সন্ত্রাসের অভিযোগ কেবল মুসলমানদের জন্যই সংরক্ষিত
কুইবেকের মসজিদে গুলি চালানো আলেক্সেন্দ্রে বিসোনেত্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই সন্ত্রাসের অভিযোগ আনতে হবে কারণ সে একজন সন্ত্রাসী, কিন্তু সেইসঙ্গে আমাদেরকে সরকারের এমন ধারণার বিরুদ্ধেও সক্রিয়ভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে যে কেবল মুসলমানরাই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত।
নভেম্বর ৩, ২০১৭
কৌসুলীরা সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে, চলতি বছরের আরও আগের দিকে কুইবেক সিটির একটি মসজিদে হামলা চালানোর ঘটনা থেকে উদ্ভূত অভিযোগগুলো যেভাবে পুরোপুরি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে আলেক্সেন্দ্রে বিসোনেত্তি সরাসরি বিচারের মুখোমুখি হবে। মসজিদে নামাজ আদায়ের সময় মুসল্লিদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা এবং ১৯ জনকে জখম করার পরও তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনা হয়নি।
এই ঘোষণাটি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে গণহত্যার ঘটনার পর পরই। সেখানে বন্দুকধারীর গুলিতে ৫৯ জন নিহত এবং ৫২৭ জন আহত হয়। সেখানেও ওই হামলাকারীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনা হয়নি, যদিও নেভাদার আইন অনুযায়ী এটা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে।
কোনও সন্দেহ নেই যে, দুটি ঘটনাতেই মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছে। তারপরও হামলাকারীদেরকে সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে খুব কম ক্ষেত্রেই। কারিগরি দিক থেকে সমস্যা হলো, সন্ত্রাসের কোনও বিশ^ব্যাপী গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নেই যা কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্টভাবে প্রয়োগ করতে পারে। ফলত, একজন যাকে সন্ত্রাসী বলছে, অন্যের কাছে সে-ই হয়তো বিবেচিত হয় অপরাধী হিসাবে অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। অনেক পর্যবেক্ষকের কাছেই এই পরিভাষাটি দৃশ্যত “অন্যদের” জন্য সংরক্ষিত।
লাস ভেগাসের শেরিফ জো লম্বার্ডোর মতে খুনি স্টিফেন প্যাডক সন্ত্রাসী ছিলো না। তিনি খুব দ্রুতই প্যাডককে জনৈক “স্থানীয় ব্যক্তি” (local individual) বা “নিঃসঙ্গ হামলাকারী” (lone wolf) বলে আখ্যা দিয়েছেন। একইভাবে কানাডার হামলাকারী বিসোনেত্তি সম্ভবত ছিলো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত (disturbed) ব্যক্তি। আর অতি অবশ্যই তারা উভয়েই ছিলো “অসুস্থ” এবং “পাগলাটে” তথা ক্ষ্যাপাটে (demented)।
তারা যদি মুসলমান হতো তাহলে তাদের বলা হতো, নিজভুমে বেড়ে ওঠা (homegrown) সন্ত্রাসী যারা “জেহাদ” বা “ইসলামী সন্ত্রাস” চালিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য অথবা ব্যক্তিগত সমস্যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখা হতো না।
ফৌজদারি দন্ডবিধিতে সন্ত্রাসবাদকে এমন এক কর্মকা- হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যা পুরোপুরি অথবা কিছুটা হলেও রাজনৈতিক, ধর্মীয় অথবা আদর্শিক উদ্দেশ্য, লক্ষ্য অথবা কার্যকারণে ঘটানো হয়ে থাকে এবং যার “লক্ষ্য থাকে জনগণকে বা জনগণের কিছু অংশকে নিরাপত্তার ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা।”
লেভাল ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র বিসোনেত্তি একজন মধ্যপন্থী রক্ষণশীল মানসিকতার ব্যক্তি থেকে কী করে চরম-দক্ষিণপন্থার অনুরাগী এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে উঠলো সে বিষয়ে দালিলিক তথ্যসহ অসংখ্য রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যদিও তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কঠোর দৃষ্টান্তমূলক প্রমাণ হিসাবে এগুলো সম্ভবত যথেষ্ট হবে না।
কৌশুলিরা বলবেন যে, দৃষ্টান্তের ভিত্তিতেই অভিযোগ গঠন করা হবে। সাধারণ অপরাধের চেয়ে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ প্রমাণ করা অনেক বেশি দুঃসাধ্য। অংশত এর কারণ হলো, অভিযুক্তের উদ্দেশ্য (motive) এবং রিলেটেড অন্যান্য জটিল অনুষঙ্গগুলো (complex factors) জটিলতর (critical) হতে পারে। কৌশুলিরা যদি মনে করেন যে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করার মত জোড়ালো তথ্যপ্রমাণ রয়েছে সে ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হলে তা আইনগত দিক থেকে মামলাটিকে অযথা জটিল করে তুলতে পারে। বোধগম্য কারণেই সন্ত্রাসবাদের উদ্দেশ্য ছিলো এটা প্রতিষ্ঠিত করা দুঃসাধ্য।
মানুষের মধ্যে এমন বিশ^াস রয়েছে যে, কেবল প্রতীকী সার্থকতা ছাড়া এধরণের অভিযোগ আনার পেছনে কোনও “প্রকৃত কারণ নেই”। কারণ এটি দন্ডদানের বিষয়টিকে খুব সামান্যই প্রভাবিত করে।
আমিও এসব বিষয়ের সঙ্গে একমত। সন্ত্রাসবাদবিরোধী গোষ্ঠীর সমালোচক হিসাবে আমি এটাও বিশ^াস করি যে, এই আইনটি বিলুপ্ত করা উচিৎ, তবে সেটা হওয়ার আগে বিসোনেত্তিকে সন্ত্রাসের দায়েই অভিযুক্ত করতে হবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত এই আইনটি রয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত একজন সন্ত্রাসী সবসময় একজন সন্ত্রাসীই। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি মুসলমান হয় তাহলে এতক্ষণ সতর্কতার যেসব পর্যায় সম্পর্কে যুক্তি দেখানো হয়েছে সেগুলোর চর্চা কখনই তেমন একটা হয় না। সেক্ষেত্রে খুব সহজেই সন্ত্রাসীর তকমা লাগিয়ে দেয়া হয় এবং এর ফলে সমাজের ওপর কতটা বিপর্যয়কর প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে সেটা বিবেচনায় নেয়া হয় না।
এমনকি সাম্প্রতিক কয়েকটি মামলার দ্রুত পর্যবেক্ষণেও দেখা যায় মুসলমান ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনেক সময় একেবারেই অনিশ্চিত কিংবা সন্ত্রাসের সঙ্গে কাল্পনিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্যদিকে একইরকম কাজের জন্য শে^তাঙ্গ অমুসলিমকে রেহাই দেওয়া হয়েছে।
চলুন আমরা ২০১৩ সালের ঘটনার দিকে ফিরে যাই। ক্যালগেরির প্রবীণ বিষয়ক ভবন উড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক বার্তা পাঠানোর পরিকল্পনাকারী সাবেক সামরিক-গোয়েন্দা কর্মকর্তা Glen Gieschen-এর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনা হয়নি।
২০১৪ সালে মার্টিন কটিউর-রাউলিউ (যিনি দুজন সৈনিকের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দিয়ে একজনকে হত্যা করেন) এবং মাইকেল জেহাফ-বাইবিউর (যিনি একজন সৈনিককে হত্যা করেন) অপরাধকেও কেবল তাদের ব্যক্তিগত অপরাধ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়নি। বহুদিন ধরে তারা মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন বলে চিকিৎসকের প্রত্যয়ন থাকার পরও তাদের অপরাধকে তাদের “ইসলামিক” বিশে^র দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত করা হয় এবং দুজনেই আজ মৃত।
অন্যদিকে আরসিএমপির পাঁচজন সদস্যের ওপর গুলি চালিয়ে তিনজনকে হত্যাকারী জাস্টিন বোর্ক হয়ে গেলেন নিছক একজন খুনি। বোর্ক যে একটি “ধর্মোন্মাদনাপূর্ণ” পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন এবং বিশ^াস করতেন যে তিনি “যীশু খ্রিস্টের সৈনিক” সেই বিষয়গুলোকে কখনই একটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়নি এবং তার অপরাধকে সন্ত্রাসবাদী সহিংসতা বলে অভিহিত করা হয়নি। বোর্ক এমনকি পুলিশকে এমন কথাও বলেছিলো যে, সে নিবর্তক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার জন্য ওই কাজ করেছে।
২০১৫ সালের ভ্যালেন্টাইন ডেতে হ্যালিফেক্স শপিং সেন্টারে হামলা চালানোর কথিত পরিকল্পনা পুলিশ নস্যাৎ করে দেয়। তারা জেমস গ্যাম্বল নামে একজন (যে নিজের হাতে জখম হয়ে মারা যায়) এবং র্যান্ডল শেফার্ড ও লিন্ডসে সোউভান্নারাথ নামে আরও দুজন সন্দেহভাজনকে খুঁজে পায়, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনা হয়নি।
আরসিএমপির মুখপাত্র ব্রায়ান ব্রেনান বলেন, সন্দেহভাজনরা ছিলো “কিছু সংখ্যক ব্যক্তির একটি গ্র“পের সদস্য যাদের কিছু নিজস্ব বিশ^াস রয়েছে এবং যারা নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংস তৎপরতা চালানোর ইচ্ছা পোষণ করতো।”
আর তৎকালীন বিচারমন্ত্রী পিটার ম্যাককে বলেন, এটি ছিলো “কিছু খুনে খাপছাড়া মানুষের একটি গ্র“প।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ওই “হামলা সাংস্কৃতিক দিক থেকে উদ্বুদ্ধ কোনও হামলা ছিলো না এবং সেজন্য এটি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।” শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনৈতিক “বিশ^াস” ও আদর্শ দৃশ্যত স্পষ্ট নয়।
টরন্টো বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর মেগান এম. বোলের বলেন, “সন্ত্রাসবাদ পরিভাষাটি শুধু ‘জাতিগত পরিচয়ে’ সংঘটিত সহিংসতার ক্ষেত্রে ব্যবহারের বাস্তবতা থেকে বোঝা যায় যে, আমাদের ভাষা এবং বিচার ব্যবস্থার মধ্যে বর্ণবাদ ও ইসলামভীতির (Islamophobia) প্রভাব কতটা গভীর ও উদ্বেগজনক পর্যায়ে নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন, বিসোনেত্তির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনতেই হবে কারণ সে একজন সন্ত্রাসী, তাছাড়া আমাদেরকে অবশ্যই সরকারের এমন ধারণার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে যে, কেবল মুসলমানরাই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত। -টরন্টো স্টার
লেখক পরিচিতি: ফয়সাল কুট্টি কেএসএম ল ফার্মের উপদেষ্টা, ইন্ডিয়ানার ভালপারেইসো বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং অসগুডি হল ল স্কুলের অতিরিক্ত অধ্যাপক (ধফলঁহপঃ ঢ়ৎড়ভবংংড়ৎ)।