কানাডার চাকরীর বাজারে ওভারকোয়ালিফাইড ইমিগ্রেন্টরা ডিসকোয়ালিফাইড!
মার্চ ১৩, ২০২০
খুরশিদ আলম
কানাডার চাকরীর বাজারে দক্ষ ইমিগ্রেন্টরা ওভারকোয়ালিফাইড। আর সে কারণে তারা ডিসকোয়ালিফাইড! এই ডিসকোয়ালিফাইড ইমিগ্রেন্টদের শেষপর্যন্ত চাকরী মিলছে পিজ্জা ডেলিভারীতে নয়তো সিকিউরিটি গার্ড হিসাবে। কিংবা ঐ রকম নিন্ম আয়ের কোন চাকরীতে যেটা কানাডিয়ানরা করতে চান না।
কিন্তু ইমিগ্রেন্টরা ওভারকোয়ালিফাইড, শুধুমাত্র এ কারণেরই কি তারা নিজ পেশায় চাকরী পাচ্ছেন না? না। কথাটি সত্য নয়। কারণ আরো আছে। দেখা গেছে কানাডার অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা চাকরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশি বৈষম্যের শিকার হন। নয়টি দেশে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জনবল নিয়োগে বিদ্বেষের দিক থেকে কানাডা প্রায় শীর্ষে!
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী লিঙ্কন কুইলিয়ান ও তার সহকর্মীরা বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশের চাকরীদাতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের কিছু প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেন। নিয়োগের আগে সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় চাকরী প্রার্থীদের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করা হয় তা দেখার চেষ্টা করেন তারা।
তাদের গবেষণার ফলাফলে কেউই বিস্মিত হননি। তারা দেখেন, চাকরীর সাক্ষাৎকারের জন্য অশ্বেতাঙ্গ প্রার্থীরা শ্বেতাঙ্গ প্রার্থীদের সমান ডাক পান না। বর্ণভিত্তিক ও জাতিগত সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোর লোকেদের প্রতি প্রায় সর্বব্যাপ্ত বৈষম্য দেখা যায়। রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় হাফিংটন পোস্টে।
চাকরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা বৈষম্যের শিকার হবার সম্ভাবনার দিক থেকে কানাডা ও যুক্তরাজ্য যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে আছেন এবং এই দুই দেশে এর হার হলো ১১ শতাংশ। গবেষণায় দেখা যায়, আফ্রিকান, এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের বংশোদ্ভূত লোকেরা সমভাবে বৈষম্যের শিকার হন। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য খুবই কম এমনকি অনেক সময় তা পরিসংখ্যানে উল্লেখ করার মতও নয়।
কানাডার শ্রমবাজারে আফ্রিকান, এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের বংশোদ্ভূত লোকদের উল্লেখযোগ্য অংশ বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছেন এবং স্থানীয়দের চেয়ে মজুরিও কম পাচ্ছেন। গবেষকরা দেখেছেন বিদেশি দক্ষ ব্যক্তি যাদের নামের মধ্যে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় স্পষ্ট, চাকরীদাতারা তাদেরকে খুব কমই সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকেন। বিদেশি নামের চেয়ে ইংরেজি বিশেষত ইউরোপীয় নামের গন্ধ আছে এমন প্রার্থীদের বেশি মাত্রায় সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়।
দক্ষ ইমিগ্রেন্টদের প্রতি এই বৈষম্য তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে রেখেছে। আর এর প্রভাব পড়েছে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে। কারো কারো ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। আর চূড়ান্তভাবে এর প্রভাব পড়ছে কানাডার জাতীয় অর্থনীতিতেও। ইতিপূর্বে গ্রেটার টরন্টো অঞ্চলের ইউনাইটেড ওয়ে একটি উদ্বেগজনক রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে এমন বক্তব্য উঠে এসেছে যে, “আপনি কতদিন ধরে কানাডায় আছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়- বাস্তবতা এই যে, এখানে আপনার জন্ম না হয়ে থাকলে তার অর্থ হলো আপনি কম উপার্জন করবেন।”
রিপোর্টে আরো দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইমিগ্রেন্টরা আসলে আরও দরিদ্র হয়েছে এবং যারা ২০ বছরে বেশি সময় ধরে কানাডায় আছেন তেমন “দীর্ঘদিনের অধিবাসীদের গড় আয় গত ৩৫ বছরেও বাড়েনি।”
আমরা জানি, কানাডায় বেশিরভাগ নবাগত আসেন অর্থনৈতিক ইমিগ্রেন্ট হিসাবে। তারা সুদক্ষ এবং কাজ করতে আগ্রহী। তাদের উদ্দেশ্য থাকে কানাডায় নিজ নিজ পেশায় চাকরী করে একটি উন্নত জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সিংহভাগ ইমিগ্রেন্টই তাদের শিক্ষা, যোগ্যতা ও পোশাগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায় এমন কাজ খুঁজে পান না। ফলে তারা কেবল অস্তিত্ব রক্ষার মতো কাজে যোগ দিতে বাধ্য হন। ইউনাইটেড ওয়ে’র রিপোর্টে বলা হয়, এর ফলে আমাদের সবাইকে মূল্য দিতে হয়, বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী মেধা অন্বেষণের এই প্রতিযোগিতার সময়ে যখন কানাডার চাকরীদাতারা অব্যাহতভাবে দক্ষ জনবলের অভাবের মোকাবিলা করছেন। কানাডায় ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে আছেন এমন একজন অভিবাসী একই স্থায়ী চাকরিতে একই কাজ করে কানাডায় জন্মানো একজন নাগরিকের আয় করা প্রতি ডলারের বিপরীতে মাত্র ৬৭ সেন্ট আয় করবেন এটা হতে পারে না।
ইমিগ্রেন্টদের বিপদ এখানেই শেষ নয়। তাদের অনেকেই এমন সব চাকরীতে নিয়োজিত যে, সেই চাকরী সকালে থাকে তো বিকালে থাকার নিশ্চয়তা নেই। অর্থাৎ অনিশ্চিত চাকরী তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে এই দেশে আসার পর। একেতো চাকরী পেতে গিয়ে তাদেরকে বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয়, তার উপর কম বেতন এবং সেই সাথে নিশ্চয়তাহীন চাকরী।
কানাডিয়ান সেন্টার ফর পলিসি অরটারনেটিভ-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, কানাডার পেশাজীবীদের ২২ শতাংশই কোন না কোনও ধরণের অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে খন্ডকালীন চাকরি ও চুক্তিভিত্তিক কাজ। আর এক্ষেত্রে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অসমানুপাতিক হারে। সমীক্ষায় সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি উঠে এসেছে সেটি হলো পেশাজীবীদের নিরাপত্তা বোধের অভাব। অনিশ্চিত চাকরিতে কর্মরতদের মধ্যে ২৬ শতাংশের সার্বক্ষণিক কাজ রয়েছে, কিন্তু এসব চাকরিতে নিরাপত্তার রয়েছে অভাব এবং অসুস্থতাজনিত ছুটি বা পেনশনের মতো সুবিধাও নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই পেশাজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকই ইমিগ্রেন্ট। সেন্টার ফর পলিসি অরটারনেটিভ-এর সমীক্ষা থেকে আরো জানা যায়, সমস্যাটা যে কেবল ব্যক্তি খাতের চাকরিতে সীমাবদ্ধ তা নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে অনিশ্চিত চাকরির হার যে তিনটি খাতে সবচেয়ে বেশি তার দুই-তৃতীয়াংশই সরকারি খাতের। এই খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা যেখানে প্রতি পাঁচটি কাজের মধ্যে একটিতে এবং শিক্ষা খাত যেখানে প্রতি ১০ টি কাজের প্রায় তিনটিতে কোনও রকম নিশ্চয়তা নেই। সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ৫৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিরাই অনিশ্চিত চাকরির ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন। এসব মানুষ ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে এধরণের চাকরিতে নিয়োজিত রয়েছেন।
কানাডায় চাকরী ক্ষেত্রে ইমিগ্রেন্টদেরকে যে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের শিকার হতে হয় তার আরেক প্রমাণ হলো ‘কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স’ নামক উদ্ভট এক বুলি। দক্ষ ইমিগ্রেন্টদেরকে পেশাভিত্তিক চাকরী থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে এই কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স নামক বুলিটি ব্যবহার করেন অধিকাংশ চাকরীদাতা। লক্ষ লক্ষ পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টদেরকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে চাকরীর বাজারে কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স নেই এই অজুহাত তুলে। এটি ইমিগ্রেন্টদের শুধু অপমান বা অপদস্থ করা নয়, নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকারও লংঘন করা হচ্ছে কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স নামক ঐ বর্ণবাদী বুলির মাধ্যমে। অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনও এর নিন্দা জানিয়েছে এবং তাদের নতুন এক পলিসিতে এই অভিমত দিয়েছে যে এটি নিশ্চিতভাবেই ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকার লংঘন। কানাডায় অন্টারিও হিউম্যান রাইটস কমিশনই প্রথম সংগঠন যারা এই ধরণের একটি বক্তব্য দেয়।
আমরা জানি গত প্রায় দুই দশকের মধ্যে পৃথীবির বিভিন্ন দেশ থেকে থেকে প্রচুর সংখ্যক পেশাজীবী কানাডায় এসেছেন ইমিগ্রেন্ট হয়ে। আর এও জানি যে, এদের সিংহভাই চাকরী পাননি তাদের নিজ নিজ পেশায়। এই পেশাজীবীদের মধ্যে আছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানীসহ আরো নানান পেশার লোক। নিজ নিজ পেশায় চাকরী না পেয়ে তারা কেউ হয়েছেন পিজ্জা ডেলিভারী ম্যান, কেউ হয়েছেন ক্যাব ড্রাইভার, কেউ হয়েছেন মিল-ফ্যাক্টরীর দিন মজুর। সারাদিন হারভাঙ্গা পরিশ্রম করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলেনা। মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে বা অন্যান্য বিল পরিশোধ করতে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয়। পরের মাসে ঐ ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করতে গিয়ে আরেক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হয়।
কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স নামক বুলিটি যে কতটা অসভ্য রকমের আচরণ তা প্রতিটি ইমিগ্রেন্টই আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ‘কানাডা ইজ এ ল্যন্ড অব অপরচিউনিটি’। ‘ধন দৌলত, সুখ শান্তি, নিরাপত্তা, দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন ইত্যাদি সবই আছে কানাডায়। আছে আরো অনেক কিছু। একবার শুধু কানাডায় পৌঁছাতে পারলেই হয়। আর পিছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন নেই। শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া।’ যারা কানাডায় আসতে চান ইমিগ্রেন্ট হয়ে – এই হলো কানাডা সম্পর্কে তাদের ধারণা। এই ধারণা তারা নিজের মন থেকে যে তৈরী করেন তা কিন্তু নয়। তাদেরকে এই স্বপ্ন দেখানো হয়। আর সেই স্বপ্নে বিভোর হয়েই অধিকাংশ লোক কানাডায় আসেন ইমিগ্রেন্ট হয়ে। দেশের মায়া, বাবা-মা, ভাই -বোন, আত্মীয়-বন্ধুদের মায়া ত্যাগ করে চলে আসেন সুদূর এই বৈরী আবহাওয়ার দেশ কানাডায়।
গত সপ্তাহে টরন্টোর বাংলাদেশ সেন্টারে আয়োজিত একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অধ্যাপক ড. তাজ হাশমী বলেন, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আপনার কি কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স আছে? তখন উল্টো তাকেই প্রশ্ন করতে হবে এই বলে যে, আপনার দাদা বা তারো আগের কেউ যখন এই দেশে এসেছিলেন তখন কি উনার কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স ছিল? কানাডা যেমন আপনার পূর্বপূরুষের জন্য এলিয়েন ল্যান্ড ছিল তেমনি আমার জন্যও এটি এলিয়েন ল্যান্ড। কানাডা যেমন আপনার দেশ, তেমনি এটি আমারও দেশ। এই কথাগুলো তিনি বলেছেন নিজ অভিজ্ঞতা ও ক্ষোভ থেকেই। বিভিন্ন দেশের অনেক নামকরা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেও তিনি কানাডায় এসে এরকম প্রশ্নের মুখমুখি হয়েছিলেন।
ইমিগ্রেন্টরা যদি এখানকার চাকরীতে প্রবশে করার সুযোগই না পান তবে কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স কোথা থেকে পাবেন? কানাডায় আসা একজন নতুন পেশাজীবী ইমিগ্রেন্টের কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স নেই একথা সবাই জানেন। কিন্তু তারপরও তাদের কাছে কোন যুক্তিতে এবং কোন রহস্যজনক কারণে কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স চাওয়া হয়?
উত্তর একটাই। সেটি হলো বর্ণবাদ। ইমিগ্রেন্টদের ভাষা, তাদের গাত্র বর্ণ, এথনিসিটি, ধর্ম এ সবই ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে চাকরী না পাওয়ার পিছনে বা ইন্টারভিউতে না ডাক না পাওয়ার পিছনে। এর মাধ্যমে কানাডিয়ান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ইমিগ্রেন্টদের মানবাধিকার লংঘন করছে। তাদেরকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসেবে গন্য করা হচ্ছে। এমন কি যে সকল পেশাজীবী ইমিগ্রেন্ট কানাডায় এসে তাদের ডিগ্রি আপগ্রেড করেছেন বা নতুন কোন বিষয়ে ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা নিয়েছেন তাদেরকেও পেশাভিত্তিক চাকরী থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে ঐ কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স নামক উদ্ভট বুলির দোহাই দিয়ে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে সকল অশ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিগ্রি ও দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞাতা নিয়ে কানাডায় এসেছেন তাদেরকেও কানাডিয়ান এক্সপিরিয়েন্স নেই এই অজুহাত দেখিয়ে পেশাভিত্তিক চাকুরীর বাজারে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
কানাডার রয়েল ব্যাংক পরিচালিত স¤প্রতিক এক গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে, কানাডায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আসা উচ্চ শিক্ষিত এবং দক্ষ ইমিগ্রেন্টদের যথাযোগ্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না আমাদের শ্রমবাজার। তারা এখনও কানাডায় জন্মানো শ্রমিকদের চেয়ে গড়ে ১০ শতাংশ কম অর্থ আয় করছেন।
ঐ গবেষণায় আরো বলা হয়, ইমিগ্রেন্টদের বেতনের ক্ষেত্রে ব্যবধান অনেক ব্যাপক এবং তা দীর্ঘ সময় ধরেই বিদ্যমান। গত তিন দশক ধরে এটি আরও বিস্তৃত হয়েছে। জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইমিগ্রেন্টের অনুপাত যে দেশে সেই দেশের জন্য এটি এক সতর্কবার্তা। বর্তমানে কানাডার মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ ইমিগ্রেন্ট। এই সংখ্যা ২০৩৬ সালের মধ্যে ২৮ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী যেসব ইমিগ্রেন্ট স¤প্রতি কানাডায় আসছেন তারা চাকরীর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে আসা ইমিগ্রেন্টদের চেয়ে বেশি শিক্ষিত। ঐ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত ১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষালাভকারী যেসব ইমিগ্রেন্ট কানাডায় এসেছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৩৫ ভাগেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা তাদের চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার চেয়ে বেশি। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সূত্র উল্লেখ করে আইপলিটিক্স.সিএ-এই তথ্য জানায়।
পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, কানাডায় কোয়ালিফাইড বা ওভারকোয়ালিফাইড ইমিগ্রেন্টদের সিংহভাগই তাদের নিজ নিজ পেশায় প্রবেশের জন্য ডিসকোলিফাইড হয়ে গেছেন! চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিরা তাই মনে করছেন। এদের কাছে ইমিগ্রেন্টদের এথনিসিটি বা গায়ের রং অথবা ধর্মবিশ্বাস পছন্দ নয়! তারা আগে থেকেই ধারণা করে বসে থাকেন যে, এই ইমিগ্রেন্টদের দিয়ে কাজ হবে না। এরা দক্ষ কর্মী নন, এদের ভাষার সমস্যা রয়েছে, এরা দেখতে সুবিধার নয়। এরা কদিন পর পরই দেশে যাবেন, লম্বা ছুটির জন্য আবেদন করবেন।
এখন ইমিগ্রেন্টদের প্রতি এদের এই ইউটোপিয়ান বা আজগুবি ধারণা ভাঙ্গাবে কে? ইমিগ্রেন্টদের প্রতি তাদের এই অবাস্তব ধারণার কারণে কানাডার ইকনমিও যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাই বা কে বোঝাবে তাদেরকে? আমরা জানি, ইমিগ্রেন্ট বিরোধী একটি চক্র সর্বদাই সক্রিয় এদেশে। চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীল এই মহলটি বরাবরই নানান কৌশলে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে আসছে কানাডায়। প্রকাশ্যে তারা বিষয়টি স্বীকার করেন না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা এই কাজটিই অতি সুু²ভাবে করে থাকেন। কানাডার ‘ফ্রেজার ইনস্টিটিউট’ এরকম একটি চরম ডানপন্থী প্রতিষ্ঠান যারা মূলত কর্পোরেট প্রচারণার কৌশলের মাধ্যমে এখানকার ইমিগ্রেন্ট বিরোধী রক্ষণশীল গোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষা করে। খুঁজলে এরকম প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠি আরো পাওয়া যাবে। এমনকি সরকারের ভিতরও সক্রিয় এ গোষ্ঠিটি। ইমিগ্রেন্টরা যাতে এদেশে দ্বিতীয়শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকেন অথবা অর্থনৈতিকভাবে যাতে তারা সচ্ছল হয়ে উঠতে না পারেন সে জন্য তারা নানাভাবে ইমিগ্রেন্টবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন।
আমরা জানি কানাডায় সবচেয়ে বেশী ইমিগ্রেন্ট আসেন অন্টারিও প্রভিন্সে। কিন্তু এখানকার শ্রমআইনটি করে রাখা হয়েছে মালিকবান্ধব। অন্টারিওতে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের কর্মীদেরকে উপযুক্ত বেতন দিচ্ছেন না, দিচ্ছেন না ভেকেশন পে এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধাও। ফলে এই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীগণ বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের পাওনা অধিকার থেকে এবং একই সাথে বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের মৌলিক অধিকার থেকেও। অন্টারিওর এমপ্লয়মেন্ট স্ট্যান্ডার্ডস এ্যক্ট এন্ড দি লেবার রিলেশনস এ্যক্ট এর পর্যালোচনার পর দুই সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল এই অভিমত প্রকাশ করেন সম্প্রতি। কানাডিয়ান প্রেস এই খবরটি প্রকাশ করে ইতিপূর্বে।
আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক টরন্টোবাসীর জন্যই স্বল্প বেতন ও অনিশ্চিত কর্মসংস্থানের বিষয়টি দ্রুত জীবনধারার অংশ হয়ে উঠছে। এক হিসাবে দেখা গেছে টরন্টো ও তার আশপাশের ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের চাকরির ক্ষেত্রে কোন না কোন ধরনের অনিশ্চয়তায় ভোগেন। আর ঝুঁকিতে থাকা সেইসব লোকেদের বেশিরভাগেরই নির্দিষ্ট পরিচিতি রয়েছে: তারা হলেন ইমিগ্রেন্ট।
এই পরিস্থিতি সুদীর্ঘ সময় ধরেই চলছে কানাডায়। ফলে উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ ইমিগ্রেন্টরা তাদের সর্ব্বোচ্চ অবদান রাখতে পারছেন না এ দেশের অর্থনীতিতে। অন্যদিকে কানাডার অর্থনীতিও বঞ্চিত হচ্ছে তার পাওনা থেকে। আমরা মনে করি দ্রুত এই অবস্থার অবসান হওয়া উচিত সকলের স্বার্থেই। আর সেটা সম্ভব ইমিগ্রেন্টদের শিক্ষা ও কর্মদক্ষতাকে যদি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়। তাদেরকে ডিসকোয়ালিফাইড করে নয়।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ