তাসের আড্ডা – ১৬
মার্চ 13, 2018
শুজা রশীদ
তুরুপের ২ দিয়ে রনির টেক্কা মেরে জালাল বিশাল এক টুকরো হাসি দিয়ে বলল, “ছোট বলে অবহেলা করবেন না। সামান্য দুই দিয়ে আপনাকে কেমন ল্যাং মেরে দিলাম দেখলেন!”
আজ তাসের আড্ডা আবার সাইদের বাসাতেই বসেছে। মাঝে কয়েক সপ্তাহ প্রকৃত আড্ডা বসে নি। দাওয়াত ফাওয়াতে কেটে গেছে। আজ হাউস ফুল। রুনাও বাসায় নেই। সবার মন আরোও ফুরফুরে। কর্ত্রী বাসায় থাকলে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। আবার কি নিয়ে ক্ষেপে টেপে যায়।
রনি ট্রাম্প হবে আশা করে নি। সে মুখটা একটু ব্যাজার করে বলল, “আমেরিকার গান কন্ট্রোলে হাই স্কুলের পোলাপাইনের প্রতিবাদের মত হল ব্যাপারটা। সব রুই কাতলা ফেল করে গেল আর কোথা থেকে এই হাইস্কুলের ছেলেমেয়েগুলো এসে বেশ একটা হৈ হুল্লোড় ফেলে দিল। এখন দেখা যাক, ট্রাম্পকে তারা ট্রাম্প করতে পারে কিনা।”
সাইদ বলল, “খুব বেশী কিছু হবে সেই আশা করা যায় না। রিপাবলিকান পলিটীশিয়ানরা সব হচ্ছে NRA (National Rifle Association এর কেনা। অধিকাংশেরই ক্যম্পেইনে প্রচুর টাকাপয়সা ডোনেশন করেছে তারা। তাদের বিরুদ্ধে যাবার অর্থ ভোটে হারা। যে কারণে তারা সেকন্ড এমেন্ডমেন্টের ধুয়া তুলে সবসময় যে কোন ধরণের গান কনট্রোলের বিরোধীতা করে যায়। ২০১২ র ডিসেম্বরে স্যান্ডী হুক এলিমেন্টারি স্কুলে ২০ জন স্কুলের বাচ্চা হত্যা কান্ডের শিকার হবার পর সবাই ভেবেছিল এবার কিছু একটা হবে। ওবামা কত চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারপরও কিছু হল না।”
কবীর বলল, “লাস ভেগাসের ২০১৭ র ঘটনাতো আরোও বড় ছিল। আটান্ন জনের মৃত্যু আর সাড়ে আটশ’ আহত। নিরীহ মানুষেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুন হল। সেই ঘটনার পর বাম্প ফায়ার স্টক বেআইনি করার কথা উঠল। ওটা ব্যবহার করে লাস ভেগাসের খুনী তার সেমী অটোমেটিক রাইফেলকে পুরা আটোমেটিক রাইফেলে পরিণত করেছিল। প্রথমে NRA রাজী ছিল। কয়েকদিন পর যেই ঘটনা একটু চাঁপা পড়ে গেল, তারা ঝট করে তাদের সমর্থন সরিয়ে নিল।”
জালাল বলল, “আচ্ছা, আমাকে এই ব্যাপারটা একটু খুলে বলেন তো। আমেরিকার এই বন্দুক প্রীতির কারণ কি?”
জিত বলল, “প্রথম যখন সেটলাররা এখানে আসে তাদেরকে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। বন্দুকের প্রয়োজন হয়ত সেখান থেকেই। জীবিকা এবং বাঁচার তাগিদে শিকার করাটাও প্রয়োজনীয় ছিল। কয়েক শ’ বছর ধরে সেভাবেই চলেছে। এখন এটা ওদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। তার উপর রয়েছে বিলিয়ন ডলারের বন্দুকের ব্যবসা।”
সাইদ বলল, “আমেরিকার কন্সটিটিউশনে সেকেন্ড এমেন্ডমেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই এমেন্ডমেন্ট মূলত এসেছিল ইংলিশ সেটলারদের কাছ থেকে। ইংল্যান্ডের ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস থেকে উদবুদ্ধ হয়েই আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা এই বন্দুক নীতির সৃষ্টি করেছিল। নানা মুনির অবশ্য এই ব্যাপারে নানা মত আছে। কেউ বলে এই এমেন্ডমেন্ট যেভাবে ব্যবহার করা হয় ততখানি উদারতা দেখানোটা যথার্থ নয়। আবার আরেক দল আছে যারা এটাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহন করে এবং যে কোন ভাবেই হোক এই অধিকারকে খর্ব হতে দিতে নারাজ, তা যত হত্যাকান্ডই হোক।”
রাজা ভাই বলল, “কিন্তু এবার যে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্ষেপেছে, তাতে কি কিছু হবে মনে হয়?”
রনি বলল, “কিচ্ছু হবে না। ফ্লোরিডায় সিনেট এপ্রপ্রিয়েশন কমিটির কাছে গান কন্ট্রোল সংক্রান্ত—— বেশ কয়েকটা বিষয় উপাস্থাপন করা হয়েছিল। সেখানে এসল্ট রাইফেল, বাম্প স্টক এবং হাই ক্যাপাসিটি ম্যাগাজিন বিক্রী ব্যান্ড করার প্রস্তাব ছিল। সেগুলো সব ফেল করেছে। শুধু পুলিশকে আরেকটু বেশী ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বিপদজনক মানুষজনকে হ্যান্ডেল করার। হাসি পায় আমার। ফ্লোরিডায় যে ছেলেটা খুন করল, পুলিশের কাছে প্য়তাল্লিশ বার তার নামে নালিশ গেছে। পুলিশ কিছুই করেনি কারণ আইনসঙ্গতভাবে যতক্ষণ না সে কোন বেআইনি কিছু করছে তাকে কিছুই করা সম্ভব নয়। এইসব হচ্ছে সাধারণ মানুষের চোখে ধুয়া দেবার পলিটিশিয়ানদের কায়দা। বেশি ক্ষেপেছে? আচ্ছা ঠিক আছে, কিছু একটা ভগি জগি দিয়ে বুঝিয়ে দেই। সারা পৃথিবীতেই একই ব্যাপার হচ্ছে।”
কবীর বলল, “বাদ দেন ওদের কথা। আমাদের এখানেও তো এখন আগের চেয়ে অনেক গোলাগুলী বেড়েছে। শুনেছি ওপার থেকে নাকি বন্দুক আসে। প্রত্যেকদিন কোথাও না কোথাও গুলি হচ্ছে টরন্টোতে। হয় কেউ আহত হচ্ছে নয়ত মরছে। আগে এই রকম দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমেরিকানদের ধোঁয়া এখন আমাদের গায়েও লাগছে।”
জালাল বলল, “আচ্ছা, আরেকটা প্রসঙ্গে আপনাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে । এই যে কয়েকদিন আগে কল্টন বুশির হত্যাকারীর বিচার হল। সব শ্বেতাঙ্গ জুরী থাকায় শ্বেতাঙ্গ চাষীকে অভিযুক্ত করা হয় নি বলে প্রচুর প্রতিবাদ হয়েছিল। সেই সময় আমাদের সরকার প্রধান এবং তার মন্ত্রীদের কেউ কেউ আমাদের বিচারব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিল। সেটা করা কি ঠিক হয়েছে?”
রনি বলল, “জাস্টিন ট্রুডোর কতখানি কাণ্ডজ্ঞান আছে সেই ব্যাপারে আমার অনেক সন্দেহ। বুশির বিচারে কোন ত্রুটি হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। জুরিতে সবাই শ্বেতাঙ্গ ছিল বলেই তারা নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে পারে নি, এই অভিযোগের পেছনে কি কোন কারণ আছে? আমাদের বিচার ব্যবস্থার উপর যদি মানুষের এতো অল্প আস্থা থাকে তাহলে তো পুরো বিচার ব্যাবস্থাই ঢেলে সাজাতে হবে। জুরি ব্যবস্থা সরিয়ে দিয়ে শুধু জাজ রাখলেই হয়। কিন্তু জাস্টিনের কোর্টের বিচার ব্যবস্থার উপর অকারণে মন্তব্য করা অধিকাংশ মানুষই পছন্দ করে নি।”
জিত বলল, “যখন যেদিকে বাতাস বয়, আমাদের নেতারাও সেদিকেই যায়। আগা পাছ তলা ভালো করে চিন্তা করে না।”
সাইদ বলল, “আমি লিবারেলের সমর্থক। জাস্টিনকেও খুবই পছন্দ করি কিন্তু এই ক্ষেত্রে তার এই জাতীয় একটা মন্তব্য করার কোন দরকার ছিল না। ত্র“টিহীনভাবে বিচার হয়েছে, সেই বিচার নিয়ে প্রশ্ন করা সরকার প্রধানের সাজে না।”
রাজা ভাই ও জাস্টিনের ঘোর সমর্থক। সে এই প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, “ভাই, বাদ দেন এইসব রাজনীতির গল্প। ভালো লাগে না। উইন্টার অলিম্পিক দেখেছেন কিনা তাই বলেন। কানাডা তো রেকর্ড করে ফেলল। আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী মেডেল পেয়েছি আমরা। তাও তো কার্লিংয়ে, ছেলেদের হকিতে মিস হয়ে গেছে।”
রনি বলল, “আমি প্রতিদিনই দেখেছি। বাংলাদেশে থাকতে তো কখন ভাবিনি আমার দেশ জীবনে কোনদিন কোন অলিম্পিকে কিছু জিতবে। কানাডিয়ান হয়ে অন্তত সেই গর্বটা করতে পারি। ভালোই লাগে। বুকটা ভরে যায়।”
জিত হাসতে হাসতে বলল, “এই অনুভূতির তুলনা হয় না। উইন্টার অলিম্পিকে আমরা আমেরিকার আগে, ভাবতেই তো ভালো লাগে। ট্রাম্পকে অন্তত এইখানে আমরা ট্রাম্প করে দিয়েছি।”
কবীর বলল, “আমরা উনত্রিশটা পেয়ে তিন নম্বর। ওরা মাত্র তেইশটা পেয়ে চার নম্বর।”
আমেরিকাকে পরাজিত করতে পেরে সবাইকেই মনে হল বেশ সন্তুষ্ট। এক চোট জয়ের হাসিও হল।
জিত বলল, “উইন্টার অলিম্পিকের কথাই যখন তুল্লেন তখন কয়েকটা জোক বলি।
“ট্রাম্প অলিম্পিকের ওপেনিং সেরেমনিতে বক্তৃতা দেবে। কিন্তু সে খুব ঘাবড়ে আছে। কিছুতেই মনে রাখতে পারছে না। শেষে টেলিপ্রম্পটার চাইল।
বক্তৃতা দেবার দিন সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, “ও, ও, ও, ও, ও।”
তার একজন সহকারী দ্রুত এগিয়ে এসে বলল, “মিস্টার প্রেসিডেন্ট, ওগুলো অলিম্পিকের রিং। আপনার বক্তৃতা ওর নীচে।”
কবীর হাসতে হাসতে বলল, “আমি একটা বলি। তিন আমেরিকান এক অলিম্পিক স্টেডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে খুব দুঃখ করছে তাদের টিকিট কিনবার সামর্থ নেই বলে। হঠাৎ তারা লক্ষ্য করল স্টেডিয়ামের একটা বিশেষ গেটে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডকে নিজ নিজ দেশ এবং খেলার নাম বলে একে একে সব এথলেটরা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।
“তিন বন্ধুর একজন চারদিকে খুঁজে পেতে একটা লম্বা পাইপ বের করল। সে সেটাকে এক হাতে বাগিয়ে ধরে গিয়ে গার্ডকে বলল, “ইংল্যান্ড, পোল জাম্প।” গার্ড তাকে ঢুকতে দিল।
এবার দ্বিতীয়জন একটা ম্যনহোলের ঢাকনি হাতে করে নিয়ে গিয়ে গার্ডকে বলল, “রাশিয়া। ডিস্কাস।” গার্ড তাকেও যেতে দিল।
এবার তৃতীজন অনেক খোঁজাখুঁজির পর কিছু কাঁটাতারার বেড়া পেয়ে সেটা নিয়েই হাজির হল। গার্ডকে বলল, “আমেরিকা। বর্ডার ফেন্সিং।”
জিত বলল, “দাঁড়ান। আমি আরেকটা বলি। বেন জনসন ছিল কানাডার সবচেয়ে বিখ্যাত দৌড়বিদ। সে ছিল জ্যামাইকান কানাডিয়ান। এক পর্যায়ে সে অবৈধ স্টেরয়েড নেবার জন্য ধরা খায়। বিভিন্ন সময়ে তার উপর কানাডিয়ান খবরের কাগজের হেডলাইন ছিল এইরকমঃ
প্রথম হেডলাইনঃ “কানাডিয়ান স্প্রিন্টার ১০০ মিটারে গোল্ড মেডেল জিতেছে!’’
দ্বিতীয় হেডলাইনঃ জ্যামাইকান-কানাডিয়ান এথলেট স্টেরয়েডের জন্য পজিটিভ টেস্টেড হয়েছে।
তৃতীয় হেডলাইনঃ “অবৈধ স্টেরয়েড নেবার জন্য জ্যামাইকান এথলেটের কাছ থেকে গোল্ড মেডেল ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।””
শুজা রশীদ
কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
টরন্টো