কানাডায় বাল্যবিয়ে বৈধ!
জানুয়ারী ১০, ২০২০
খুরশিদ আলম
অবাক হওয়ার মতই তথ্য! পৃথিবীর অনেক পশ্চৎপদ দেশে যখন বাল্যবিয়ে অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তখন কানাডার মত এরকম একটি উন্নত ও আধুনিক দেশে বাল্যবিয়ের রীতি এখনো বলবৎ রয়েছে!
আর কৌতুহলের বিষয় হলো, নিজ দেশে বাল্যবিয়ের রীতি অব্যাহত থাকলেও কানাডা পৃথিবীর বিভিন্ন অনুন্নত দেশে বাল্যবিয়ে নির্মূল কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে আসছে। বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য জাতিসংঘের যে প্রচেষ্টা চলছে তাতে প্রধান তহবিল প্রদানকরী দেশও কানাডা।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত ১৮ বছরে কানাডার বিভিন্ন প্রভিন্সে ৩,৩৮২টি বাল্যবিয়ের অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্টারিওতে প্রদান করা হয়েছে সবচেয়ে বেশী। গত ১৮ বছরে ১,৩৫৩টি বাল্যবিয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে এই প্রভিন্সে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে আলবার্টা। সেখানে ৭৯১টি বাল্যবিয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কুইবেকে দেয়া হয়েছে ৫৯০টি এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় দেয়া হয়েছে ৪২৯টি। আর কানাডায় বালকদের তুলনায় বালিকারাই এই বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে বেশী। এবং বালিকাদেরকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের বয়সের তুলনায় অনেক বেশী বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গে। এ সকল তথ্য উঠে এসেছে ম্যাক্গিল ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজি, বায়োস্ট্যাটিস্ক ও অকুপেশন্যাল হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপিকা এ্যালিসা কসকী কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণা কর্মে। তিনি বলেন, বাল্যবিয়ের যে সংখ্যার কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে আরো বেশী হতে পারে। খবরটি প্রকাশিত হয় ন্যাশনাল পোষ্ট পত্রিকায়।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বাল্যবিয়ে যে ঘটনা ঘটে তার প্রায় কোনটাই কানাডার আইনে রেজিস্ট্রি করা হয় না। অন্যদিকে এক স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় অন্য মহিলাকে বিয়ে করার যে সকল ঘটনা ঘটে সেটাও কানাডার আইনে রেজিস্ট্রি করা হয় না। কারণ, সেটি অবৈধ এখানকার আইনে। তবে কানাডীয় আইনে এক স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় কোন পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করতে না পারলেও ইসলামী আইনে একজন পুরুষ তা পারেন কতিপয় শর্ত মেনে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কানাডার মুসলিম কমিউনিটিতে কেউ কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করছেন প্রথম স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায়ই। কিন্তু তা করছেন ইসলামী শর্ত না মেনে। এবং একই সঙ্গে কানাডার আইন ভঙ্গ করে। ৫ বছরের জেল হতে পারে জেনেও অনেকেই প্রথম স্ত্রীর অমতে দ্বিতীয় বিয়ে করছেন।
যারা এক স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে করছেন তারা মনে করছেন এটি তাদের ধর্মীয় অধিকার। তারা কানাডার আইন এবং একই সঙ্গে ইসলামী আইনও ভঙ্গ করছেন এ কথা স্বীকার করতে রাজী নন। এদের মধ্যে কয়েকজন ইমাম-ও আছেন। আর এরা নিজেরাই যে শুধু দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে করছেন তা নয়, সাধারণ কোন মুসলিম দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে করতে চাইলে তাকেও নানানভাবে সহায়তা করছেন। কেউ কেউ এমন পরামর্শও দিচ্ছেন যে, ‘পারিবারিক শান্তি’ বজায় রাখার প্রয়োজনে প্রথম স্ত্রীর কাছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ের ঘটনা গোপন রাখা অন্যায় নয়!
টরন্টো সান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডায় বহুবিয়ে বেআইনী হলেও অন্টারিওতে কেউ কেউ একাধিক স্ত্রীর জন্য সরকারী ভাতা নিচ্ছেন। কোন কোন ব্যক্তি চার স্ত্রীর জন্য ওয়েলফেয়ার মানি পাচ্ছেন। কানাডিয়ান সোসাইটি অব মুসলিমস এর প্রেসিডেন্ট মমতাজ আলী টরন্টো সান-কে বলেন, শত শত মুসলিম একাধিক স্ত্রীর জন্য ওয়েলফেয়ার মানি সংগ্রহ করছেন অন্টারিওতে।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় মুসলিম সম্প্রদায় ছাড়াও খ্রীষ্টান ধর্মালম্বীদের মধ্যে একটি গোড়া সম্প্রদায় আছেন যারা একাধিক বিয়ে করে থাকেন। বছর দুই আগে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সুপ্রিমকোর্ট ৬০ বছর বয়সী উইনস্টন ব্ল্যাকমোর এবং ৫৩ বছর বয়সী জেমস ওলারকে বহুবিয়ের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। ব্ল্যাকমোর একই সময়ে ২৫ নারীকে বিয়ে করেছেন আর তার ১৪০ সন্তান রয়েছে। আর ওলার করেছেন ৫ নারীকে। তারা দু’জনই বাউন্টিফুলের একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন। ব্ল্যাকমোর ও ওলার ‘লেটার ডে সেইন্টস’ নামের গোড়া খ্রিস্টানদের একটি শাখার অনুসারী, যেখানে বহু বিয়ে বৈধ। এদের প্রধান ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ-অ্যারিজোনা সীমান্তে। ব্ল্যাকমোর দাবী করেন ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে তিনি এতগুলো স্ত্রী রেখেছেন।
সিবিসি নিউজ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডায় এক শ্রেণীর ইমাম আছেন যারা দ্বিতীয় বিয়েতে ইচ্ছুক মুসলিম পুরুষদেরকে বিয়ের কাগজপত্র তৈরী করে দেন। তবে এসকল বিয়ের কোনটাই কানাডার আইনে রেজিস্ট্রি করা হয় না। ফলে কেউ যদি এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তখন কানাডার আইন কিছুই করতে পারে না। কারণ, বিয়ের কোন কাগুজে প্রমাণ নেই।
এই ইমামদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কতটা সত্য তা জানার জন্য সিবিসি কয়েকজন পুরুষকে গুপ্তচর হিসাবে তাদের কাছে পাঠিয়েছিল। ঐ ইমামদের কাছে গিয়ে তারা দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করলে দুইজন তা করতে অস্বীকৃতি জানান, তবে অন্য দুইজন রাজী হন এবং ছদ্দবেশী ঐ পুরুষদেরকে অভিনন্দন জানান দ্বিতীয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। এই দুইজন ইমাম জানান, টরন্টোতে আরো কয়েকজন আছেন যারা এ কাজে সহায়তা প্রদান করে থাকেন। দ্বিতীয় বিয়ের কাগজপত্র তৈরীর জন্য তারা ফি নিয়ে থাকেন বিয়েপ্রতি ৪৫০ ডলার করে। তবে আলী হিন্ডি নামের একজন ইমাম আছেন যিনি মাত্র ২০০ ডলারেই তা করে দেন। ইনি টরন্টোর সালাহউদ্দিন মসজিদের ইমাম। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে যাই হোক না কেন, তার ফি ২০০ ডলার। এমনকি সাক্ষীও তিনি যোগাড় করে দেন। ইসলামী আইনে বিয়ে পড়ানোর জন্য দুইজন সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। আলী হিন্ডি ছদ্দবেশী রিপোর্টারকে আরো জানান, কানাডার আইনে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে নিষিদ্ধ হলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ এই বিয়ে সরকারী কোন অফিসে রেজিস্ট্রি করা হবে না। সরকারী অফিসে রেজিস্ট্রি করতে গেলেই ঝামেলা হবে।
উল্লেখ্য যে, যারা বহুবিয়ে করেন তাদের পছন্দের তালিকায় প্রায়শই অপ্রাপ্তবয়স্ক কনে থাকে। এসকল ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয় যে কানাডায় মুসলিম কমিউনিটিতে সব বিয়ে সরকারী খাতায় রেজিস্ট্রি হয় না। সুতরাং ম্যাক্গিল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপিকা এ্যালিসা কসকী কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা কর্মে বাল্যবিয়ের যে সংখ্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃত সংখ্যা যে তার চেয়ে বেশী সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া, এই বাল্যবিয়ের অনেকগুলো ঘটে কানাডার বাইরে। অর্থাৎ অপ্রাপ্তবয়স্ক পাত্র বিশেষ করে পাত্রীদেরকে বিয়ে দেয়ার জন্য অনেক সময় নিয়ে যাওয়া হয়ে তারা যে দেশ থেকে এসেছে সেই দেশে। আর এসব বিয়ের প্রায় সবগুলোই দেয়া হয় জোর করে।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, কানাডায় জোর করে বিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে কোন আইন নেই। জোর করে বিয়ে দেয়া হলে কেউ যদি আদালতের স্মরণাপন্ন হন তাহলে সেই বিয়ে অকার্যকর করার সুযোগ রয়েছে বটে কিন্তু যিনি জোর করে বিয়ে দেয়ার জন্য দায়ী তাকে জেলে পাঠানোর কোনও সুযোগ নেই এখানে। জোর করে বিয়ে দেয়ার ঘটনা তখনই ঘটে যখন পাত্র-পাত্রীর মধ্যে একজন অথবা উভয়েই বিয়েতে সম্মতি না দেন অথবা যখন তৃতীয় কেউ, সাধারণত পরিবারের কোনও সদস্য শারীরিকভাবে বা মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করেন।
অন্টারিওর কিংস্টোনে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পারিবারিক আইন বিষয়ের অধ্যাপক নিকোলাস বালা সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘‘এই দেশে এটি অবশ্যই একটি উদ্বেগের বিষয়। এটি একটি সমস্যা এবং খুবই বেদনাদায়ক সমস্যা। তবে এটির ব্যাপ্তি কতটা তা আমরা জানি না।’’
উল্লেখ্য যে, বাল্যবিয়ের প্রায় শতভাগই দেয়া হয় জোরপূর্বক। কোন মেয়েই অপরিণত বয়সে বিয়েতে রাজী হয় না। কিন্তু পারিবারিক সম্মান, ধর্ম বা ইমিগ্রেশনের দোহাই দিয়ে তাদেরকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। সম্প্রতি বলপূর্বক বিয়ের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে এখানকার সাউথ এশিয়ান লিগাল ক্লিনিক অব ওন্টারিও। তাদের ঐ প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায় ২০১০ থেকে ২০১২ সাল এই দুই বছরে ওন্টারিওতে দুই শতাধিক নারীকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছে। সংস্থাটি ঐ দুই বছরে ২১৯টি বলপূর্বক বিয়ের ঘটনার কথা জানতে পারে। তাদের তথ্যে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৯৭ শতাংশই ছিল নারী। যারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন তাদের মধ্যে ৮১ শতাংশের বয়স ছিল ১৬ থেকে ৩৪ বছর। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, দাদা-দাদি, নানা-নানি এবং ধর্মীয় নেতারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করার জন্য চাপ দেন। এখানে লক্ষ্যণীয় যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা বলপূর্বক বিয়ের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে নারী সদস্য অর্থাৎ মা, বোন, দাদি ও নানিরাও আছেন। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে নারী হয়েও নারীর এ সর্বনাশ তারা কেন ডেকে আনছেন?
সাউথ এশিয়ান লিগাল ক্লিনিক অব ওন্টারিওর জরিপে আরো দেখা গেছে, জোর পূর্বক বিয়ে করতে বাধ্য হওয়া অনেকেই নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হন। এরমধ্যে হুমকি ৬৮ শতাংশ, শারীরিক নির্যাতন ৫৯ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন ২৬ শতাংশ। জরিপে আরো দেখা গেছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতে বাধ্য করার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে কানাডার মুসলিম সমাজে। হিন্দু, শিখ ও খ্রীষ্টান কমিউনিটিতেও এ ধরণের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশী কমিউনিটিতেও এই বলপূর্বক বিয়ের ঘটনা ঘটছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পাত্রীকে জোর করে দেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পাত্রী উপায় না দেখে ঢাকায় কানাডীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিয়ে রোধ করার চেষ্টা নিয়েছেন। কিন্তু যারা এই সাহসটুকু দেখাতে পারেননি তারা সাময়ীকভাবে হয়তো ঐ বিয়েকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী এক বা দুই বছরের মাথায় দেখা গেছে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে।
জোর করে বিয়ে দেয়া এবং বাল্যবিয়ে এ সবই কানাডায় ঘটছে। আর বলপূর্বক বিয়ের পরিণতি যে ভাল হয়না তা আমরা দেখেছি সাউথ এশিয়ান লিগাল ক্লিনিক অব ওন্টারিওর জরিপ থেকে। যৌন নির্যাতনসহ নানারকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয় নারীদেরকে। এইসব নারী রক্ষণশীল পরিবার ও পরিবেশে বড় হওয়ার কারণে নির্যাতনের বিষয়গুলো সাধারণত চেপে যান। লোকলজ্জা ও নির্যাতন আরো বেড়ে যেতে পারে এই ভয়ে তারা মুখবুঝে এগুলো সহ্য করেন। নিজ পিতা-মাতার কাছ থেকেও খুব একটা সহযোগিতা বা সহনুভূতি পান না নির্যাতনের শিকার এই নারীদের অধিকাংশই। পিতা-মাতারা নির্যাতনের শিকার ঐ নারীকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে এটি তার স্বামীর ঘর। এখানেই তাকে থাকতে হবে। নির্যাতনের বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তা আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে, লোকে ছি ছি করতে পারে সেই ভয়েও অনেক অভিভাবক তাদের মেয়েকে মুখবুজে তা সহ্য করার পরামর্শ দেন। এভাবে অনেক ঘটনা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের জরীপ রিপোর্টে ঐ ঘটনাগুলো সঠিকভাবে চিত্রায়িত হয় না। আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বলপূর্বক বিয়ের বিরুদ্ধে কানাডায় সুনির্দিষ্ট কোন আইন নেই।
অন্যদিকে বাল্যবিয়েও পরিবারে সৃষ্টি করে নানান সমস্যা। এর মধ্যে আছে শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হওয়া। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর অধিকাংশ মেয়েরই আর স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় না। বাল্যবিয়ের কারণে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। গর্ভপাতের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। জীবন কি তা বুঝে ওঠার আগেই তাদের শরীরে আরেকটি শিশুর অস্তিত্ব অনুভব করে তারা কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে পড়ে। এই বালিকা বধুরা নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকে না। ফলে মা ও অনাগত শিশু উভয়েই নানারকম ঝুঁকির মধ্যে থাকে। অল্পবয়সে মা হলে পুষ্টিহীনতা ছাড়াও নানারকম অসুখে আক্রান্ত হয় তারা। এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। মানসিক সমস্যাও দেখা দেয় অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়ের। অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়ের প্রতিবন্ধী শিশু জন্মদান করার ঝুকিঁ থাকে। বাল্য বিয়ের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের আশংকা তৈরী হওয়া ছাড়াও নানান পারিবারিক অশান্তি দেখা দেয়।
এতকিছু ঝুঁকির পরও কোন কোন বাবা-মা নিজেদের আদরের মেয়েকে বিসর্জন দেন পরিবারের তথাকথিত সম্মান রক্ষার নামে, মেয়ে বিপথে চলে যেতে পারে এই ভয়ে অথবা দেশ থেকে কোন আত্মীয়কে স্পন্সর করার উদ্দেশ্য নিয়ে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দেয়া যে প্রকারন্তরে তাকে যৌন নির্যাতনের মুখে ঠেলে দেয়া, একথাও ভাবেন না বাবা মায়েরা।
তাছাড়া বাল্যবিয়ে কখনো একটি মেয়েকে সুরক্ষা দেয় না বা তার জন্য কোনো সুফলও বয়ে আনেনা। অল্প বয়সের মেয়েরা প্রতিবাদী হতে পারে না বিধায় তারা যৌন নির্যাতনসহ আরো নানারকম পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়। শৈশবের যে মধুর জীবন তা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়। মোট কথা, এই বাল্যবিয়ের প্রথা কোনও সম্প্রদায় বা সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনে না।
অবশ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার তুলনায় কানাডায় বাল্যবিয়ের হার কম। এখানে সবচেয়ে বেশী মাত্রায় বাল্যবিয়ে হয়ে আলবার্টা প্রভিন্সে। ম্যাক্গিল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপিকা এ্যালিসা কসকী-র হিসাব অনুযায়ী ঐ প্রভিন্সে এই হার হলো প্রতি ১০ হাজারে ৫ জন। আর গোটা কানাডায় এই হার প্রতি ১০ হাজারে ৩ জন। এটা সার্বিক হিসাব।
তবে কানাডায় এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন এথনিক কমিউনিটিতে এই হার আরো অনেক বেশী হবে। কারণ, এই দুই মহাদেশ থেকে আসা ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা কম নয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাল্যবিয়ে বা একাধিক বিয়ের ঘটনাগুলো এরা সরকারী অফিসে রেজিস্ট্রি করান না। ফলে তাদের হিসাবটা সহকারী অধ্যাপিকা এ্যালিসা কসকী’র গবেষণায় উঠে আসেনি।
আর কানাডায় বাল্যবিয়ের হিসাবটা একটু গোলমেলেও বটে। কারণ ফেডারেল সরকারের ‘সিভিল ম্যারেজ এ্যাক্ট’ এ বলা আছে বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রীর বয়স কমপক্ষে ষোল হতে হবে। বিয়ের লাইসেন্স প্রদান করে থাকে প্রভিন্সগুলো। কেউ যদি ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে করতে চায় তবে সেক্ষেত্রে পিতা-মাতার অনুমোদন লাগবে। অর্থাৎ ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে বিয়ে করতে হলে পিতা-মাতার অনুমোদন লাগবে। কিন্তু কানাডা ও জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশে বাল্যবিয়ে বন্ধের যে কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে সেখানে বলা হচ্ছে ১৮ বছরের নিচে হলে সেটা বাল্যবিয়ে হিসাবে গণ্য হবে। অথচ কানাডায় ১৬ বছর বয়সেও বিয়ে করা যাচ্ছে অথবা পিতা-মাতা জোর করে সন্তানদের বিয়ে দিচ্ছে যেটা বাল্যবিয়ে হিসাবে গণ্য হচ্ছে না। ম্যাক্গিল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপিকা এ্যালিসা কসকী বলেন, এই বয়সে জোর করে বিয়ে দেয়ার বিষয়টি ব্যাপকভাবে বালক বালিকাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচিত হয়।
তবে আশার কথা যে, বিশ্বব্যাপী বাল্যবিয়ের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ বলছে, গত এক দশকে প্রায় আড়াই কোটি বাল্যবিয়ে ঠেকানো গেছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
ঐ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এক দশক আগে প্রতি চারজনের একজন বাল্যবিয়ের শিকার হতো। এখন এ হার কমে প্রতি পাঁচজনে একজন হয়েছে। বাল্যবিয়ের হার কমাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে। বিশেষ করে ভারত। এই সাফল্য এসেছে মেয়েদের উন্নততর শিক্ষা ও বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা বৃদ্ধির মাধ্যমে।
তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাল্যবিয়ের হার কমলেও আফ্রিকায় এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয় এখানে এক দশক আগে প্রতি পাঁচজনে একজন বাল্যবিয়ের শিকার হলেও এখন সে হার বেড়ে প্রতি তিনজনে একজন হয়েছে। তবে ঐ মহাদেশটির ইথিওপিয়া বাল্যবিয়ের হার এক-তৃতীয়াংশ কমাতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আরেকটি সুখবর এলা। আরব নিউজ জানায়, সৌদি আরবের আইন মন্ত্রণালয় দেশটিতে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে দেশটিতে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যেই বিয়ের সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৮ বছর করে দেওয়া হয়েছে।
বাল্যবিয়ে সৌদি আরবে খুব সাধারণ একটি ঘটনা। দেশটিতে প্রতি সাত জনের মধ্যে একজন মেয়ের ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হয়ে থাকে। সম্প্রতি এ চিত্র পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির আইন মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ করেছিল সৌদি আরব। এবার বিয়ের সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৮ করার মাধ্যমে ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে নিষিদ্ধ করা হল। নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এ আইন প্রযোজ্য। আইন না মানলে শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে।
ইউনিসেফের লিঙ্গবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা অঞ্জু মালহোত্রা বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বাল্যবিয়ে কমেছে। এটা স্বাগত জানানোর মতো খবর। তবে আমাদের এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ কোনো মেয়েকে ছোটবেলায় জোর করে বিয়ে দেয়া হলে সে মেয়েটি বাকি জীবন তার কষ্ট ভোগ করে।’
জাতিসংঘের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাল্যবিয়ের অবসানের অঙ্গীকার করেছেন বিশ্ব নেতারা। আমরা আশা করি কানাডাও তার নিজ দেশে বাল্যবিয়ে অবসানে সক্ষম হবে এবং বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮তে উন্নীত করবে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ