করোনা মহামারীর কবলে পুরা পৃথিবী আর আমাদের কোরাইন্টেনে থাকা জীবন
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
গৃহবন্ধী জীবন। কোয়ারেন্টাইন। আমি এই শব্দটার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের সময়। কোরাইন্টাইন শব্দটা এসেছে ইটালীয়ান শব্দ কোয়ারেন্টা শব্দ থেকে।
আজকের করনোর ভয়াবহতার মতন এমন ঘটনা পৃথিবীতে আগে দেখেনি কেউ। মানব জাতীর ইতিহাসে এমন দিনের ঘটনা কেউ শুনেনি। সমস্ত পৃথিবী আজ স্তব্দ, নি:শ্চল থমকে গেছে প্রাণচঞ্চল পৃথিবী। আমাদের ধরণীর প্রাণবন্ত ব্যস্ততম আনন্দ উৎসব মুখোরিত শহরগুলো আজ নিস্তব্ধ নিষ্প্রাণ আর প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি শুধু বেজেই চলেছে সবদিকে। তিন সপ্তাহের বেশী সময় ধরে কাজ কর্ম নেই। ১৬ই মার্চ,২০ সরকার জরুরী কর্ম প্রতিষ্ঠান ছাড়া সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। সেকারনে শুধুমাত্র জরুরী কাজে অথবা বাজারে যাওয়া ছাড়া বাইরে যাওয়া বন্ধ। টরোন্টোতে ইমারজেন্সি ঘোষনা করা হয়েছে দুই সপ্তাহ আগে। আমাদের জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অদ্ভুত এক অন্ধকার নেমেছে আমাদের সমস্ত গ্রহে। সমস্ত পৃথিবীজুড়ে শুধুমাত্র একটাই সংবাদ। শুধু একটাই সংবাদ। করোনাভাইরাস সংবাদ। সারাদিন রাত শুধু করোনা নিউজ রেডিও টিভি ফেসবুকে। সারাদিন রাত এই খবর দেখতে-দেখতে বলতে-বলতে আমরা যেন এই ভয়ংকর মহামারী সংকটে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি। ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। সবাই গৃহবন্দী। তাদেরও সময় কাটেনা। এই ঘর থেকে ওঘর, নীচে উপরে লেপটপে ফোনে তাদের ব্যস্ততা। দেশে ফোন করে একই কথা। করোনা মৃত্যু আশংকা নিয়ে উদ্বেগ ভয় ভীতি নিয়ে থাকে আলাপ উপদেশ। দেশে বিদেশে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব খবর নিয়ে একই উদ্বেগের কথা। সবাই সবাইকে ভাল থাকার কামনা।
গতকাল কথা হচ্ছিল এখানে অনুজপ্রতিম সাহেদের সাথে। অনেক দিন তার সাথে কথা হয়নি। সে জানাল তার এক বন্ধু ইটালীর মিলান থেকে ফোন করে জানিয়েছে সেখানকার ভয়াবহ জীবন মৃত্যুর কথা। সে বলল, সারা রাত ঘুমাতে পারিনা শুধু এম্বুলেন্সের কো-কো-কো সাইরেনের শব্দ। ভয়ে বুক ধরফর করে। এম্বুলেন্স সেকি ভয়ংকর আর্তনাদ নিয়ে গলিতে- গলিতে ঢুকছে কোন রোগী নিয়ে যেতে। কার যেন পাওয়া হল মৃত্যু সনদ। তার পর কার যাবার পালা। চারিদিকে শুধু মৃত্যুর আয়োজন জানালার ওপারে,রাস্তায় শহরে অলিতে গলিতে মৃত্যু শুধু মৃত্যুর ভয়াল থাবা। সীমান্তের ওপারে চলে যাবার বুঝি আমাদের সময়ের ব্যবধান মাত্র।
আজঅব্দি কানাডায় করোনা আক্রান্ত রুগী ১৭৭০০,
আর মৃত্যুর সংখা ৩৩৭। অন্টারিও প্রভিন্সে ৪৩৪৭ করোনা রুগী আর মৃত্যু সংখা ৩৭। টরোন্টোতে এই মৃত্যু সংখা ৩২। কারণ কানাডার এক তৃতীয়াংশ লোকের বসবাস এই প্রভিন্সে আর তার সিংহ ভাগই টরন্টোতে। পাশের দেশ আমেরিকা এখন করোনার ভয়ংকর থাবায় কাঁপছে, সম্পুর্ণ দিশেহারা। নিউইর্ক শহর আজ এক মৃতুপুরী। ঘন্টায় ঘন্টায় হাসপাতালে করোনা রুগীরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পরছে। ৮০ জন বাংগালী এপযর্ন্ত নিউইর্কে প্রাণ হারিয়েছেন। নিউইর্কে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের সাথে কথা হলে শুনা যায় তাদের মৃত্যু আতংকের কথা। ভয়াবহ মহামারীর কাছে নতজানু আসহায় মানুষের উৎকন্ঠা উদ্বেগের কথা। নিউইর্ক গভর্নর অসহায় দিশেহারা বিপর্যস্ত। হাসপাতালের পার্কিংলটে বড় বড় লরীতে তৈরী করা হয়েছে অস্থায়ী মর্গ। বৃহৎ যুদ্ধজাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে যার মধ্যে আছে চারহাজার শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। আজ পর্যন্ত প্রায় ৩৭০,০০০ রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। মৃত্যুর সংখা ১০ হাজার। চীনে রোগীর সংখা ৮০,০০০ এবং মৃত্যু সংখা ৪০০০। চীন ইউরোপ ছাড়িয়ে সর্ব উচ্চ সংখ্যক রোগী এখন আমেরিকায়। গত সপ্তাহ ইটালিতে ছিল মৃত্যুর মিছিল। আশি হাজারের বেশি রোগী সনাক্ত করেছে তারা। মৃত্যু সংখা ১৬,০০০। করোনা মহামারী চলছে স্পেনে, প্রাণ হারিয়েছে ১৩,০০০। ফ্রান্সে রোগী ৭৪,০০০ আর প্রাণ হারিয়েছে ৯০০০। প্যারিসে প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে পাঁচ ছয়শত নাগরিক। গত কয়েকদিন আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জাতীকে জানিয়েছেন এই করোনাভাইরাস
মহামারীতে ২০০,০০০-২৫০,০০০ আমেরিকানের প্রাণ হারানোর সম্ভবনা রয়েছে।
গতকাল করোনা ভাইরাসে প্রথম একজন বাংগালী মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন কানাডায়। কানাডা ভবিষ্যতবাণী করেছে ১০০,০০০-১৬০,০০০ লোকের মৃত্যু হতে পারে। গৃহবন্দী ,সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা এখন নতুন আইন। নিজেকে সুরক্ষা রাখা এবং অপরকে নিরাপদ রাখা এই আইনের মূল মন্ত্র।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডঐঙ) পৃথিবীব্যাপী কোরেইন্টাইন অবস্থায় ডমেস্টিক ভায়োলেন্সকে এক ভয়ংকর সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছে গতকাল। এটা এক ভয়ংকর সমস্যা ছড়িয়ে পরছে ঘরে ঘরে। ছোটখাট ব্যপার নিয়ে ছেলে মেয়ে গৃহিনীর সাথে ঝগড়া মন মালিন্য হাতাহাতি মারামারী এসকল সমস্যায় এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে লক্ষ-লক্ষ পরিবার পৃথিবীর দেশে-দেশে। এই ভয়াবহ অন্ধকার নৈরাশ্যজনক অবস্থা কবে অবসান হবে তা হলফ করে কেউ বলতে পারছেনা। বিশ্বের সকল বিজ্ঞানী দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করে এই ভায়াবহ রোগের প্রতিষেধক আবিস্কার করতে কাজ করে যাচ্ছেন। এবং তাদের ভবিষ্যতবাণী – আগামী এক দেড় বছর লেগে যেতে পারে এই রোগের ভেকসিন আবিস্কার করতে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের অনেকের এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যেতে হবে।
পৃথিবীর ইতিহাসে মহামারীর ইতিহাস লেখা রয়েছে যিশুক্রিস্টের পাচ শতাব্দী পূর্বে। তারপর জাস্টিনিয়ান প্লেগ ৫৪১ খৃস্টাব্দে বাইজান্টিইন (পূর্ব রোমান সম্রাজ্যে) ২০-১০০ মিলিয়ন প্রাণ কেড়ে নেয়। ব্ল্যাক ডেথ ১৩৪৭-১৩৫১
মধ্যযুগে সিল্ক রোড দিয়ে মোংগলীয়ান সৈন্যদের সাথে গিয়ে ছড়িয়ে পরেছিল সারা ইউরোপে। ইউরোশিয়া ইউরোপ মহাদেশে ৭৫-২০০ মিলিয়ন প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। মানব জাতির ইতিহাসে এক ভয়ংকর মহামারীর নাম ব্ল্যাক ডেথ। ১৬৬৫ হয় লন্ডনে ভয়ংকর প্লেগ। সেটাকে বলে গ্রেট লন্ডন প্লেগ। ১৭০০ শতাব্দীতে আমেরিকায় ফ্লু ইনফ্লোয়েঞ্জা চিকেন পক্সে প্রায় ২০ মিলিয়ন নেটিভ ইন্ডিয়ান মারা যায়। নেটিভরা সেটাকে বলে ওয়াইটমেন ডিজিস। ইউরোপিয়ানদের দ্বারা এই রোগ আসে নতুন মহাদেশ আমেরিকায়। ১৮৮৫ সালে বুবন প্লেগ ছড়িয়ে পরে চীনে সেখান থেকে ভারতে। মোট ১২ মিলিয়ন প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল সেই প্লেগ। ভারতেই মৃত্যু সংখা ছিল ১০ মিলিয়ন। ১৯১৮-১৯২০ সালে আসে স্পেনিস ফ্লু প্রাণ নিয়ে যায় প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইউরোপিয়ানদের।
তাই মহামারী অভিশাপ মানবজাতীর ইতিহাসের পাতায় পাতায়। কিন্তু এবারের করোনাভাইরাস প্রাকৃতিক না মানবসৃষ্ট সে নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পরা করোনাভাইরাস পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে আজ। এটা উহানের লেবেরটিরিতে তৈরী করা হয়েছে বলে আমেরিকা আংগুল তুলছে। যদি সেটা আসলেই সত্য বলে প্রমানিত হয়, তবে আমাদের পৃথিবী চীনা পরাশক্তির বিরুদ্ধে সম্মলিত ভাবে কি ভাবে গর্জে উঠবে আর পংগু বিপর্যস্ত ধসে পরা অর্থনীতি কিভাবে সামাল দিবে! এই এক মহা জটিল অংকের সমাধান করতে পশ্চিম বিশ্বের অবস্থা এক বিস্ময়কর গভীরতম অন্ধকার অবস্থায় গিয়ে ঠেকবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
আসুন আমরা পৃথিবীর ইতিহাসে এই ভয়ংকর দু:সময়ে সবাই নিজেকে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে সুরক্ষা করি এবং অপরকে নিরাপদ রাখি। আমাদের প্রাণপ্রিয় পৃথিবী আবার আলোজ্বলোমলে উৎসব আনন্দে সোনালী রোদের স্নানে খিল-খিল হাসিতে ভরে উঠুক সেই প্রার্থনা করি করজোড়ে নতজানু হয়ে সৃস্টিকর্তার কাছে। সবাই ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন পৃথিবীর যে যেখানেই আছেন এই কামনায়।
মোয়াজ্জেম খান মনসুর
টরন্টো কানাডা, ৬ই এপ্রিল, ২০২০