প্রবাসে পরহিতকর্ম -৬০

ইউরোপের পথে পথে

জুলাই ১৭, ২০১৯

রীনা গুলশান

বেশ একটা দীর্ঘ পথ অত্যন্ত আনন্দের সাথে পাড়ি দিয়ে এলাম। ইস্ট হ্যাম থেকে লন্ডন সেন্টারে আসতে ২ ঘন্টার মত লেগে গেল, কারণ মাঝে আবার  ট্রেন বদলানো লাগে। তবু মনে হলো এক ফুৎকারে এই সময়টা চলে গেল। আর নতুন দেশের চারপাশে এবং সব নতুন মানুষের ভীড় দেখতে দেখতে কখন জানি লন্ডন সেন্টারে চলে এলাম। এদের সাবওয়েগুলো খুব সুন্দর। ঝকঝকে এবং পরিচ্ছন্ন। খুব ভাল লেগে গেল। ঐ মূহুর্তে নিউয়র্কের সাবওয়ের কথা মনে পড়ে গেল। এত বিশ্রি দেখলে মনে হয় ৫০০ বছর আগের। এবং ওদের সাবওয়ের পরিবেশও খুবই ভীতিকর। লন্ডনের সাবওয়ে খুবই সুন্দর। আলোকিত। বিশেষ করে চলন্ত সিড়িগুলো খুবই চমৎকার। উচ্চতা আমাদের ঠিক ডবল। আনেক উপর থেকে নীচে নামতে গেলে রেলিং এ অটোমেটিক হাত চলে যাবে। না হলে বেশ ভয় ভয় লাগে। আর চলন্ত সিড়ি এবং নরমাল সিড়ির দু’পাশ দিয়ে লন্ডনের নামকরা সব শিল্পিদের ছবি। বিশেষ করে লন্ডনের মঞ্চ নাটকের কথা আমরা জানি। যেটা সারা পৃথিবী ওদের এখনও ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। সেই সব নতুন নাটকের বিজ্ঞাপন। এত সুন্দর ভাবে দেওয়া। এমনকি বিভিন্ন পন্যের বিজ্ঞাপনও ওখানে দেওয়া আছে। তবে সব কিছু একই সাইজে, একই ভাবে পর পর দেওয়লের পাশ দিয়ে পরপর নেমে গেছে। ব্যাপারটি আমার এত ভাল লেগেছে। এমনকি কোন ঘরভাড়া, সেটাও আপনি নাম্বার পাবেন, কিন্তু এত আর্টিস্টিক ওয়েতে দেওয়া যে প্রথমে বুঝতেই পারবেন না।

এবং বড় বড় সাবওয়েতে এত গুছানো সব কিছু যে টুরিস্টদের একটুও প্রব্লেম হবে না। তবে কোন কোন সাবওয়েতে এটেন্ডেন্স (সাহায্যকারী) খুবই কম। আবার অনেক জায়গাতে অনলাইনে বা কার্ড দিয়েই শুধু টিকিট কিনতে হয়। এটাও বেশ অসুবিধাজনক অনেকের জন্য। ডাউনটাউনে যাবার শেষ স্টপেজটা (সাবওয়ে) এত্ত সুন্দর যে আপনার হঠাৎ করে মনে হতে পারে, কোন আর্ট গ্যালারীতে চলে এসেছেন। আমি উপরে উঠবো কি ভিতরেই ছবি তোলা শুরু করেছি। আমার ছেলেরা হাসছিল। তা হাসুক। যা সুন্দর, সেটা আমার মস্তিষ্কের গভীরে লেগে থাকে। বিশেষ করে আর্ট দেখলেই আমার মাথা আউলা হয়ে যায়।

যাইহোক ‘লন্ডন ব্রীজ’ এ নামলাম। যেহেতু এটা লন্ডনের একটা ফেমাস দ্রষ্টব্য স্থান, তাই স্টেশনের নামও ‘লন্ডন ব্রীজ’। এই স্টেশনটা অনেক বড়। এবং খুবই গোছালো। এখানে মানুষগুলোকে ভালোই মনে হলো। খুবই সহায়ক। স্টেশনের উপরে উঠলাম। একদম চকচকে রৌদ্রালোকিত দিবস। এত সুন্দর এই রোদেলা মধ্যসকাল দেখেই মনটা ভাল হয়ে গেল। এক্সিডেন্টের পর যখন একই সাথে দুটো ফিমার বোন ভেঙ্গে বিকল হয়ে পড়ে ছিলাম সেন্ট মাইলেক হাসপাতালে। ঘুরছিলাম হুইল চেয়ারে। তখন কখনো ভাবিনি  কোনদিন এই অজানিত দেশের অপরূপ শোভা বর্ধিত উজ্জল সকাল দখবো। এই দেখাতো কিছু নয়। ক্যাবলই চোখের অন্তস্থল থেকে হৃদয়ের গহীনে ধারণ করা –

“এ ভ্রমণ আর কিছু নয়,

কেবল তোমার কাছে যাওয়া

এখন তোমার কাছে যাবো

তোমার ভেতরে এক সাবলীল শুশ্রুষা আছেন,

তিনি যদি আমাকে বলেন,

তুই ক্ষত মোছ, আকাশে তাকা-

আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো

আমি আঁধার রাখবো না॥”

পুত্রের হাত ধরে আলোকিত রাস্তায় যেতে যেতে আবুল হাসানের কবিতা বিড় বিড় করে পড়ছিলাম। প্রতিটি মুহুর্তে আমি তাঁর কবিতা পড়ি। মনে হয় আমার হৃদয়ের রক্ত দিয়ে একটি একটি শব্দ চয়ন করেছে আবুল হাসান।

মাত্র হাফ ব্লক হাটতেই কি অপরূপ ঝকঝকে ‘টাওয়ার অব লন্ডন’ এর প্রাচীন শোভিত প্রাসাদ চোখের উপর জেগে উঠলো। কি অসাধারণ প্রাসাদের কারুকাজ!

তবে এটা দেখতে গেলে আগেই ‘টাওয়ার অব ব্রীজ’ এ উঠতে হবে। কারণ আপনি বাইরে থেকে যদি ‘টাওয়ার অব লন্ডন’ দেখতে চানতো অবশ্যই আগে এই ব্রীজের উপর উঠতে হবে। এক কথায় বলতে গেলে গোটা লন্ডনের শান শওকত সবই এই ব্রীজ। যেমন দেখতে, তেমনই তার শৈলী। টাওয়ার ব্রীজ এর কন্সট্রাকশন শুরু হয় ১৮৮৬ সালে এবং শেষ হয় ১৮৯৪ সালে। এটা থেমস্ নদীর উপরে নির্মিত। মনে হয় ব্রীজের উপর দাড়ালে গোটা লন্ডনটা এক নজরে দেখা যায়। থেমস্ নদীর দুই ধার ঘেষে যা কিছু নির্মিত সব দেখা যায় এক নিমিষেই। কাছে যেতে ইচ্ছা করে না। ব্রীজের দুই পাশেই আমার দাড়াতে ভাল লাগছিল। ব্রীজটা এত্ত সুন্দর। তারপর ব্রীজের এ পাশ থেকে পার হয়ে ও পাশে গেলাম। আগেই একটু দেখছিলাম ‘টাওয়ার অব লন্ডন’ এর কিয়দাংশ। এবার ঐ  পাশে যেতেই একেবারে যেন দিগন্ত বিস্তৃত ভাবে চেয়ে রইল আমার দিকে। যদিও এত বড় যে গোটা ক্যাসলটা এক জায়গায় দাড়িয়ে সবটা দেখা যায় না। এটার প্রধান সৌন্দর্যই যেন, ক্যাসেলটা

ঘিরে থাকা থেমস্ নদীটা। ক্যাসেলটা বাইরে থেকে দেখতেই আমার বেশী আনন্দ লাগছিল। ভিতরে যেতে একদম ইচ্ছে করছিল না। কারণ আমি মোটামুটি জানি ঐ ক্যাসেল এর ভিতর কি আছে।  একমাত্র ‘কহিনূর’ টা দেখবার একটা প্রবল বাসনা ছাড়া আর কিছু দেখবার ইচ্ছা ছিল না। কারণ ভারত ভ্রমণের সময় (ভারতে আমি কলকাতা থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সব দেখেছি, পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ, উত্তর, ভাতের যতগুলো  শহর আছে, সেখানে আমার পদচিহ্ন পড়েছে।) অনেকগুলো ক্যাসল দেখেছি। তারমধ্যে রাজা মানসিংহ নির্মিত ক্যাসেলের সাথে লন্ডন টাওয়ার এর অনেক মিল। তবে লন্ডনের ব্রীজটার হাইট অনেক বেশী (২১৩ ফিট)। তাই চারপাশ দেখতে অনেক ভাল লাগছিল।

অবশেষে লন্ডন টাওয়ার এর সামনে গেলাম। এর ভেতর প্রবেশ করতে গেলে যেহেতু টিকিট কাটা লাগে তাই প্রায় মাইল খানেক লম্বা লাইন। অনেকে আবার অনলাইনে টিকিট কেটে থাকে। আবার অনেকে জানে না, আপনি যদি লন্ডনে এক সপ্তাহর ,মত থাকেন তাহলে খুব ভাল হয় লন্ডন ওয়েস্টার ট্রাভেল কার্ড কিনে নিলে। এটি থাকলে আর টিকিট কাটতে হবে না।

ঘন্টাখানেক লাইনে দাড়িয়ে তারপর ভেতরে ঢুকতে পেলাম। শুক্রবারে প্রচন্ড ভীড় থাকে। এই ঐতিহাসিক ক্যাসেল প্রথম শুরু করেছিল রাজা উইলিয়াম। ১০১৭ সালে। ১০০০ বছর ধরে এটা এখনও মাথা উচু করে সকল সৌন্দর্য নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আগে রাজা/রানীরা এখানেই অবস্থান করতেন। এখন শুধু রাজকার্য পরিচালনা হয়। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে এটা এখন ভিজিটরদের দখলে। ক্যাসলের ভিতরের প্রতিটি জিনিশ খুব ভাল তবে দেখতে গেলে অন্তত পক্ষে এক মাস তো লাগবেই। কিন্তু ট্যুারিস্টদের এত সময় থাকে না। তাই হড়বড় করেই সব দেখতে হয়। তবু যে ইতিহাস পড়তে পড়তে বড় হয়েছি। তারপর শুনতে শুনতে এসব দেখার স্পৃহা চির জাগরুক ছিল। সেই সব ঐতিহাসিক জিনিশ নিজ চোখে দেখতে পাওয়া সত্যি অতি বড় সৌভাগ্যের মনে হচ্ছিল। ইউনিভার্সিটিতে আমার সাবসিডিয়ারী বিষয় ছিল ইতিহাস। তাই বহুকাল ধরেই আমি ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জাড়য়ে আছি। তাই সবকিছু দেখছিলাম আর মনে হচ্ছিল, সব আমার অনেক চেনা। কহিনূরের সামনে উপচে পড়া ভীড়। জানিনা কেন। এত বড় একটা  স্টোন শাহজাহান কিভাবে মাথায় নিয়ে বসে থাকতো সেটাই ভাবছিলাম। ‘সোর্ড অব টিপু সুলতান’ দেখেছিলাম আজ থেকে ৩০ বছর আগেই দিল্লির মিউজিয়ামে। গোটা একটা রূম জুড়ে কাঁচের ক্যাসকেটে সেই তলোয়ার ছিল।  এত বড় তলোয়ার নিয়ে কি ভাবে উনি যুদ্ধ করতেন, হতবাক হয়ে ভাবছিলাম! আবার এখানে দেখছিলাম। দেখে হাসি পাচ্ছিল। সারা পৃথিবীটা শাসন করেছে ব্রিটিশ। আর সেই সব দেশের মাস্টারপিস গুলো এদের দেশে শোভিত হচ্ছে।

রাজা/রানীদের স্ট্যাচুগুলোও খুব সুন্দর ভাবে শোভিত হচ্ছে। খুব ভাল লাগছিল ওদেরকে দেখতে। মনে হচ্ছিল চোখের উপর এরা জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ ইতিহাসের পাতায় এরা ছোট ছোট পাসপোর্ট সাইজ ছবিতে ছিল। কোন কোন স্ট্যাচু এত্ত সুন্দর বানিয়েছিল শিল্পী, যেন মনে হচ্ছিল এরা এখুনি কথা বলে উঠবে।

“এই রীনা গুলশান, এখানে কি করছিস? তোদের অত্যাচারে তোদেরকে আমরাতো ছেড়ে চলে এসেছি! এখন বাপু একটু শান্তিতে ঘুমাতে দে!”

মনে মনে ভাবছিলাম এইসব আজগুবি কথা আর হাসি পাচ্ছিল। আসেপাশের সবাই নিশ্চই আমাকে পাগল ভাবছিল!

যাক, কোন মতে নম নম করে টাওয়ার অব লন্ডন দেখা শেষ করে বের হলাম। এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি  যে-।  (চলবে)

রীনা গুলশান

টরন্টো

gulshanararina@gmail.com