প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৪০

অক্টোবর ৭, ২০১৭

রীনা গুলশান

সাতই সেপ্টেম্বর আমরা কানাডার মাটিতে অবতরণ করলাম। সুদীর্ঘ এক মাস পর। এই এক মাস কিছুই না, যদি আমরা নিজ দেশ অথবা কোন হলিডে স্পটে যেতাম। কিন্তু এটা তা নয়। আমরা হজ্ব শেষে ফিরে এলাম। খুব বেশী ঠান্ডার দেশে এতদিন থেকে এখন গরমের দেশে এক সপ্তাহ থাকাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশে মে থেকে আগস্টে থাকা যায় না। আর বাংলাদেশের গরমের ঠিক ডাবল গরম মক্কাতে থাকে। তবে মদীনাতে গরম বেশ খানিকটা কম অনুভূত হবে। মক্কাতে একটু বেশী অনুভব হবার কারণ, মক্কা নগরীর চারপাশ পাহাড় দিয়ে ঘেরা। তাই বাতাস নগরীর উপর দিয়েই চলে যায়। নগরীর ভিতর প্রবেশ করতে পারে না।

যদিও আপনি গরম খুব কমই অনুভব করবেন। একমাত্র রাস্তায় যদি চলাচল করেন তবেই গরম অনুভব করবেন। এছাড়া সর্বত্র এসি। এবং বরফ ঠান্ডা পানি। জমজমের পানিও বরফ ঠান্ডা খেতে পারবেন। আমিতো উল্টো নরমাল পানি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান।

কারণ আমার বহু বছরের দেখা মতে হজ্ব থেকে আসা ৯০% হাজীরা প্রবল কাশি এবং ঠান্ডা নিয়ে আসে। একমাত্র ঐ প্রচন্ড ঠান্ডা পানির কারণে। তাই আমরা যাবার আগে থেকেই মনে মনে তৈরী ছিলাম, মরে গেলেও ঠান্ডা পানি পান করবো না। যদিও পরবর্তীতে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছিলাম। জামারাতে কঙ্কর মারার (শয়তানকে পাথর মারার সময়) সময় প্রতিজ্ঞা রাখতে পারিনি। সে কথা পরে।

এবারে আসি প্রারম্ভে। হ্যাঁ, হজ্বে যাবার ডিসিশন এবং এরপর কিভাবে এবং কোন প্যাকেজ দিয়ে যাবেন? এটা একটা অনেক বড় ডিসিসানের ব্যাপার। আমরা হজ্বে যাবার জন্য প্রায় ১ বছর আগে থেকেই মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। শারীরিক এবং অর্থনৈতিক ব্যাপারটাতো আছেই। বিশেষত আমাদের মত নিু মধ্যবিত্তদের কাছে নর্থ আমেরিকা থেকে হজ্বে যাওয়া সত্যি অনেক বড় একটা ধাক্কার মত।

তবে আপনি যখন থেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিবেন যে ‘ওকে ফাইনালি এবারে আমি হজ্বে যাচ্ছি ইনশাল্লাহ। এটাকে বলে মানসিক প্রস্তুতি বা নিয়ত। এখন দেখবেন সব কিছুু ক্যামোন যেন তরতড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

আমি কোন ধর্ম বিশারদ নই। আমি হাফেজ, মুফতি বা মৌলানা নই। শুধুমাত্র নিজ ধর্ম অনুসারী একজন মানুষ। এবং এই একটি ব্যাপারে আমি কারো সাথে কোন তর্কে যেতেও রাজী নই। আমি জাস্ট একটি কথায় বিশ্বাসী –  ‘যার ধর্ম তার’। অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা আমি প্রবল ভাবে ঘৃণা করি। আমার ফেসবুকে প্রচুর হিন্দু বন্ধু আছে। মজার ব্যাপার এরাই সব থেকে সুন্দর ভাবে আমাকে হজ্বে যাবার আগে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। এবং আসবার পর ‘সুস্বাগতম’। এমনকি অনেকে বলেছে – রীনা তোমার জন্য বিশেষ ভাবে দোয়া করবো। আমার এত্ত ভাল লেগেছিল, কি আর বলবো??

আবার আমার অনেক কবি বন্ধুরা মিষ্টি করে কটাক্ষ করেছিল। “কবি তুমি হজ্বে যাচ্ছো?” আমি এই সব প্রশ্নের কোনদিন জবাব দেই না। আমি একই সাথে লেখালেখি করি। একসময় গানও গেয়েছি। আবার ৮ বছর বয়স থেকে খুব নিষ্ঠার সাথে ধর্ম পালনও করি। কোন ব্যাপারেই আমি কট্টর মনোভাব পছন্দ করিনা। আমার হাবেন্ডও ঠিক আমার মতোন।

তাই এবার যখন আমি হজ্বের ব্যাপারে ডিসিশন নিলাম। কাজিম বেশ দোনামনা করছিলো। বলছিলো, এই মুহুর্তে, তোমার শরীরও বিশেষ ভাল না। তাছাড়া টাকাও নেহাত কম নয়। নেক্সট্ ইয়ারে যাই। এই রকম করছিল। আমি আবার খুবই ফ্লেকসিবল ক্যারেক্টারের। জানিনা এবারেই প্রথম আমি খুবই কঠোর মনোভাব পোষণ করলাম। বললাম : দ্যাখো মেঘে মেঘে যথেষ্ট বেলা হয়েছে। অলরেডী আমরা দেরী করে ফেলেছি। আরো ১০ বছর আগেই যাওয়া উচিৎ ছিল। আর আমার এই কথাটা আমরা হজ্বে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, অল্প বয়েসে যাওয়ার সুফলতা কি!

যাইহোক মাইন্ড সেট আপ হবার সাথে সাথে আমরা লোকজনের সাথে কথা বলা শুরু করলাম। বিভিন্ন জনের সাথে। তখন আর একটা চক্রে পড়লাম। বিশাল চক্র। একেকজন একেকটা কোম্পানীর নাম বলে আর তার গুণগান করে। কেউ কেউ আবার নানান প্রবলেমের কথা বলে। আমরা খুবই কনফিউজড হয়ে পড়লাম। অনেকেই ‘মদিনা’ এবং ‘ইখলাশ’ এর কথা বললো। এরা দুই ভাই। তবে এ্যারাবিয়ান। কাজিম এদের সাথে কথা বললো। এমাউন্ট ভালই মোটা অংকের। তারপরও কথা বলছিলাম। এর মধ্য আরো অনেক প্যাকেজ বা কোম্পানীর নাম দেখলাম। বিসমিল্লাহ, ফ্যালকন, দারুস সালাম এরকম আরো কয়েকটি দেখলাম। এখন সবগুলোর নাম মনে পড়ছে না। দারুস সালাম ইউএস ডলারে পেমেন্ট নেয়। কানাডিয়ান ডলারে ২১ হাজার পড়ে। এর মধ্যে অবশ্য কোরবানী ইনক্লুডেড কিনা জানিনা। আমাদের পারিবারিক বন্ধু তৌহিদ নোমান ভাই একটি প্যাকেজের সন্ধান দিলেন। জনৈক কামাল ভাই আমাদের নিয়ে যাবে। দুজনের পড়বে ১৯ হাজার ডলার। খুবই চিপ। খোঁজ খবর করলাম। যাই হোক আমরা চাইছিলাম একটি ভাল ভাবে থাকতে আবার টাকার অঙ্কটাও কিছুটা চিপ হবে।

একজন সিলেটি ভদ্রলোক সন্ধান দিল ‘আল-ফালাহ’র। তবে উনি একটি চমৎকার কথা বললেন যে, আপনারা কোন প্যাকেজ নেবার আগে অনলাইনে যেয়ে সেই প্যাকেজ সম্পর্কে পূর্বেকার হাজীদের মন্তব্য পড়–ন। গুড আইডিয়া। খুবই ভাল আইডিয়া। কাজিম প্রায় দীর্ঘ ১ মাস ধরে বিভিন্ন প্যাকেজের আলোচনা, সামালোচনা পড়লো।

দারুস সালাম খুবই ভাল। তারা বলেছে ফাইভ স্টার হোটেল, মুজ দালিফাতে তারা কার্পেট দিবে শোবার জন্য। মিনাতে এসি, তাবু ইত্যাদি।

পরে আমরা মিলিয়ে দেখলাম, আফ-ফালাহ্ তেও একই রকম হোটেল। মুজদালিফাতে শোবার জন্য আলফালাহ খুবই সুন্দর শ্লিপিং ব্যাগ দিবে (পরবর্তীতে সেটা পেয়েওছিলাম, খুবই সুন্দর শ্লিপিং ব্যাগ, নরমাল যেগুলো দেখতে পাই, এগুলো আরো সুন্দর। বেডের মাথায় একটি বালিশের মতন আছে। ৪/৫ ঘন্টার ঘুমের জন্য মোর দ্যান এনাফ)। (চলবে)

রীনা গুলশান, টরন্টো

gulshanararina@gmail.com