একি লাবন্যে পূর্ন প্রাণ হে- সে হলেন -হৈমন্তী শুক্লা

অক্টোবর ৭, ২০১৭

ফারহানা পল্লব

টরন্টো ডাউন টাউন এর এয়ারপোর্ট এ আমারা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে গেছি।

প্রণাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কি স্বাভাবিক সরলতা আমাদের ছবি তুলায় একটুও বিরক্ত না হয়ে হাসি মাখা মুখখানী নিয়ে দাড়িয়ে রইলেন। ঝলমলে রোউদ্রোজ্বল দিন, অন্টারিও লেকের পানিতে সূর্যের ঝিলিমিলি, সাথে আমাদের আনন্দ কলতান। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি আর গায়ে জড়ানো লাল শাল, কপালে বড় একটা লাল টিপ, এই সাজে কি স্নিগ্ধ আর মায়াময় মুখখানা। নিমিষেই আমাদের সকলকে আপন করে নিলেন।

আমরা এক গাড়ি তে আলো ভাবী, ইয়াসমীন ভাবী, সুমি দি আর স্নিগ্ধা, আমি চালক। আর বিপ্ল্লব দা এলেন আরেক গাড়ি নিয়ে। শিল্পী কে নিয়ে পৌঁছে দিলাম গন্তব্যে, সেখানে মুন্নী সুবহানী আর আফজাল সুবহানী তাঁকে সাদরে আপ্যায়ন করলেন। সুমি দি-র হাতের লুচি, হালুয়া, রসগোল্লা আর সব্জী খেয়ে দিদি আর ঋষিদা কে রেস্ট এ রেখে আমরা বেড়িয়ে পরলাম মঞ্চ করতে।

সকল আয়োজন হলে  হৈমন্তী শুক্লা যখন মঞ্চে প্রবেশ করলেন, কথা শিল্পী ফরিদা রহমানের ভাষায় সে বনলতা সেন, মঞ্চে আসন নিয়ে দর্শক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কইলেন, তারপর গাইলেন, সেই ছোট বেলা থেকে শুনে শুনে বড় হওয়া কিছু গান, ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুয়ো না- আমার বুবুর কন্ঠে শুনতাম অনেক। তারপর আমার বলার কিছু ছিল না, এই গান গুলো জেনো আমাদের বড় হওার একেক বয়েসে একেক অর্থ বহন করে আমাদের প্রতিপালন করে চলেছে। আমরা যেমন আমাদের গান বাজনা, ভাষা সাহিত্যে আমাদের নিজেদের পরিচয় লালন করি তেমনি করে এই একেকটি  গান জেনো আমাদেরকেও অনেক দিয়ে গেছে। আমাদের বাংলা সংস্কৃতিতে সঙ্গীতের অবস্থান বিরাট- আর হৈমন্তী শুক্লার মত কিংবদন্তী শিল্পীরা সেই পথ প্রদর্শক বাতি ঘরের কাজটি করে চলেছেন যুগ যুগ ধরে।

হৈমন্তী শুক্লার সাথে তবলায় ছিলেন ঋষি কুমার চ্যাটার্জী। তার হাত জেনো বাতাসে খেলে যায়- মাঝে মাঝে হাত দেখা যায়  না- কি দারুন তার বাজনা, শুধু হারমোনিয়াম আর তবলায় হাজারো দর্শক কি করে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে গান শুনেন সেরকম গাইয়ে হলেই তা সম্ভব। আমরা বলেছিলাম একটু কী বোর্ড বা গীটার রাখি সাথে, শিল্পী জানিয়েছিলেন তার প্রয়োজন হবে না। দর্শকদের কে শিল্পীর অনুরোধ করতে হয় নি হাতে তালি দিতে, বরং প্রতিটি গানের পর মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে উঠেছে প্রেক্ষাগৃহ।

শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার সঙ্গে লেখিক ফারহানা পল্লব

আমরা সকলে দর্শক সারি তে বসে পরিচিত গানগুলো শুনতে গিয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো, সাথে গলা মেলালাম -আমার বলার কিছু ছিল না গানের সাথে- এক বান্ধবী এইসময় বলল, এই রকম প্রেম আর হবে না। সত্যিই তাই, এ যেন ঈশ্বরের প্রতি অগাধ প্রেম- এই গানের যে আকুতি যে আবেগ, কি শব্দচয়ন, কি সুর আর কি হৈমন্তী শুক্লার কন্ঠ, গায়কী। এই সমন্বয় আর কি হবে? আর কি হবে এমন সৃষ্টি? মান্না দে নিজের গানটি হৈমন্তী শুক্লাকে গাইতে দিয়ে কি এক সমন্বয় এক অভাবনীয় সৃষ্টির সাথে বাধা পড়ে গেলেন, যে হৈমন্তী শুক্লা আজো অকপটে তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। এই যে শিল্পীর প্রতি শিল্পির সম্মান, শিল্পের প্রতি তাঁদের প্রতিশ্রুতি, এ যেনো শিল্পীকে এক জাগতিক বলয়ের উর্ধ্বে নিয়ে যায়। দর্শকের প্রিয় গান গুলোকে আবারো অনু রোধে শিল্পী দুইবার করে শোনান। এই বিষয়টি সত্যিই বিরল। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে তিনি প্রেক্ষাগৃহের আলো জ্বালিয়ে দিতে অনুরোধ করেন, যেনো দর্শকের মুখগুলো দেখতে পান। এই যে বিনয়, এই যে আপন করে ফেলা, এভাবেই হৈমন্তী শুক্লা শুধু গান নয় তার সুমিষ্ট ব্যাক্তিত্বের জন্য ও বিখ্যাত।

দারুন উত্তেজনায় অনুষ্ঠান শেষ হলো সম্মাননা পর্বে বাঙ্গালী কালচারাল সোসাইটির সভাপতি জনাব জসিমুদ্দিন এর হাত থেকে পদক গ্রহনের সময় তিনি নিজ থেকে অনুরোধ করেন সংগঠনের জীবন সদস্যা হ্বার জন্য। সংগঠনের সকল সদস্য আর দর্শক শ্রোতারা  আবেগে আপ্ল্লুত হয়ে ওঠেন।

তারপর ছবি তোলার হিরিক, একটু আপত্তি না করে হাসিমাখা মুখখানী সকলের সাথে ক্যামেরা বন্দী করে গেলেন।

পরের দিন মন্দির এ অনুরোধে হাজিরা দিলেন, আরো সম্মান আরো উপহার তারপর অনেক পরিশ্রান্ত একটু লেকের ধারে বসে আবার

দুপুরের থাই খাওয়া- এর মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান। একা  একা  গুন গুন  করেন, আর এতো আন্তরিকতার সাথে কথোপকথন করেন যেন কতকালের পরিচিতা – থাই রেস্তরায় আলাপের এক পর্যায় আফজাল সুবহানী জিজ্ঞেস করেন সুর আর ঈশ্বরের মিলনের বিষয়টি কি? হৈমন্তী  শুক্লা উত্তর দেন- আমি ধ্যান এ মন বসাতে পারি না, নানা চিন্তা মাথায় চলে আসে, কিন্তু যখন গানে বসি- আমার সাধনা আমার সুর কোথায় যেন আমাকে নিয়ে যায়। মনে হয় এইতো আমার ঈশ্বর পেয়েছি- আমি হাছন রাজা, লালন ফকিরের সেই বাণী আবারো প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম – ‘ মানুষের মাঝেই ঈশ্বর, বাহিরে বৃথাই সময় ব্যায়।’  স্মৃতি রোমন্থনের এক পর্যায় হৈমন্তি শুক্লা  গেয়ে উঠেন বেগম নূরজাহানের গাওয়া কোনো এক পাঞ্জাবি গীত যা  বহু বছর আগে তিনি টরন্টতে পরিবেশন করেছিলেন,  আমরা তার পাশে বসে দেখি, আর শুনি এই জীবিত কিংবদন্তী- আর কখনো এতো কাছ থেকে দেখা হবে কিনা জানিনা, তবে লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁশলে , সন্ধ্যা মুখার্জি , হৈমন্তী  শুক্লা এনারা নিজেরাই একেকজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- তাদের  ত্যাগ, সংগীতের জন্য সুরের সাধনায় এনারা  জীবন উৎসর্গ করেছেন, এদের কাছে শেখার অনেক আছে/ কত বড় মাপের মানুষ হতে হয় একজন সত্যিকার সংগীত শিল্পী হতে হলে তা উনাকে  কাছে থেকে না দেখলে জানতাম না. হৈমন্তী শুক্লা শতায়ূ  হন সেই কামনা করি।

ফারহানা পল্ল্লব, টরন্টো