শিশুদের ওপর অভিবাসনের অভিনব প্রভাব রয়েছে
অক্টোবর ৭, ২০১৭
ড. ম্যারিলিন চোটেম
কানাডায় আসার অর্থ হলো আপনার এবং আপনার শিশুদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দরোজা খুলে যাওয়া। এই সম্ভাবনাগুলো হয়তো খুবই চমৎকার, কিন্তু এজন্য আপনার শিশুদেরকে অনেক কিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। আর বাবা-মার উচিৎ শিশুদের এসব নতুন অভিজ্ঞতার ব্যাপারে সচেতন থাকা।
দৃষ্টন্ত স্বরূপ বলা যায়, কানাডায় জন্মগ্রহণকারী শিশুদের চেয়ে অভিবাসী শিশুকে অনেক বেশি চাপ নিতে হয় এবং তার ওপর আশাবাদের চাপও বেশি থাকে। অভিবাসী শিশু হয়তো একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারে। কিন্তু তাকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে দোটানার মধ্যে পড়তে হয়। তাদেরকে নিশ্চিতভাবেই নিজের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ ও আচার-আচরণ অনুসরণের জন্য বাবা-মায়ের দিক থেকে চাপ এবং সহকর্মীদের পক্ষ থেকে কানাডীয় জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চাপ এই দুটি বিপরীতমুখি টানাপোড়েনের মধ্যে পড়তে হয়। সহকর্মীরা হয়তো অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে দৃশ্যমান সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে কৌশলে বা খোলাখুলিভাবেই সমালোচনা করতে পারে যা সামাজিক সম্পর্ক এবং আত্মমর্যাদার জন্য এতটাই ক্ষতিকর হতে পারে যেমনটা ঘটে শৈশবে পারিবারিক নিগ্রহের কারণে।
যেখানে মিঠা পানি সাগরের সঙ্গে মেশে সেখানটা সব সময়ই উত্তাল। অভিবাসী শিশু যারা বৃহত্তর কানাডীয় সমাজের মধ্যে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাদেরকেও সমাজে একীভূত হওয়ার আগে একইরকম উত্তাল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
নতুন সংস্কৃতি ও ভাষার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সঙ্গে আরও যোগ হয় পারিবারিক জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো। এক্ষেত্রে সচ্ছল পরিবারগুলো হয়তো দরিদ্র পরিবারের চেয়ে কিছু সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। কানাডায় দারিদ্র্য হলো শিশুদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত যেমন, মনোযোগের অভাব ও অস্বাভাবিক সক্রিয়তাজনিত অসুস্থতা, বিষন্নতা, উদ্বেগ ও আচরণগত ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। তবে দরিদ্র অভিবাসী শিশুদের মধ্যে দরিদ্র কানাডীয় শিশুর তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা কমই দেখা যায়। দরিদ্র অভিবাসী শিশু বা দরিদ্র কানাডীয় শিশু এই উভয়ের মধ্যেই সচ্ছল পরিবারের শিশুদের চেয়ে বেশি সমস্যা থাকে।
অন্যদিকে, মোটামুটি ধনী অভিবাসী পরিবারে অনেক সময় বাবা থাকেন না। বাবা হয়তো তার নিজ দেশে কর্মরত থাকেন কিন্তু মা ও শিশুরা কানাডায় অবস্থান করেন। শিশুরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় যখন বাবা-মা উভয়েই তাদের বেড়ে ওঠার ব্যাপারে মনোযোগী হন। যেসব শিশুর বাবা দূরে থাকেন তারা বাবার সম্পর্কে একধরণের ভীতির মধ্যে থাকে। এধরণের মেয়েরা আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে সমস্যা নিয়েই বড় হয়। ছেলেরা অবশ্য এমন বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়ে ওঠে যে তাকে তার অনুপস্থিত বাবার গুরুত্ব প্রমাণ করতে হবে।
যেসব মা ঘরে থেকে বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারেন তাদের চেয়ে যেসব মা বাইরে কাজ করেন তাদেরকে অনেক বেশি কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। একক মাকে হয়তো তার বাচ্চার সঙ্গে কাঠামোগত ও সীমাবদ্ধতার দিকগুলো মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়তে হয়। তাছাড়া তারা হয়তো নিজের আবেগগত চাহিদা পূরণের জন্য শিশুর দিকে মনোযোগী হন এবং সেজন্য সন্তানের সঙ্গে বয়সের ব্যাবধান ঘুঁচিয়ে তার চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হয়। যে মা তার সন্তান লালন-পালনে স্বামীর সহায়তা পান তিনি এবং বর্ধিত পরিবারগুলো শিশুদের সেবাযতœ, পরিচালনা, শাসন, সাহস যোগানো এবং পাঠ্যসূচির বাইরের কর্মকান্ডে সমর্থন দিতে বেশি সমর্থ হন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, অভিবাসী এবং কানাডার বৃহত্তর নগরগুলোতে জন্ম নেয়া লোকেদের জীবনযাত্রার ব্যয় এমন যে, বাবা-মা উভয়কেই কাজ করতে হয়। কর্মজীবী দম্পতির জন্য ঘরে বা ঘরের বাইরে তাদের সন্তানের সমস্যাগুলো সমাধান করে দেয়া সম্ভব হয় না। বাইরে গিয়ে বৈষম্য বা হিংসামূলক আচরণের শিকার হওয়া শিশুরা বিষণœ, নিঃসঙ্গ বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে পারে। কর্মস্থলে হিংসামূলক আচরণ বা বিদ্বেষের শিকার হওয়া বাবা-মাও হয়তো দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে পারেন এবং এর ফলে তারা হয়তো ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন। যেমন, মানসিকভাবে আহত হওয়ার ক্রোধ তারা তাদের সন্তানের ওপর ঝাড়তে পারেন অথবা মাদক গ্রহণ ও মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়তে পারেন।
উড়োজাহাজে শিশুদের সাহায্য করার আগে বাবা-মাকে অক্সিজেন মাস্ক পরে নিতে বলা হয়। জীবনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি একইরকম। যেসব বাবা-মা তাদের নিজেদের জন্য সহায়তা, বিশ্রাম, আত্মমর্যাদা ইত্যাদি চাহিদা পূরণে সক্রিয় তারা তাদের সন্তানের চাহিদা ভালোভাবে পূরণ করতে পারেন। একক বাবা অথবা মা হয়তো এমন অন্য কোনও প্রাপ্তবয়স্ক সঙ্গী খুঁজে নিতে পারেন যিনি তার সন্তানদের জন্যও সহমর্মিতা ও রোল মডেলের ভূমিকা নিতে পারবেন। বড় ভাই বা বড় বোন হচ্ছে ছোটদের জন্য আরেকটি সম্পদ যারা ছোটদের জন্য স্বেচ্ছায় বড় ভাই বা বোনের ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী। এই স্বেচ্ছাসেবকরা ছোট ভাইবোনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে এবং একক বাবা অথবা মায়ের জন্য কিছুটা অবকাশের সময় করে দেয়। কমিউনিটি সেন্টার, বহুমুখি সাংস্কৃতিক কর্মসূচি অথবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন অভিবাসীদের প্রয়োজনীয় সাহচর্য ও সমর্থন দিতে পারে।
ড. ম্যারিলিন চোহেম একজন মনস্তত্তবিদ। তিনি উত্তর ভ্যাঙ্কুভারে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন । রুশ-ইহুদি বংশোদ্ভূত এই চিকিৎসক ওয়ামিংটনের সিয়াটলে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩০ বছর আগে কানাডায় চলে আসেন।
– canadianimmigrant.ca