনেটিভ উত্তর পাওয়া যায়নি। কোন কোন মুফতি ‘জরুরত’-এর পরিপ্রেক্ষিতে কনভেনশনাল মর্টগেজের মাধ্যমে শুধুমাত্র নিজে বাস করার জন্য একটি বাড়ী কেনা জায়েজ বলে ফতোয়া দিলেও অন্যেরা তাতে দ্বিমত পোষণ করেছেন। আবার বাজারে প্রচলিত ‘হালাল মর্টগেজ’ সার্ভিসগুলিও বিভিন্ন কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা বাড়ী কেনা নিয়ে সামাজিক এবং ধর্মীয় এই দুই দিক থেকেই এক প্রকার জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন। যথা সময়ে এই হালাল মর্টগেজ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করার চেষ্টা করা হবে।

শরিয়াহ আইন নিয়ে বিতর্ক ছাড়াও এই সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও কিছু ঘটে ঘটনা কানাডার মিডিয়াগুলিতে গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হতে থাকে। এই ঘটনাগুলির মধ্যে ইসরাইল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ ছিল অন্যতম। চৌত্রিশ দিন ব্যাপী এই যুদ্ধ শুরু করে ইসরাইল, লেবাননের ভিতর গিয়ে আক্রমণ করে বসে হিজবুল্লাহ বাহিনীকে। কিন্তু ইরানের পরোক্ষ সহায়তায় হিজবুল্লাহ বেশ কড়া জবাব দিলে রণে ভঙ্গ দিয়ে ইসরাইল ‘ইউ এন’-এর মধ্যস্থতায় যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটায়। বাংলাদেশে আমরা ইসরাইলের এই রকম আগ্রাসনমূলক কর্মকান্ডকে প্রকাশ্যে নিন্দা জানাতে দ্বিধা বোধ করি না। আর আমাদের ঘরোয়া রাজনীতির সাথে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের কোন সম্পর্ক নেই। আমি সিঙ্গাপুরে
দীর্ঘদিন ছিলাম। সিঙ্গাপুরের সাথে ইসরাইলের সুসম্পর্কের কারণে এবং সিঙ্গাপুর তার নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের কারণে ইসরাইলকে সব সময়ই মরাল গ্রাউন্ডে সাপোর্ট করে যায়, তবে সেটা নিয়ে তাদের মিডিয়াতে তেমন কোন উচ্চবাচ্য নেই। কিন্তু কানাডাতে এসে দেখলাম ব্যাপারটা অন্য রকম। মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন ধরণের সংঘাতই অনেকটা তাদের ঘরের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ইসরাইল-হিজবুল্লাহ-র এই যুদ্ধে প্রায় পঞ্চাশ হাজার আরব বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক লেবাননে আটকা পড়ে যাদেরকে নিকটবর্তী নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য কানাডিয়ান সরকারকে সাধারণ নাগরিকদের দেয়া ট্যাক্স থেকে প্রায় পঁচাশি মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। আবার অপরদিকে থম ফারকাস নামক এক তরুণ ইসরাইলি বিমানসেনা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয় এই যুদ্ধে যিনি জন্মসূত্রে ছিলেন কানাডিয়ান। এই সংবাদটি যখন প্রায় সবক’টি নিউজপেপারের শিরোনাম হিসেবে পরিবেশিত হয় তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল যে এই যুদ্ধের উভয় পক্ষেই কানাডিয়ান নাগরিকরা অংশ নিচ্ছে। সেই বিচারে মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত নানাদিক থেকে কানাডার জন্য একটি জটিল সমীকরণ। আর কানাডার রাজনৈতিক দলগুলোকে এই জটিল সমীকরণের সমতা রক্ষার্থে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। সেই কৌশলের অংশ হিসেবেই ‘মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেস’ যদিও ইসরাইলের নীতিকে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিবিদ্বেষের সাথে তুলনা করে বিবৃতি দেয়, তবে ততোদিনে তারেক ফাতাহ এই সংঘটন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
‘মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেস’-এর সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে তার জীবন বিপন্ন, এই কারণ দেখিয়ে তারেক ফাতাহ এই প্রতিষ্ঠান থেকে রিজাইন করেন। ‘গ্লে­াব এন্ড মেইল’-এর এক প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে ‘কানাডিয়ান ইসলামিক কংগ্রেস’-এর ডিরেক্টর ডঃ মুহাম্মদ এলমাসরি তার ‘সিমারিং ইসলাম এন্ড ব্যাশিং মুসলিমস, হু এন্ড হোয়াই’ নামক আর্টিকেলে তারেক ফাতাহকে একজন ‘ইসলাম-বিরোধী’ ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই আর্টিকেলকে ‘ফতোয়া’র সাথে তুলনা করে তারেক ফাতাহ বলেন যে এর মাধ্যমে প্রচ্ছন্নভাবে ব্লাসফেমির দায়ে তার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়েছে। আর তাতেই তিনি ‘মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেস’ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও ‘কানাডিয়ান ইসলামিক কংগ্রেস’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদা ভ্যালিয়েন্ট বলেন যে ‘কানাডিয়ান ইসলামিক কংগ্রেস’ কোনভাবেই ফতোয়া জারীর সাথে জড়িত নয়, কারণ এটি কোন ‘রিলিজিয়াস বডি’ নয় বরং ইসলামের প্রতি তারেক ফাতাহর দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধের চাইতে ভিন্ন, ‘কানাডিয়ান ইসলামিক কংগ্রেস’ শুধু সেটাই উল্লেখ করতে চেয়েছে। এই সময়ে তারেক ফাতাহ কানাডার অন্যতম রাজনৈতিক দল এনডিপি-এর সাথে তার দীর্ঘ দিনের পলিটিক্যাল এফিলিয়েশন ছিন্ন করে যোগ দেন ‘লিবারেল পার্টি’তে। কারণ হিসেবে তিনি এনডিপি-কে ‘ফেইথ ককাস’ বলে উল্লেখ করেন। তবে পরবর্তীতে তিনি একই অভিযোগে অভিবাসী-বান্ধব ‘লিবারেল পার্টি’ ত্যাগ করেন। ২০১৫ সালে তিনি ‘টরন্টো সান’ পত্রিকাকে দেয়া এক ইন্টারভিউতে খোলাখুলিভাবে উল্লেখ করেন যে আসন্ন ফেডারেল নির্বাচনে তিনি ‘কনজারভেটিভ’ দলের নেতা স্টিভেন হারপারকে ভোট দিবেন। হারপারের কনজারভেটিভ দল ইসলামোফোবকে পুঁজি করে সেই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কৌশল অবলম্বন করলেও সেটাই অবশেষে তাদের জন্য হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী এক অধ্যায়ে এই নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
‘টরন্টো এইটিন’-এর গ্রেফতার, শরীয়াহ আইন নিয়ে মতভেদ, ইসরাইল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধে আটকে পড়া কানাডিয়ানদের নিয়ে উত্তেজনা – যখন এই ঘটনাগুলো ছিলো কানাডার প্রায় সব ধরণের মিডিয়ায় আলোচনার মূল বিষয়, ঠিক তখনই আরো একটি ঘটনা এসে যুক্ত হয় এর সাথে। সেটা ছিলো ‘মাহের আরার’-এর ঘটনা। সিরিয়ায় জন্ম নেয়া মাহের আরার তার বাবা-মার সাথে ১৭ বছর বয়সে কানাডাতে আসেন ১৯৮৭ সালে। স্বনামধন্য ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর এবং কুবেক ইউনিভার্সিটি থেকে টেলি-কমিউনিকেশনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তার স্ত্রী ম্যাকগিল থেকে ফিন্যান্সে পিএইচডি করেন। দুই সন্তানের জনক মাহের আরার ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিউনিস থেকে কানাডা ফেরার পথে আমেরিকার ‘জন এফ কেনেডি’ এয়ার পোর্টে মার্কিন সিকিউরিটির হাতে আল-কায়েদার সদস্য সন্দেহে আটক হন। সেখান থেকে তাকে সরাসরি সিরিয়াতে পাঠানো হয় যেখানে সিরিয়া সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অকথ্য অত্যাচার করে। দীর্ঘ এক বছরের মতন সময় ধরে টর্চার সেলে আটকে রেখে অবশেষে সিরিয়ার সরকার তাকে ‘নির্দোষ’ হিসেবে মুক্তি দিলে তিনি কানাডাতে ফিরে আসেন এবং তার এই অত্যাচারের পিছনে ‘আরসিএমপি’-এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। সেই তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর। ‘কানাডিয়ান কমিশন অব ইনকোয়ারী’ তার ফাইনাল রিপোর্টে পরিস্কার জানিয়ে দেয় যে মাহের আরার কোন ধরণের টেরোরিষ্ট সংগঠনের সাথে যুক্ত নন এবং কোনভাবেই কানাডার সিকিউরিটির জন্য বিপদজনক ব্যক্তি নন। এই রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয় যে কানাডিয়ান অফিসিয়ালরা তাদের মার্কিন কাউন্টারপার্টকে মাহের আরার সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রদান করেছিলো যার ফলে তাকে সিরিয়াতে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার কানাডা সরকারের ভূমিকার জন্য মাহের আরারের কাছে দাপ্তরিকভাবে ক্ষমা চান এবং তাকে প্রায় সাড়ে দশ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।
এই সব ডামাডোলের ভিতর দিয়ে পালিত হলো নাইন-ইলেভেনের পঞ্চম বার্ষিকী। তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এর কোন প্রভাব পড়েনি, শুধুমাত্র আমার সাত বছর বয়সী পুত্র এই প্রথম বুঝতে পারল যে এই দিনটি একটি বিশেষ দিন। সেটা যত না সিঙ্গাপুর থেকে টরন্টোতে আসার কারণে তার চাইতে বেশী তার বেড়ে উঠার কারণে। রূঢ় বাস্তবের মুখোশ আস্তে আস্তে উন্মোচিত হয় শিশুদের কাছে যখন তারা সময়ের হাত ধরে বড় হতে থাকে। তখন তাদের মনে অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় করে। বিশেষ করে যখন তারা স্কুলে যাওয়া শুরু করে, সেখানে যখন তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন কালচার, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন বর্ণ, ভিন্ন শ্রেণীর সহপাঠীদের সাথে, শিক্ষকদের সাথে। আমাদের উচিৎ তাদের সেই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর তাদের উপযোগী করে তাদের কাছে মেলে ধরা যাতে তারা সঠিক জ্ঞান নিয়ে বড় হতে পারে, কোনটি ন্যায় এবং কোনটি অন্যায় সেটা বুঝতে পারে। ফলে তারা যেন নিজেদেরকে শক্তভাবে তুলে ধরতে পারে এই সমাজে, মূলধারার যে কোন ধরণের ন্যারিটিভে নিজেদের অবস্থানকে করে তুলতে পারে গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য্য। আর এই প্রসঙ্গে ‘টরন্টো স্টার’ পত্রিকার স্বনামধন্য কলামিস্ট হারুন সিদ্দিকী ‘বিইং মুসলিমঃ এ গ্রাউন্ডওয়ার্ক গাইড’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন ২০০৬ সালে। এখানে তিনি কানাডিয়ান মুসলমানদেরকে কি কি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় এবং সেগুলোকে কীভাবে সামলানো উচিৎ সেই নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইটির আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিলো ভীষণভাবে সময়োপযোগী, ফলে প্রকাশের সাথে সাথেই বইটির পঁচিশ হাজার কপি বিক্রী হয়ে যায়।
নাইন-ইলেভেনের ঘটনার দশ বছর পরেও কানাডিয়ান মুসলিমদের জীবনে এর প্রভাব কতখানি বিদ্যমান সেটি তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফুয়াদ চৌধুরী ‘চেঞ্জ ইয়োর নেম, ওসামা’ নামে একটি ডকুমেন্টারি তৈরী করেন যা ‘ওমনি’ টিভি চ্যানেলে প্রদর্শীত হয়। তিনি এখানে সফলভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন যে অভিবাসী মুসলমানদের অনেকক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হতে হয় শুধুমাত্র তাদের মুসলমান পরিচয়ের জন্য। ফলে অভিবাসী তরুণ-তরুণীরা যারা এদেশে বড় হয়েছেন তাদের ভেতর অনেকেই তাদের ‘মুসলিম’ আইডেন্টিটি নিয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। মুসলমানদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ যা অস্বীকারের কোন উপায় নেই। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে কানাডাতে টিকে থাকার জন্য আমাদের চেয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য আরো বেশী চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। কারণ আমরা বড় হয়েছি এমন একটি দেশে যেখানে আমরা ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ, আর তারা বড় হবে এমন একটি দেশে যেখানে তারা সংখ্যালঘু। এই দুইয়ের মাঝে রয়েছে কিন্তু বিরাট ব্যবধান।

কাজী সাব্বির আহমেদ
টরন্টো