এই পরবাসে রবে কে-৭

নভেম্বর ৪, ২০১৮

নাজমুল ইসলাম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

এদেশে ৯১১ কল করলে ইমাজেন্সি পুলিশ যেমন দ্রুত চলে আসে, নন-ইমার্জেন্সি সেরকম নয়। এখানে নন-ইমার্জেন্সিতে কল দিলে পুলিশ আসতে বেশ সময় নেয়। কন্যাকে নিয়ে অটোশপ থেকে ৫০-৬০ গজ দুরে অপেক্ষা করছিলাম। প্রায় দু’ঘন্টা পরে পুলিশ এসে আমাদের কল দিয়ে সেই অটোশপের গেটে ডাকলো। গিয়ে দেখি পুলিশ আমার দেয়া ঠিকানা মোতাবেক সেই দোকানের সামনে হাজির। গত পর্বে একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় উল্লেখ করতে ভুলে গেছি। সেটা হলো, আগেরদিন সকালবেলা প্রথমবার যেয়েই লক্ষ্য করি বিজনেস কার্ডের তথ্য মোতাবেক ডিএমকে অটো সার্ভিস নামে কোন দোকান বা সাইনবোর্ড কিছুই সেখানে নেই।

পুলিশ অফিসার দুজনের মধ্যে একজন বেশ একটু বিরক্তি নিয়েই আমার কাছে ঘটনা জানতে চাইলে আমি এদেশে নবাগত হিসাবে নিজের পরিচয় দিয়ে পুলিশ অফিসারকে আমার সঙ্গে প্রিন্ট করে নিয়ে যাওয়া বিবরণটা হাতে ধরিয়ে দিলাম এবং পড়তে অনুরোধ করলাম। আমার ধারণা ছিল পুলিশ আমার এই বিশদ বিবরণ লেখা কাগজ পড়বে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বেশ কয়েক মিনিট খরচ করে পুলিশ অফিসার দু’জন আমার লেখা বিবরণটি মনযোগ দিয়ে পড়লো। পড়ার পর জানতে চাইলো ‘এখানে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে’? যে লোকাটি আমাদের সঙ্গে আগেরদিন চোটপাট করেছিল, তার নাম জেম। লক্ষ্য করছিলাম, জেম আমাদের মোটামুটি কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করলেও সে আমাদের না দেখার এবং না চেনার ভান করছে।

পুলিশের প্রশ্নে আমি জেমকে দেখিয়ে দিলাম। জেম আমাদের সঙ্গে আগের দিন খারাপ ব্যবহার করেছিল। আমাকে দেখার পর হয়তো তার সেই রাগ আবার উথলে উঠেছে। কালপ্রিটরা তাদের আচার আচরণের জন্য নিজের ফাঁদে নিজেই পড়ে। জেম পুলিশের সঙ্গে উচ্চস্বরে হাত পা ছুঁড়ে কথা বলা শুরু করতেই পুলিশ অফিসার এক ধমক দিয়ে তাকে নিচু গলায় আঙ্গুল না নাচিয়ে কথা বলতে বললো। তখন জেম পুলিশকে পাত্তা না দিয়ে তার বস্-এর সঙ্গে কথা বলতে বলে দোকানের ভিতরে চলে গেল। কে কালপ্রিট আর কে ভিকটিম এদেশে পুলিশ সেটা দ্রুত বুঝতে পারে কিনা জানি না, তবে একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম, পুলিশ যদি একবার বুঝতে পারে কে ভিকটিম, তাহলে তাকে অন্তত সাহায্য করে।

আমি আগের দিনের সেই তথাকথিত বস্-এর নম্বরে ফোন দিয়ে পুলিশকে ফোন ধরিয়ে দিলাম। ফোন লাউড স্পীকারে দেয়া ছিল বলে সবই শোনা যাচ্ছিল। পুলিশ কথা বলার এক পর্যায়ে যখন সেই তথাকথিত ‘বস্’ তার বস্-এর সঙ্গে পুলিশকে কথা বলতে বললো। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অফিসারটি বেশ একটু ধমকের সুরেই বলে উঠলো, ‘তুমিই বস্, তুমিই আমার সঙ্গে কথা বলো’। পুলিশকেও সে একই হাইকোর্ট দেখাতে চেষ্টা করলো। পুলিশ টোয়িং চার্জ বেশী হবার কারণ জানতে চাইলে সেই বস্ জানালো, যে তারা গাড়ী পাঁচ কিলোমিটার দুরে একটা পাউন্ডে রেখে এসেছে। পুলিশ গাড়ী দুরে রেখে আসার কারণ জানতে চাইলে ‘বস’ ফোনের ওপাশ থেকে আবারও গল্প দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। তাদের এই পাউন্ড বা স্টোরেজ রেজিস্টার্ড নয়। তাই তারা গাড়ী রেজিস্টার্ড পাউন্ডে রেখে এসেছে…… গভীর রাত পর্যন্ত স্টোরেজ খোঁজার জন্য গাড়ীসহ টো-ট্রাক নিয়ে তাদের সারা টরন্টো শহর ঘুরে বেড়াতে হয়েছে…. ইত্যাদি ইত্যাদি।

এসব শুনেই পুলিশ বললো, ‘তাহলে তো তোমাদের এই পুরো প্রপার্টি আমাকের ইনস্পেক্ট করতে হবে’। সাপুড়িয়ার তাবিজ দেখে সাপ যেমন চুপসে যায়, পুলিশের এক কথায় বস্ যেন হঠাৎ সেরকম চুপসে গেল। ‘জোঁকের মুখে নুন’ যাকে বলে আর কি। কথা বলার এক পর্যায়ে ‘বস্’ পুলিশকে ফোনে রেখে কিছুক্ষণ সময় নিল। সম্ভবত তখন বস্ জেমকে ফোন করেছে। কারণ লক্ষ্য করলাম জেম তার ফোনে কথা বলতে বলতে পুলিশের কাছে এসে ফোনটা পুলিশকে ধরিয়ে দিল। পুলিশ আরও কিছুক্ষণ টোয়িং চার্জ নিয়ে কথা বলার পর এবার ‘বস্’কে ফোনের লাইনে রেখে আমার কাছে জানতে চাইলো যে, আমি টোয়িং চার্জ কত দিতে চাই? বললাম, এক্সিডেন্ট স্থল থেকে এখানে আনতে সাধারণত যে রেটে চার্জ নেয়া হয়, তা দিতে আমি রাজী। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত পুলিশ ৩০০ ডলারে রফা করে দিয়ে সেই ‘বস্’কে জানালো, এক্ষনি যেন (তাদের উপস্থিতিতে) গাড়ী পাউন্ড থেকে বের করে আনা হয়।

আমি আর আমার মেয়ে বিরস বদনে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে পুলিশ অফিসারদের একজন আমাকে বললো, ‘মন খারাপ করো না। আমরা যেহেতু এর মধ্যে ইনভলভ হয়ে গেছি, এরা আর তোমাদের হার্ড টাইম দেবে না’। জেম এসে পাউন্ডের গেট খুলতেই পুলিশ অফিসার আমাকে ডেকে নিয়ে ভিতরে গিয়ে আমার গাড়ী সনাক্ত করতে বললো। আমি যেয়ে দেখি আমার গাড়ী তারা পাউন্ডের অনেক ভিতরের দিকে ঢুকিয়ে রেখেছে। আমার গাড়ীর পরে আরও চার পাঁচটা গাড়ী, ফর্ক লিফট, ববক্যাট ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের মেশিনপত্র সামনে রেখে আমার গাড়ীটা এমনভাবে ব্লক করে রেখেছে যেন সহজে বের না করা যায়। এখন এই সবকিছু সরিয়ে তারপর আমার গাড়ী বের করতে হবে।

জেম একবার পুলিশকে বলতে চেষ্টা করলো, ‘গাড়ী বের করতে লোক লাগবে… আজ তাদের লোক নেই… সময় দিতে হবে…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। পুলিশ সোজা জানিয়ে দিল, যে গাড়ী না বের করা পর্যন্ত তারা সেখান থেকে যাবে না। জেম রাগে গজ গজ করতে করতে আমার গাড়ী বের করার কাজে লেগে গেল। আমার টোয়িং ইনসিওরেন্স বা সার্ভিস টোয়িংয়ের ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চেয়ে অফিসার সেখানে ফোন দিতে বললো। কানাডিয়ান টায়ার রোডসাইড অ্যাসিস্ট্যান্সের মেম্বারশিপ আছে আমার। কল দিতে গিয়ে দেখি ফোনের চার্জ জিরো। পুলিশ অফিসার তার ফোন এগিয়ে দিলেন। সেটা দিয়েই কাজ সারলাম। টো-ট্রাক আসতে ঘন্টাখানেক সময় লাগেবে।

অফিসার দু’জনের একজন এই সময়ে আমার আর আমার মেয়ের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করলো। কবে এসেছি এ দেশে? এখানে কেমন লাগছে? দেশে কি করতাম? কোথায় থাকি? ইত্যাদি। আলাপের এক পর্যায়ে পুলিশ অফিসারটি বললো, ‘তোমার গাড়ীটা বের করা হয়ে গেলে আমরা চলে যাবো। তুমি এটা যত তাড়াতাড়ি পারো এখান থেকে নিয়ে যাবে’। ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম।

প্রায় ঘন্টাখনেক লেগে গেলেও অবশেষে গাড়ী বের করা হলো। আমি চাচ্ছিলাম আরও দেরী হোক যাতে এরমধ্যে টো-ট্রাক এসে যায়। এখন পুলিশ চলে যাবে। কারণ গাড়ী বের করা হয়ে গেছে। বিদায় নেয়ার সময় অফিসার দু’জন যা বলে গেলেন, তাতে আমি যেন একটু ধাক্কা খেলাম। অফিসার বললেন, ‘এ জায়গাটা খুব একটা ভাল না, আমরা চলে যাচ্ছি। সম্ভব হলে তোমার মেয়েকে বাসায় পাঠিয়ে দাও। আর তুমি থাকো। টো-ট্রাক এলে গাড়ী নিয়ে চলে যাও’। আমি অবশ্য আমার মেয়েকে নিয়েই অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখনও টো-ট্রাক আসার কোন খবর নেই।

কাহিনী শেষ হয়েও হয় না। জেম গাড়ী বের করেই পুলিশের রফা করে দেয়া ৩০০ ডলার দাবী করে বসলো। ক্যাশ দিতে হবে। নইলে গাড়ীর চাবি দেবে না। এদিকে আমার কাছে কোন ক্যাশ টাকা নেই। কার্ডে দিতে চাইলে আবার চেঁচামেচি করে উঠলো সে। জানালো তাদের নাকি কার্ডে টাকা নেবার ব্যবস্থা নেই। ক্যাশ ছাড়া হবে না। এখনই দিতে হবে। নইলে গাড়ী আবার পাউন্ডে ঢুকিয়ে রাখবে। মহাবিপদ হলো দেখি। পুলিশও চলে গেছে।

হঠাৎ দেখি একটু দুরে দাঁড়িয়ে টো-ট্রাকের ড্রাইভার ছেলেটি আমাকে হাত ইশারা করে ডাকছে। দুর থেকেই লক্ষ্য করলাম ড্রাইভার আমার পূর্বপরিচিত। নাম আমীর সোহেল। বাড়ি পাকিস্তান। মাস ছয়েক আগে আমার গাড়ী পথে নষ্ট হওয়ায় সে একবার টো করেছিল। আমাকে ইশারায় কাছে যেতে বললো। সে এখানকার পরিবেশের সঙ্গে ভালভাবেই পরিচিত মনে হলো। কাছে যেতেই বললো, তোমরা এখানে এসেছো কেন? এরা ভয়ংকর খারাপ। এখান থেকে তাড়াতাড়ি চলো যাই’। আমি বললাম এরা তো গাড়ী দিতে ঝামেলা করছে। ক্যাশ টাকা চাচ্ছে। আমার কাছে তো ক্যাশ টাকা নেই। কার্ড আছে। ছেলেটি বললো, ‘তোমার ক্যাশ দরকার? আমার কাছ থেকে নাও। বাসায় যেয়ে আমাকে দিও’। জেমকে টাকা দিয়ে গাড়ীর চাবি নিলাম। টো-ট্রাক সেট করা হয়ে গেলে আমিও মেয়েকে নিয়ে সোহেলের সঙ্গে টো-ট্রাকে উঠে বাসায় চলে এলাম।

দু’দিনের অভিজ্ঞতায় যেন বাকরহিত হয়ে গিয়েছিলাম। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, এদেশেও তাহলে গ্রে-এরিয়া আছে। এদেশে আসার আগে মনে হয়েছিল এখানে সবকিছুই খুব সুন্দর, সিসটেম্যাটিক। হ্যাঁ, এখানে অনেক কিছুই সিসটেম্যাটিক। কিন্তু বাতির নিচেও তো কখনও কখনও অন্ধকার থাকে।

মাঝ বয়স পেরিয়ে স্কীলড ওয়ার্কার ইমিগ্রেশনে এদেশে এসেছি। অথচ এখানে স্কীলড ইমিগ্রেশনে আসা ইমিগ্র্যান্টদের অবস্থা দেখলে হতাশ হতে হয়। এ প্রসঙ্গে আমেরিকা প্রবাসী আমার এক ভাগ্নের কথা মনে পড়ছে। সে আমাকে প্রায়ই ফোন করে কানাডায় স্কীলড ইমিগ্র্যান্টদের স্কীলস কিভাবে অপচয় হচ্ছে সেটা নিয়ে দুঃখ করে। মাঝে মাঝে মনে হয়, দেশে তো খারাপ ছিলাম না। ভাল একটা চাকরি, সামাজিক সম্মান, সবই ছিল। তাহলে কী ছিল না?

পরে নিজেকে সান্তনা দিতে চেষ্টা করলাম। দেশে যা ছিল না, কিংবা যা থাকা দরকার ছিল, তা তো এখানে আছে। বাচ্চাদের পড়ার জন্য দেশের তুলনায় ভাল স্কুল আছে এবং তাতে পড়ালেখার ব্যবস্থা আছে। কেউ বাটপারি করলে তাকে শায়েস্তা করার জন্য পুলিশের সাহায্য পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। রাস্তায় দশ মিনিটের পথ দশ মিনিটেই যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ভেজালমুক্ত খাবারের ব্যবস্থা আছে। বিশুদ্ধ পানি আছে। রাস্তায় হাঁটবার যায়গা আছে। সাধারণ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা আছে।

আর, কী নেই? অফিস আদালতে ঘুষ তদবিরের ব্যবস্থা নেই। রাত বিরাতে চলাচলে কোন বাধা নেই। মধ্যরাতে নিরাপত্তার নামে ইয়াবা বা অন্য কোন মাদক কেসে ফাঁসানোর জন্য কেউ গাড়ী থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে না- ‘কই যান? গাড়ী চেক করতে হবে’।

নাজমুল ইসলাম , টরন্টো, কানাডা।

nazmul13@gmail.com