প্রবাসে পরহিতকর্ম -৬৩
ইউরোপের পথে পথে
অক্টোবর ৯, ২০১৯
রীনা গুলশান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পরদিন সকালে লন্ডন সেন্টারে যাবার প্রাক্কালে আমরা আবার ‘হোয়াইট চ্যাপেল’ এ কিছুক্ষণের জন্য নামলাম। অনেক নাম শুনেছি। রায়হানের কয়েকজন বন্ধু ওখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। লম্বা টানা রাস্তা। দুপাশের দোকান বা বাড়ি ঘর সব কেমন যেন পুরানো এবং দোকান পাট সব দেখে মনে হলো এক লহমায়; আমি বাংলাদেশের কোন এক ছোট শহরের মার্কেট প্লেসে এসেছি। আমি অসম্ভব রকমের আশ্চর্য হয়ে দেখছিলাম সমস্ত এলাকাটা। মজার ব্যাপার হলো, ঢাকার গাউসিয়াতে যেমন দেখেছি- ‘যা নিবেন ৫ টাকা (এখন অবশ্য ২৫ টাকা)’ এই একই স্টাইলে বেশ কিছু ফেরিয়ালা এখানেও ঘোরা ফেরা করছিল। পথচারীরা হাটাচলা করছিল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মত। এবং বেশ কিছু পথচারী অবলিলায় পান খেতে খেতে যাচ্ছিল এবং পানের পিক রাস্তায় ফেলছিল। আমি চোখ মোটা মোটা করে এই অসম্ভব ঘটনা প্রতক্ষ্য করলাম। দোকান বা রেস্টুরেন্টগুলো আমাদের কানাডার (বাঙ্গালী পাড়ার মত নয়) মত নয়। এমন কি আমাদের টরন্টোর জেরার্ড ইন্ডিয়া বাজারের মতও নয়। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস্ কিছুটা ঘিঞ্জি। তবু জ্যাকসন হাইটস্ এর পরিসর অবশ্য অনেক বৃহৎ। দোকন পাট, রেস্টুরেন্ট অনেক বেশী চকচকা।
যাই হোক বেশ কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে একটি বাঙ্গালী রেস্টুরেন্টে ঢুকে এক প্লেট করে চিকেন বিরিয়ানী আর শিক কাবাব খেলাম। সাথে সালাদ এবং বোরহানি দিল। আরো কিছুক্ষণ গল্প করে আমরা ২টার দিকে ট্রেনে উঠে পড়লাম, লন্ডন সেন্টারের উদ্দেশ্যে।
সেন্টারে এবার আমাদের গন্তব্য সরাসরি বাকিংহ্যাম প্যলেস, অর্থাৎ রাণীর প্রাসাদ। পার্লামেন্ট স্কোয়ারেই এটি অবস্থিত। কিন্তু রাণীর প্রসাদ দেখতে হলে সরাসরি নাক ধরা যাবে না। ঘুরিয়ে নাক ধরতে হবে। অর্থাৎ পার্লামেন্ট স্কয়ারে নেমে বেশ অনেকটা পথ আপনাকে হাটতে হবে। খুব বিশাল এরিয়া নিয়ে একটি পার্ক, তার নাম ‘গ্রীন পার্ক’। যদিও পার্ক টি আপনারা যেরকম কল্পনা করছেন তেমন কিছুই না। শিশুদের খেলার তেমন কিছুই নাই। অথবা বাহারী বৃক্ষের কোন সমাহার নাই। যদিও পার্লামেন্ট স্কয়ার যথেষ্ট শোভিত। গ্রীন পার্কে কেবলমাত্র ছড়ানো ছিটানো বেশ কিছু বৃহৎ আকারের বৃক্ষরা দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। বেশ দূরে দূরে ছড়ানো ছিটানো বেঞ্চ আছে, হয়তবা কান্ত দর্শকদের বসবার জন্য। গ্রীন পার্ক আগেই বলেছি যথেষ্ট বড়। হাটতে হাটতে আমার জন্ম শেষ। অবশেষে বহু জনমের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছালাম। বহু জনমের বললাম, ব্রিটেনের রাজপ্রাসাদের ব্যাপারে ছেলেবেলা থেকেই এত বেশী জেনে আসছি যে, এক অপার কৌতুহল আমার ভেতরে কাজ করছে। সারা পৃথিবীর উপর তাদের রাজত্ব ও কৃতিত্ব অবশ্যই আমার উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া ইতিহাস বহুদিন সঙ্গী হয়েছিল; তাই এইসব রাজা/রাণীদের উপর আমার বরাবরই যথেষ্ট আগ্রহ। তবে এটা না বললে মিথ্যে বলা হবে, রাণীর প্রাসাদে এসে কেমন যেন ভড়কে গেলাম। কেমন যেন এক অনুহুত হতোদ্যম আমাকে আচমকা গ্রাস করলো। যা যা ভেবে এসেছি, বাইরে থেকে তার কিছুই মনে হলো না। অতি আগ্রহে আমার কেমন যেন ভাটা পড়লো। আমি অবাক বিষ্ময়ে পর পর বিশাল দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে থাকা গেটে হাত দিয়ে ভাবছিলাম, এই বুঝি সেই? আমি কি আর কিছু দেখতে চাইছিলাম? এখানেই আমার প্রিয় মানবি প্রিন্সেস ডায়ানা বসবাস করতো? এই প্রসাদের প্রতিটি অলিন্দের প্রতিটি ইট পাথরে আজও নিশ্চই কান পাতলে তার গুমরে গুমরে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাবে। এক ভালবাসা বঞ্চিত রমণীর ব্যর্থ হাহাকারে; এখন অন্য কারো হাসি, আনন্দ কি আমার কানে ক্রমাগত বেজে চললো। আমার ভাল লাগলো না। আমি বেশ মনমরা হয়ে সামনের দিকে যেখানে দর্শকের উপচে পড়া ভীড় ছিল, ওখানে দাড়ালাম। এখানে শুনেছি বিশেষ বিশেষ দিনে রাণী আগত দর্শকদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেন অথবা বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। তবে শুনেছি ঠিক সন্ধ্যায় ৬টার দিকে রাণীর সিকিউরিটি বদল হয়। এবং ঐ বদলানোটা নাকি দেখার মত। কেও নাকি কিছুতেই বুঝতে পারেনা কখন কিভাবে সিকিউরিটি বদলে যায়। কিন্তু সেতো সন্ধ্যা ৬টায়। অতক্ষণ অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এখনও অনেক কিছু দেখার আছে। তাই আমিই এবারে তাড়া দিয়ে ফিরে চললাম। আবার ‘ওয়েস্টমিনিস্টার’ এর ‘মে ফেয়ার’ হয়ে (এখানে প্রতিটি জিনিশ দেখার মত এবং এবং ঐতিহাসিক, তাই কোনটা রেখে কোনটা দেখবো, হাবুডুবু খাচ্ছিলাম!!) ‘পিকাডিলি সারকাস’ এর দিকে চল্লাম। Piccadily Circus এর নামও আমরা কম বেশী সবাই জানি। সেই যখন সিক্স, সেভেনে পড়ি তখন-ই আম্মার বিশাল বইয়ের ভাড়ার থেকে চুরি করে নিমাই ভট্রাচার্যের বিখ্যাত উপন্যান ‘পিকাডেলী সার্কাস’ বইটি পড়েছিলাম। আজও হৃদয়ের তন্ত্রিতে তা তারার মত জ্বল জ্বল করছে।
পিকাডেলী সার্কাস ওয়েস্টমিনিস্টারের একদম শেষ মাথায় অবস্থিত। এটা বানানো হয়েছিল ১৮১৯ সালে। রিজেন্ট স্ট্রীটের সাথে পিকাডেলী। যদিও আমরা সার্কাস অন্য অর্থে বুঝে থাকি। কিন্তু ল্যাটিনে এই সার্কাস শব্দটি ঈরৎপষব অর্থাৎ ঘুরানো অর্থে বোঝানো হয়ে থাকে। এটা মূলত একটি জংশন স্টেশন।
ওয়েস্টমিনিস্টার অসম্ভব বড় এরিয়া। (আমার মনে হলো, লন্ডনের টোটাল ‘সেন্টার’ (ডাউন টাউন) এই ওয়েস্টমিনিস্টার এর মধ্যে। তবু দেখলাম একসময় Westminister end এ চলে এলাম। যেহেতু আমি ডিসেম্বরে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, তাই যেমন ভিড় ছিল, তেমনি সুন্দর করে সাজানো ছিল।
লম্বা লম্বা ভেতরের রাস্তা যাকে আমরা গলি বলি, অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো ছিলো। আলোক সজ্জায়, দিনের আলোকেও যেন হারিয়ে দিচ্ছিল। দোকান পাট, বাড়ি, অফিস সব অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো। বিশেষ করে মেইন রাস্তার পাশে যা কিছু ঘর বাড়ি আছে সব আলোকিত, সজ্জিত।
সেই আলোকোজ্জল নগরী আমাদেরকেও ক্রমশই প্রভাবিত করছিলো। (চলবে)
রীনা গুলশান
টরন্টো। gulshanararina@gmail.com