এসএনসি-লাভালিন নিয়ে লঙ্কাকান্ড
এপ্রিল ৮, ২০১৯
খুরশিদ আলম
নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন এর দুর্নীতি নিয়ে সম্প্রতি এক লঙ্কাকান্ড ঘটে গেল কানাডার রাজনীতিতে। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডার রাজনীতিতে এমন তুমুল বিতর্ক আর কোন ইস্যু নিয়ে হয়নি। আর এই বিতর্কটি শুরু হয় লিবারেল পার্টির সাবেক ভেটেরান এ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী জোডি উইলসন-রাইবোল্ড এর পদত্যাগের পর। এর আগে তিনি এটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
জোডি উইলসনের অভিযোগ, তিনি এটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তার উপর অনৈতিকভাবে তীব্র চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তিনি যাতে নির্মান প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন এর বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতি মামলায় সাজা না হওয়ার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন। আর এই চাপ এসেছিল প্রধানন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অফিসে কর্মরত সিনিয়র স্টাফ মেম্বারদের কাছ থেকে। কয়েকজন মন্ত্রীও এই চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।
কিন্তু জোডি উইলসনের এই অভিযোগ অস্বীকার করেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এসএনসি-লাভালিন এর বিষয়ে পক্ষপাতমূলক কিছু বলা হয়নি এবং কোন সুবিধাও চাওয়া হয়নি। আর নিয়ম ভঙ্গ করে কোন চাপও প্রয়োগ করা হয়নি ডোডি উইলসনের উপর।
সাবেক আইন মন্ত্রী জোডি উইলসনের পদত্যাগের ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, সরকারের কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে তিনি তা নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা করতে পারতেন। অথবা আমার সঙ্গেও সরাসরি কথা বলতে পারতেন।
উল্ল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে Globe and Mail পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়, এসএনসি-লাভালিন চলমান মামলার রায়ে কোনো সাজা না দিতে জাস্টিন ট্রুডো সরকারের কাছে জোর তদবির করেছে। মন্ট্রিয়লভিত্তিক কোম্পানিটির মতে, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে হুমকিতে পড়বে হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ এবং চাকরি হারাতে পারে প্রায় ৯ হাজার কর্মী।
তবে এসএনসি-লাভালিন এর প্রধান নির্বাহী নীল ব্র“স এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। কানাডিয়ান প্রেস-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমরা কখনোই প্রধানমন্ত্রীর নিকট চলমান মামলার রায়ে কোনো সাজা না দিতে তদবির করিনি।
এদিকে এই বিতর্ক চলাকালে অগ্নিতে ঘি ঢেলে দেন জাস্টিন ট্রুডোর আরেক সহকর্মী জেন ফিলপট। জোডি উইলসনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও পদত্যাগ করেন ট্রেজারী বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এর পদ থেকে। তিনি বলেন, লাভালিন বিষয়ে সরকারের দুর্নীতি তদন্ত পরিচালনার বিষয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলায় তিনি তার দায়িত্ব থেকে সরে দাড়িয়েছেন। তার ভাষ্য হলো, আমাকে অবশ্যই মূল নীতি, নৈতিক দায়িত্ববোধ ও সাংবাধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়ে অটল থাকতে হবে।
ফিলপট তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছেন যে এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলায় হস্তক্ষেপ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে সাবেক আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল জোডি উইলসনকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল-এমন অভিযোগের কারণে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি আরো লিখেন, এই মন্ত্রিসভার হয়ে দায়িত্ব পালন একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয় তার পক্ষে। ফিলপট এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন। ছিলেন ইনডিজেনাস সার্ভিসেস মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও।
তবে কৌতুহলের বিষয় হলো, লিবারেল সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেও এরা দুজনেই লিবারেল ককাস এ ছিলেন এবং বলে আসছিলেন আগামী অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য ফেডারেল নির্বাচনে তারা লিবারেল এর হয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
কিন্তু সেই সুযোগ তারা আর পাচ্ছেন না। কারণ, অনেক বাক-বিতন্ডার পর প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এদের দুজনকেই শেষ পর্যন্ত লিবারেল ককাস থেকে বহিস্কার করেছেন। তারা এখন সংসদে স্বতন্ত্র এমপি।
এই দুই সাবেক মন্ত্রীকে লিবারেল কাকাস থেকে বহিস্কার করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদের প্রতি দলের বিশ্বাস এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা পুনরুদ্ধার কারা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, এই দুই সাবেক মন্ত্রী ক্রমাগত দলের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে আসছিলেন। এদের একজন জোডি উইলসন বিবেকবর্জিত ও অযৌক্তিকভাবে প্রিভি কাউন্সিলের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে তার ফোনালাপ গোপনে রেকর্ড করেন।
সাবেক এই দুই মন্ত্রীকে দলের কাকাস থেকে বহিস্কারের ঘোষণা দেয়ার পর দলের প্রায় সব এমপি-ই বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে প্রধানন্ত্রীকে সমর্থন করেন।
উল্লেখ্য যে, ফিলপটের আগে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর শীর্ষ উপদেষ্টা ও তার দীর্ঘদিনের বন্ধু জেরাল্ড বাটস-ও পদত্যাগ করেন তার দায়িত্ব থেকে যখন এসএনসি-লাভালিন বিতর্ক শুরু হয়। তবে তিনি জোডি উইলসনের দাবীর সাথে এক মত হতে পারেননি। House of Commons justice committee সামনে তিনি বলেন, জোডির উপর কোন অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়নি এসএনসি-লাভালিন বিষয়ে। জোডিকে তার পূর্বের দায়িত্ব থেকে স্থানান্তর করা হয়েছিল মন্ত্রীসভা রদবদলের অংশ হিসাবে। এর পিছনে অন্য কোন কারণ নেই।
জেরাল্ড বাটস আরো বলেন, জোডি উইলসন আগে কখনোই অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে এমন কথা বলেননি। তিনি এই অভিযোগ তুলেন যখন গত জানুয়ারীতে মন্ত্রীসভা রদবদলের সময় তাকে তার শক্তিধর পদ আইন মন্ত্রী থেকে স্থানান্তর করা হয়। ঐ সময় তাকে ইনডিজেনাস সার্ভিসেস মিনিস্ট্রির দায়িত্ব নিতে বলা হয়। তিনি ঐ দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান। বাটস বলেন, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সবসময়ই বলে আসছিলেন, এসএনসি-লাভালিন এর বিরুদ্ধে প্রসিকিউট করা বা না করার দায়িত্ব এটর্নি জেনারেল হিসাবে জোডি উইলসনেরই। আর জোডি যদি মনে করতেন এসএনসি-লাভালিন এর বিষয়ে অনৈতিক কোন কিছু করা হচ্ছে তবে তিনি প্রধনমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করতে পরতেন বা তাকে অবহিত করতে পারতেন। কিন্তু ঐ সময় তিনি তা করেননি।
জেরাল্ড বাটস এর পাশাপাশি প্রিভি কাউন্সিলের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মাইকেল ওয়ার্নিক-ও House of Commons justice committee’র সামনে জোডি উইলসনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এসএনসি-লাভালিন এর বিষয়ে আমি জোডি’র প্রতি কোনরকম প্রচ্ছন্ন হুমকী প্রদান করিনি যেটা তিনি দাবী করে আসছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের অন্য কোন কর্মকর্তাও অনৈতিক কোন চাপ সৃষ্টি করেননি।
কিন্তু কানাডার রাজনীতিতে এরকম একটি সিনারিও সৃষ্টির পিছনে আসল রহস্য কি? সাবেক মন্ত্রী জোডি উইলসন কি সত্যি সত্যি প্রধানমন্ত্রী ও তার অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তাদের অনৈতিক চাপের মুখোমুখি হয়েছিলেন? কিংবা অন্যন্য মন্ত্রীদের?
জোডি উইলসনের অভিযোগ সত্য-মিথ্যা যাই হোক, বিরোধী দলগুলো বিষয়টিকে বেশ বড় একটি সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করছে লিবারেল দলকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য। তারা এখন উঠেপড়ে লেগেছে এ কথা প্রমাণ করার জন্য যে, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো একজন অপরাধী। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান নেতা এন্ড্রু শিয়ার বার বার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগ দাবী করে আছেন।
বিরোধী দলগুলোর কাছে জোডি উইলসন এখন একজন হিরোইন হিসাবে আভির্ভূত হয়েছেন। কারণ তিনি তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার জমাটবাঁধা পিচ্ছিল তুষার পথে লবন ছিটিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, আজকে বিরোধী দলের কাছে হিরোইন বনে যাওয়া এই জোডি উইলসনেরই অপসারণ চেয়েছিলেন তারা ইতিপূর্বে যখন তিনি আইন মন্ত্রী ছিলেন। কানাডার একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক নীল ম্যাকডোনাল্ড তার এক লেখায় বলেন, গত ক্রিসমাসের সময় বিরোধী দল এনডিপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও এমপি চার্লি অ্যাঙুস প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবী করেছিলেন তখনকার আইনমন্ত্রী ও এটর্নি জেনারেল জোডি উইলসনকে যেন তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়। তিনি অভিযোগ করে বলেছিলেন, জোডি তার মন্ত্রণালয়ে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি করেছেন। জোডির বিরুদ্ধে তিনি পরশ্রীকাতরতা, বিদ্ধেষ, হিংসা ইত্যাদির অভিযোগও তুলেছিলেন।
অন্যদিকে জোডি উইলসনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে প্রধান বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ পার্টির একজন এমপি লিসা রেইট-ও অভিযোগ তুলেছিলেন এই বলে যে, তিনি পার্লামেন্টে দাড়িয়ে ডাহা মিথ্যা কথা বলছেন। উল্ল্লেখ্য যে, কানাডায় অপর এমপি’র বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ তোলাকে শিষ্টাচারবহির্ভূত কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে লিসা রেইট পরে তার এই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চান। তবে তিনি জোডির বিরুদ্ধে যে সমালোচনা করেছেন সেটা তিনি সঠিক করেছেন বলে জানান।
কিন্তু আজকে এই লিসা রেইট বা চার্লি অ্যাঙুস এর মত রাজনীতিবিদরাই আবার জোডি উইলসনকে হিরোইন পদে বসিয়েছেন। জোডি যখন পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন তিনি এসএনসি-লাভালিন বিষয়ে সত্যটা তুলে ধরতে চান তখন এই বিরোধী দলের সদস্যরা পার্লামেন্টে তুমুল করতালির মাধ্যমে তার প্রতি সম্মান জানান। শুধু করতালি নয়, তার প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের জন্য সবাই তখন দাঁড়িয়ে যান।
আবার জোডি উইলসনকে হিরোইন এর আসনে বসাবার পিছনে অবদান রেখেছেন লিবারেল পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী জেন ফিলপট-ও। তিনি জোডিকে সমর্থন দেয়ার জন্য মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং বলেন সরকারের দুর্নীতি তদন্ত পরিচালনার বিষয়ে তিনি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। উল্ল্লেখ্য যে, ফিলপট জোডি উইলসনের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু হিসাবে পরিচিত। আর এখানেও একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, জোডির বন্ধু হিসাবে পরিচিত এই এমপি ও সাবেক মন্ত্রী ফিলপট ইতিপূর্বে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন টেক্সপেয়ারদের অর্থে লিমোজিনে চড়ে বিলাস ভ্রমণের জন্য। তার বিরুদ্ধে যখন এই অভিযোগ উঠে তখন তিনি সত্য গোপন করে পার্লামেন্টকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়।
সিবিসির এক নিউজে বলা হয়, কনজার্ভেটিভ পার্টির এমপি ডেন এলবাস ঐ সময় আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চেয়েছিলেন ফিলপট কেন জনগনের অর্থ ব্যয় করে বিলাসবহুল লিমোজিন ব্যবহার করেছিলেন। তখন তিনি সুস্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, তিনি কোন বিলাসবহুল লিমোজিন ভাড়া করেননি।
ফিলপট তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তার ডিপার্টমেন্ট থেকে তার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পার্লামেন্টকে জানানো হয়েছিল, “সরকারী কাজে ভ্রমণের জন্য মন্ত্রী দেশে বা দেশের বাইরে কোন লিমোজিন ভাড়া করেননি।”
কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে তিনি গ্রেটার টরন্টোতে সফরের সময় মাত্র একদিনেই ১,৭০০ ডলার ব্যয় করেছেন একটি লিমোজিন সার্ভিস এর পিছনে। আর এই লিমোজিন সার্ভিসের মালিক এমন একজন ব্যক্তি যিনি ফেডারেল নির্বাচনের সময় তার পক্ষ হয়ে প্রচারকার্য চালিয়েছিলেন।
কানাডিয়ান প্রেস এর এক খবরেও বলা হয় ফিলপট নায়েগ্রা ফসল এলাকায় আদীবাসীদের এক অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য ইতিপূর্বে লিমোজিন সার্ভিসকে ১,৯৯৪ ডলার পে করেছেন। একই সময়ে টরন্টো পিয়ারসন বিমান বন্দরে আরো ২০ টি ট্রিপের জন্য এই একই লিমোজিন সার্ভিস কে তিনি ৩,৮১৪ ডলার পে করেছেন।
বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে ফিলপট পরে অনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চান তার ঐ বিলাসী ভ্রমণের জন্য। তিনি এই ধরণের কাজ আর করবেন না জানিয়ে বলেন ঐ দুই বিলের পরিমাণ থেকে তিনি নিজের পকেট থেকে ৩,৭০৩ ডলার পে করবেন।
জেন ফিলপটের এই আচরণকে অনেকেই সেদিন অসাধুতা হিসাবে উল্ল্লেখ করেছিলেন। আর সেই ফিলপটই এখন সরকারের দুর্নীতি তদন্ত পরিচালনার বিষয়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন এই দাবী করে জোডি উইলসনের পক্ষ নেন এবং নিজ দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই বলে যে, জোডি উইলসন এবং জেন ফিলপট কি সত্যিকার অর্থেই নৈতিকতার প্রশ্নে পদত্যাগ করেছেন নাকি বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এ কাজ করছেন? অথবা নিছকই ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটানোর জন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছেন?
এ প্রসঙ্গে দীর্ঘদিনের লিবারেল এমপি জুডি স্ক্রো সিবিসি রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জোডি উইলসন এবং জেন ফিলপট দায়ী করে বলেন, তারা তাদের হতাশা আর ক্রোধ মেটানোর জন্য এসএনসি-লাভালিন বিষয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে টার্গেট করছেন। আর এর মধ্য দিয়ে তারা বিরোধী দলের হাতে তুরুপের তাস তুলে দিচ্ছেন।
উল্ল্লেখ্য যে, সপ্তাহখানেক আগে লিবারেল ককাস এর এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে জেন ফিলপটকে অন্যান্য এমপিদের কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তিনি নাকি ঐ বৈঠকে দাবী করার চেষ্টা করছিলেন এই বলে যে তিনি নীতি রক্ষার্থে এবং দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে পদত্যাগ করেছেন। এই সময় অনেকে তার লিমোজিন কেলেংকারীর কথা তাকে স্বরণ করিয়ে দেন। সিবিসি নিউজকে এ তথ্য দেন বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন।
অন্যদিকে কানাডিয়ান প্রেস এর এক খবর থেকে জানা যায়, কানাডার সুপ্রিম কোর্ট এর চিফ জাস্টিস পদে নমিনেশন দেয়ার জন্য জোডি উইলসন বিতর্কিত কজারভেটিভ জাজ গ্লেন জয়ালের নাম সুপারিশ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নিকট। এটি ২০১৭ সালের কথা। জাস্টিন ট্রুডো তখন রাজী হননি। জোডি উইলসনের সঙ্গে জাস্টিন ট্রুডোর বিরোধের সূত্রপাত তখন থেকেই শুরু বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
জোডি উইলসন নাকি আবার প্রধান্ত্রীকে কয়েকটি শর্ত দিয়েছিলেন আপস করার জন্য। সিবিসি নিউজের এক খবরে বলা হয়, গত প্রায় দুই মাস ধরেই চলছিল আপস এর চেষ্টা। তবে জোডির শর্ত ছিল, আপস করতে হলে প্রধানমন্ত্রীকে তার কার্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীকে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে অথবা দলের ককাসে ক্ষমা চাইতে হবে।
জোডি উইলসনের এই শর্তসমূহের ব্যাপারে অনেকেই চোখ কপালে তুলেছিলেন। তাদের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী কাকে নিয়ে অফিস চালাবেন বা দেশ পরিচালনা করবেন সেটি কি ডোডির নির্দেশ মত করতে হবে? আর প্রধানমন্ত্রীতো কোন অপরাধ করেননি। তা হলে ক্ষমা কেন চাইতে হবে?
আমরা উপরে দেখেছি, জোডি উইলসনের বিষয়ে বিরোধী দলের অভিযোগ কম ছিল না। তিনি মন্ত্রণালয়ে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি করেছেন এমন অভিযোগ তারা ইতিপূর্বে করেছে। তার বিরুদ্ধে পরশ্রীকাতরতা, বিদ্ধেষ, হিংসা ইত্যাদির অভিযোগও তুলেছে বিরোধী দল ইতিপূর্বে। তিনি বিতর্কত এক ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে দেখতে চয়েছিলেন এমন তথ্যও এখন সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। অন্যদিকে জেন ফিলপট ইতিপূর্বে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন টেক্সপেয়ারদের অর্থে লিমোজিনে চড়ে বিলাস ভ্রমণের জন্য। তার বিরুদ্ধে যখন এই অভিযোগ উঠে তখন তিনি সত্য গোপন করে পার্লামেন্টকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলেও জানা যায়। সুতরাং জনগণ এখন কাকে বিশ্বাস করবে? আর তারা প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করছেন সেটি কি কোন প্রমাণিত সত্য?
সামনে ফেডারেল নির্বাচন। আর মাত্র সাত মাস বাকি। এরকম একটা মূহুর্তে নিজ দলের সরকারের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করার অর্থ নিশ্চিতভাবেই বিরোধী দলের নিকট বল ছেড়ে দেয়া এবং আসন্ন নির্বাচনে নিজ দলের ভড়াডুবির পথ পরিষ্কার করা। এটুকু বোঝার ক্ষমতা নিশ্চই জোডি আর ফিলপটের আছে। তা হলে তারা কেন এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আর তারা যদি মনেপ্রাণে বিশ্বাসই করে থাকেন যে লিবারেল পার্টির প্রধান নেতা জাস্টিন ট্রুডো দুর্নীতিগ্রস্ত তবে তারা লিবারেল পার্টির সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করেননি কেন নিজ থেকে? কেনই বা বলে আসছিলেন আগামী নির্বাচনে লিবারেল পার্টির হয়েই আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন? এই স্ববিরোধীতা কেন?
কানাডার সাবেক এমপি এবং সাবেক উপ প্রধানমন্ত্রী শিলা কপস্ টরন্টো স্টার এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন, জোডি উইলসন এবং জেন ফিলপট এর এই ধরণের স্ববিরোধী আচরণের কোন অর্থই হয় না। এরা একদিকে সরকারের উপর অনাস্থা প্রকাশ করে মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করছেন আবার অন্যদিকে লিবারেল ককাসে অবস্থান করছেন। ককাস হলো সরকারের একটি লেজিসলেটিভ ব্রাঞ্চ। কেবিনেট ও ককাস হাত ধরাধরি করে চলে। একটির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে আরেকটির সঙ্গে চলা সম্ভব নয়।
এদিকে টরন্টো স্টার কর্তৃক পরিচালিত এক জরীপেও দেখা গেছে জোডি উইলসন ও জেন ফিলপট লিবারেল ককাসে থাকুক এই মতের পক্ষে ছিলেন না শতকরা ৮১ জন কানাডিয়ান। এই জরীপ ফলাফলটি ২৭ মার্চ এর।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ