প্রবাসে দাদা-দাদী বা নানা-নানী থাকাটা এক ধরণের আশীর্বাদ
জুলাই ৬, ২০১৮
আসফিয়া ইয়াসির
কোনও একক পরিবারে দাদা-দাদী বা নানা-নানী থাকলে তারা হতে পারেন রতেœর মত অত্যন্ত মূল্যবান। দৈনন্দিন জীবনে তারা কী ভূমিকা রাখলেন সেই বিবেচনা না করেও বলা যায়, কেবল তাদের অবস্থানটাই পরিবারের অন্য সবার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে।
একটি পরিবারের চৌহদ্দিতে এই প্রভাব হতে পারে নিঃসঙ্গতা দূরীকরণ থেকে শুরু করে সদস্যদের মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় করা অথবা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা বয়ে নিয়ে যাওয়া। অনেক অভিবাসী পরিবারে বাস্তবতার আলোকে দেখা যায়, দাদা-দাদীরা শিশুদের দেখাশোনার মাধ্যমে অনন্য ভূমিকা পালন করেন এবং এই খাতে যে অর্থ ব্যয় হতো তা বাঁচিয়ে দেন।
রিতু গনেশ-এর জন্য ডেকেয়ার সেন্টারের ব্যয় তার সামর্থের চেয়ে বেশি। তার ১৮ মাস বয়সী মেয়ে ডেকেয়ার সেন্টারে এতটাই অসুখী যে সে কিছু খেতে চায় না বা কারও সঙ্গে কথা বলে না। ফলে রিতুর কষ্ট আরও বেড়ে যায়।
রিতু গনেশ স্মৃতিচারণ করে বলেন, “একবার আমার মা বেড়াতে আসার পর এবং আরও পরে আমার শ্বাশুড়ী মা আমাদের সঙ্গে থাকতে কানাডায় এলে পরিবারে সুখের দেখা মেলে। আমাকে আর ডেকেয়ার সেন্টারের খরচ বহন করতে হয়নি এবং সেই ব্যয়টা ছিলো আমাদের বাড়ির বন্ধকী (মর্টগেজ) বাবদ প্রতিমাসে ব্যয় হওয়া অর্থের অর্ধেকেরও বেশি।”
রিতুর পরিবার যখন কানাডায় একটি বাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর রিতুর পরিবার অর্থনৈতিক টানাপোড়নের মধ্যে পড়ে। ফলে তারও চাকরি নেওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। গনেশের মা কানাডায় আসার পর তিনি নাতনিকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেন।
কানাডায় দাদা-দাদী বা নানা-নানীর সংখ্যা সাধারণ জনসংখ্যার চেয়ে দ্রুততর হারে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ছে। দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া দাদা-দাদী বা নানা-নানীরা পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনা, পরামর্শদাতা এবং আধ্যাত্মিক অভিভাবক হিসাবে গুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
উভয় পক্ষের লাভ
নিজেদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কারণে অনেক অভিবাসীই ভিন্ন দেশে অবস্থানরত নিজের বাবা-মার অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকেন। এ ধরণের বাবা-মা যখন কানাডায় ছেলে বা মেয়ের কাছে চলে আসেন তখন সেটা সেই পরিবারের প্রতিমাসে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যয় কমিয়ে আনতে সহায়ক হয়।
ছেলে মেয়ের পরিবারের সঙ্গে থাকতে অনেক বাবা-মাই পছন্দ করেন কারণ সেক্ষেত্রে তাদেরকে নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না। যদিও অনেক দাদা-দাদী বা নানা-নানীর জন্যই নতুন জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসের বিষয়টি মানিয়ে নিতে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর এবং সাহসিকতার প্রয়োজন হয়। সেইসঙ্গে কানাডায় বসবাসের জন্য তাদেরকে পেছনে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিকাতরতা কাটিয়ে উঠতে হয়।
এখানে ছেলের পরিবারের সঙ্গে বসবাসরত সুমিতা গণেশ যেমনটা বললেন, “আমার ফেলে আসা বাড়িতেও জীবন যথারীতি বয়ে চলেছে। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যেসব আনন্দ-স্ফূর্তি হতো, যেসব উৎসব আয়োজন উপভোগ করতাম সেগুলো খুব মনে পড়ে।” আর এই স্মৃতিকাতরতার জন্যই গণেশ বছরে একবার করে দেশের বাড়িতে বেড়াতে যায়, যাদের জন্য মনটা আকুল হয় তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে।
অভিবাসী পরিবারগুলোতে দাদু-দিদাদের সংখ্যা বাড়ছে
নতুন ‘কানাডীয় জীবন যাপনে’ অভ্যস্ত হয়ে ওঠার প্রয়াসে লিপ্ত অভিবাসীদের ক্ষেত্রে বহু-প্রজন্মের পারিবারিক ব্যবস্থা এক ধরণের সান্ত্বনার বিষয় হিসাবে দেখা দিতে শুরু করেছে। ২০১১ সালে সম্প্রতি আসা অভিবাসীদের প্রতি পাঁচজনে একজন (২১%) নাতি-নাতনীদের সঙ্গে বসবাস করছিলেন, যেখানে কানাডায় জন্মগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে নাতি-নাতনীর সঙ্গে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন শতাংশ।
একক বাবা-মার পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারীর ওপরই সমস্ত বোঝা চেপে বসে এবং সেক্ষেত্রে এটা প্রায়শ বহনক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। দুই প্রজন্মের বাবা-মা একসঙ্গে থাকলে একটি নতুন দেশে অভিবাসনের কষ্টটা যেমন সহনীয় হয়, একক বাবা-মার জন্য সেটাই অনেক বেশি কষ্টকর হয়ে ওঠে।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী আরজা রিফাত তার মা’সহ পরিবারের দায়িত্ব পালন করেন। টিনএজ বয়সের দুই ছেলের মা রিফাতের জন্য নিজের বয়স্ক মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব নেওয়ার ফলে তার স্বচ্ছলভাবে সংসার চালানো ক্রমশই কঠিনতর হয়ে ওঠে। তিনি সন্ধ্যা ও রাতের বেলা চাকরি করেন কারণ তার মার পক্ষে দিনের বেলা বাসায় একা থাকা সম্ভব নয়।
আরজা রিফাত বলেন, “আমার রোজগার দিয়ে আমাদের চাহিদাটুকু মেটানো সম্ভব হয়, তবে মা’র জন্য যে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হয় সেটার জন্য শুকরিয়া, কারণ ওটা দিয়ে আমাদের বাসা ভাড়ার কিছুটা মেটানো যায়।” তিনি আরও বলেন, তার কষ্ট আরেকটু কমতো যদি তিনি প্রতিবন্ধী মায়ের দেখাশোনাকারী হিসাবে ভাতা পেতেন। যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপের দেশগুলোতে এধরণের ভাতা চালু রয়েছে।
নতুন দেশে জীবন শুরু করতে, বিশেষ করে অভিবাসীদের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে নৈতিক ও মানসিক সমর্থনের গুরুত্ব রয়েছে।
আবেগের দায়
দাদু-দিদার মতো বয়স্ক মানুষ ঘরে থাকলে সেটা তণ প্রজন্মের দম্পতির জন্য বাড়তি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। কারণ বৃদ্ধ বয়সের লোকদের স্বাস্থ্যগত কিছু জটিলতা থাকে যেজন্য তাদেরকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবাযতœ এবং মানসিক সহযোগিতা দিতে হয়।
অশোক ও মিরা দম্পতি অনেক বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন এবং তাদের কোনও সন্তানাদি নেই। কিন্তু অশোকের মা তাদের সঙ্গে থাকেন। তিনি স্মৃতিভ্রষ্টতার রোগী এবং বৃদ্ধনিবাসে যেতে চান না। কিন্তু অশোক-মিরার পরিবার আর্থিকভাবে ভালো অবস্থায় থাকলেও বৃদ্ধনিবাসে তার মায়ের জন্য যে অর্থ ব্যয় হতো সেটা বাঁচাতে পারছে। অশোক তার বয়োজ্যেষ্ঠ মা’র দেখাশোনার মধ্য দিয়ে সহানুভূতি ও ধৈর্যের শিক্ষা দিচ্ছেন যা একটি অধিকতর মমতাময় সমাজ তৈরি করছে।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “আমি আমার মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছি এজন্য নয় যে আমি বৃদ্ধনিবাসের ব্যয় বহন করতে পারি না। বরং তার প্রতি আমাদের ভালোবাসার কারণেই ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং তার সেবাযতœ করছি।”
মা সঙ্গে থাকার কারণে ওই দম্পতি সুখী। মিরা বলেন, “তিনি বাসায় থাকায় নিঃসঙ্গতা বোধ করি না। আমি তার সাহচর্য উপভোগ করি।” শ্বাশুড়ী থাকার কারণে কখনও কখনও মিরার স্বাধীনভাবে চলাফেরা কিছুটা ব্যাহত হয় বটে তবে তারা অশোকের বোনের সাহায্যে ছুটি কাটানোর সময় বের করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার সুযোগ পান।
কানাডায় প্রচলিত একক পরিবারের চেয়ে বহু প্রজন্মের মানুষের যৌথ পরিবারের বাস্তবতা কিছুটা বেশি জটিল। তবে অনেক অভিবাসীর জন্যই পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি তাদের জীবনযাত্রার অনেক নেতিবাচক দিক সহজতর করে দেয়।
বাবা-মায়ের দায়িত্বটা হলো এমন এক সফর যেখানে আপনাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং একইসঙ্গে এটা হলো গভীর অনুরাগের বিষয়। এতসব নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস সত্ত্বেও মনে হয় যেন এইসব বাবা-মার পক্ষে তাদের বৃদ্ধ বয়সেও আরও কিছু দেওয়ার আছে। পরের প্রজন্মের সহায়তাকারী হিসাবে তারা পুরো পরিবারের জন্য অনেকটাই স্বস্তির কারণ হয়ে ওঠেন। ছেলেমেয়েরা দায়িত্ব নেওয়ায় কানাডার নতুন বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের অন্তহীন জীবনচক্র অব্যাহত থাকে।
-সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ান মিডিয়া