বাঙ্গালীদের জন্য নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিবান্ধব বৃদ্ধাশ্রম
জুন ১০, ২০১৭
খুরশিদ আলম
অন্টারিওর মিনিস্টার অব সিনিয়র এ্যাফেয়ার্স দীপিকা ডামেরলা’র কার্যালয় থেকে গত ২৪মে একটি ইমেইল আসে প্রবাসী কণ্ঠ বরাবর। ইমেইলটি পাঠিয়েছেন মন্ত্রীর সিনিয়র কমিউনিকেশন এ্যাডভাইজর নোয়া ফারবার। চিঠিতে বলা হয়, অন্টারিওতে বয়স্ক ব্যক্তিদের (সিনিয়র সিটিজেন) জন্য সাংস্কৃতিকভাবে আরো অন্তর্ভুক্ত এবং সহায়ক স্থান গড়ার একটি পরিকল্পনা নিয়ে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে মত বিনিময় করতে চায় মন্ত্রণালয়।
অন্টারিওতে জুন হলো ‘সিনিয়র মান্থ’। এই মাসটিকে সামনে রেখে এই আয়োজন। অন্টারিওতে বিভিন্ন এথনিক ও কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ডের বয়স্কদের জন্য বিভিন্ন সেবা প্রদানের কার্যক্রমকে কিভাবে আরো উন্নত করা যায় এবং বৃদ্ধাশ্রমগুলোকে কিভাবে আরো বৃদ্ধবান্ধব করা যায় সে বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠকের এই উদ্যোগ।
ইমেইলে মন্ত্রী দীপিকার একটি কোটেশনও যোগ করা হয়েছে যেখানে বলা হয়, “মানুষ যখন বৃদ্ধ হয় তখন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন পড়া ও নিষ্ক্রিয়তা একটি বড় ইস্যু হয়ে দাড়াতে পারে। এই সময়টাতে তারা যদি সক্রিয় থাকতে পারেন, একজন আরেকজনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারেন, নিজ কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন তবে সত্যিকার অর্থেই তাড়া এ থেকে উপকৃত হতে পারেন। বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমির বয়স্ক ব্যক্তিগণ সর্বদাই নিজেদের রীতি-নীতি, দেশাচার, ভাষা, খাদ্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উপভোগ করেন বেশী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্টারিওর ডেমোগ্রাফিক (জনসংখ্যা বিষয়ক) পরিস্থিতিতে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে সে বিষয়টি চিন্তায় রেখে আমাদেরকে নতুন পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে যাতে করে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য আরো উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তোলা যায়।”
অতি উত্তম প্রস্তাব। আমরা জানি অন্টারিওসহ কানাডায় সিনিয়র সিটিজেনদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মে মাসের ৩ তারিখে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বর্তমানে কানাডায় ৫.৯ মিলিয়ন সিনিয়র সিটিজেন রয়েছেন। অন্যদিকে ১৪ বা তারো কম বয়সের ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা ৫.৮ মিলিয়ন। এই তথ্য স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার। অর্থাৎ শিশুদের তুলনায় সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা এখন বেশী। ১৮৬৭ সালে কানাডার কনফেডারেশন গঠনের পর এই প্রথম সিনিয়র সিটিজেনদের সংখ্যা শিশুদের তুলনায় বেশী হলো। স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার ভবিষ্যৎবানী হলো, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী ২০৬১ সালে কানাডায় সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা ১২ মিলিয়নে পৌঁছাতে পারে। আর শিশুদের সংখ্যা ৮ মিলিয়নে।
সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক ব্যক্তিদের এই সংখ্যা বৃদ্ধি বর্তমানে কানাডার জন্য অর্থনীতির পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও হয়ে দাড়িয়েছে।
কানাডায় এই সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক ব্যক্তিদের মাঝে কিছু বাংলাদেশীও রয়েছেন যারা অনেক আগে এ দেশে এসেছেন বা যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের ছেলে-মেয়েদের দ্বারা স্পন্সর্ড হয়ে এসেছেন। আর আমরা যারা গত ১৫/২০ বছর আগে এই দেশে এসেছি তারাও আগামী ১০, ১৫ বা ২০ বছরের মধ্যে সিনিয়র সিটিজেনের খাতায় নাম লিখাবো। আর সেই সংখ্যাটি কিন্তু তখন নেহায়েৎ কম হবে না।
কানাডায় বাঙ্গালীদের মধ্যে যারা ইতিমধ্যেই সিনিয়র সিটিজেনের পর্যায়ে চলে গেছেন বা আগামী এক বা দুই দশকের মধ্যে যারা সিনিয়র সিটিজেন হয়ে যাবেন তাদের নিয়ে চিন্তা করার সময় ইতিমধ্যেই চলে এসেছে।
আমরা জানি বাঙ্গালীদের মধ্যে ইতিমধ্যেই যারা সিনিয়র সিটিজেন হয়ে গেছেন তাদের কেউ কেউ এল্ডার এবিউজেরও শিকার হচ্ছেন। এবং এই এবিউজ যারা করছেন তারা ঐ সিনিয়র সিটিজেনদেরই পরিবারের সদস্য। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, নিজেদের ছেলে-মেয়ের হাতেই তারা এবিউজের শিকার হচ্ছেন! এ বিষয়ে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিন গত বছর এপ্রিল মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল যার হেডিং ছিল, “ইমিগ্রেন্ট পরিবারগুলোতে এলডার এবিউজের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে”। আর সাব হেডিং ছিল, “নিভৃতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ : লজ্জার কারণে অথবা পারিবারিক সম্মান বা সম্ভ্রম নষ্ট হবে এই ভয়ে তা প্রকাশ করছেন না অনেকেই”।
এলডার এবিউজ অন্টারিও এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, কানাডায় এলডার এবিউজ একটি গুরুতর এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যা। কিন্তু এর প্রয়োজনীয় ও প্রকৃত চিত্রটি ফুটে উঠছে না কারণ, অনেক এবিউজের ঘটনা পরিবারের সদস্যরা বা এবিউজের শিকার ব্যক্তি নিজেই গোপন রাখেন। ধারণা করা হয় নর্থ আমেরিকায় ২ থেকে ১০ পার্সেন্ট বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিবছর কোন না কোন ধরণের নির্যাতনের শিকার হন।
বর্তমানে ২ মিলিয়ন সিনিয়র সিটিজেন বাস করেন অন্টারিওতে যাদের বয়স ৬৫ বা তারো উপরে। এরা অন্টারিও প্রভিন্সের মোট জনসংখ্যার ১৪.৬%। উপরে উল্লেখিত নর্থ আমেরিকার হিসাবটিকে (২-১০%) আদর্শ হিসাবে ধরে নিলে অন্টারিওর যে চিত্রটি ফুটে উঠে তা হলো এখানে বর্তমানে ৪০ হাজার থেকে ২ লক্ষ সিনিয়র সিটিজেন প্রতি বছর কোন না কোন ভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা হচ্ছেন। অন্টারিওর মিনিস্ট্রি অব সিনিয়র এ্যাফেয়ার্স এলডার এবিউজের এ বিষয়টি নিয়ে আসন্ন গোলটেবিল বৈঠকে কমিউনিটির লোকদের সঙ্গে মত বিনিময় করলে অনেক তথ্যই বেড়িয়ে আসবে যা পরবর্তীতে নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে বড় রকমের ভূমিকা রাখতে পারে।
এলডার এবিউজের শিকার এই সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম হলো একটি উপযুক্ত স্থান। কিন্তু সেই বৃদ্ধাশ্রম যদি বৃদ্ধবান্ধব না হয় তবে সমস্যা কিছু থেকেই যায়। অন্টারিওর মিনিস্ট্রি অব সিনিয়র এ্যাফেয়ার্স এই বৃদ্ধাশ্রম নিয়েও কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে কমিউনিটির লোকদের সঙ্গে আলোচনা করতে চায়।
আমরা জানি অন্টারিতে বৃদ্ধদের জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরীর বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধাশ্রমগুলো বিভিন্ন এথনিক ব্যাকগ্রাউনেডর লোকদের জন্য ষোলআনা বৃদ্ধবান্ধব নয়। বৃদ্ধাশ্রম যদি বৃদ্ধবান্ধব না হয় তবে বৃদ্ধদের সমস্যা বরং আরো জটিল আকার ধারণ করে। বৃদ্ধাশ্রমগুলো বৃদ্ধবান্ধব না হওয়ার প্রধান কারণ হলো ভাষা এবং সংস্কৃতির ব্যবধান।
কানাডায় আমরা যারা প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্ট, তাদের অধিকাংশেরই রয়েছে ভাষার সমস্যা। ইংরেজীতে আমরা যোগাযোগটা ষোলআনা করে উঠতে পারি না। যোগযোগটা সঠিক ভাবে না হয়ে উঠলে সেবাটাও সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না। কারণ যিনি সেবা দিবেন তাকে বুঝতে হবে সেবাগ্রহণকারী কি চাচ্ছেন। আর সেবা যিনি নিবেন তাকেও সঠিকভাবে বুঝাতে হবে সেবাপ্রদানকারীকে যে তিনি কি চাচ্ছেন। ভাষা ছাড়াও রয়েছে কালচারাল বা সাংস্কৃতিক সমস্যা। সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী যদি দুই সাংস্কৃতিক পটভূমির হন তবে সেক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়। যেমন এশিয়দের মধ্যে বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো একধরনের ম্যান্ডেটরী বা বাধ্যতামূলক বিষয়। প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টরা সেই সংস্কৃতিকে মনে প্রাণে ধরে রাখেন। কিন্তু এই সংস্কৃতি মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমে সবসময় পাওয়া যাবে তার কোন গ্যারন্টি নেই। কারণ সেখানে নানান সাংস্কৃতিক পটভূমির লোকেরা কাজ করেন। ফলে সেখানে বৃদ্ধরা সহজ হতে পারেন না অধিকাংশ সময়। এর পর রয়েছে ধর্ম, খাদ্য, পোষাকসহ আরো নানা বিষয়। বাঙ্গালীর প্রিয় ভাত মাছ। সেই ভাত মাছ কি নিয়মিত পাওয়া যাবে মূলধারার কোন বৃদ্ধাশ্রমে? শুক্রবার জুম্মার দিন। মসজিদের না যেতে পারুক, মূলধারার কোন বৃদ্ধাশ্রমে কি আলাদা কোন ব্যবস্থা থাকবে একসাথে জুম্মার নামাজ আদায় করার? একজন লুঙ্গি বা ধুতি পরা বৃদ্ধের সংগে আরেকজন লুঙ্গি বা ধুতি পরা বৃদ্ধ, অথবা একজন শাড়ী পরা বৃদ্ধা আরেক জন শাড়ী পরা বৃদ্ধার সঙ্গে যতটা সহজভাবে মিশতে পারবেন, নিজের দুঃখ বেদনা ভাগাভাগি করতে পারবেন তা কি অন্য পোষাক পরা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার সঙ্গে সম্ভব? সম্ভব নয়। এ কথাগুলো আমি আমার আগের একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। মিনিস্ট্রি অব সিনিয়র এ্যাফেয়ার্স এর কার্যালয় থেকে পাওয়া ইমেইলটিতেও সেই রকমই একটি বার্তার আভাষ যেন দেখতে পাচ্ছি।
মন্ত্রী দীপিকা ডামেরলা ভারতীয় বংশোদ্ভূত মাঝবয়সী একজন কানাডিয়ান নাগরিক। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে তার জন্ম। এ কারণে ধরে নেয়া যায়, কানাডায় বৃদ্ধ বয়সী ইমিগ্রেন্টদের (বিশেষ করে যাদের ভাষা ইংরেজী বা ফরাসী নয়) অবস্থাটা তাঁর ভাল করেই জানার কথা। বৃদ্ধদের নিয়ে তিনি যে নতুন উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছেন তা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
উল্লেখ্য যে, অন্টারিওতে এরকম বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা একেবারে নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই সরকারী বৃদ্ধাশ্রমের পাশাপাশি কিছু কিছু এথনিক বৃদ্ধাশ্রমও গড়ে উঠেছে অন্টারিওতে। যেমন মূলধারার সরকারী বৃদ্ধাশ্রমের পাশাপাশি চীনারা তৈরী করেছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বৃদ্ধাশ্রম, ইটালিয়ানরাও তৈরী করেছে। তৈরী করেছে আরো কিছু এথনিক সম্প্রাদয় তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বৃদ্ধাশ্রম। এই সব বৃদ্ধাশ্রমে সরকারী বৃদ্ধাশ্রমের মতই সব ব্যবস্থা থাকে। যেমন, প্রত্যেকের জন্য নিজ নিজ ঘর, চব্বিশ ঘন্টা নার্স সেবা, বিনোদনের ব্যবস্থা। আর সবচেয়ে বড় যে সুবিধা এই সব এথনিক বৃদ্ধাশ্রমের তা হলো, এখানে বৃদ্ধদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অনেক ভাল থাকে মেইনস্ট্রিমের বৃদ্ধাশ্রমের তুলনায়! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? মোটেও তা নয়। গবেষণায় দেখা গেছে এই এথনিক বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন তারা নিজেদেরকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মনে করেন না, শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন, বিষন্নতা বা মনমরা ভাব তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এবং সর্বপোরি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হারও কম এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মধ্যে। কানাডার ওয়েলেসলি ইনস্টিটিউট সম্প্রতি এই তথ্য প্রকাশ করেছে। মন্ত্রী দীপিকা ডামেরলা’র কথায়ও আমরা সেই রকম আভাষই পাই।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে ভর্তি হওয়ার পর বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে বিষন্নতার হার ২৫.১%। অন্যদিকে এথনিক বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে এই বিষন্নতার হার মাত্র ৩.৩৫%! গ্রেটার টরন্টোর ই হং নামের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে এরকম চিত্রই দেখা গেছে। ই হং এর চারটি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে জিটিএ’তে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ এই সকল বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে যারা থাকেন তারা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যেই থাকেন। তাদের চারপাশে সবাই তাদের নিজেদের সংস্কৃতিরই লোক। তারা স্টাফদের সঙ্গেও নিজের ভাষায় কথা বলতে পারেন। ফলে যোগাযোগটা হয় ষোলআনা। কোথাও কোন ফাক থাকে না। এখানকার অধিবাসীদের অভিমত হলো, “আমরা এখানে একটি পরিবারের মতই বাস করি”। কিন্তু মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে এথনিক বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাগণ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। নিজেরদেরকে তারা বিচ্ছিন্ন মনে করেন যার যুক্তিসংগত কারণও রয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়ার সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক কারেন কোবাইশীর মত হলো, “যখন কেউ নতুন একটি পরিবেশে যান এবং সেই পরিবেশের ভাষার সঙ্গে তার কোন ঘনিষ্ঠতা বা নৈকট্য থাকে না তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থের অবনতি ঘটে। মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমে এথনিক বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই এথনিক বৃদ্ধাশ্রমগুলোর সংখ্যা অন্টারিওতে খুবই কম। এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে জায়গা পেতে হলে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়। ওয়েটিং লিস্টে নাম পড়ে থাকে বছরের পর বছর। অন্টারিওতে মূলধারার কোন বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয় তিন থেকে চার মাস। আর চাইনিজ কমিউনিটির ই হং এ জায়গা পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয় গড়ে পাঁচ বছর! ই হং বৃদ্ধাশ্রমের স্কারবরো-ম্যাকনিকল শাখায় জায়গা পাওয়ার জন্য কেউ কেউ অপেক্ষা করছেন দশ বছর ধরে! জিটিএ-তে তাদের শাখা রয়েছে মাত্র চারটি। আর বাঙ্গালীদের? সংখ্যার কথা বাদই দিলাম, নিজেদের জন্য আলাদা একটি বৃদ্ধাশ্রমের চিন্তা তাদের মাথায়ও নেই। এ প্রসঙ্গে প্রয়াত অধ্যাপক ড. মীজান রহমানের একটি লেখা থেকে কয়েকটি লাইন উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছিলেন, “আজকাল কানাডা-আমেরিকার অনেক জায়গাতেই মুসলমানদের জমি কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। বসতবাড়ির জমি নয়, কবরস্থানের জমি। নিজের জন্য, স্ত্রীর জন্য, অনেকে যারা বাবা-মাকে নিয়ে এসেছে এখানে, তাদের জন্য। শুনেছি কবরের দালালি করে কেউ কেউ নিজের কবর কেনার পয়সাও বানিয়ে ফেলেছে। ভাল কথা, চোখ বুঁজার পর যে কংকালটা থাকবে তার একটা স্থায়ী ঠিকানা হল। কিন্তু তার আগেও তো মানুষের একটা ঠিকানার প্রয়োজন। যত অস্থায়ীই হোক ওই ঠিকানাটা না হলে মানুষ সম্মানের সাথে কবরেও যেতে পারবে না।”
এখন প্রশ্ন হলো, বাঙ্গালীদের জন্য এই কানাডায় আলাদা বৃদ্ধাশ্রম বানাবে কে? চীনারা তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে নিজেদের মত করে বৃদ্ধাশ্রম বানিয়েছে। অন্যান্য কয়েকটি এথনিক সম্প্রদায়ের লোকেরাও বৃদ্ধাশ্রম বানিয়েছে দু-চারটি করে। বাঙ্গালীদের পক্ষে কি সম্ভব ঐ রকম কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলা?
এখানে সম্ভব বা অসম্ভবের বিষয়টি নির্ভর করছে বাঙ্গালীদের সদিচ্ছার উপর। স্বার্থের বিষয়ও আছে। স্বার্থ না থাকলে কেন তারা এরকম একটি উদ্যোগ নিতে যাবে? আর স্বার্থের বিষয়টি আসবে তখনই যখন নিজের প্রয়োজন দেখা দিবে। কিন্তু সেই প্রয়োজনের ‘মূহুর্ত’ আমাদের প্রথম প্রজন্মের বাঙ্গালীদের সামনে এখনো তেমনভাবে আসেনি। তবে খুব শীঘ্রই আসবে। আগামী ৫ থেকে ১০ বা ১৫ বছরের মধ্যেই অনেক বাঙ্গালী আশির কোঠায় পৌঁছে যাবেন। তখন আমরা যদি নিজেদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশবান্ধব কোন বৃদ্ধাশ্রম না পাই তা হলে উপায় কি হবে?
তার আগে আসুন দেখে নেই মেইনস্ট্রিম বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে থাকতে হলে কি পরিমাণ ব্যয়ভার আমাদেরকে বহন করতে হবে। কানাডা মর্টগেজ এ্যান্ড হাউজিং করপোরেশন এর হিসাব মতে অন্টারিতে বৃদ্ধদের জন্য বাড়ি ভাড়া করতে গেলে মাসে গড়ে ২,৮১৫ ডলার দিতে হয়। ঘাবড়াবেন না। এই পরিমান অর্থের সঙ্গে ঘর ছাড়াও আরো যা যা পাবেন তা হলো, তিন বেলার খাবার, ইউটিলিটিজ, অনসাইট মেডিকেল সার্ভিস, রেজিস্টার্ড নার্সসহ আরো কিছু সার্ভিস এবং সুযোগ-সুবিধা। এই হিসাবটি ২০১৫ সালের।
কিন্তু সত্যিই কি ঘাবড়ানোর মত ফিগার নয় ২,৮১৫ ডলার? এত অর্থ কোথায় পাব আমরা বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে? জোয়ানকালেই তো অধিকাংশ বাঙ্গালীর আয় এর চেয়ে কম থাকে।
২,৮১৫ ডলার অবশ্য একটি গড় হিসাব। বৃদ্ধাশ্রমের অবস্থাভেদে ডলারের পরিমাণও বাড়ে কমে। অন্টারিওতে আমরা দেখতে পাই বৃদ্ধাশ্রমগুলোর রকমফেরও আছে। এর মধ্যে প্রধান তিনটি হলো- রিটায়রমেন্ট হোম, লং-টার্ম কেয়ার হোম (নার্সিং হোম), সাপোর্টিভ হাউজিং। এর বাইরে আরো আছে সিনিয়র এপার্টমেন্ট।
রিটায়ারমেন্ট হোম : রিটায়ারমেন্ট হোমগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়ে থাকে। এগুলোতে বৃদ্ধদের জন্য ভাড়ায় রুম পাওয়া যায়। রিটায়ারমেন্ট হোমগুলোতে রুম ছাড়াও বাড়তি আরো কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন খাবার এবং ওষুধ ব্যবস্থাপনা। এছাড়াও রয়েছে গোসলে সহায়তা প্রদান, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধিতে সহায়তা, পোষাক পরিধানে সহায়তা, হাটাচলায় সহায়তা প্রদান, ডাক্তার নার্স বা ফার্মাসিস্ট সেবা পেতে সাহায্য করা ইত্যাদি। এখানে সাধারণ বাসিন্দাগণ স্বাধীনভাবে বাস করতে পারেন যৎসামান্য বা মাঝারি পর্যায়ের সহায়তা নিয়ে। আর এই রিটায়ারমেন্ট হোমগুলোতে সকল ব্যয়ভার বহন করতে হয় বাসিন্দাদের নিজেদেরকেই। সরকার বা অন্যকোন সাহায্য সংস্থার কাছ থেকে কোন সাবসিডি বা অনুদান পাওয়া যায় না।
অন্টারিওতে রিটায়ারমেন্ট হোমের জন্য মাসিক খরচ হয় প্রাইভেট স্টুডিও রুমের জন্য ২,৭৪৪ ডলার, এক বেডরুমের জন্য ৩,৭৬৪ ডলার, দুই বেডরুমের জন্য ৪,৫৩৬ ডলার। (সোর্স : সিনিয়রসজেন.কম)
যাদের বয়স ৬৫ বা তদুর্ধ কেবল তারাই এই রিটায়ারমেন্ট হোমের বাসন্দিা হওয়ার যোগ্য।
লং-টার্ম কেয়ার হোম (নার্সিং হোম) : লং-টার্ম কেয়ার বা নার্সিং হোমগুলো রিটায়ারমেন্টে হোম থেকে আরো বেশী সুবিধাযুক্ত। এখানে বয়স্কদের জন্য থাকে সার্বক্ষনিক নার্সিং কেয়ার এর সুবিধা ও সুপারভিশন বা তত্ত্বানুসন্ধানের সুবিধা। অন্টারিওর নার্সিং হোমগুলো সরকারী লাইসেন্সপ্রাপ্ত এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বাসগৃহ হিসাবে অনুমোদিত। এই হোমগুলো ‘মিনিস্ট্রি অব হেলথ এ্যান্ড লং-টার্ম কেয়ার’ থেকে ফান্ড পেয়ে থাকে। তবে নার্সিং হোমের অধিবাসীদেকে তাদের বাসস্থানের জন্য ‘কো-পেমেন্ট’ প্রদান করতে হয় যা নির্ধারণ করে মিনিস্ট্রি অব হেলথ এ্যান্ড লং-টার্ম কেয়ার কর্তৃপক্ষ। এই কো-পেমেন্ট দিয়ে খাবার সরবরাহ, ঘরবাড়ি পরিস্কার রাখা, লন্ড্রি, বিল্ডিং এর মেইনটেনেন্স এবং প্রশাসন পরিচালনা করা হয়।
নার্সিং হোমের জন্য অন্টারিওতে ডেইলী কো-পেমেন্ট রেট হলো
বেসিক লং স্টে : ৫৮.৯৯ ডলার।
সেমি-প্রাইভেট লং স্টে : ৬৭ থেকে ৭১ ডলার (নির্ভর করে বাড়ির স্ট্রকচারের উপর)।
প্রাইভেট লং স্টে : ৭৭ থেকে ৮৪ ডলার (নির্ভর করে বাড়ির স্ট্রকচারের উপর)।
সর্ট স্টে : ৩৮ ডলার।
(সোর্স – অন্টারিও লং টার্ম কেয়ার এসোসিয়েশন)
সাপোর্টিভ হাউজিং : সাপোর্টিভ হাউজিং তাদের জন্য যাদের স্বল্পমাত্রায় বা মধ্যমমাত্রায় পার্সোনাল কেয়ারের প্রয়োজন পড়ে এবং যারা স্বতন্ত্রভাবে এপার্টমেন্ট স্টাইলের জীবনযাত্রা পছন্দ করেন। এখানে গভার্নমেন্ট ফান্ডেড পার্সোনাল কেয়ার এর সুবিধা রয়েছে। অপশনাল সার্ভিসের মধ্যে আছে খাবার, লন্ড্রি, স্যোশ্যাল এক্টিভিটি ইত্যাদি। অন্টারিওতে সাপোর্টিভ লিভিং এর জন্য মাসিক খরচ ৩,২০৪ ডলার। (সূত্র : এ প্লেস ফর মাম)
বিভিন্ন টাইপের এই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে খরচের মাত্রা ভিন্ন। আবার একই টাইপের বৃদ্ধাশ্রমেও খরচের মাত্রা একেটিতে একেক রকম। এটি মূলত নির্ভর করে কোনটিতে কি পরিমাণ সুযোগ সুবিধা রয়েছে এগুলোর উপর। খরচের মাত্রা আপতদৃষ্টিতে অনেক বেশী মনে হলেও মনে রাখতে হবে যে এই খরচ শুধু ভাড়া বাবদ নয়, এর সঙ্গে আছে খাবার এবং ওষুধ ব্যবস্থাপনা। এছাড়াও রয়েছে গোসলে সহায়তা প্রদান, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধিতে সহায়তা, পোষাক পরিধানে সহায়তা, হাটাচলায় সহায়তা প্রদান, ডাক্তার নার্স বা ফার্মাসিস্ট সেবা পেতে সাহায্য করা ইত্যাদি।
আর এই সকল বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে খরচের যে মাত্রা তা পরিশোধ করা অতটা কঠিন
নয় যতটা খরচের ফিগার দেখে মনে হয়। নিজ বাড়িতে থাকলেও কিন্তু বৃদ্ধদের জন্য খরচের বেশ কিছু খাত রয়েছে। প্রপার্টি টেক্স থেকে শুরু করে বাড়ি সংস্কারের কাজ, হাইড্রো, খাবারসহ আরো কিছু হিডেন কস্ট রয়েছে যা সচরাচর চোখে পড়ে না। বাড়িতে একজন বৃদ্ধ মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তাকে টেক কেয়ার করার জন্য পরিবারের উপার্জনক্ষম কাউকে না কাউকে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিতে হয়। এই ছুটি কয়েকদিন থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে। নির্ভর করে অসুস্থতার মাত্রার উপর। আর যদি অসুস্থতা হয় ক্রনিক তবে ছুটির বিষয়টি হয় আরো দীর্ঘ। আর এই ছুটির সময়টি হয় বিনা বেতনের। সুতরাং এগুলো যদি হিসাবে ধরা হয় তবে বৃদ্ধাশ্রমের খরচ তখন আর অযৌক্তিক মনে নাও হতে পারে।
অন্যদিকে বৃদ্ধাশ্রমের খরচ যোগানোর জন্য বৃদ্ধদের জন্য যে সকল বেনিফিটের ব্যবস্থা রয়েছে যেমন ওল্ড এজ সিকিউরিটি এবং কানাডা পেনশন প্লান এগুলোও হিসাবে ধরতে হবে। এছাড়াও আরো কিছু আয়ের পথ রয়েছে যা নির্ভর করে বৃদ্ধ ব্যক্তিটির ব্যক্তিগত অবস্থার উপর। তার সঞ্চয় কি পরিমাণ আছে, ওয়ার্ক প্লেস পেনশন, কোথাও কোন ইনভেস্টমেন্ট করা আছে কি না, বাড়ি থাকলে সেই বাড়ি থেকে কোন ভাড়া পান কি না ইত্যাদি। তাছাড়াও ফ্যামিলি মেম্বারদের কেউ কেউ এই বৃদ্ধাশ্রমের খরচের অংশবিশেষ পরিশোধ করতে পারেন। বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা ব্যক্তির কোন উত্তরাধিকারী না থাকলে কিংবা উত্তরাধিকারীরা অর্থনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত তার বাড়ি বিক্রি করে যে মোটা অংকের অর্থ পাবেন সেই অর্থ কোথাও বিনিয়োগ করলে সেখান থেকেও ভাল একটা আয় আসতে পারে যা দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের খরচের অংশবিশেষ মেটানো যেতে পারে।
এখানে একটি সাধারণ দৃশ্যকল্প বর্ণনা করা যেতে পারে। একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা অথবা উভয়ে মিলে ওল্ড এজ সিকিউরিটি এবং কানাডিয়ান পেনশন প্লান থেতে মাসে আনুমানিক ২ হাজার ডলার পেতে পারেন। কোম্পানী পেনশন হতে পারে মাসে আনুমানিক ৮৫০ ডলার। আরআরএসপি এবং অন্যান বিনিয়োগ থেকে আসতে পারে আরো ৫ শত ডলারের মত। এগুলোর যোগফল দাড়ায় ৩,৩৫০ ডলার। বাড়ি বিক্রি থেকেও আসতে পারে একটা মোটা অংকের অর্থ। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী একটি বাড়ি বিক্রি করে আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়েও হাতে থাকতে পারে প্রায় ৪ লক্ষ ডলার। এই অর্থ বিনিয়োগ করে ৩% ইন্টারেস্ট পেলেও মাসে গিয়ে দাড়াতে পারে প্রায় হাজার ডলার। উপরের ফিগারের সঙ্গে এটি যোগ করলে মাসিক আয় গিয়ে দাড়াতে পারে প্রায় ৪,৩৫০ ডলারে।
অবশ্য এই অংকটি নির্ভর করে একজন বৃদ্ধের অতীত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর। স্বল্প আয়ের কর্মজীবী হয়ে থাকলে, নিজ বাড়ি না থাকলে, অন্য কোন সঞ্চয় বা বিনিয়োগ না থাকলে বৃদ্ধ বয়সে আয়ের পরিমাণ এর অর্ধেক বা তারো কম হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বৃদ্ধাশ্রমের খরচ যোগানো কিছুটা কঠিনই হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য স্বল্প আয়ের বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের জন্য কিছু সরকারী সহায়তা হয়তো পাওয়া যেতে পারে। স্থানীয় চার্চ বা অন্যান্য চ্যারিটেবল অরগানাইজেশনের পক্ষ থেকেও ক্ষেত্র বিশেষ আর্থিক সহায়তা পাওয়া যেতে পারে।
সরকারী সহায়তার মধ্যে আছে বেসিক রুমের জন্য সাবসিডি’র ব্যবস্থা। এটি রেট রিডাকশন হিসাবে পরিচিত। তবে এই সহায়তা সেমি প্রাইভেট বা প্রাইভেট রুমের জন্য দেয়া হয় না।
কিন্তু এ সবেরই ব্যবস্থা হয়তো হয়ে যাবে বাঙ্গালী বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের জন্য। শুধু হবে না নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিবান্ধব কোন বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থা। আগেই উল্লেখ করেছি, ইংরেজীতে প্রথম প্রজন্মের অনেক বাঙ্গালীর দখল একেবারেই বেসিক বা তারো কম। অন্যদিকে আছে সাংস্কৃতিক ব্যবধানের সমস্যা। আছে খাদ্য সংস্কৃতির ব্যবধান, ধর্ম বিশ্বাসের ব্যবধান। এই সমস্ত ব্যবধান কতটা সমস্যা তৈরী করে তা কেবল ভুক্তভুগিরাই বলতে পারবেন।
অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন এই বলে যে কেন? বৃদ্ধ বয়সে আমরা যখন পরনির্ভর হয়ে পড়বো তখন আমাদের ছেলে-মেয়েরাই তো আমাদেরকে দেখাশুনা করবে। আমরা তাদের দেখাশুনা করেছি না? ছোট থেকে কে তাদেরকে বড় করে তুলেছে এই প্রবাসে?
এরকম প্রশ্ন করাটা একেবারেই স্বাভাবিক। কিন্তু একই সাথে পুরোপুরি আবেগী প্রশ্নও এটি। মনে রাখতে হবে, জীবনের বাস্তবতা হলো, এর সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনীতি দ্বারা। আজকে যারা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা, তারাও একসময় প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলেন অর্থনৈতিক কারণে অর্থাৎ রুটি-রুজীর কারণে। মানুষের এই ব্যস্ততা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে বংশপরস্পরায়। আগামীতেও এই ধারা চলতে থাকবে। সুতরাং ইচ্ছা থাকলেও এই প্রবাসে আমাদের সন্তানেরা সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের টেক কেয়ার করতে পারবে না। তাই এ বিষয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা ভাল।
বাংলাদেশের সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করলে হয়তো অনেকের কাছে বৃদ্ধাশ্রমের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কারণ বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের কনসেপ্টটি একেবারেই নতুন এবং এটি এখনো সামাজিকভাবে গ্রহণীয় হয়ে উঠেনি। বৃদ্ধ বাবা মা’কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোকে প্রায় সকলেই খারাপ চোখে দেখেন। বাবা-মা’র প্রতি এটি একধরণের অবজ্ঞা ও অবহেলা এবং অবিচার বলেই মনে করেন প্রায় সকলে। বৃদ্ধাশ্রম অবহেলিত বৃদ্ধদের জন্য শেষ আশ্রয় এমনটিই ধারণা সকলের।
কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবং জীবনের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে হলে এই বৃদ্ধাশ্রমের ধারণাকেও মেনে নিতে হবে। যতদিন নিজগৃহে থাকা যায় সে চেষ্টা যেমন করতে হবে, পাশাপাশি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন চলাফেরার শক্তি কমে আসবে, প্রতি পদে পদে যখন কারো না কারো সাহায্য লাগবে তখন বৃদ্ধাশ্রমের কথা চিন্তা করাই শ্রেয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যে সকল বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার বয়স ৮০ পেরিয়ে যায় তাদেরকে সর্বক্ষণই নজরে রাখতে হয়। সময়মত খাওয়ানো, ওষুধ সেবন করানো, বাথরুম করানো, নিয়মিত সুগার চেক করা, প্রেসার চেকসহ আরো অনেক কিছুই করতে হয় এই বয়সের লোকদের জন্য। এবং এর জন্য চাই সার্বক্ষনিক সেবক। আর এই সার্বক্ষণিক সেবা দিতে পারে একমাত্র বৃদ্ধাশ্রমই। আর কানাডায় বাঙ্গালীদের জন্য সেই বৃদ্ধাশ্রম যদি হয় ভাষাবান্ধব, সংস্কৃতিবান্ধব, ধর্মবান্ধব তবে সেটা তো হবে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের জন্য খুবই সুুবিধাজনক ও উপযুক্ত স্থান। সেখানে সমবয়সীদের সঙ্গে সময় কাটবে ভাল।
ভাষাবান্ধব ও সংস্কৃতিবান্ধব বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধরা কেমন থাকেন তার একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। চীনাদের একটি বৃদ্ধাশ্রম ‘ই হং’ এর এক বৃদ্ধ বাসিন্দার নাম সু টিন হো। তার বয়স ৮৭। বছর দুই আগে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। দিন দশেক থাকতে হয়েছিল তাকে সেখানে। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে তাকে ই হং বৃদ্ধাশ্রমে স্থানান্তর করা হয়। তার স্বামীও ছিলেন ঐ বৃদ্ধাশ্রমে আগে থেকেই। এখানে আসার পর তিনি ফিরে পেলেন তার নিজ ভূবন। চারপাশেই তিনি খুঁজে পেলেন তার নিজ ভাষার লোকজন, নিজ সংস্কৃতির লোকজন। এখানে তিনি এতটাই আনন্দ উপভোগ করতে শুরু করেন যে একপর্যায়ে তিনি বলেই ফেলেন, “আমি আমার বাড়িতে আমার সন্তানদের সঙ্গে বাস করতে চাই না। একঘেয়েমী জীবন সেখানে। বরং এই বৃদ্ধাশ্রমে আমি অনেক ভাল আছি।”(সূত্র : গ্লোব এন্ড মেইল।)
অন্টারিওর মিনিস্ট্রি অব সিনিয়র এ্যাফেয়ার্স অন্টারিওতে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সাংস্কৃতিকভাবে আরো অন্তর্ভুক্ত এবং সহায়ক স্থান গড়ার একটি পরিকল্পনা নিয়ে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে মত বিনিময় করতে চেয়েছে। অন্টারিওতে বিভিন্ন এথনিক ও কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ডের বয়স্কদের জন্য বিভিন্ন সেবা প্রদানের কার্যক্রমকে কিভাবে আরো উন্নত করা যায় এবং বৃদ্ধাশ্রমগুলোকে কিভাবে আরো বৃদ্ধবান্ধব করা যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। সন্দেহ নেই, তাদের এই চিন্তাভাবনা খুবই সময়োপযোগী।
আগামী ২৭ জুন টরন্টোর বাংলাদেশী অধ্যুষিত ফার্মেসী এভিনিউ এবং সেন্ট ক্লেয়ার এলাকায় অবস্থিত ওয়েস্ট স্কারবরো কমিউনিটি সেন্টারে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। আগ্রহীরা এতে যোগ দিতে পারেন। ঠিকানা : ৩১৩ ফার্মেসী এভিনিউ, স্কারবরো। সময় : ৩:৩০ -৭:৩০। নাম রেজিষ্ট্রি ও আগাম প্রশ্ন পাঠানো জন্য DiversityRoundtable@ontario.ca এই ইমেইলে যোগাযোগ করা যেতে পারে। কন্টাক্ট পার্সন – Noah Farber : 416-325-3749
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ