তাসের আড্ডা – ৬
মে ১৪, ২০১৭
শুজা রশীদ
এই শনিবার সন্ধ্যায় আবার সাইদের বাসায় তাসের আড্ডা বসল। রুমা আজকে উপরে নিজের ঘরে শুয়ে ছিল। মাথাটা ধরেছে তার। আজকে এই হৈ হট্টগোল না হলেই ভালো হত কিন্তু সাইদকে বলে কোন লাভ নেই। সে কাচুমাচু করে বলবে, “পোলাপাইনগুলা একটু তাস খেলতে পছন্দ করে। মানা করতে কষ্ট লাগে, না হয় তুমিই ফোন করে বলে দাও।”
এই জাতীয় কথা শুনলেই রুমার মেজাজ খারাপ হয়। পোলাপাইন কারা? বুড়ার দল। কাম কাজ নাই। তাস খেলে আর গলা ফাটিয়ে পরচর্চা করে। রাজনীতি নিয়ে কথা বলে রাজ্যের তাবৎ রাজা উজিরের পিন্ডী চটকানো আর পরচর্চা করার মধ্যে কি এমন পার্থক্য আছে? দোষ শুধু মেয়েদের।
সাইদ সবাইকে পই পই করে বলে দিয়েছে, গলা নামিয়ে কথা বলতে হবে। শব্দ টব্দ যত কম করা যায় ততই ভালো। রনি, জালাল এবং কবীর আসতে খেলা শুরু হল। কিন্তু প্রথম দান খেলার পরই সমস্যা দেখা দিল। নাম্বার লেখার কাগজ পাওয়া গেল কিন্তু কলম নাই। সারা ঘর খুঁজেও যখন লেখার কিছু পাওয়া গেল না তখন কবীরকেই পাঠানো হল উপরে গিয়ে কলম, পেন্সিল যা হোক কিছু একটা নিয়ে আসতে। কবীর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বেসমেন্ট থেকে একতলায় উঠে এল। খুব সাবধানে ড্রয়ার খুলে কলমের খোঁজ করছিল। রুমার কান খুব তীক্ষ্ণ। সে উপর থেকে গলা উঁচিয়ে বলল, “কে আমার ড্রয়ার টানাটানি করছে?”
কবীর থমকে দাঁড়িয়ে গেল। “রুমা ভাবী, একটা কলম লাগত।”
রুমা নীচে নেমে এল। “তাস খেলতে আসো এতগুলা মানুষ, একটা কলম আনতে পারো না? এমনি এমনি কলম পাবে না। আমার একটু কাজ করে দিতে হবে।”
মনে মনে প্রমাদ গুনল কবীর। এ কি বিপদে পড়া গেল? রুমা বেসমেন্ট থেকে বাকীদেরকে ডেকে উপরে নিয়ে এলো। তার লিভিংরুমের সোফাগুলো সরিয়ে নতুন করে সাজাতে হবে। সাইদের কোমরে ব্যাথা। পনের বিশ মিনিট গেল রুমার কথামত আসবাবপত্র সরাতে। ইতিমধ্যে জিত এবং লাল ভাই এসে পড়েছে। ভারী জিনিষপত্র টানাটানি করতে দেখে জিত কোমরে হাত দিয়ে বসে পড়ল। “ভাবী, আমার কোমর ভাঙ্গা। ডাক্তার বলে দিয়েছে ভারী কোন কিছু না ওঠাতে।”
লাল ভাই অবশ্য খুশি মনে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল ভালোর চেয়ে খারাপ করতেই তার পটুতা বেশী। বার দুয়েক দেয়ালে সোফা দিয়ে খোঁচা দেবার পর রুমা তাকে অব্যহতি দিল।
কলম হাতে তারা যখন নীচে তাসের আড্ডায় ফিরে এলো ততক্ষণে হাঁফ ধরে গেছে সবার। রনি গলা নামিয়ে বলল, “সাইদ ভাই, এই প্ল্যানটা কি আপনার এবং ভাবীর দু’জনার? একেবারে ঘাম ছুটে গেল তো।”
সাইদ সারেন্ডার করল। “না রে ভাই, আমি এসবের কিছুই জানি না।”
খেলা শুরু হতে আবার কবীরের ডাক পড়ল। ঠান্ডা সরবত এলো। সবার মুখে হাসি ফুটল।
জালালের হাত আজকে খুব ফুরফুরে। ডাকাডাকি করবার জন্য তাকে আদৌ চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে না। হাত ছবিতে ভরপুর। সে ফটাফট দু খানা গেম দিয়ে বোনাস নিয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে লাগল। “পোলাপাইনের সাথে খেলার কোন অর্থ হয়?”
রনি বিরক্ত কন্ঠে বলল, “কাঁচা প্লেয়েররাই সবসময় ভালো কার্ড পায়।”
জালালের হাসি আরোও বিস্তৃত হল। “নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা।”
সাইদ হো হো করে হেসে উঠল। “তোমরা তো দেখি এবার ট্রাম্পের মত শুরু করলে। যেটা কাজ হয় সেটাই তার কৃতিত্ব, যেটা কাজ হয় না সেটা ওবামার দোষ। নাফটা নিয়ে কি খেলটাই না দেখাল।”
কবীর বলল, “এ তো জানা কথা বাবাজী আমাদের ঘাড়ের উপর এসে পড়বে। তার সমর্থকদেরকে দেখাতে হবে না সে তার কথামত কাজ করছে? তাতে ভালো হোক আর খারাপ হোক। নাফটা তো শুধু আমাদের জন্য না। ব্যাটা এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন এতে আমাদেরই শুধু উপকার হচ্ছে।”
জালাল বলল, “সাইদ ভাই, নাফটার ব্যাপারটা একটু খুলে বলেন তো। ঘটনাটা কি? ব্যাটা সেই প্রথম দিন থেকে নাফটা খারিজ করব বলতে বলতে মাথাটা খারাপ করে দিয়েছে।”
সাইদ বলল, “আরে, সব পার্টির যদি লাভ না হয় তাহলে তারা কি কখন কোন কন্ট্রাক্টে যায়? আমেরিকানরা কি গর্দভ? কানাডার সাথেই তাদের ব্যবসায়িক লেনদেনের কথা ধর না। প্রতিদিন প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা এর সাথে জড়িত। দু’ পক্ষেরই। আমরা হচ্ছি ওদের সব চেয়ে বড় ক্রেতা। কিন্তু ট্রাম্প এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন ট্রুডো ওর কাছে হাত পা ধরে নাফটা ঠেকিয়ে রেখেছে।”
রনি তাস শাফল করছে তো করছেই। তার হাতে এখন পর্যন্ত পাঁচ পয়েন্টের বেশী আসে নি। সে এবার বদ্ধ পরিকর কার্ডের মতিগতি তাকে পালটাতেই হবে। সে বলল, “তবে ট্রুডো আরেকটু শক্ত হতে পারে। এতো তেলানোর কি আছে ব্যাটাকে? নাফটা তুলে নিলে আমাদেরও যেমন ক্ষতি হবে ওদের সমান ক্ষতি হবে। কাজ তৈরী করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছে, তৈরির বদলে যদি মিলিয়ন খানেক কাজ হঠাৎ করে হাওয়া হয়ে যায়, তাহলে ওর প্রেসিডেন্সির কি অবস্থা হয় দেখা যাবে।”
জিত হাসতে হাসতে বলল, “ওর প্রেসিডেন্সির কি হবে বলতে পারি না কিন্তু আপনার হাতে আর বেশিক্ষন থাকলে ঐ তাসের অবস্থা যে কি হবে সেটা বলতে পারি।”
রনি শাফল করায় ক্ষান্ত দিল। সাইদকে দিয়ে তাস কাটিয়ে সে বাট করতে লাগল।
লাল ভাই বলল, “মেজাজ দেখিয়ে কাজ করে কি কারো কোন লাভ হয়? জাস্টিন বুঝে শুনে কাজ করছে। তাই না?”
রনি বলল, “করলেই ভালো। আমাদের কাঠের উপর তো ট্রাম্প ঠিকই ডিউটি বসিয়ে দিল – চব্বিশ পার্সেন্ট পর্যন্ত। কি করতে পেরেছে আপনাদের জাস্টিন? কিছুই না।”
সাইদ বলল, “কিন্তু সে আবার দুধের ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায় নি। দুধে কানাডিয়ান ডিউটি হচ্ছে ২৭০%। কয়েকটা ক্ষেত্রে কোন ডিউটি ছিল না, যেমন আল্ট্রা ফিল্টারড দুধ এবং প্রোটিন রিচ মিল্ক প্রডাক্ট। সেটারও পরিবর্তন হয়েছে বছর খানেক আগে। সেই কারনেই আমেরিকান দুধ ব্যবসায়ীরা খুব ক্ষ্যাপা আমাদের উপর। সবই লেনা দেনার ব্যাপার। একদিকে কিছু যাবে, আরেক দিকে কিছু আসবে। যদিও আমেরিকানরা এই কাঠ নিয়ে আগেও অনেক ঝামেলা করেছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশনে পর্যন্ত গেছে। তারা কানাডার পক্ষে রায় দিয়েছে। আমেরিকানদের কথা হচ্ছে আমাদের সরকার কানাডিয়ান লাম্বার কম্পানীগুলোকে ভর্তুকি দেয়, যে কারণে তারা কাঠের দাম কম রাখতে পারে। কানাডিয়ানরা সেটা স্বীকার করে না। এই নিয়ে ক’দিন পরপরই লেগে যায়।”
জালাল বলল, “তাহলে কানাডা এখন কি করতে পারে? শুনলাম ডিউটি বহাল থাকলে লাম্বার ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকের কাজ চলে যেতে পারে।”
জিত বলল, “কি আর করবে, আগে যা করেছে এখনও তাই করবে। চেষ্টা করবে আমেরিকানদের সাথে নতুন কোন চুক্তিতে যাওয়া যায় কিনা। ক্ষতি তো দুই পক্ষরেই। আমাদের এদিকে কাজ যাবে, আর ওদের ওদিকে মানুষ বেশী দাম দিয়ে কাঠ কিনবে। সাধারণ আমেরিকান ক্রেতাদের খুশী হবার কোন কারণ নেই।”
কার্ড বাটা শেষ হতে ঝটপট নিজের হাত তুলেই মুখ ব্যাজার করে ফেলল রনি। আজকে শালার কার্ডের হাত এতো খারাপ যাচ্ছে কেন কে জানে। তার কাছে মাত্র তিন পয়েন্ট। ওদিকে জালালের মাড়ির দাঁত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কবীর জালালের পাশে বসে ছিল। রনি তার হাতে কার্ড ধরিয়ে দিল। “তুমি খেল।”
কবীর কার্ড দেখে হাসতে লাগল। “আজকে কার মুখ দেখে উঠেছিলেন, রনি ভাই?”
রনি তিক্ত গলায় বল্ল, “কার আবার? আজ সকালে বিছানা থেকে টেনে তুলে হাতে ভ্যাকুম ক্লিনার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। সারা বাড়ি ভ্যাকুম করতে হল। কি যন্ত্রণা! জীবনে করেছি এইসব আমি? এখন এই মাঝ বয়েসে আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। দজ্জাল!”
রুমার মুখ দেখা গেল সিঁড়ির গোড়ায়। “রনি ভাই, আমি কিন্তু ঠিক আপনাদের উপরের তলাতেই আছি। কথা বার্তা সব শুনতে পাচ্ছি। তথ্য চালান হয়ে যাবে কিন্তু।”
রনি দাতে জিভ কাটল। দজ্জাল শব্দটা শুনলেই ক্ষেপে যায় বেলা। সে অবশ্য সেই কারণেই শব্দটা বেছে বেছে ব্যবহার করে। “রুমা ভাবী, কি শুনতে কি শুনছেন! বলছিলাম বড় দয়ার প্রাণ তার। চুপচাপ বসে থাকলে গায়ে মরিচা ধরে যাবে, তাই একটু কাজকর্ম দিয়ে আমাকে তরতাজা রাখে।”
রুমা খিল খিল করে হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
জালাল আবার খেলা নিয়েছে। সাইদ হাত পেতে দিল। এবারও যে আরেকটা গেম হবে তাতে তার কোন সন্দেহ নেই। লাল ভাই বল্ল, “ওদিকে নর্থ কোরিয়ার সাথে তো খুঁট খাট লেগে গেল। সত্যিই কি কিছু হবে মনে হয়?”
রনি মুখ বাঁকাল। “মুন্ডু হবে। চীনকে দিয়ে ওদের মাথা ঠান্ডা করানোর চেষ্টা করাটাই হচ্ছে আমেরিকার নর্থ কোরিয়া স্ট্রাটেজি। যুদ্ধে জড়ানোর তো প্রশ্নই নেই। নর্থ কোরিয়া হচ্ছে কিম জং আনের বাপের দেশ। সত্যিকার অর্থেই। সুতরাং সে যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। ব্যাটা যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারে। তাতে দেশের কত মানুষ মরল না জাহান্নামে গেল তাতে ওর কি?”
জালাল বলল, “কিন্তু ওদের কাছে কি এখনও তেমন শক্তিশালী মিসাইল আছে আমেরিকাকে আঘাত করবার মত?”
সাইদ বলল, “আরে, আমেরিকাকে আঘাত করতে হবে কেন? সাউথ কোরিয়া, জাপানকে আঘাত করলেই তো চলে। আমেরিকা তাদেরকে রাজনৈতিক এবং সামরিক সমর্থন দেয়। সেই কারনেই তো কিম জং আনের এতো জোর। সাউথ কোরিয়াকে আঘাত করবার মত যথেষ্ট ক্ষমতা তার আছে।”
লাল ভাই বলল, “কেউ যদি এই দেশটাকে কিছু না বলে তাহলে তারা তো যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। তারা যদি শক্তিশালী নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরী করতে পারে, তাহলে তো তুলকালাম কান্ড করে ফেলবে, তাই না?”
জিত বলল, “সেটাই তো সবার ভয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে চীনকে নিয়ে। তারা আবার নর্থ কোরিয়াকে ব্যবহার করে হাতের তরুপের তাস হিসাবে। চীন থেকে প্রচুর রফতানী হয় সেখানে, কিছু আমদানীও হয়। নর্থ কোরিয়াকে সরাসরি আর্থিক সাহায্যও দেয় চীন। সেই কারণেই চীনকে তারাও সমীহ করে চলে।”
কথা বার্তা বলতে গিয়ে বোধহয় মনযোগ হারিয়ে ফেলেছিল জালাল কারণ সে হিসাবে ভুল করে একটা ট্রিকের জন্য গেম করতে পারল না। তার মুখে আষাঢ়ের মেঘ নেমে এলো। “যাহ্! কি সাংঘাতিক ভুলটাই না করলাম।”
রনি গাল ভরে হাসল। “এই কারণেই তো আলাপটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আপনার মনযোগ নষ্ট করবার জন্য।”
উপর থেকে কবীরের ডাক এলো। ছুটল কবীর। একটু পরে সে এক প্লেট ভর্তি করে নানান ধরণের পিঠা নিয়ে হাজির হল। পিঠাগুলো দেখেই চিনতে পারল ওরা। আগের শনিবার কবিরের বাসায় নব বর্ষের পার্টি হয়েছিল। সেখানে সবাই নানান ধরণের পিঠা বানিয়ে এনেছিল। যা বেঁচে গিয়েছিল সেগুলো বাড়ি বাড়ি ভাগ করে দিয়েছিল কবীরের বউ। সেই পিঠা এখন রুমা তাদেরকে সাধছে।
রনি বিড়বিড়িয়ে বলল, “পিঠা কি ভালো আছে এখনও?”
সাইদ বলল, “ডিপ ফ্রিজে ছিল। আমরা তো কেউ মিষ্টি খাই না। আজকে তোমরা সবাই আসবে বলে কিছুক্ষন আগে বাইরে বের করে রেখেছিল।”
রুমার মুখ দেখা গেল আবার সিঁড়ির গোড়ায়। “রনি ভাই, পিঠা নষ্ট হয়ে গেছে। সেই জন্যই আপনাদেরকে দিলাম। তাস খেলতে খেলতে যাই খাবেন তাই তো অমৃতের মত লাগবে, তাই না?”
রনি লজ্জা পেয়ে ফিসফিসিয়ে বল্ল, “রুমা ভাবীর কান কি বায়োনিক নাকি?”
রুমা যেতে যেতে বলল, “ঐটাও শুনেছি। আপনাদের মত আইলসা পুরুষদের সাথে সংসার করতে করতে আমাদের সবার কানই বায়োনিক হয়ে গেছে।”
দেখা গেল লাল ভাই পিঠার সবচেয়ে ভড় ভক্ত। সে ফটাফট কয়েকটা পেটে চালান করে দিয়ে বলল, “বড় মজার পিঠা! আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি, এই যে জাস্টিনের গভর্নমেন্ট মারিজুয়ানা লিগাল করে দিল, এটা কি ঠিক হল? এখন দোকানে দোকানে পাওয়া যাবে, মানুষের ঘরে ঘরে গাজার চাষ হবে – ভাবতেই কেমন যেন গা ছম ছম করে আমার।”
জিত বলল, “ভাই, গা ছম ছম করার কি হল? এই সুযোগে নিজেও না হয় দু এক ফুঁ দিয়ে দিন। আর গাছপালা লাগানো তো ভালো, তা সে গাজার গাছ হোক আর কলা গাছই হোক।”
লাল ভাই বিশাল জিভ বের করে দাঁত দিয়ে কাটল। “বেগম সাহেবা একেবারে ঝাড়ু মেরে বের করবেন।”
জিত হাসতে হাসতে বলল, “বেগম সাহেবাকে বাদ দিয়ে করবেন কেন? ক’দিন বাদে এটা তো সরকারী কানুন হয়ে যাবে। বাড়ি বাড়ি গাঁজার চাষ করতে হবে।”
জালাল বলল, “আচ্ছা, ফাজলামী রাখেন। এখন বলেন তো, এই ব্যাপারটা কি ভালো হল? এটা লিগাল করে দিল। বুঝলাম আগে একটা দল এইসব বেঁচে দু হাতে কামাচ্ছিল। এটা যেহেতু ক্রাইম ছিল সেহেতু পুলিশও কারো কাছে অল্প পরিমান মারিজুয়ানা পেলেও তাকে নিয়ে সময় এবং অর্থ নষ্ট করছিল। কিন্তু এখন তো দোকানে দোকানে, ঘরে ঘরে পাওয়া যাবে। চারদিকে গাঁজার গন্ধে ভরে যাবে। জীবনে ওসব টানি নি। মাঝে মাঝে বিড়ি ফুকি। কিন্তু গাজাঁর যে পচা গন্ধ। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।”
লাল ভাই মুখ ব্যাজার করে বলল, “আমার নীচ তলায় যে ছেলেটাকে ভাড়া দিয়েছি সে সকাল বিকাল গাঁজা টানছে। বলেছি বাসার মধ্যে টানা যাবে না, তাই এখন বাসার সামনে রাস্তায় গিয়ে টানছে। সরকারী রাস্তা। কি বলব? সারা এলাকা এখন গন্ধে ভরে গেছে। কি বিপদ বলেন তো।”
সাইদ বলল, “আরে, শুধু নিজের কথাটাই ভাবেন? মেডিকেল মারিজুয়ানা কত মানুষের ব্যাথা বেদনা কমিয়ে দিয়েছে, জানেন? তা ছাড়া মদ আর গাজার মধ্যে কতটুকু ফারাক? মদ যদি আরামসে যত্র তত্র বিক্রী হতে পারে, তাহলে গঞ্জিকার কি অপরাধ?”
রনি খোঁচা দিয়ে বলল, “এতই যদি আপনার গঞ্জিকা প্রীতি, তাহলে রুমা ভাবীকে সঙ্গে নিয়ে দু টান দিয়ে দেখেন।”
কবীর চাঁপা গলায় বলল, “আস্তে বলেন। বায়োনিক কান। সাইদ ভাইয়ের দু’ এক ফোটা খাবার দোষ ছিল, মনে আছে নিশ্চয়। সেটা কিভাবে গেছে, ভেবে দেখুন। এখন আবার গাঁজার নাম করলে পানিপথের যুদ্ধ হয়ে যাবে।”
জালাল তাস বাটা শেষ করে বলল, “গাঁজার আলাপ বাদ দিয়ে এবার বলেন টরন্টোর বাড়ীর বাজার এই রকম তেতে গেল কেন? রাতারাতি বাড়ীর দাম প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায় কি করে? এর পেছনেও কি গঞ্জিকা সেবনের কোন অবদান আছে?”
রনি হাতের তাস দেখে পরিত্রানের নিঃশ্বাস ছাড়ল। শেষ পর্যন্ত কুফা কেটেছে। সে হাসিমুখে বলল, “সরকার যা নিয়ম কানুন করেছে তাতে কিছুটা মনে হয় কাজ হয়েছে। ভ্যাঙ্কুভারের বিদেশী ক্রেতাদের জন্য ১৫% ট্যাক্স যোগ করার পর সেখানে কিন্তু বিক্রী কমে গিয়েছিল। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, তখন ক্রেতারা টরন্টোর মার্কেটে এসে হানা দেয়। রাতারাতি একটা এলাকায় ২০% – ৩০% দাম বাড়তে পারে? ক্রেতার সংখ্যা হঠাৎ করে তো আকাশে লাফ দেয় না। স্থানীয় সরকার যদি আরো আগেই এখানেও নিয়ম কানুনে কড়াকড়ি করত তাহলে হয়ত এইরকম একটা বিতিকিচ্ছির অবস্থার সৃষ্টি হত না।”
জিত বলল, “রিয়েল স্টেটের লোকজন তো মানে না। তারা বলছে বিদেশী ক্রেতার সংখ্যা মাত্র ১০%। সেটাতো আগেই ছিল। এখন কত সেটাই হল প্রশ্ন। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যাটা পাওয়া কঠিন। অনেকেরই এখানে আত্মীয় স্বজন আছে। তারা নিজের আত্মীয় স্বজনের নামে কিনতে পারে, টাকা আসবে বাইরে থেকে। ঠেকানো কষ্ট।”
সাইদ বলল, “টাকা আসলে তো খারাপ না, কিন্তু বাড়ী যেহেতু ডিমান্ডের সাথে তাল মিলিয়ে তৈরী হচ্ছে না, সেহেতু দাম বাড়ানোটা ঠেকানো কষ্টকর হয়ে গেছে। শুধু ট্যাক্স বসালে চলবে না, মার্কেটে বাড়ীর আমদানীও বাড়াতে হবে। সরকার যা উদ্যোগ নিয়েছে খারাপ না। তবে যারা একাধিক বাড়ী কিনছে ব্যবসা করবার জন্য, তাদেরকে আরেকটু নিয়ন্ত্রন করা দরকার। ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্সও বাড়ানো দরকার। অনেকে এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ীতে লাফিয়ে গিয়ে ক’দিন থেকে সেই বাড়ী প্রাইমারী রেসিডেন্স বলে বিক্রী করে কোন ট্যাক্স দিচ্ছে না। এটা বন্ধ করলেই একাধিক বাড়ি কেনা অনেক কমে যাবে।”
রনি তাড়া দিল, “সাইদ ভাই, ডাকেন। এতক্ষনে আমার একটা ডাক দেবার মত কার্ড এসেছে।”
ডাকাডাকি হল। খেলা সাইদই নিল। রনি চার হার্টস পর্যন্ত গিয়েছিল কিন্তু চার স্পেডের কাছে হার মানতে হল। তার মন খুবই খারাপ হয়েছে। তার হাত যেবার একটু ভালো এসেছে, সেবার সাইদের হাতেও ভালো তাস এসে গেল! বদ নসিব কাকে বলে!
জালাল হাত পেতে দিয়ে চেয়ারে গ্যাঁট মেরে বসল। সাইদ পটাপট খেলছে।
জালাল বলল, “আচ্ছা, রনি ভাই, আপনাদের কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে কি হচ্ছে বলেন তো? কেভিন ও লিয়ারি দেখি ছুটে গেল। আমি তো ভেবেছিলাম সে-ই সবাইকে হটিয়ে দিয়ে গদিতে বসবে।”
রনি মুখ বাঁকাল। “ব্যাটার কথাবার্তার কোন ঠিক নাই। সবাই তাকে ট্রাম্পের সাথে তুলনা করত। কানাডায় সেটা মোটেই ভালো ব্যাপার না। যদিও সে ইমিগ্রেশনের পক্ষেই ছিল। আমার পছন্দ হত না। ফুটেছে, ভালো করেছে।”
জিত বলল, “কে হবে মনে হয় শেষ পর্যন্ত? এতো ক্যান্ডিডেট! কেলী লিচের কানাডীয়ান ভ্যালু টেস্ট সম্বন্ধে আপনাদের কি মতামত?”
লাল ভাই ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল, “ইশরে! কানাডীয়ান ভ্যালুর পরীক্ষা নেবে। বদমাশ মহিলা। কক্ষনো জিততে পারবে না।”
রনি বলল, “কানাডিয়ান ভ্যালু টেস্ট না নিলেও কিছু একটা থাকা দরকার। কানাডার মত পশ্চিমা দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থা এখন যেমন মাল্টি ন্যাশনাল, কেউ যদি সেকুলার সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাস না করে, তার পক্ষে সব কিছু মেনে নিয়ে এখানে জীবন যাপন করা সম্ভব হবে না। দেখা যাবে এক সময় তারা তাদের নিজস্ব দৃষ্টীভঙ্গী নিয়ে সেকুলার সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচারণ করতে শুরু করেছে। এই সমাজ ব্যবস্থার মুক্ততার সুযোগ নিয়ে এর বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করতে লেগে গেছে। অন্তত সেটা যেন না হয়, সেই ব্যবস্থা করা উচিৎ।”
সাইদ বলল, “কিন্তু সেটা তো যারা ইতিমধ্যে এদেশে আছে , তারাও করতে পারে। তাদেরকে ঠেকাবে কিভাবে?”
রনি বলল, “সেই সম্ভাবনা তো আছেই। কিন্তু তারপরও আমাদেরকে যতটুকু সম্ভব সতর্ক থাকতে হবে, তাই না? তার মানে আমি বলছি না ঢালাওভাবে কোন দেশ থেকে, কোন বিশেষ ধর্মের মানুষ জনকে আসা বন্ধ করে দেয়া হোক। কিন্তু ব্যাক্তিগতভাবে একটা ইন্টারভিউ নিলে খারাপটা কি? লিবারেলরা তো সবাইকে খুশী করবার জন্য এতো অস্থির যে ইমিগ্রেশন সম্বন্ধে কোন বিতর্কিত কথা উঠলেই তারা একেবারে মরীয়া হয়ে ওঠে সেটাকে ধামা চাঁপা দেবার জন্য।”
সাইদ গেম দিয়ে বলল, “যাক, আরেকটা গেম দেয়া গেল। জালাল, আজকে এই বালক দু’জনাকে একবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছি আমরা।”
জিত বলল, “ভাগ্য পাল্টাতে কিন্তু বেশী সময় লাগে না। সাইদ ভাই, আপনি বাট করেন, আমি একটা জোক বলি। ক’ দিন আগে পড়েছিলাম। রাজনৈতিক জোক।
এক মহিলা বেলুনে চড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে। নীচে এক লোককে দেখে সে চীৎকার করে জানতে চাইল, ‘এই যে শুনুন, আমি এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, কিন্তু কোথায় যে আছি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
লোকটা বলল, ‘তোমার বর্তমান লোকেশনের নর্থ ল্যাটিচুড হচ্ছে ৩১ ডিগ্রী ১৪.৫৭ মিনিট এবং ওয়েস্ট লঙ্গিচুড হচ্ছে ১০০ ডিগ্রী ৪৯.০৯ মিনিট।’
মহিলা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তুমি নিশ্চয় ডেমোক্র্যাট।’
‘ঠিক ধরেছ। জানলে কি করে?’ লোকটা অবাক হয়ে জানতে চাইল।
‘সহজেই। তুমি আমাকে যে তথ্য দিয়েছ, সেটা ঠিক হলেও আমার কোন কাজে আসছে না। আমি এখনও জানি না আমি কোথায়। তুমি আমার কোন উপকারেই এলে না।’
লোকটা সাথে সাথে জানতে চাইল, ‘তুমি নিশ্চয় রিপাবলিকান?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে?’ এবার মহিলার অবাক হবার পালা।
‘সহজেই,’ লোকটা বলল। ‘বেলুনে চড়ে পথ হারিয়েছ তুমি, কিন্তু আশা করছ কোন এক যাদুর বলে আমি তোমার সমস্যার সমাধান করে দেব। আমার সাথে দেখা হবার আগেও তুমি যেখানে ছিলে, এখনও সেখানেই আছো, কিন্তু অকারণে আমাকে মনপীড়া দিচ্ছ।’
শুজা রশীদ টরন্টো