কর্মক্ষেত্রে নিজ কমিউনিটির কাউকে নিয়োগ করতে চাওয়া কি বর্ণবাদী আচরণ?
সেপ্টেম্বর ২, ২০১৭
প্রদীপ রডরিগাস
বার্লিংটনে একটি হোমকেয়ার প্রভাইডার প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ‘ করললর ’র ওয়েবসাইটে একটি ‘আবশ্যক’ বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। ঐ বিজ্ঞাপনে একজন রেজিস্টার্ড নার্স চাওয়া হয়। বিভিন্ন শর্তের মধ্যে একটি শর্ত ছিল, ঐ নার্সকে হতে হবে শ্বেতাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গীনি। গোল বাধে ঐ গাত্রবর্ণ উল্ল্লেখ করাতেই। বসঢ়ষড়ুসবহঃ ল’ইয়ারদের কেউ কেউ বলেন, এটি শুধু বেআইনীই নয়, এক অর্থে অতীত যুগে ফিরে যাওয়াও।
বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠে। একপর্যায়ে হোমকেয়ার প্রভাইডার কর্তৃপক্ষ বাধ্য হন অনলাইন থেকে বিজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করে নিতে এবং দুঃখ প্রকাশ করতে। কারণ, পশ্চিমা এই মাল্টিকালচারাল সোসাইটিতে শ্বেতাঙ্গ বা খ্রিষ্টান সম্প্রদায় নিজেদের গাত্রবর্ণ বা ধর্মের লোক নিয়োগ করার জন্য এভাবে প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন প্রচার করলে অন্যান্য গাত্রবর্ণের বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা মর্মাহত হতে পারেন এবং তাদের কাছে এটি অপরাধমূলক এবং অবমাননাকর মনে হতে পারে।
কানাডার ‘চার্টার অব রাইটস’ এর নীতি অনুযায়ী সব সম্প্রদায়ের যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের সমান অধিকার রয়েছে কোথাও চাকরী পাওয়ার ক্ষেত্রে।
কিন্তু কানাডায় অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন এই একই কাজটি করেন তখন কি বিষয়টি নিয়ে এরকম হৈ-চৈ হয়? চাইনীজ বা সাউথ এশিয়ান সম্প্রদায় যখন নিজেদের ভাষাভাষী লোককে চাকুরীতে নিয়োগ দেন তখন এ নিয়ে কাউকে কথা বলতে দেখা যায় না। টরন্টো বা অন্য যে কোন শহরে এথনিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গেলে দেখা যাবে অধিকাংশ কর্মীই মালিক যে ভাষায় কথা বলেন কর্মীরাও সেই ভাষায় কথা বলেন। চাইনীজ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে শতকরা প্রায় একশ জনই চাইনীজ সম্প্রদায়ের লোক।
আমার ধারণা, বার্লিংটনের ঐ হোমকেয়ার প্রভাইডার প্রতিষ্ঠানটি এরকম একটি শর্ত দিয়ে বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করে এই কারণে যে, তাদের ক্লায়েন্টরা প্রায় সবাই শ্বেতাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গিনী। তারা জন্ম নিয়েছেন এবং বড় হয়েছেন ঐ শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতির মধ্যেই। কানাডায় এখন যারা সিনিয়র সিটিজেন তাদের বেশীরভাগই শ্বেতাঙ্গ। তারা স্বাভাবিকভাবেই এমন লোক চাবেন যারা তাদের ভাষায় কথা বলেন, বিশেষ করে তাদের একসেন্ট বা উচ্চারণভঙ্গিতে কথা বলেন যাতে করে ভাবের আদানপ্রদানটা যথাযথভাবে হয়। অর্থাৎ নার্সদের কথা যাতে তারা সঠিকভাবে বুঝতে পারেন। আমার আরো ধারণা, এই সিনিয়র সিটিজেনরা প্রায় সবাই অবস্থাপন্ন এবং এরা এমন নার্সই চাবেন যারা তাদের সংস্কৃতিকেও ভালকরে বুঝেন এবং জানেন।
সব সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে তাদের নিজ সংস্কৃতির লোকদের অগ্রাধিকার দেয়ার প্রবণতা থাকে
নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি সবসময় বর্ণবাদী আচরণ নাও হতে পারে, এটি তারচেয়ে একটু বেশী জটিল বিষয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, স্কারবরোতে একটি নার্সিং হোমের একটি ফ্লোর শুধুমাত্র তামিল সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। মার্কহামের ণবব ঐড়হম নার্সিং হোমে সাউথ এশিয়ান শাখা রয়েছে। টরন্টোর নর্থে ভন সিটিতে ইটালিয়ান বংশোদ্ভূত সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য রয়েছে ভিলা কলম্বো নামের একটি নার্সিং হোম। মিসিসাগায় অবস্থিত ণবব ঐড়হম নার্সিং হোম সম্পূর্ণভাবেই চাইনীজ বংশোদ্ভূত সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য খোলা হয়েছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এই নার্সিং হোমগুলোতে যারা নার্সিং এর কাজ করেন তারা প্রায় সকলেই সেবাগ্রহণকারী সিনিয়র সিটিজেনদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির লোক।
এথনিক সিনিয়র সিটিজেনদেরকে সেবা প্রদান করার জন্য খোলা এই স্বতন্ত্র নার্সিং হোমগুলোতে রিলেটেড এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের নার্সদেরকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে সুবিবেচক ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ কানাডিয়ান নাগরিক বা বসঢ়ষড়ুসবহঃ ল’ইয়ারগণ ক্রোধ প্রকাশ করছেন না বা ভ্রুকুটিও করছেন না। কারণ তারা জানেন, এথনিক এই সিনিয়র সিটিজেনদের বেশীরভাগই হয়তো ইংরেজী জানেন না বা ভাল বুঝেন না। সেই ক্ষেত্রে এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের এই নার্স বা পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কারগণ যারা ঐ সিনিয়র সিটিজেনদের ভাষা বুঝেন তাদের সংস্কৃতি বুঝেন তাদের পক্ষে ভাল সার্ভিস দেয়া সম্ভব। এটি অন্য এথনিক গ্র“পের সদস্যদের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়।
বর্তমানে প্রায় ডজনখানেক এথনিক নার্সিং হোম রয়েছে সম্ভবত কানাডাজুরে। দিনে দিনে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। টরন্টোর থর্নহিলের মুসলিম জাফারী সেন্টার কর্তৃপক্ষের একটি পরিকল্পনা রয়েছে ১৭ তলাবিশিষ্ট একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার যেখানে একশটির মতো এসিস্টেট লিভিং ইউনিট থাকবে। এটি খুব সহজেই অনুমেয় যে ঐ বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা সকলেই মুসলিম হবেন। আর আমি আশ্চর্য হবো ঐ বৃদ্ধাশ্রমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীরা নির্দিষ্ট একটি এথনিক ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক না হয়ে যদি বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক হন। আর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যদি বলা হয় প্রার্থীদেরকে ফারসী বা উর্দু ভাষায় দক্ষ হতে হবে তবু কর্তৃপক্ষ পক্ষপাতিত্বের দোষে অভিযুক্ত হবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।
সিনিয়র সিটিজেনদের কাছে তাদেরই অগ্রাধিকার বেশী যারা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বুঝেন ভাল
একবার এক পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কারের সঙ্গে আমার আলাপের সুযোগ হয়েছিল যার ব্যাকগ্রাউন্ড এথনিক কালচারের। এই ভদ্রমহিলাকে কোম্পানীর পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছিল এক শ্বেতাঙ্গ সিনিয়র সিটিজেন এর বাড়িতে তার দেখাশুনা করার জন্য। শ্বেতাঙ্গ ঐ সিনিয়র সিটিজেন ভদ্রলোকটি বাড়িতে সবসময় অপরা মিউজিক শুনতেন এবং ভালবাসতেন হলিউড ক্লাসিকস ও বই নিয়ে আলাপ করতে। ঘটনাক্রমে ঐ ভদ্রমহিলাও পাশ্চাত্য সাহিত্য সংস্কৃতি ও ক্লাসিক মিউজিকের সঙ্গে ভালভাবে পরিচিত ছিলেন। ফলে তিনি ঐ বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোকটিকে ভাল সঙ্গ দিতে পেরেছিলেন। আগে একাধিক পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কারকে পাঠানো হয়েছিল এই বাড়িতে। কেউই বেশীদিন টিকতে পারেননি। কারণ তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল এথনিক এবং তাদের কেউই ঐ ভদ্রলোকের সংস্কৃতি বুঝতেন না।
বৃদ্ধাশ্রমে হোক বা নিজ বাড়িতেই হোক এই সিনিয়র সিটিজেন বা বৃদ্ধ মানুষদের একেকজনের একেক রকম স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকে। তবে সকলেরই একটি ক্ষেত্রে মিল থাকে। আর সেই মিলটি হলো, একাকিত্ব। যারা নিজ বাড়িতেই থাকেন তাদের কথা বলার লোক থাকে না। বাড়িতে পরিবারের কেউ থাকলেও সময় দিতে পারে না। তখন ঐ পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কারগণই তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেন কথা বলার বা ভাব প্রকাশের। নিজের সুখ-দুঃখের কিছু কথা কিছু স্মৃতি এই পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কারদের সঙ্গেই হয়তো শেয়ার করেন বা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এই পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কার যদি ঐ সিনিয়র সিটিজেনের ভাষা না বুঝেন, তার সংস্কৃতি না বুঝেন তা হলে তার কাছে কি করে নিজের সুখ-দুঃখের কথা প্রকাশ করবেন তিনি? কি করে একটু সান্ত্বনা খুুঁজবেন এই জীবনের এই অন্তিম সময়গুলোতে? এই পরিস্থিতিতে তিনি যদি একজন স্বগোত্রীয় ও স্ব-সংস্কৃতির একজন কর্মীকে খুঁজেন তবে কি তিনি বর্ণবাদী হিসেবে আখ্যায়িত হবেন? হয়তো হবেন যেমন আমরা অন্যসবাই হবো। কিন্তু তিনি কি সত্যি কোন ভুল করবেন যদি জীবনের অন্তিম সময়গুলো একটু ভালভাবে থাকার জন্য, মনের ভাললাগা না লাগার বিষয়গুলো নিজ ভাষায় কারো সঙ্গে একটু শেয়ার করার জন্য একজন নিজ সংস্কৃতির লোককে কাছে চান? আমার মনে হয় না তিনি কোন ভুল করবেন।
-সূত্র : ক্যানইন্ডিয়া