তাসের আড্ডা – ১০
সেপ্টেম্বর ২, ২০১৭
শুজা রশীদ
নিজের হাতের তাস দেখে আনান্দ আর ধরে না জালালের। ভয়ানক হাত। আটখানা হার্টস পড়েছে হাতে। তার কাছ থেকে এবার কল নেবে এমন সাধ্য কার আছে? এই শনিবার আবার সাইদের বাসায় তাসের আড্ডা বসেছে। রুনা গেছে কোন এক মেলায়। কোরবাণীর ঈদ আসছে সামনে। চারদিকে জামা কাপড়ের মেলা বসছে। বেলা, ইলা এবং লতাকে সাথে নিয়ে গেছে রুমা। সাহেবরা তাস খেলুক। বেগম সাহেবরা ঈদের কেনা কাটা করবে। রনি অবশ্য বেলাকে পই পই করে বলে দিয়েছে সে যেন কিছু না কেনে। বেলা অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে তাকে ভস্ম করে গেছে। যার একটাই অর্থ হয়, আজ সে দামী পোষাক আষাক কিছু একটা কিনবেই। তার ভাষ্য অনুযায়ী, সে ভালো বলে রনি তাকে বেশী পেয়েছে। এবার সে এর একটা বিহিত করে ছাড়বেই।
ডাকাডাকি শুরু হতে জালাল টের পেল কত ধানে কত চাল। দেখা গেল সাইদও খুব ভালো হাত পেয়েছে। জালাল যতই হার্টস ডাকে, সাইদ ততই স্পেড ডাকে। সমস্যা হচ্ছে, স্পেডের মূল্য হার্টসের চেয়ে বেশি। ফলে সাইদ জিতে যাচ্ছে। পাঁচ স্পেডে গিয়ে থেমে গেল জালাল। জিত এবং কবীর তাকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বেশী ডেকে শর্ট খাবার চেয়ে না ডাকাই ভালো। মনক্ষুন্ন হয়ে পাশ দিয়ে দিল জালাল। সাইদ আরামসে গেম করে হাসি মুখে বলল, “বড় বাঁচা বেঁচে গেছ জালাল। আরেকবার ডাকলে একেবারে কচু কাঁটা করে দিতাম।”
জালালের মন খুবই খারাপ। সে বিষন্ন মনে বলল, “আরে সাইদ ভাই, দুনিয়ায় কত কি ঘটে যাচ্ছে। আপনি কি ভেবেছেন এই সামান্য তাসের খেলা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই।” সবাই হেসে উঠলেও আলাপটা ঝট করেই খেলার বাইরে চলে গেল।
রনি বাট করতে করতে বলল, “আলাপ করার মত ঘটনা তো এখন একটাই। নাজীবাদী। চিন্তা করা যায়, আজ এতো বছর পর এরা নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তাও ট্রাম্পের মত একটা সুযোগসন্ধানীর নেতৃত্বে। ও যে শুধু আমেরিকার বারোটা বাজাবে তাই না, এই ভাবে চললে সারা ইউরোপ, আমেরিকা এদের জন্য বিষাক্ত হয়ে উঠবে। একদিকে শালা আইসিস, আরেকদিকে এই নাজীবাদী। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।”
জিত বলল, “চার্লসভিলের ঘটনাটার কথাই ধরুন না। শান্তিপূর্ণ মিছিল করবার কথা। কিন্তু কেউ যখন এই জাতীয় রেসিস্ট, জেনোফোবিক ধ্যান ধারণা নিয়ে রাস্তায় নামে তখন সেটা কি করে শান্তি পূর্ণ হতে পারে? ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে এই জাতীয় সমাবেশ কি করতে দেয়াটা ঠিক? কনফেডারেট স্ট্যাচু এখনও এইভাবে সংরক্ষিত করবার দরকারটা কি? গৃহযুদ্ধ শেষ হয়েছে সেই ১৮৬৫ সালে। তারা যুদ্ধ করেছিল দাসত্বের পক্ষে। যাদের গোড়াতেই গলদ তাদেরকে নিয়ে এতো নাচানাচি করার কি আছে?”
কবীর বলল, “এটার জন্য ট্রাম্পই দায়ী। ইলেকশনের আগে থেকেই নাজীবাদীদেরকে উষ্কাণী দিয়েছে। চার্লসভিলে নাজীবাদীদের হাতে একজন খুন হবার পরও সে তাদেরকে সরাসরি দোষারোপ করতে চায়নি। আশ্চর্য! আমেরিকার শাসন ব্যবস্থাকে যে ধরণের সম্মানের চোখে দেখতাম, তা একেবারে ধুলায় মিশিয়ে গেছে। যে দেশ নিজেকে গণতন্ত্রের ধারক বলে দাবী করে, সেই দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বিকারে এই ধরণের বিভেদ সৃষ্টি করে যেতে পারে এবং সেই ব্যাপারে কারো কিছু করার ক্ষমতা নেই, ভাবতেই পারি না।”
সাইদ বলল, “করতে পারে না, তা নয়। রিপাবলিকানরা চাইলেই ইম্পিচমেন্ট করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল, তাতে তাদের কি কোন লাভ আছে? নেই। অযথা তারা বেশ কিছু সমর্থক হারাবে। কোন রকমে চার বছর পার করে দিতে পারলেই তারা খুশী। কিন্তু ওর আলাপ থাক। ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রসঙ্গ যখন তুললে তখন সেটা নিয়ে একটু আলাপ করা যাক। আমরা পছন্দ করি বা না করি, গণতান্ত্রিক প্রথায় সবারই তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকা দরকার। কারণ সুযোগ না থাকলে এরাই তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে, টেররিজম করবে। তোমরা বলছ কনফেডারেট স্ট্যাচু রাখার দরকারটা কি। হ্যা, ওরা দাসত্বের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ভুলে যেও না যুদ্ধ শুরু হয় নানা অছিলায়, কিন্তু একবার শুরু হল তখন দুই পক্ষই যোঝে তাদের জান-মাল-পরিবার রক্ষা করবার জন্য। উভয়পক্ষেরই বীরত্বকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখাটা কি উচিৎ নয়? তাদের যারা বংশধর আছে তারা কি এই অবমাননা সহজে মেনে নেবে?”
রনি বলল, “আপনার কথায় কিছু যুক্তি আছে। কিন্তু তাই বলে ঘৃণা, বর্ণ বৈষম্য মূলক ধ্যান ধারনাকে তো আর আমরা প্রশ্রয় দিতে পারি না। চার্লসভিলে হিটলারের সমর্থকরা পিস্তল নিয়ে মিছিল করতে গেছে, ফাঁকা গুলী ছুড়েছে, যারা তাদের বিরোধিতা করছিল তাদের উপর শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছে, পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে দেখেও না দেখার ভান করেছে – এগুলো ভাই ভালো আলামত না। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এক একটা দাঙ্গাতে শত শত মানুষ খুন হয় কারণ আইন শৃংখলা বাহিনী দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখে।”
লাল ভাই এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। সে এবার বলল, “ভাই, আপনারা আমেরিকার কথা বলছেন, এই জিনিষতো এখন আমাদের কানাডাতেও শুরু হয়ছে। ক’ দিন আগে মার্কহামে স্কুলের দেয়ালে আর খেলারমাঠের ইকুইপমেন্টের উপর হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট গ্রুপের সদস্যরা সোয়াস্তিকা এঁকেছে! ছবিতে দেখা যাচ্ছে যারা করেছে তারা ছেলেমানুষ। আর আমরা এতোকাল ভাবছিলাম শুধু বুঝি মুসলিম ছেলেমেয়েরাই ভুল পথে গিয়ে টেররিস্টদের দলে গিয়ে ভিড়ছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে, তরুণদের মাথা নিয়ে খেলা করার মানুষের অভাব নেই। এখানেও নিশ্চয় নাজীবাদীরা সংঘবদ্ধভাবে অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েদের মাথায় ঘৃণার বীজ বুনছে।”
সাইদ বলল, “তা তো অবশ্যই। দুনিয়া এগিয়ে গেছে, আর এরা গ্রামে গঞ্জে পড়ে আছে, শিক্ষা দীক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অল্প, জীবনে সাফল্য খুব একটা নেই। এক কথায় আমরা যাদেরকে বলি লুজার – হারুপাট্টি। এখন ওরা নিজেদের দূর্বলতা ঢাকার জন্য নানান ফন্দী ফিকির বের করছে। মন্ট্রিয়ল, ভ্যাঙ্কুভারে এন্টাই ইমিগ্রান্ট, এন্টাই মুসলিম মিছিল হল না! যে সমস্ত দেশ নতুন ইমিগ্রান্টদেরকে দু’ হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছে, সেখানে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন তো হবেই। নানা ধর্মের মানুষ নিজস্ব ধর্ম পালন করবে, নিজস্ব প্রথা মেনে চলবে, এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু এই গোঁড়া নাজীবাদীদের সমস্যা হচ্ছে, তারা মানসিক ভাবে উন্মুক্ত হতে পারে নি। অবধারিত কিছু সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে পারে নি। মানসিকভাবে তারা এখনও আদ্যিকালে পড়ে আছে। সেই কারণে দূর দেশ থেকে মানুষ এখানে এসে পাঁচ সাত বছরের মধ্যে সাফল্যের মুখ দেখছে, আর এই উড়নচণ্ডীর দল যেখানে পড়ে ছিল সেখানেই পড়ে আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পশ্চিমের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফসল তারা চোখেও দেখে না।”
লাল ভাই মান খারাপ করে বলল, “কিন্তু এই কানাডাতেও মুসলমানদের উপর ওদের এতো রাগ কেন? মুসলমানরা ওদের কি ক্ষতি করেছে?”
রনি তাস বাট শেষ করেছে। সে হাতের তাস দেখতে দেখতে বলল, “আমার অভিমত হচ্ছে মুসলমানরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেখানে বসবাস করতে যায়, সেখানে নিজেদের রীতি নীতিকে প্রাধান্য দেবার চেষ্টা করে। স্থানীয়রা এটাকে ভীতির চোখে দেখে। তারা ভাবে মুসলমানরা এসে তাদের সাংস্কৃতিক প্রাধণ্যকে চ্যালেঞ্জ করছে, বিকৃত করছে, পরিবর্তন করছে।”
কবীর বলল, “কিন্তু তাতে তো অন্যায় কিছু নেই। একটা গণতান্ত্রিক দেশে যার যার ধর্ম এবং সংস্কৃতি নিয়ে জীবন যাপন করবার অধিকার তো সবার আছেই।”
রনি বলল, “সব কিছু কি আর আইন কানুন দিয়ে চলে। যাদের সাথে থাকব তাদের বিশ্বাস অর্জন করাটাও তো গুরত্বপূর্ণ। সব ক্ষেত্রে নিজেদের জন্য পৃথক নিয়ম কানুন সৃষ্টি করাটা সব সময় হয়ত বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য কাম্য নয়। কারণ তাতে একটা বড় রকমের বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। সেটা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।”
জিত বলল, “ঘৃণা যারা করে তাদের যুক্তি তর্কের প্রয়োজন হয় না। তারা মন গড়া কিছু একটা বের করে তাদের রোষ ঝাড়বার চেষ্টা করে। কিন্তু খুশির ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ মানুষ কিন্তু ওদের সাথে নেই। মন্ট্রিউল এবং ভ্যাঙ্কুভারে নাজীবাদীদের বিরুদ্ধেও বিশাল মিছিল হয়েছে। ”
জালাল বলল, “এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিতে খুব বেশীক্ষণ লাগবে না। আমরা ভাবি কানাডায় আমরা খুব ভালো আছি, নিরাপদে আছি। কতদিন পরিস্থিতি তেমন থাকবে সেটা ভেবেই দুশ্চিন্তা হয়।”
সাইদ দার্শনিকের মত বলল, “সবই আপেক্ষিক। শান্তি বল আর সুখ বল, যতক্ষণ আছে ততক্ষণ মন ভরে উপভোগ করে নাও। এইসব উধাও হতে বেশী সময় লাগে না।”
জিত মৃদু হেসে বলল, “আপনার কথা শুনে একটা জোক মনে পড়ে গেল।
এক ম্যাজিসিয়ান রাস্তায় ম্যাজিক দেখাচ্ছে।
একটা মন্ত্র বলে বলল: গিলিগিলি ফট।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোকের টাইটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোককে ফুঁ দিতে বলল। পাশের লোকটা ফুঁ দিতেই টাইটা স্বাভাবিক হয়ে গেল।
ম্যাজিসিয়ান আবার মন্ত্র বলে বলল: গিলিগিলি ফট।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক
ভদ্রমহিলার চুলের বিনুনিটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মহিলাকে ফুঁ দিতে বলল। পাশের মহিলাটা ফুঁ দিতেই বিনুনিটা স্বাভাবিক হয়ে গেল।
ম্যাজিসিয়ান আবার মন্ত্র বলে বলল: গিলিগিলি ফট।
সবাই খুঁজতে লাগলো, এবার কি দাঁড়ালো।
হঠাৎ দেখে এক দাদু বাড়ির দিকে দৌড়াচ্ছে, আর চেঁচাতে চেঁচাতে বলছে……… ‘কেউ ফুঁ দিবি না… কেউ ফুঁ দিবি না…দিদাকে দেখাবো!’”
জালাল হাসতে হাসতে বলল, “আমাদের গনতন্ত্র যদি একটা ফুঁ দিলেই উধাও হয়ে যায় তাহলে তো এতো কষ্ট করে এতো কিছু করাটাই বৃথা।”
তাসের পরের রাউন্ডের ডাক শুরু হল। এবারো সাইদ খেলা নিল। কবীর বলল, “একটা চমৎকার বক্তব্য পড়লাম কয়েকদিন আগে। ভারতে কয়েক দিন আগে কোর্ট আইন করেছে তিন তালাক দিয়ে কোন ডিভোর্স করা যাবে না। বাংলাদেশ, পাকিস্থানে আগেই এই নিয়ম ছিল, ভারতে নতুন করে হল। ইগগঅ (ভারতীয় মহিলা মুসলিম আন্দোলন) এর সহ স্থাপিকা নুরজাহান এটার বিপক্ষে অনেক দিন ধরেই যুদ্ধ করছিলেন। উনি একটা দারুন কথা বলেছিলেন। আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। একেবারে তার কথাগুলোই বলি “ My creator cannot create me in a way that I am subservient to another human being. My creator cannot make me secondary to a man just because I’m a woman. That gave me strength to question patriarchal attitudes. I’m equal to anybody in this world.”
রনি বলল, “আমেন!”
শুজা রশীদ
লেখক ও গল্পকার
টরন্টো