টরেটক্কা টরেন্টো – আগমন
মার্চ ১৩, ২০২০
কাজী সাব্বির আহমেদ
এই সময় আমার স্ত্রীর ভাষায় ‘দেবদূতের মতন আবির্ভূত’ হলো আমার আরেক বন্ধু গোলাম ফারুক। ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন সহপাঠী এই বন্ধুটি বেশ কয়েক বছর আগে টরন্টোতে এসেছে। সে আমাদেরকে নিয়ে গেলো শেপার্ড-বার্চমাউন্ট ইন্টারসেকশনের কাছে ক্যারাবব কোর্ট নামক স্থানে। নিরিবিলি একটা খোলামেলা কম্পাউন্ডের ভিতর পাঁচটি উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। বিল্ডিংগুলির মাঝে বাচ্চাদের খেলার পার্ক, আর বড় বড় গাছ গাছলি সহ খোলা সবুজ মাঠ। ইনডোর সুইমিংপুলের সুবিধা। এলিমেন্টারী স্কুল মিনিট তিন-চারেকের হাঁটা পথ। ওয়ালমার্ট, নো-ফ্রিলস, চাইনিজ গ্রোসারী, পাবলিক লাইব্রেরী, বাসস্টপ সবকিছুই হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক কিংবা তার চেয়েও কম দূরত্বে।
পাঁচটি বিল্ডিং-এর ভেতর প্রথম যে বিল্ডিং-এ গেলাম তার নাম্বার হচ্ছে ‘ফিফটি’। পার্ক প্রপার্টি নামক ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী এই বিল্ডিং সহ এখানকার আরো তিনটি বিল্ডিং পরিচালনা করে। সুপারের অ্যাসিস্টান্ট ভ্যানেসা আমাদেরকে নয় তলার দুই বেডরূমের একটা ফ্ল্যাট দেখাল। পুরানো দাগ পড়া কার্পেট, দেয়ালের রং উঠে গেছে, ফ্রিজ, ইলেকট্রিক কুকার সব কিছুই বেশ পুরানো। পছন্দ হওয়ার মতন তেমন কিছুই নেই, তবে ব্যালকনিটি বেশ পরিস্কার, আর সেখানে দাঁড়ালে বেশ খোলামেলা একটা ভিউ পাওয়া যায়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কথা মাথায় রেখে এবং এর চেয়ে ভালো কিছু কোথাও পাওয়া যাবে বলে ভরসা না হওয়াতে আমরা ভ্যানেসাকে বললাম যে আমাদের পছন্দ হয়েছে। কিভাবে ভাড়ার ব্যাপারে নেগোসিয়েশন করতে হবে সেই ব্যাপারে আমাদের বন্ধুটি আমাদেরকে কিছু টিপস দিয়ে দিল। সেই সূত্র ধরে কোন ‘ডিল’ আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই পেয়ে গেলাম প্রথম মাসের ভাড়া মওকুফের আশ্বাস। আর সেই সাথে প্রথম বছরের জন্য ফ্রি পার্কিং। যেহেতু গাড়ী নেই, তাই ফ্রি পার্কিং-এর সুবিধা আমাদেরকে তেমন খুশী করতে পারল না।
এরপর শুরু হলো পেপার ওয়ার্ক। যেহেতু আমার কোন জব নেই, সেই সাথে নেই কোন ক্রেডিট হিস্ট্রি তাই আমাকে বাড়ী ভাড়ার আবেদন করতে হবে একজন কো-অ্যাপ্লিক্যান্ট বা গ্যারান্টর কে সাথে নিয়ে। আর দিতে হবে পুরো বছরের ভাড়ার নিশ্চয়তা। প্রথম মাস আর শেষ মাসের ভাড়া দিতে হবে মানি অর্ডার-এর মাধ্যমে, বাকী দশ মাসের ভাড়া পোস্ট ডেটেড চেকের মাধ্যমে। আমার সেই বন্ধুটি নিজে থেকেই গ্যারান্টর হিসেবে তার নাম দিতে বললো। এই বন্ধুটিই দ’দিন আগে আমাকে টরন্টো-ডোমিনিয়ন বা সংক্ষেপে ‘টিডি’ ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে দিয়েছে। সাথে করে আনা দশ হাজার ডলার জমা করেছি সেই অ্যাকাউন্টে। ব্যাংক থেকে চারখানা সৌজন্যমূলক চেক দিয়েছে, আর বলে দিয়েছে আমাদেরকে আলাদা ভাবে চেক বইয়ের জন্য অর্ডার করতে হবে। সেই চেক বই কিছুতেই চার থেকে ছয় সপ্তাহের আগে আমার ঠিকানায় পৌঁছাবে না। চেক সংক্রান্ত জটিলতা ভ্যানেসাকে বলাতে সে রাজী হলো দশ মাসের বদলে চার মাসের পোস্ট ডেটেড চেক নিতে। অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম পূরণ করার দুই দিন পর ফোন করে জানতে পারলাম যে পার্ক প্রপার্টি আমাদের আবেদন অ্যাপ্রুভ করেছে, তবে দু’দিন পর অর্থাৎ জুলাই মাসের দশ তারিখে হাতে চাবি পাওয়া যাবে।
আমরা জুলাইয়ের ঠিক দশ তারিখে উইটবির সেই বন্ধুর বাসা থেকে আমাদের এই নতুন বাসায় এসে উঠলাম। সাথে সিঙ্গাপুর থেকে আনা ঢাউস সাইজের ছয়টি স্যুটকেস, গোটা কয়েক হ্যান্ড ব্যাগ আর দু’টো আইবিএম ল্যাপটপ। ফার্নিচার বিহীন এই ফ্লাটে আমাদের প্রথম রাত কাটলো লিভিং রূমের কার্পেটে বিছানার চাদর বিছিয়ে। মাথার নীচে অবশ্য বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে আনা বালিশ ছিলো। পরদিনই তোড়জোড় করে একটা ম্যাট্রেস কেনা হলো। দু’দিন পর আমার স্ত্রীর ছোটবোন অ্যাটলান্টা থেকে আমাদের দেখতে এলো। সাথে নিয়ে এলো রান্নাঘরের নানা সরঞ্জাম -বিভিন্ন আকারের সসপ্যান থেকে শুরু করে রাইস কুকার পর্যন্ত। প্রথমেই খাবারের ব্যবস্থাকে চালু করার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এর পর কেনা হলো ছয়টা চেয়ার সহ একটি ডাইনিং টেবিল। আমাদের এপার্টমেন্টের কাছেই কেনেডি রোডের উপর বেশ অনেকগুলি ফার্নিচারের দোকান। সেই দোকানগুলির একটি থেকে কেনা হলো এসব, তারাই বাসায় ডেলিভারি দিয়ে গেলো বাক্সে ভরা ডিসম্যান্টেল অবস্থায়। আমি আর আমার স্ত্রী মিলে ছবি মিলিয়ে মিলিয়ে সেগুলো জোড়া লাগালাম। পাশের ‘নো ফ্রিলস’ থেকে গ্রোসারী করে আমাদের রান্নাঘর চালু হয়ে গেলো বেশ তাড়াতড়ি। ইতিমধ্যেই জানালায় পর্দার বিকল্প হিসেবে বিছানার চাদর টানানো হয়েছে। স্যুটকেসগুলো খুলে প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় বের করা হলো, সিঙ্গাপুর থেকে আনা ল্যাপটপগুলির চার্জারের প্ল্যাগ বদল করে নর্থ আমেরিকান প্ল্যাগ জোগাড় করা হলো – এইভাবেই দুই তিনের ভেতর মোটামুটি একটা বাসযোগ্য অবস্থায় আনা হলো আমাদের ফ্ল্যাটটিকে।
টরন্টোতে আসার সাথে সাথেই আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই রজার্স কোম্পানীর সেল ফোন নিয়েছিলাম। আমাদের ক্রেডিট হিস্ট্রি না থাকায় এক বছরের জন্য ডিপোজিট রাখতে হয়েছিল একশত ডলার। মাসিক একটা নির্দিষ্ট ফি-এর বিনিময়ে কথা বলা যাবে দুইশত মিনিট, তবে সন্ধ্যা সাতটার পর, কিংবা উইক এন্ডে অথবা নিজেদের মাঝে কথা বললে মিনিট কাউন্ট হবে না। এটার নাম ‘ফ্যামিলি প্যাকেজ’। তিন বছরের চুক্তি, সাথে পুরানো মডেলের মটোরোলা ব্র্যান্ডের দু’টি ফোন পেলাম ফ্রি। ফোন হাতে পাওয়ার পর সবার সাথে আমাদের যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা হলো, কিন্তু কিছুদিনের ভেতরই টের পাওয়া গেলো যে এই দুইশত মিনিট কথা বলার জন্য খুবই অপ্রতুল। এই ‘ফ্যামিলি প্যাকেজ’ দীর্ঘ তিন বছর আমাদের গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিলো।
যোগাযোগের আরেকটি মাধ্যম হলো চিঠিপত্র। অ্যাপার্টমেন্টের লবিতে আমাদের লেটার বক্স। অধীর আগ্রহে আমরা আমাদের ব্যাংক স্টেটমেন্ট আর রজার্সের বিলের অপেক্ষায় আছি। এই দু’টি চিঠি পেলেই আমরা সেগুলোকে আমাদের টরন্টো ঠিকানার প্রমাণ স্বরূপ ব্যবহার করতে পারব বিভিন্ন সরকারী এজেন্সীর কাছে – যেমন স্কুল, লাইব্রেরী, স্বাস্থ্য দপ্তর, ইত্যাদি। প্রতিদিনই আমাদের লেটার বক্স ভরে থাকে বিভিন্ন ‘জাঙ্ক’ মেইল দিয়ে। সেই ‘জাঙ্ক’ মেইলের ভেতর পেলাম রজার্স কোম্পানীর ইন্টারনেট, হোমফোন আর ক্যাবল সার্ভিসের অফার। বিজ্ঞাপনে দেয়া নাম্বারে ফোন করতেই বিজ্ঞাপন দাতা এজেন্ট আমাদের ঠিকানা নিয়ে জানাল যে খুব শীঘ্রই টেকনিশিয়ান এসে সবকিছুর সংযোগ দিয়ে যাবে। কথা অনুসারে কাজ হলো। সেল ফোন, হোম ফোন, ইন্টারনেট আর ক্যাবল সার্ভিস -রজার্সের কাস্টমার সার্ভিসে ফোন দিয়ে এগুলোকে ‘বান্ডিল’ প্যাকেজে আনা হলো, ফলে মোট বিলের শতকরা পাঁচ ভাগ ছাড়। কিন্তু এই রজার্স তার বিলের ফাঁদে ফেলে আমাদের জীবনকে এক সময় বিষিয়ে তুললো। প্রায়ই আমাকে কাস্টমার সার্ভিসে ফোন করে ওদের পাঠানো অতিরিক্ত বিলের মুসাবিদা করতে হতো। আবার এই কাস্টমার সার্ভিসের লাইন পেতে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত।
রজার্সের ক্যাবল সার্ভিস নেয়ার আগেই অবশ্য আমরা ডিভিডি প্লেয়ার আর বত্রিশ ইঞ্চি একটা ‘সানিয়ো’ টিভি কিনেছিলাম। সন্ধ্যার পর যখন হাতে কোন কাজ থাকত না তখন সিঙ্গাপুর থেকে আনা বাংলা নাটকের কালেকশন নিয়ে বসতাম। একই নাটক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা হত অনেকবার। এই সময় সালাউদ্দিন লাভলুর ‘রঙের মানুষ’ আর হুমায়ূন আহমেদের ‘উড়ে যায় বক পক্ষী’ সিরিয়াল নাটক দু’টি দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। তবে একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছিলাম যে পরিচিত প্রায় সবার বাসাতে ডিভিডি প্লেয়ারের পাশাপাশি ভিসিআর সেটও আছে। এই যুগেও ভিসিআর ব্যবহারের কারণ হিসেবে জানতে পারলাম যে এখানকার জনপ্রিয় মুভি রেন্টাল ফ্র্যান্চাইস শপ ‘ব্লকব্লাস্টার’ থেকে ভিসিআর-এর ক্যাসেটে মুভি পাওয়া যায়। এখানকার পাবলিক লাইব্রেরী থেকে অবশ্য বইয়ের পাশাপাশি মুভিও ধার করা যায়, তবে সেখানে নতুন মুক্তি পাওয়া মুভির জন্য লম্বা লাইন পড়ে যায়। ‘ব্লকব্লাস্টার’ আমাকে ঢাকার ‘রোজ ভ্যালি’-এর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই এই ‘ব্লকব্লাস্টার’-কে অবশ্য ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে দেখেছি। ক্যাবল সার্ভিস আসার পর আমাদের সেই ‘সানিয়ো’ টিভিতে চালু হলো বিভিন্ন ক্যানাডিয়ান চ্যানেল। বেশীর ভাগ চ্যানেলেই দেখার মতন কিছু নাই। ‘সিপি টোয়ান্টি-ফোর’ নামক খবরের চ্যানেলে সারাক্ষণ ওয়েদার আর ওন্টারিও-তে সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখানো হচ্ছে। একই সাথে ওয়েদার আর লেটেস্ট খবর জানা যায় বলে টিভি চালু করলেই প্রথমে চোখ বুলিয়ে নেই এই চ্যানেলে। আমাদের সাত বছর বয়সী ছেলের জন্য রয়েছে শিশুতোষ কার্টুনে ভরা ‘ট্রী-হাউস’। এই চ্যানেলের কার্টুনগুলি সিলেক্ট করা হয় শিশুদের সুস্থ মানসিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখেই। কার্টুনের মাধ্যমেই শিশুদেরকে অনুপ্রাণিত করা হয় প্রকৃতিকে ভালবাসতে, সবকিছু সবার সাথে ভাগ করে উপভোগ করতে। আর এই সমাজে যে বিভিন্ন বর্ণের আর ধর্মের মানুষের বাস, সেই জ্ঞানের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। ছেলের সাথে কার্টুন দেখতে দেখতে আমরাও ভক্ত হয়ে গেলাম এই চ্যানেলের। একটা সময় আমার ছেলে ‘ট্রী-হাউজ’ দেখা বন্ধ করে দিয়ে ‘টিভিও কিডস’ চ্যানেল দেখা শুরু করল, কিন্তু আমি সেই ‘ট্রী-হাউজ’-এর ভক্তই রয়ে গেলাম। ট্রী-হাউজের বাইরে আরেকটা চ্যানেল দেখতাম সেটা ছিল একটা রান্নার চ্যানেল। কোন এক বিচিত্র কারণে আমি আকৃষ্ট হলাম ‘ফুড নেটওয়ার্ক’ নামক এই চ্যানেলে। সিঙ্গাপুরে থাকার সময় ‘জাপান আওয়ার’ আর ‘মাকান সূত্রা’ নামক দু’টি টিভি প্রোগ্রাম দেখতাম আগ্রহ নিয়ে। ‘জাপান আওয়ার’ ছিলো একজন ট্যুরিস্টের দৃষ্টিতে জাপানের বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যসহ সেখানকার খাবারের উপর ডকুমেন্টারী। বিভিন্ন এপিসোডে জাপানের বিভিন্ন স্থানের সৌন্দর্য্য দেখার আকর্ষণেই নিয়মিত দেখা হত এই অনুষ্ঠান। আর ‘মাকান সূত্রা’-তে দেখানো হত সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্টের খাবার দাবার। মালেয় ভাষায় ‘মাকান’ শব্দের অর্থ হলো ‘খাওয়া-দাওয়া’। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে সিঙ্গাপুরের এই দু’টি প্রোগ্রামের সাথে ‘ফুড নেটওয়ার্ক’-এর বেশ কিছু প্রোগ্রামের অনেকখানি সাদৃশ্য রয়েছে। হয়ত সেই কারণে আমার এই আকৃষ্ট হওয়া। সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট হলাম ‘রেস্টুরেন্ট মেইকওভার’ অনুষ্ঠানটির প্রতি। এক ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানে দেখানো হয় ব্যবসায়িকভাবে মার খাওয়া এক রেস্টুরেন্টকে কিভাবে আবার জনপ্রিয় করে তোলা হয়। শুরুতেই রেস্টুরেন্টের মালিক ‘রেস্টুরেন্ট মেইকওভার’ টিমের কাছে তার রেস্টুরেন্টকে সমর্পন করে চলে যান। তারপর একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার আর একজন সেফ-এর নেতৃত্বে শুরু হয় এই ভোল পাল্টে দেয়ার কাজ। প্রথমেই নির্দয়ভাবে ভাঙ্গা হয় ফার্নিচারসহ পুরান সব কাঠামো। এভাবে পুরো রেস্টুরেন্টের ‘টিয়ার ডাউন’ যখন কমপ্লিট, তখন মালিককে ডাকা হয়। অবস্থা দেখে মালিকের চক্ষু হয় ছানাবড়া। মালিককে আশ্বস্ত করা হয় যে খুব তাড়াতাড়ি সবকিছু ফিক্স করা হবে। নতুন ফার্নিচার দিয়ে ইন্টেরিয়র সাজানো হয়, ভেতরের কাঠামোও চেঞ্জ করা হয়। এরই মাঝে নতুন কিছু আইটেম শিখিয়ে দেয় রেস্টুরেন্টের পুরান সেফ-কে। তারপর আবার মালিককে আনা হয় চোখ বেঁধে। মালিক যখন চোখ খুলে তার প্রিয় রেস্টুরেন্টের নতুন রূপ দেখে তখন তার চোখ হয় আবার ছানাবড়া, তবে এবার খুশীতে। সেই খুশী দ্বিগুণ হয়ে যায় যখন তাকে নতুন আইটেমের খাবারগুলি পরিবেশন করা হয়। একই ফরম্যাটের প্রোগ্রাম – তারপরও এপিসোডের পর এপিসোড দেখে যাই আমি ক্লান্তিহীন ভাবে।
আমি টরন্টোর লোকাল নিউজ কিংবা কানাডার রাজনৈতিক খবরে মোটেই আগ্রহী ছিলাম না। আমার স্ত্রীর অবশ্য সেদিকে ছিলো সজাগ দৃষ্টি। কানাডার প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ, সেই দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের নাম-ধাম, আমাদের এলাকার কে এমপি, পার্লামেন্টে কী নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, এগুলো সবকিছুই ইতিমধ্যেই তার নখদর্পণে। সে যখন আমাদের প্রাইম মিনিস্টার বলতে স্টিভেন হারপারকে বুঝায়, আমি তখন বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বুঝি। কানাডার ব্যাপারে আমার এই নির্লিপ্ততার জন্য সে আমাকে প্রায়ই ভৎসর্না করত এই বলে যে, যে দেশে তুমি চিরদিনের জন্য থাকতে এসেছ সে দেশের কিসে ভালো কিসে মন্দ সেটার খোঁজ তুমি রাখবে না? যে খবরে আমি প্রথম নড়াচড়া দিয়ে উঠলাম কানাডার আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সেটা ছিল মন্ট্রিয়েলের ডসন কলেজের ম্যাস-শুটিং। কানাডাতে আসার প্রায় আড়াই মাস পরে অর্থাৎ ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে এই ঘটনা ঘটে। আমরা যারা বাংলাদেশ অথবা এশিয়া থেকে নর্থ আমেরিকাতে এসেছি তাদের কাছে এই ম্যাস-শুটিং-এর ব্যাপারটা কিছুটা অদ্ভুত ঠেকে। কারণ চেনা নেই জানা নেই অপরিচিত মানুষদের উপর তীব্র আক্রোশে নির্বিচারে গুলি করার যে কারণ থাকা দরকার, সেই কারণটার স্বরূপ কী এবং সেটাই বা কিভাবে হঠাৎ করে আপাত দৃষ্টিতে একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে এসে ভর করে, এই ব্যাপারগুলোর নিশ্চয় কোন ব্যাখ্যা আছে সংশ্লিষ্ট মনস্তাত্তিকবিদদের কাছে। আমাদের দেশে নৃশংস খুন খারাবী যে ঘটে না তা নয়, বরং অনেক তুচ্ছ কারণেই মানুষ মানুষকে খুন করে কিংবা ভাড়াটে খুনী দিয়ে খুন করায়। কিন্তু কোন কারণ ছাড়াই অন্যকে খুন করার ঘটনার সাথে আমরা পরিচিত নই। ডসন কলেজের ম্যাস শুটার কিমভীর গিল বেশ সময় নিয়েই এই সুইসাইড মিশনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। তার সাথে ‘বেরেট্টা সিএক্স ফোর ষ্ট্রর্ম সেমি অটোমেটিক কারবাইন’ রাইফেলসহ ছিল বেশ অনেকগুলো ফায়ার আর্মস। সে তার বাবা মার সাথে একই বাড়ীতে বাস করত, অথচ তারা এই প্রস্তুতি সম্পর্কে বিন্দু বিসর্গও জানতেন না। গিল প্রায় এক বছর ধরে বেকার ছিল। কিন্তু এই বেকারত্ব থেকে হতাশাই কি তাকে ঠেলে দিয়েছিল এই ম্যাস-শুটিং-এর মতন নৃশংস কর্মকান্ডে? আর সে কিভাবে সেমি অটোমেটিক অস্ত্র জোগাড় করতে পেরেছিল যখন এই প্রকার অস্ত্র কেনাটা ছিল রেস্ট্রিক্টেট? এই ঘটনার সূত্র ধরে জানতে পারলাম যে মন্ট্রিয়েলে এর আগেও এই ধরণের ম্যাস শুটিং-এর ঘটনা দু’বার ঘটেছিল। পত্রিকাতে এই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন মতামত প্রকাশিত হতে শুরু হল। সময়ের হাত ধরে আজ প্রায় চৌদ্দ বছর পরেও দেখছি ম্যাস-শুটিং কিংবা কিলিং নর্থ আমেরিকার একটি বড় সামাজিক সমস্যা। আমেরিকাতে বিগত ওবামা সরকার এই সমস্যার মূল কারণ স্বরূপ ‘গান পলিসি’কে চিহ্নিত করে তার সংস্কার আনার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তখন ন্যাশনাল রাইফেল এ্যাসোসিয়েশন কিংবা এনআরএ এই সংস্কারের তীব্র বিরোধিতা করে এবং ল-মেকার আর সিনেটরদের সাথে ‘লবি’ করে সেই সংস্কারের পথ রুদ্ধ করে দেয়। আর বর্তমানের ট্রাম্প সরকার তো বলতে গেলে এই এনআরএ-এরই অফিসিয়াল মুখপাত্র।
এই সময় আমরা সাপ্তাহিক এক ডলার অর্থাৎ মাসিক চার ডলারের বিনিময়ে ‘ডেইলি টরন্টো ষ্টার’ পত্রিকা রাখা শুরু করি। অথচ পত্রিকা স্ট্যান্ড থেকে কিনতে গেলে একেক কপির দাম ছিল তখন এক ডলারের উপর। বিকেল পাঁচটা কিংবা ছয়টার পর থেকে শুরু হত ডোর-টু-ডোর সেলসম্যানদের দরজায় নক, একেক জনের একেক ‘লাইন অব বিজিনেস’। কেঊ আসে আপনার ইলেকট্রিসিটির বিল কমানোর ডিল নিয়ে, কেউ বা আবার আপনার বর্তমান ক্যাবল/হোম ফোনের সার্ভিস প্ল্যান থেকে আরও সাশ্রয়ী প্ল্যানের অফার নিয়ে, কেউ বা আসে ফুড ব্যাংক বা হাসপাতালের জন্য ডোনেশন তুলতে। এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেককেই দেখেছি দরজায় ‘নো সলিসিটিং’ নোটিশ টাঙ্গিয়ে রাখতে। এ রকম একজন সেলসম্যানের মাধ্যমেই টরন্টো ষ্টার পত্রিকার গ্রাহক হই। প্রতিদিন সকালে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দরজার সামনে কেউ একজন দিয়ে যেত সেই পত্রিকা। এই পত্রিকার প্রখ্যাত কলাম লেখক হারুন সিদ্দিকির লেখার সাথে আগেই পরিচয় ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যমে, আর এখন থেকে তার লেখা একেবারে সরাসরি পড়তে পারব। প্রতি বুধবার তার কলামের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। হারুন সিদ্দিকির কলাম আমাকে এদেশের রাজনৈতিক পটভূমি এবং ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের একচোখা নীতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, যা পরবর্তীতে আমাকে এদেশের রাজনীতি সম্পর্কে গভীরভাবে আগ্রহী করে তুলে। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ, টরন্টো।