প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৫৭

ইউরোপের পথে পথে

এপ্রিল ৮, ২০১৯

রীনা গুলশান

(পূর্ব প্রকাশের পর)

যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে। আর মাত্র দুদিন আছে। মনের ভিতরে একই সাথে চরম ভীতি এবং পরম আনন্দ নৃত্য করছে। এর ভেতরেই এক সকালে রুম্মান বললো, একটু বাইরে যেতে। যদিও এখন বহুদিন সেন্ট মাইকেল হাসপাতাল আর ফিজিও থেরাপীর ওখানে ছাড়া কোথাও যাইনি। কতদিন যে শপিং করতে যাইনা। আর ১৯ বছর ধরে শপিং সেন্টারেই (ইটন সেন্টারে) যেহেতু কাজ করি। তাই শপিং করা অনেকটা নেশার মত হয়ে গিয়েছিল। অন্ততপক্ষে উইন্ডো শপিংতো রোজই করতে হয় লাঞ্চ টাইমে। লাঞ্চ খাবার পরও ২০ মিনিটের মত টাইম থেকে যায়, তখন কি আর করা, ঘুরে ঘুরে উইন্ডো শপিং করি। তো, সেই আমি এক বছর বিছানায়। শপিং তো দূরে, কোন দোকানে পর্যন্ত যাইনি।

রুম্মান অনেক দিন পর এজাক্সেরই একটা মলে নিয়ে গেল। এ দোকান, সে দোকান ঘুরলো। আল্লাহ-ই জানে ও কি কিনবে। মাঝেমধ্যে তিতলীকে (স্ত্রী) কোন সারপ্রাইজ করতে হলে আমাকে নিয়ে যায়। ভাবলাম সেই রকম কিছু। অবশেষে ‘উইনার্স’ এ গেলো। ওখানে কি কিনবে কি জানি?

যাইহোক ভিতরে যেয়ে দেখি, জ্যাকেট দেখা শুরু করেছে। লেডিস। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, এই জ্যাকেটটা কেমন? দেখলাম কালো, গোল্ডেন চেইন। খুব সুন্দর এবং খুব হালকা। আমাকে বললো, দেখো, এটা কি তুমি উচুঁ করতে পারছো? আমি দেখলাম, খুব হালকা।

ইদানিং আমি একটু ভারি কিছুই উচুঁ করতে পারি না। সাথে কেউ থাকলে তার হাতে ধরিয়ে দেই। রুম্মান যেহেতু আমাকে ডাক্তার বাড়ি, হাসপাতাল সর্বত্র সেই-ই আনা নেওয়া করে। তাই সে সব জানে। অনেক দামী একটা জ্যাকেট কিনে দিল। খুব সুুন্দর। খুব আনন্দিত হলাম এই ভেবে যে, ছেলেটা মায়ের কথা ভেবেছে, বা ভাবছে। আবার কারো খুব দামী গিফট নিতেও আমার বেশ কিছুটা সঙ্কোচ হয়।

সব কিছু মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছি। ডাক্তারকে দেখিয়ে এলাম। যাবার আগে একটা এন্টিবায়োটিকের কোর্স দিয়েছিল। এবং যেহেতু শরীর খুবই দুবর্ল তাই ডাক্তার আরো একটা এক্সট্রা এন্টিবায়োটিকের কোর্স দিয়ে দিল।

এমনিতেই এখন কড়া শীত। ডিসেম্বরের ভ্রমণ। এতো সহজ নয়। কেউ বিশ্বাসই করবে করবে না, প্রায় এক মাসের ভ্রমনে আমি তিনটে প্যান্ট, দুটো টপস, দুটো সোয়েটার আর একটা নাইটি, এই নিয়ে ভ্রমণে বের হলাম। আমার হাসবেন্ডও তথৈবচ। যদিও ওষুধ একেবারে রামকথন।

যাবার দিন প্রায় ঘনিয়ে এলো। কথা ছিল রুম্মান ঐ দিন ছুটি পাবে না। তাই আমরা আমাদের এসইউভি গাড়িটা চালিয়ে ছোট বোন (কাজিন) বাসায় যাবো, তারপর ওদের গ্যারাজে গাড়ি রাখবো। আর আমার বোন শরবত এর হাসবেন্ড ফিরোজ আহমেদ আমাদেরকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে আসবে। শরবত তো খুব খুশী। কারণ ঠিক একটা বছর ওর বাসায় আমি যেতে পারিনি আমার এক্সিডেন্টের কারণে। একেতো শীতের মৌসুম, উপরন্তু আমার হাঁসের মাংশ খুবই প্রিয় বিধায় সে রাজ হাঁসের মাংশ রান্না করে পিঠা বানিয়ে হুলস্থুল করে রেখেছে।

এদিকে রুম্মনের কি হলো, হঠাৎ যাবার দিন সকালে অফিসে ‘সিক কল’ দিল। বললো, মামনি, বাপী ইউরোপ ট্যুরে যাচ্ছে এত্ত দিনের জন্য, সাথে না থাকলে চলে? তাই সকাল সকাল শরবতের বাড়ি চলে গেলাম। সেখানে শরবতের ছোট বোন রিঙ্কু আর তার বাচ্চারাও এসে হাজির। রীতিমত একটা উৎসব উৎসব ভাব। রিঙ্কু বিভিন্ন রকম টিপস দিয়ে চলেছে। সে আবার এসব জায়গাতে বহুবার গেছে। আমিও মনোযোগি স্রোতার মত শুনে যাচ্ছিলাম। যদিও মনটা বড়ই বিক্ষিপ্ত ছিল। একটা অজানা, অচেনা দেশে যাবার যথেষ্ট বিড়ম্বনা। তারপর দুজনেই বেশ কিছুটা কমজোরী মানুষ চলেছি ইউরোপ ট্যুরে। কেন জানি একটা অজানা শঙ্কা মনের ভিতরে বারবার উঁকি মারছে। মনের ভিতরে, আর একটা মন প্রশ্ন করছে বারবার, পারবো তো, এই এত্তগুলো দেশে প্রদক্ষিণ করতে?

যাবার আগের দিন-ই পিকারিং মল থেকে বেশ কিছু পাউন্ড, ইউরো এবং ইউএস ডলার কিনে নিয়েছিলাম। ক্রেডিড কার্ড বিদেশে যেয়ে ব্যবহার করার পারমিশন নিয়ে নিয়েছি। যদিও আগে থেকেই জানি, শপিং আমরা একেবারেই করবো না। পৃথিবীর বহুদেশ আমরা দুজন ঘুরেছি। কিন্তু আমরা যখন ভ্রমণের জন্য ভ্রমণ করি, তখন আমরা ১ টাকার শপিংও করি না। কারণ শপিং করলে ভ্রমণ করা যায় না। আমরা দুজনই অনেকটা যাযাবরের মত ভ্রমণ করতে পছন্দ করি। অনেক আগে আমরা ভ্রমণ করতে গেলে, অন্তত পক্ষে সেইসব দেশের একটা করে শো-পিস কিনে আনতাম। ইদানিং তাও করি না। ঘরে শো-পিস রাখার মত আর জায়গা নাই। আর একটা শো-কেস বানিয়ে শো-পিস রাখার মন মানসিকতাও নেই। এখন মনের মধ্যে শুধু “অন্য কোথা… অন্য কোনখানে…”।

এই যে এতগুলো দেশ ঘুরলাম, কিছু কিনিনি।

যাবার আগে টিকিট পেয়েও আর একটা ধাক্কা খেলাম। আমাদের ‘হিথরো এয়ারপোর্ট’ নয়। আমাদের ‘গ্যাটওয়ে এয়ারপোর্ট’। এদিকে লন্ডনে কোথায় উঠবো সেটা নিয়েও ছেলের সাথে বেশ কিছুটা বিতন্ডা। তার এক কথা – হোটেলে ওঠো। নিজের প্রাইভেসি থাকে। কিন্তু তা কি হয়? আমার তিন মামা, সর্বপরি আমার বড় বোন থাকে। দুলাভাই বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে অবশেষে বাচ্চাদের স্বার্থে লন্ডনে সেটেল্ড হয়েছেন। দুলাভাইয়ের কাজ হলো এখন রিটায়ার্ড করার পর থেকে তাবলিগ করে বেড়ানো। আমরা যাবো শুনে, দুলাভাই একটা দীর্ঘ প্রোগ্রাম ক্যানসেল করেছে। এখন না গেলে কেমন হয়? এদিকে মামারাও খুবই এক্সাইটেড। মামারা কেন জানি আমাকে প্রচন্ড ভালবাসে। তবে মামাদের বাড়ি উঠবো না, এ যাত্রায়। কারণ তারা থাকে উইম্বলডনে। ঢাকার উত্তরা/গুলশানের মত। ওখানে সব বড়লোকেরা থাকে। ওখান থেকে ডাউন টাউন ইবেং সর্বত্র যাতায়তে বড়ই দুস্কর। আমার বোন থাকে ইস্টহ্যামে। এবং একদম সাবওয়ে থেকে জাস্ট ৫ মিনিট ওয়াকিং ডিস্টেন্স। অতএব আমি ওখানেই উঠবো বলে ঠিক করলাম।

এখন প্রবলেম হলো, ‘গ্যাটওয়ে’ এয়ারপোর্ট টা আবার লন্ডন সিটির বাইরে। বেশ দূরত্ব। হিথরো আবার লন্ডনের মধ্যেই ছিল। অতএব, আমার হাসবেন্ড অনলাইনে দেখা শুরু করলো গ্যাটওয়ে থেকে কিভাবে খুব সহজে ইস্টহ্যামে যাওয়া যায়। (চলবে)

রীনা গুলশান, টরন্টো