প্রবাসে পরহিতকর্ম – ৩৯
আগস্ট ১৩, ২০১৭
পবন অন্তর থেকে মমতার উপর খুবই খুশী হলো। মনে মনে ভাবলো… মমতা সত্যিই স্ত্রী হিসাবে একটি রতœ। যে তার স্বামীর অন্তর বোঝে। এবং স্বামীর উপর সর্বত ভাবে কর্তব্য করে। তার টাকার খেয়ানত করে না। পবন আসার পর বাড়ি বানানোর সব খরচ পাই পাই করে লিখে রেখেছে। সেই সাথে সংসার খরচের হিসাবও। পবন সব দেখেছে। পবন মোটেও কৃপন নয়। তবে এটাও ঠিক বাবার ব্যবহারে পবন মানসিক ভাবে খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলো। সেটা মমতাও বুঝতে পেরেছিল।
এরপর একদিন তাদের পারিবারিক মিটিং হলো। সালেহার বাবা মাও ছিল মিটিং এ। সালেহার বাবাই জানালো যে, ওদের বাড়ির সামনে একটি ৬ কাঠার জমি বিক্রি করছে একজন। যদি তারা জমিটা কিনে নেয় তবে ধীরে ধীরে আরেকটা বাড়ি বানাতে পারবে। তখন আর খুব বেশী দিন তাদের দুই বন্ধুকে বিদেশে থাকতে হবে না। দেশে থাকার যে আনন্দ সবাই মিলে, সে আনন্দ প্রবাসে কোথায়? তারপর ধরো গিয়া, মমতার ৩/৪টা ছোট ছোট বাচ্চা… সালেহার ২টা হতে যাচ্ছে। বিদেশে কাজে লোক নাই। খুউব কষ্ট হবে।
পবনের মা ও এখানে কথা বলে উঠলো… ভাই সাহেব ঠিকই কইছে। আর একটা বাড়ি বানাইলে আর খাওন পরনের চিন্তা নাই। তাইলে ব বাইচ্চা লইয়া এই হানেই থাইক্কা যাও।
মমতা এবং সালেহাও সমর্থন করলো ওদের। আব্দুর রহমানও বললো, ‘বুদ্ধিটা কিন্তু খারাফ না দোস্ত, তুই কি কস?’
হু! আমারও মনে হইতাছে বুদ্ধিটা ভালই। বিদেশ বিভূইয়ে আমারও আর বেশীদিন ভাল লাগতাছে না।
তারপর তাদের গ্রীন সিগলান পেয়ে সালেহার বাবা ঐ জমির মালিকের সাথে দর কাষাকষি শুরু করলো। জমির মালিক নাসের সাহেব পরিচিতই ছিল। জমির দাম প্রায় লাখ খানেক কমিয়ে দিল। ৬ তলা বাড়ি বানানোর পরও তাদের দুইজনের হাতে ভালই টাকা ছিল। তারাও আর কাল ক্ষেপন না করে জমিটা দুজনে মিলে কিনে নিল। আর আলাদা আলাদা করে রেজিস্ট্রিও করে ফেললো। সবাই খুব খুশী হলো।
সব থেকে খুশী হলো পবননের মা। সন্তানের সাফল্যে এক মায়ের থেকে আর কেই বা বেশী খুশী হতে পারে? আর পবনের মতন সন্তান? এই যে এত দৌড়া দৌড়ির মধ্যে পবন তার মাকে বড় একজন ডাক্তার দেখিয়ে ওভারঅল চেকআপ করিয়ে দিল। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কিনে দিল। এ ছাড়া এত করে গেলেও বাবাকে ঠিকই প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। শুধু ফোন করেনি।
পবনদের কানাডা যাওয়ার সময় হয়ে গেল। ওরা দুই বন্ধুই বেশ চিন্তিত ছিলো। একদিকে নতুন দেশ, অন্যদিকে দুজনের স্ত্রীই প্রেগনেন্ট। আসবার সময় এবারে মমতা খুবই কাঁদছিলো। মাও পবনকে জড়িয়ে খুউব কাঁদছিল। পরি এখন বেশ বড়, আসবার সময় বেশ মুরুব্বীর মত বললো – বাবা তুমি চিন্তা করো না ( পবনের ছেলে মেয়েরা সব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে) আমি সবাইকে দেখে শুনে রাখবো।
পবন এত দুঃখেও হেসে ফেললো তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে।
এরপর তারা কানাডায় এলো। দুবাইতে এক পরিচিত বন্ধু, সে আরো ৩/৪ বছর আগেই কানাডায় এসেছিল। তার বাসায়ই তারা দুই বন্ধু মিলে উঠেছিল। কৃষ্ণা রেড্ডির সাথেও দেখা হলো। সবাই বেকার। অতপর এক এজেন্সীর মাধ্যমে বেশ কিছুদিন কারখানাতে কাজ করলো। প্রায় দুই বছর লাগলো তাদের প্রফেশনাল জব পেতে। ভালই হলো এর মধ্যে তারা লিং এ ভর্তি হয়েছিল। স্পোকেন ইংলিশও বেশ রপ্ত হলো। দুবাইতে তো বেশ কিছুটা আরবী শিখেছিল। সেটাতো আর এখানে কাজে লাগবে না। এখানে লাগবে ইংরেজী।
পবন মনে মনে হাসে, এক জীবনে শেখার কোন শেষ নাই। এর মধ্যে পবনের একটা মেয়ে হয়েছিল আর আব্দুর রহমানের ছেলে আবারো। পবন মেয়ের নাম রেখেছিল জারি। জারি নাকি পরির চেয়েও সুন্দর হয়েছে।
এখন তারা ফেসটাইম (আইপ্যাডে) এ কথা বলে। শনিবার আর রবিবার সারাদিন তারা ফেসটাইমে কথা বলে। রান্না করে। ঘর গুছায়, আবার কথা বলে। প্রথম তিন বছরের একটু বেশী সময়ের মধ্যে দেশে যাওয়া হয়নি। একেবারে সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করে পরে দেশে গ্যালো। ততদিনে তাদের বাড়ির এক তলা হয়ে গেছে। এই বাড়িটা একটু অন্যভাবে করছে। একতলাটা সম্পূর্ণ বিজনেস পারপাসে এবং বাকী ৫ তলা ডাবল ইউনিটে। ভবিষ্যতে পবন তার এই বাড়ির একতলাতেই অটোমোবাইলের শপ করবার ইচ্ছায় এটা করেছে। আপতত অন্য কোন ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দেবে। অনেক সময় অনেক ব্যবসায়ীরা উঠতে চায় না। তাই ৫ বছরের টার্মে ভাড়া দেবে।
দেশে তারা এবারে দুই মাস থাকবে। পবনের তিনটে বাচ্চাই স্কুলে যাচ্ছে। পরীকে এবং ছেলেদেরকে প্রথমেই হিফজ (কোরআনে হাফেজ) লাইনে পড়াচ্ছে। এরপর রেগুলার স্কুলে দেবে।
এতক্ষনে আমি একটু ফুটন কাটলাম…, চাচা, কানাডাতে তো পরিবার আনতে পারতেন। আনলেন না কেন?।
পবন চাচা সুন্দর করে একটা পবিত্র হাসি দিয়ে বললেন… মা-রে, জীবনের সবকিছু ছকে বাধাঁ হয় না! আর সবার জীবনের পরিকল্পনাও একই ছাঁচে বাঁধা না। যখন খুউব ইচ্ছা করতো মমতা পাশে থাক, বাচ্চাগুলান আমারে জড়াইয়া থাকুক… তখন ওগরে পাই নাই। কলুর বলদের লাহাল খাটছি, আর খাটছি। মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ই কিন্তু ২৫ থেকে ৪৫। সেই ময়টা কি করলাম? একা একাই দিনের মরুভূমি দেখেছি আর রাতের তারা গুনেছি। সুখ বলতে যা বোঝায় সেতো আমার দুবাই আসার আগের জীবনটাতেই ছিল। তারপরতো হইয়া গেলাম টাকা বানানোর মেশিন। এই জীবনের কোথাও আর, জীবনের জন্য খুইজা পাইলাম না।
তারপর কানাডা আসনের পর, জীবনের আরো কিছু চালচিত্র দেখলাম। কানাডা আমার খুব ভাল লাগছে। সব থেইকা ভালো লাগছে আমার যে এইহানে কোন রেসিজম নাই। কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলায় না। কিন্তু মা, এইহানে আমার ছেলে মেয়েদের আনুম না। আমার মাইয়া দুইটা খুবই সুন্দরী … আমি তোমারে হাছা কথাইত কই। আমি অগোর জীবনডারে নরক বানাইতে চাই না। আমি চাই না আমার পোলা মাইয়ারা বিধর্মীদের বিয়া করুক। আমার সিটিজেনশীপ থাকবো, যদি ভবিষ্যতে দরকার হয়, তখন কামে লাগাইবো। তবে সামনের বছর ইনশাল্ল্লাহ চইল্লা যাইতাছি।
আপনার অন্য বাড়িটার সব শেষ হয়েছে?
হ্যা মা, ৬ তলা শ্যাষ। ৫ তলা মোট ১০ টা ফ্লাটে ভাড়াও দেওয়া হইছে। নীচের তলা খালিও কইরা ফালাইছি। এখন নীচের তলায় যাইয়া অটোমোবাইলের একটা দোকান খুলুম। বিনা কামে বইয়া থাকতে পারুম না।
খুউব ভাল লাগলো চাচা,
আপনার কাহিনী শুনে। তবে সব শেষে একটা অনুরোধ রইলো। পারলে আপনার আব্বাকে ক্ষমা করে দিয়েন।
হু… মা। দিছি ক্ষমা কইরা দিছি তারে। ভাবছি এবারে যাইয়া দেখা করুম। তবে টাকা ঠিক মতই পাঠাই। বাপ মায়ের উপর আমার কর্তব্যে আমি কখনো পিছ টান দেই নাই।
আপনার মত ছেলে পাওয়া প্রতিটি বাবা মায়ের ভাগ্য। বাবা মায়ের কর্তব্য সন্তানকে জন্ম দিয়ে বড় করা। আবার সন্তানদেরও কর্তব্য বৃদ্ধ বাবা ময়ের হেফাজত করা। তবে আপনার ক্রোধ এবং দুঃখের হেতু আমি বুঝতে পারি খুইব ভালো ভাবে। প্রবাসে আমাদের ইনকাম যে কতটা কষ্টার্জিত সেটা যারা না করে, তারা বুঝবে না। আপনার আব্বার, আপনার সেই কষ্টের টাকাকে নয়/ছয় করা উচিৎ হয়নি।
হ্যা… মা (চাচার চোখে পানি চলে এলো) ঠিকই কইছো। আজ থিইক্যা ২০ বছর আগের টাকার দাম অনেক ছিলো। তখন ৫/৬ লাখ দিয়া ১/২ কাঠা জমি কিনা যাইতো…এখন আর যায় না।
এই বছরের শেষেই দেশে যামু গিয়া। আমার জন্য দোয়া কইরো। তোমার জন্যও দোয়া থাকলো।
আমারও লাঞ্চটাইম অনেক আগেই শেষ হয়েছিল। আজ কপালে দুঃখ আছে। তবু সব ছাপিয়ে পবন মোল্লার চোখে পানি বুকে নাড়া দিচ্ছিল। এই প্রবাসে আমাদের হরেক রকম মানুষের দুঃখ এবং আনন্দের দিন রাত্রি গুলো কাছাকাছি ধরণের। কারো কিছুটা কম, কারো কিছুুটা বেশী। দুঃখ?? নাকি আনন্দ??
রীনা গুলশান, কবি ও লেখক