প্রদেশগুলোর ইমিগ্রেন্ট ইনভেস্টর ভিসা বন্ধ করা উচিৎ

কানাডার প্রদেশগুলোর জন্য সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে ভিসা বিক্রি বন্ধ করার এখনই সময়

নভেম্বর ৪, ২০১৮

অ্যালান ফ্রিম্যান

অভিবাসী-বিনিয়োগকারী ভিসা নামে কথিত এই ভিসা দিয়ে কানাডার কোনও ব্যবসায় সক্রিয়ভাবে বিনিয়োগ বা প্রাদেশিক সরকারকে অর্থ ধার দেওয়ার বিনিময়ে সম্পদশালী অভিবাসীদেরকে এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস এবং নাগরিকত্ব পাবার প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়।

কিন্তু বাস্তবে এই ভিসা কর্মসূচি হলো প্রধানত চীনের মূল ভূখন্ড থেকে আসা বিত্তবান ব্যবসায়ীদের জন্য এমন একটি অবাস্তব কর্মসূচি যার সুযোগ নিয়ে তারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কানাডায় একটি লুকিয়ে থাকার জায়গা করে নেয়। ভ্যাঙ্কুভার বা টরন্টোতে একটি চড়া দামের কন্ডো কিনে শূন্য ফেলে রাখা ছাড়া তারা কখনই হয়তো এদেশে আসার বা বসবাসের চিন্তাও করে না।

এর চেয়েও যেটা গুরুতর সেটা হলো, এই কর্মসূচি আসলে সেইসব বিবেকহীন লোকেদের জন্য কানাডাকে মানি লন্ডারিংয়ের কাজে ব্যবহারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো এবং সেইসব অভিবাসন বিষয়ক পরামর্শক, প্রশ্নবিদ্ধ আইনজীবী ও বিনিয়োগ উপদেষ্টাদের একটি পঙ্কিল চক্রকে কার্যত উৎসাহিত করা যারা সম্ভাব্য অভিবাসীদের কাছ থেকে গলাকাটা ফি আদায় করে।

কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালে এই অভিবাসী-বিনিয়োগকারী ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু কিছু প্রদেশ তথাকথিত প্রাদেশিক নমিনি প্রোগ্রামের নামে এটি এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। এধরণের একটি প্রদেশ হলো প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড।

বহু অনিয়মের কারণে অনুরূপ একটি কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ার ১০ বছর পর আরেক নতুন কেলেঙ্কারীর ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রদেশ কর্তৃপক্ষ প্রাদেশিক নমিনি প্রোগ্রামের মাধ্যমে আসা উদ্যোক্তার ¯্রােত বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।

২০০৮ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৫৬৬ জন নতুন অভিবাসীকে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করতে দেওয়ার অভিযোগে কানাডার বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সি সম্প্রতি অভিবাসন আইনে শার্লটি টাউনের দুটি হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ওই অভিবাসীরা শেরউড মোটেলকে তাদের প্রধান আবাসস্থল হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিলো। এর ফলে মোটেলটি জনবহুল হবার কথা।

প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের কর্মসূচির আওতায় সম্ভাব্য অভিবাসীদেরকে প্রাদেশিক ডিপোজিট হিসাবে প্রদেশটিকে দ্ইু লাখ ডলার জমা দিতে হয়। তবে সেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে ওই অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। এটি নতুন কানাডীয় নাগরিকদের জন্য এক সুলভ সুযোগ। গত বছর নভেম্বরে প্রাদেশিক সরকার ডিপোজিট রাখা সম্ভাব্য অভিবাসীদের দুই-তৃতীয়াংশের অর্থ জব্দ করেন, কারণ তারা নিয়ম অনুযায়ী কাজ করেননি এবং সেখানে কোনও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেননি।

লক্ষ্য করলে যে কারও কাছে এটা স্পষ্ট হবে যে, এই তথাকথিত অভিবাসী বিনিয়োগকারীদের শার্লটি টাউন বা সামারসাইডে কোনও ধরণের স্যুভেনির শপ বা দোকান করার ইচ্ছা কখনই নেই। তারা নিছক কানাডায় ঢোকার একটি চোরাপথ খুঁজছিলেন যাতে করে তারা বা তাদের সন্তানরা এদেশে এসে মার্কহ্যাম বা রিচমন্ডের মত জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। মূলত অভিবাসী আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে বেপরোয়া হবার কারণে দ্বীপ প্রদেশের কর্মকর্তা ও রাজনীতিকরা এ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছেন।

কুইবেকে অভিবাসী বিনিয়োগকারী কর্মসূচি আরও বড় এবং সেখানে এর অপব্যবহারও বহুমাত্রিক। চলতি মাসে রেডিও-কানাডা টিভির অনুষ্ঠান এনকুইটিতে প্রচারিত এক রিপোর্টে বিষয়টি উঠে এসেছে।

অনুষ্ঠানে তুলে ধরা নথিপত্রে দেখানো হয়েছে যে, কুইবেকের ওই কর্মসূচি চীনা ব্যবসায়ীদের জন্য কানাডার স্থায়ী আবাসিকের মর্যাদা কিনে নেওয়ার একটি অদৃশ্য ড্রেন। তারা কুইবেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছার কথা জানায় কিন্তু এমনকি একবারের জন্যও এখানে না এসেই অভিবাসী হয়ে যায়। এক হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮৬ সাল থেকে এ পযন্ত ওই কর্মসূচির আওতায় যে হাজারও বিনিয়োগকারী অভিবাসী কুইবেকে এসেছেন তাদের ৮৫ শতাংশই হয় অন্টারিওতে অথবা ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় চলে গেছেন।

এনকুইটির রিপোর্টে মি. চেন নামের এক চীনা ব্যবসায়ীর ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে যিনি কুইবেকে বিনিয়োগকারী অভিবাসী হতে চান। রিপোর্টে কুইবেকের অভিবাসন আইন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে মি. চেন-এর আলোচনার গোপনে ধারণ করা ভিডিও দেখানো হয়। এটি চোখ কুলে দেওয়ার মত একটি ঘটনা।

মি. চেন যখন ওই আইনজীবী ও উপদেষ্টাদের বলেন যে, কর্মসূচির পূর্বশর্ত হলেও তিনি আসলে কুইবেকে বসবাস করতে চান না। তখন তাকে বলা হয় যে, এটা কোনও সমস্যা নয়। একজন আইনজীবী পরামর্শ দেন যে, কুইবেকে নিজের একটি ঠিকানা আছে এটা প্রমাণের জন্য মি. চেন মন্ট্রিয়লে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনে ফেলে রাখতে পারেন। এটা যদি খুব বেশি ব্যয়বহুল মনে হয় তাহলে তিনি ওই আইনজীবীর মন্ট্রিয়লে অবস্থিত আইনী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানাটিই নিজের আবাসনের ঠিকানা হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন।

মি. চেন যখন স্বীকার করেন যে তার সম্পদের উৎস পুরোপুরি স্বচ্ছ নয় এবং তিনি আসলে বন্ধকী কারবারের দোন চালান এবং মানি-লন্ডারিং ব্যবসায় যুক্ত তখন একজন উপদেষ্টা পরামর্শ দেন যে, মি. চেন তার অবৈধ সম্পদ ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে লুকিয়ে রাখতে এমনকি ক্যারিবীয় অঞ্চলের কোনও দ্বীপের পাসপোর্ট কিনে নিজের দ্বিতীয় পরিচয় গ্রহণ করনে পারেন। ক্যারিবীয় দ্বীপে টাকা হলেই পাসপোর্ট কিনতে পাওয়া যায়। আইনজীবী হিসাবে পরিচয় দেওয়া ওই নারী প্যারালিগ্যাল (আইন বিষয়ে যার শিক্ষা আছে কিন্তু চূড়ান্ত ডিগ্রি নেই) বলেন, “আপনি মি. চেন হতে পারেন, কিন্তু সে নাম পাল্টে আপনি ব্র“স লি-ও রাখতে পারেন।”

অন্যান্য বিষয়ে অভিজ্ঞতা যদি কোনও সূচক হয় তাহলে এই কর্মসূচি হলো বিষাক্ত, এতে ভুল লোকদের বাছাই করা হচ্ছে এবং এর যে অর্থনৈতিক লক্ষ্য তা খুব কমই অর্জিত হচ্ছে।

সীমান্তের দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেনশিপ ও অভিবাসন সার্ভিস সম্প্রতি ভারমন্টে ইবি-৫ নামের অভিবাসী-বিনিয়োগকারী কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে।

সেখানে অভিবাসী-বিনিয়োগকারী কর্মসূচির ২০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থের অপব্যবহার থেকে জে পিক স্কি রিসোর্টের উদ্যোক্তদেরকে বিরত রাখতে রাজ্য কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার জন্য ওই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ওই অর্থ বেশ কিছু প্রশ্নবিদ্ধ কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করা হয়েছিলো।

অস্ট্রেলিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাধীন পরামর্শক সংস্থা অস্ট্র্যাক ২০১৬ সালে দেশটির ‘সিগনিফিসেন্ট ইনভেস্টর ভিসা’ কর্মসূচি বাতিল করার সুপারিশ করে। মানি লন্ডারিং সম্পর্কিত নজরদারির ওই প্রতিষ্ঠানটি বলেছে যে, ওই ভিসা কর্মসূচির আওতায় আবেদনকারীদের অর্থ ও সম্পদের উৎস চিহ্ণিত করা দুরূহ কারণ এই সম্পদ অর্জনের বিষয়টি প্রায়শ বৈদেশিক আইনগত কর্তৃত্বের আওতায় পড়ে। সংস্থাটি বলেছে, ওই কর্মসূচি থেকে সরকারের লাভ হয় খুবই সামান্য, যা কিছু লাভ হয়, ভিসা আবেদনকারী ও তহবিল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত লোকেদের।

তখন থেকে অস্ট্রেলিয়া ন্যূনতম বিনিয়োগের সীমা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়িয়ে ৫০ লাখ ডলারে উন্নীত করে এবং এ বিষয়ে নজরদারি জোরদার করে।এর ফল হয়েছে এই যে, আবেদনকারীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। আপনি যদি কুইবেকের কর্মসূচির নিয়ে কানাডায় ডুকতে পারেন তাহলে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে ভাবার দরকার কি। কুইবেকে সরকারকে মাত্র ১২ লাখ ডলার দিতে হয় পাঁচ বছরের জন্য এবং সেটাও আবার সুদমুক্ত।

এটা সত্য যে আটলান্টিক তীরবর্তী প্রদেশগুলো এবং কুইবেকে অভিবাসী আকৃষ্ট করা এবং তাদের ধরে রাখা নিয়ে বড় ধরণের সমস্যা আছে। তবু ধনাঢ্য অভিবাসীদের কাছে ভিসা বিক্রি করার মাধ্যমে অভিবাসী সংখ্যা বাড়ানোর চিন্তাটাই এক ধরণের ভ্রান্তি। প্রকৃতপক্ষে এরা কোনওভাবেই কর্নারব্র“ক বা ড্রুমন্ডভিলিতে স্থায়ীভাবে থাকতে চায় না।

অথচ এসব জায়গার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এগুলো কানাডার বড় শহরগুলোর মত সম্পদশালী নয় কিন্তু এখানে আবাসন সুবিধা সুলভ এবং কানাডায় সহজে নতুন জীবন শুরু করার জন্য এগুলো সবচেয়ে ভাল জায়গা। ম্যানিটোবার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, সেখানে ফিলিপাইনের মতো বিভিন্ন স্থান থেকে কঠোর পরিশ্রমী অভিবাসীদের আকৃষ্ট করা সম্ভব যারা কানাডাকে অসুস্থ উপায়ে অর্জিত সুবিধা হিসাবে না দেখে এখানকার সমাজে সত্যিকারের অবদান রাখতে পারে।

অভিবাসী হিসাবে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কানাডা বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। ভিসা ও পাসপোর্ট বিক্রি করাটা অবমাননাকর এবং এটা নেতিবাচক ফল বয়ে আনে।

-আইপলিটিক্স

(এ্যলান ফ্রিম্যান ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার পাবলিক এ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স এর একজন অনারারী সিনিয়র ফেলো।)