আত্মহত্যা : একটি মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক সমস্যা ও এর প্রতিকার

মে ১৪, ২০১৭

ড. গোলাম দস্তগীর

প্রত্যেকটি মানুষই প্রত্যক্ষণ, চিন্তন, মনন, অনুভুতি ও আচরণ দিয়ে নিজেকে বা আত্মসত্ত্বাকে প্রকাশ করে, যা সম্পর্কে সে কখনও কখনও সচেতন থাকে, আবার কখনও বা অসচেতন থাকে। আর এটাই তার ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ব প্রকাশে মানুষ সামঞ্জস্য হারিয়ে ফেললে অসংলগ্ন আচরণ করে যা তার কথা, কাজ, ব্যবহার, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি  ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলন যখন অন্যদের নিকট দৃষ্টিকটু বা অস্বাভাবিক মনে হয় তখন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার মধ্যে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, বিষন্নতা, দুঃশ্চিন্তা, স্নায়ুচাপ ইত্যাদি সমস্যা হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী হয়, যা উত্তরোত্তর মানসিক ব্যাধিতে (mental illness) রুপান্তরিত হয়ে থাকে। একথা সত্য যে, প্রতিটি মানুষই জীবনে আে

বগ, উদ্বেগ, অতিরাগ, বিরাগ ইত্যাদির সম্মুখীন হয়, কিন্তু যে এগুলোকে সামলাতে পারে কিংবা এগুলোকে মোকাবেলা করে সন্তোষজনক বা গ্রহণযোগ্য আচরণ অব্যাহত রাখতে পারে সেই মানসিকভাবে সুস্থ্য। আর যে পারে না, সেই মানসিকভাবে অসুস্থ্য। পৃথিবীতে প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ্য। মানসিক রোগীদের সবচেয়ে বড়ো আত্মঘাতী আচরণ হলো ‘আত্মহত্যা’ (suicide)।

আত্মহত্যার প্রেক্ষাপটঃ

আত্মহত্যা মানে স্বেচ্ছায় উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে নিজের জীবনকে নিঃশ্বেষ করে দেয়া। এটি একটি ব্যক্তিগত, জটীল ও আবেগগত সমস্যা। তবে আত্মহত্যাকে এককথায় মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক (psychosocial) সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয়। সমাজবিজ্ঞানী এমিলি ডুর্খেম মনে করেন যে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তিসমূহই মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। তাঁরমতে, খৃস্টান ধর্মাবলম্বী ক্যাথলিকদের তুলনায় প্রটেস্টান্টদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলক বেশী, কারণ কড়া সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আত্মহত্যার হার হ্রাস করে। ডুর্খেমের মতে, নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে, যুদ্ধকালীন সময়ের তুলনায় শান্তিকালীন সময়ে, বিবাহিতদের তুলনায় অবিবাহিতদের মধ্যে, সন্তানসম্বলিত মানুষদের তুলনায় নিঃসন্তান মানুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশী। সব সমাজে, সব সংস্কৃতিতে, কিংবা সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আত্মহত্যা সংঘটিত হয়। উন্নত বা উন্নয়নশীল সকল সমাজেই আত্মহত্যা হয়। বিশ্বের শ্রেষ্ট ধনী দেশে বসবাস করা থেকে শুরু করে সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়–য়ারাও আত্মহত্যা করে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও আত্মহত্যা করে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে প্রতি তিনজন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে অন্ততঃ একজন বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়। আর দক্ষিণএশিয়ার অভিবাসীদের মধ্যে বিষন্নতা এবং “মানসিক আঘাত-উত্তর স্নায়ুচাপ ব্যাধির” {Post-Traumatic Stress Disorder (PTSD)} হার সবচেয়ে বেশী। তাই তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশী। যুদ্ধ কিংবা হত্যাকা- থেকে প্রতিবছর যত না মৃত্যু হয় তার চেয়েও অধিক মৃত্যু ঘটায় আত্মহত্যা। সারবিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ৩০০০ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতিবছর খোদ কানাডাতে ৪০০০ মানুষ আত্মহত্যায় মুত্যুবরণ করে। কানাডায় প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৬.৮ জন পুরুষ আর ৫.৫ জন নারী আত্মহত্যা করে। অন্য পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্রতি চল্লিশ সেকে-ে কেউ না কেউ আত্মহত্যা করে। সম্প্রতি টরন্টোতে দু’জন তরতাজা বাংলাদেশী যুবকের আত্মহত্যায় বাংলাদেশী কমিউনিটিতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যাঃ

উত্তর আমেরিকায় আত্মহত্যা দশম মৃত্যুর কারণ এবং ১৫ থেকে ২৪ বছরের পুরুষদের মধ্যে সপ্তম মৃত্যুর কারণ। আত্মহত্যার হার স্বল্পবয়স্ক তরুণ-তরুণীদের (adolescent) মধ্যে সবচেয়ে বেশী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ হার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, ১৯৬০ থেকে ২০০০ সালে স্বল্পবয়স্ক তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যা দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কেবল ২০০৪ সালেই তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যা ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো মেয়েরা ছেলেদের থেকে চার গুণ বেশী আত্মহত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু ছেলেরা মেয়েদের থেকে চার গুণ বেশী আত্মহত্যায় সফল হয়। আর, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলেরা ধারালো বা মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করে আত্মহত্যার জন্য। উঁচু ছাদ বা ব্রীজ থেকে লাফ দেয়া, ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে গলা কেটে ফেলা, চলন্ত ট্রেন বা গাড়ী বা বাসের সামনে ঝাপ দেয়া, বুকে ছুরি বিদ্ধ করা, পিস্তলের সাহায্যে গুলি করা ইত্যাদি। অন্যদিকে, মেয়েরা আত্মহত্যার জন্য অপেক্ষাকৃত কম যন্ত্রণাদায়ক পন্থা অবলম্বন করে, যেমন ঘুমের বড়ি, গলায় ফাঁস, হোস পাইপ দিয়ে গলা পেঁচানো, বালিশ চেপে শ্বাস রোধ করা  ইত্যাদি। সম্প্রতি দেখা গেছে যে, বেশ কিছু একক গাড়ী দূর্ঘটনায় আহত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দূর্ঘটনার কারণ হিসেবে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে দায়ী করা হয়।

তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কেন এত বেশী তা জানতে হলে তাদের শারিরীক ও মানসিক বৃদ্ধি সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতে হয়। ১৩ থেকে ১৯ বছরের বয়সের সময়টা নব তরুণ-তরুণীদের (young adults) জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে তাদের মধ্যে শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তন যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি জৈবিক ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে আসে আমুল পরিবর্তন। পিতামাতার জন্য এটি একটি কঠিন সময়, কারণ তাঁরা আশা করেন তাঁদের সন্তান ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের মধ্যেই ব্যক্তিত্বের (personality) প্রকাশ ঘটাবে। অন্যদিকে তরুণ-তরুণীরা তাদের এ যাবৎকালের সব মূল্যবোধকে ঢেলে সাজাতে চায়। ভাবাবেগের তোলপাড়ে হোঁচট খায় আত্ম-প্রত্যয় (self-concept)। ব্যক্তিত্বকে দেখতে চায় নিজেদের মতো করে। খুঁজতে থাকে স্বতন্ত্র আত্ম-পরিচিতি (individual self-identity)। শুরু হয় পিতামাতা-সন্তান দ্বন্ধ। তারা মনে করে তারাই বেশী জানে বা তাদের বন্ধুরাই সঠিক। সম্পর্কের এ টানাপোড়েনে স্বল্পবয়স্ক তরুণ-তরুণীরা অনেক সময় পিতামাতার চেয়ে নিজেদেরকে বা বন্ধু-বান্ধবকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অনেকসময় পিতামাতার সঙ্গটাও বিরক্তিকর মনে হয়। এক্ষেত্রে, পিতামাতার অধিক অনুশাসন, চাপ, শাস্তি, অবহেলা, অযতœ বা অবজ্ঞা কোমলমতি কিশোরদের মনে ধীরে ধীরে আঘাত আনে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, শৈশবে বা কৈশোরে কোন শিশু মানসিক চাপে আক্রান্ত হলে তা মানসিক ব্যাধি হিসেবে সারাজীবন তার জীবনে বাসা বেঁধে থাকে। আর এরূপ একটি সাধারণ মানসিক সমস্যা হলো “মনোযোগ-সঙ্কট/অধিপরতা ব্যাধি” {Attention-Deficit/Hyperactivity Disorder (ADHD)}।

তরুণ-তরুণীদের  আত্মহত্যার কারণঃ

আত্মহত্যার অংখ্য কারণ থাকতে পারে কেননা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সকল বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া অসম্ভব। তবে সঠিকভাবে সকল বিষয় জানা না গেলেও মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, যেসকল মূল কারণে তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তাদের মধ্যে কয়েকটি হলো: আর্থিক অস্বচ্ছলতা, প্রাচুর্যের অপ্রতুলতা, কঠোর প্রতিযোগিতা, কর্মক্ষেত্রের বা পড়াশুনার অত্যধিক চাপ, কর্মসংস্থানের অভাব কিংবা নি¤œমানের কর্মসংস্থান, পারিবারিক অশান্তি, পিতামাতার বিচ্ছেদ, সন্তানের ওপর পিতামাতার অতিশয় শাসন, অনুশাসন ও শাস্তি, পরিবারের অবহেলা ও অপব্যবহার, আত্মবিশ্বাসের অভাব, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা হারিয়ে ফেলা, একাকিত্ব বা সামাজিক ও সাংগাঠনিক কর্মকা- থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, মানসিক অশান্তি বা  মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়া, হতাশা ও অবসাদগ্রস্থ হওয়া, মাদকাসক্ত হওয়া ইত্যাদি।

তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার পূর্বলক্ষণঃ

আত্মহত্যার কোন সুনির্দিষ্ট সময় বা কারণ না থাকলেও কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে আত্মহত্যার পূর্বসতর্কতা অনুমান করা যায়। মানুষের যেসব আচরণ আত্মহত্যার পূর্বসংকেত বহন করে তার একটা নমুনা নি¤œরূপ । তবে এসব আচরণ অনিবার্যভাবে আত্মহত্যার কারণ নয়, এগুলো সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণামাত্র। ধারণাসমূহ হলোঃ

–  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রেডের ক্রমাগত নিম্মমানতা

–  হঠাৎ করে বিনা কারণে বা তুচ্ছ কারণে রেগে যাওয়া

–  কোন কিছুতে আগ্রহ বা উদ্যোগের অভাব দেখা দেয়া

–   নিয়ম, নীতি ও রীতির তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়াল-খুশি মতো চলা

–  নিজেকে সবকিছু এবং সবার নিকট থেকে গুটিয়ে রাখা বা ঘরকুনো হওয়া

–  সামাজিক কর্মকা- বা অনুষ্ঠান, যেমন বিয়ে, জন্মদিন ইত্যাদিতে যোগ না দেয়া

–   নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিষগুলোকে অনায়াসে অন্যকে বিলিয়ে দেয়া

–   পারিবারিক যোগাযোগ বন্ধ বা ক্রমাগত কমিয়ে ফেলা

–  বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে আনা বা একেবারে বন্ধ করে দেয়া

–   শারিরীকভাবে অপরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করা

–   ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে প্রায়ই আত্মহত্যার কথা বলা

–   সর্বোপরি, “আমার মরার পর …”, “আমি যখন থাকব না…”, “আমি মরলে…” এই জাতীয় কথাবার্তা প্রায়ই বলা।

তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যা সম্পর্কে সতর্ক হতে হলে আমি অভিভাবকদের পাঁচটি বিষয়ে নজর রাখতে বলব। প্রথমতঃ সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য। যখন কোন স্বল্পবয়স্ক তরুণ বা তরুণী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার সহপাঠী বা সহপাঠীনীর সঙ্গে প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়ে, কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অত্যধিক পড়ালেখার চাপ বা সামাজিক কর্মকা-ের চাপে হিমসীম খায়, আহার ও নিদ্রায় অনিয়ম বা  বিঘœতা সৃষ্ঠি হয়, হতাশা বা বিষাদ আচ্ছন্ন করে, নিজের প্রতি আস্থা বা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে কেবলই নিজের অক্ষমতাকে দায়ী করে নিজেকে অবজ্ঞা বা হেয় করে, কিংবা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নিজের জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলে অথবা বাবা মায়ের পছন্দ-অপছন্দের চাপে নিজের পছন্দের

প্রেমকে বলি দিয়ে একাকিত্ব বরণ করে, তখন বুঝতে হবে যে সে মানসিক ব্যাধিতে পর্যবসিত, যার নাম “বিষন্নতা” (depression)। এই ধরণের কোন স্বল্পবয়স্ক তরুণ বা তরুণীর মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশী। আর বিশেষকরে যারা বিষন্নতা-বিরোধী (antidepressant) ওষুধ সেবন করে তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশী। বিষন্নতা যখন প্রকটরূপ ধারণ করে এবং যখন তা ২ সপ্তাহেরও অধিক স্থায়ী হয় তখন তাকে “প্রধান বিষাদময় অধ্যায়” (major depressive episode)  বলা হয়। আর “প্রধান বিষাদময় অধ্যায়” যখন ২ বছরেরও অধিক সময় ধরে বার বার আক্রমন করে, তখন তা “প্রধান বিষাদময় ব্যাধিতে” (major depressive disorder)  রূপান্তরিত হয়। “প্রধান বিষাদময় ব্যাধি” দ্বারা আক্রান্ত শতকরা ১৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করে।

দ্বিতীয়তঃ আত্মহত্যার হুমকী। কিছু তরুণ-তরুণী পরিবারের বা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আত্মহত্যার হুমকী দেয়। এখানে, কোন মানসিক ব্যাধির ব্যাপার নেই। সে ক্ষিপ্ত হয়ে কিংবা আত্মাভিমানে অন্যকে নিজের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে আত্মহত্যার ভান করে, কিংবা কথায় কথায় আত্মহত্যা করার হুমকী দিয়ে অন্যকে ভয় দেখায়। সাধারণতঃ মেয়েরা এ ধরণের কাজ বেশী করে থাকে। এদের সঙ্গ অন্যকে প্রভাবিত করে। আত্মহত্যা নিয়ে মজা করা, আত্মহত্যার ভান করা বা ছলনা করা, কিংবা কথায় কথায় আত্মহত্যার কথা যারা চিন্তা করে তারা জীবনের কোন না কোন শক্ত প্রতিঘাতে কোন পরিকল্পনা ব্যতীতই আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে, কারণ আত্মহত্যা তার মস্তিস্কে একটা নৈমিত্তিক চিন্তার অংশ হয়ে পড়ে।

তৃতীয়তঃ শারীরিক যন্ত্রণার অব্যাহতি হিসেবে আত্মহত্যা। শারিরীক অসুস্থ্যতা শতকরা ৫০ ভাগ আত্মহত্যার জন্য দায়ী । আজকাল অনেক তরুণ-তরুণী দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে, শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর হলে, বাঁচার সকল উপায় ব্যর্থ হলে, বা আর কোন আশা না থাকলে মৃত্যু বা আত্মহত্যাকে শেষ অবলম্বণ হিসেবে বেছে নেয়। অনেক সময় সে অন্যের সাহায্য ব্যতিরেকে যন্ত্রণা নিবারণের শেষ উপায় হিসেবে আত্মহত্যা করে। আবার অনেকে অনেক দেশে প্রচলিত আইনের আওতায় “কৃপামৃত্যু” বা “স্বেচ্ছামৃত্যুর” (euthanasia) আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে, প্রাপ্তবয়স্ক কোন রোগী অনিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্ত হলে সে চিকিৎসকের সহায়তায় “কৃপামৃত্যু বেছে নেয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটিও আত্মহত্যা এবং এখনও অনেক দেশে এটি অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে, কানাডায় ২০১৬ সালের জুন মাসে এটি বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যদিও এর অনেক শর্ত আছে।

চতুর্থতঃ পীড়ন-নিপীড়নের কারণে আত্মহত্যা। আমাদের বাংলাদেশী অভিবাসীরা রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার আদর্শে লালিত-পালিত।  অনেক ছেলেমেয়ে কম বয়সে প্রলুব্ধ হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে। আজকাল ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষ পুরানো বন্ধুকে যেমন খুঁজে পায়, তেমনি বন্ধুবেশে অচেনা-অজানা প্রতারকও বন্ধুর তালিকায় যুক্ত হয়, যারা পরিনামে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। যৌন হয়রানী (sexual harassment), যৌন নিপীড়ন (sexual assault) এবং স্কুলে পীড়নের (bullying) শিকার হয়ে অনেক মেয়ে কলঙ্কিত মনে করে এবং অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ২০১২ সালে আমান্দা টড নামে ১৫ বছরের এক কিশোরী তারই সহপাঠীদের দ্বারা নিপীড়িত হয়ে এবং সাইবার পীড়নের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর পূর্বে ইন্টারনেটে ছেড়ে যাওয়া ভিডিও ক্লিপ সারা দুনিয়ার সাড়া জাগায় যে, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তিও মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়।

পঞ্চমতঃ ধর্মীয় অপব্যাখ্যায় আত্মহত্যা। ইদানিং মুসলিম বিশ্বে ধর্মের অপব্যাখ্যা ও বিকৃতিতে, ধর্মীয় গোঁড়ামী ও উন্মাদনায়, বিপদগামী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত এবং মস্তিস্কবিকৃত কতিপয় মুসলমান নামধারী সন্ত্রাসীর প্ররোচনায় পথভ্রষ্ট হয়ে ধর্মের নামে কতিপয় যুবক আত্মাহুতি দিয়ে সন্ত্রাস করে। এটিও আত্মহত্যা এবং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ। এদের থেকে আমাদের সন্তানদের নিরাপদ দূরত্বে রাখা আমাদের কর্তব্য।

আত্মহত্যা সম্পর্কে কয়েকটি ভ্রান্ত ধারণাঃ

অনেকে মনে করেন যে, যারা আত্মহত্যার কথা বলে তারা আসলে আত্মহত্যা করে না। কথাটা সঠিক নয়। অনেকেই আছে যারা তাদের অভিপ্রায় নিকট আত্মীয় বা বন্ধুদের নিকট প্রকাশ করে। আত্মহত্যাকারীদের তথ্য থেকে জানা গেছে যে, আত্মহত্যাকারীদের ৪০ শতাংশ পূর্বে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। কারও কোন হত্যার হুমকী বা আত্মহত্যার হুমকীকে কখনই খাটো করে দেখা উচিত নয়। এটাও মনে করা হয় যে, কেবলমাত্র বিষন্ন (depressed) ব্যক্তিরাই আত্মহত্যা করে থাকে। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। বিষন্নতা আত্মহত্যার একটি বড় ঝুঁকি, কিন্তু সব আত্মহত্যাই বিষন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত হয় না। মানসিক অসুস্থ্যতা (mental illness) আত্মহত্যার একটা বড় ঝুঁকি। আর একটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেবলমাত্র নি¤œ আর্থ-সামাজিক বা নিন্মবিত্ত পরিবারেই আত্মহত্যা হয় না, আত্মহত্যা উচ্চ আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রেও হয়, যদিও  নিন্মবিত্ত পরিবারে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশী। আবার এটাও ভ্রান্ত যে, কচি শিশুরা কখনই আত্মহত্যা করে না। বস্তুতঃ আত্মহত্যা ৪ বছরের শিশুদের মধ্যেও দেখা যায়।

উপসংহারঃ

আত্মহত্যা মোকাবেলায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পরিবারের। এরপর আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের ভূমিকা রয়েছে। আত্মহত্যার মতো মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক ব্যাধি নিরসনে এদের প্রত্যেকের সাহায্য প্রয়োজন। সমাজে মানুষ যতবেশী নিজেকে আত্তীকরণ করবে সে ততবেশী সমাজমুখী ক্রিয়াকর্মে নিয়োজিত হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শ ও মুল্যবোধ মানুষকে জীবনমুখী করে। জীবনের অর্থ অনুধাবন করতে শেখায়। ফলে, মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। অপ্রতুল অর্থের মধ্যে থেকেও সুনিবিড় পারিবারিক বন্ধন ও পারস্পরিক সহমর্মিতা সন্তানের নিজের জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণ পোষণ করতে সাহায্য করে। সে পরিবারের ও সমাজের একজন অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজেকে ভাবতে শুরু করে। ফলে, সমাজে তার জীবন অর্থবহ হবে, অর্থহীন হবে না। তাই আত্মহত্যা নয়, আত্মরক্ষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সুস্থ্য সামাজিক মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে।  ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, প্রতিটি মুশকিলের পিছনে উপশম আছে (কুরআন, ৯৪:৫)।

আমার একটি পরামর্শ হলো আপনার সন্তানের যদি কোথাও কোন কাজে অপারগতা বা অনগ্রসরতা দেখেন তবে কখনই তাকে অন্যের সন্তানের অগ্রসরতার সঙ্গে তুলনা করে নিজের সন্তানকে হীনমন্য করে তুলবেন না। প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবে কিছু প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আমাদের উপযুক্ত শিক্ষা, পরিবেশ ও সুযোগ্য অভিভাবকত্বে সে বিকাশ ঘটাবে তার সুপ্ত প্রতিভার।

পরিশেষে, আপনার সন্তান কাদের সঙ্গে ওঠাবসা করে, কী ধরণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কর্মকা- পছন্দ করে  বা সেগুলোতে অংশগ্রহণ করে, নেশা বা মাদক সেবনে আসক্ত হচ্ছে কি না, চলাফেরা বা গতিবিধিতে সন্দেহজনক কোন কিছু দেখা যায় কি না, আচরণে কোন অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে কি না, কর্মক্ষেত্র বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনকিছু তাকে উদ্বিগ্ন করছে  কি না, দীর্ঘদিন ধরে কোন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত কি না, বাসায় বা নিজের ঘরে ধারালো বা মারণাত্মক অস্ত্র আনা-নেয়া করে কি না ইত্যাদি বিষয়ে আপনার সম্যক ধারণা থাকলেই আপনার সন্তান নিরাপদে থাকবে। এসব বিষয়ে গরমিল দেখলে অবশ্যই সমাজকর্মী বা কমিউনিটি সেবাপ্রদানকারীর (Community Service Worker) সাহায্য নেয়া প্রয়োজন, কারণ আত্মহত্যা কেবল একটি মহামূল্যবান পবিত্র জীবনেরই অবসান নয়, আত্মহত্যার ফলে সমাজ বা রাষ্ট্রের যেমন আর্থিক ক্ষতি হয়, তেমনি পরিবার, পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও সর্বোপরী জীবিত পিতামাতার জীবনে বয়ে আনে দূর্বিসহ মানসিক যন্ত্রণা এবং দুঃসহ পারিবারিক অশান্তি ও আজনম অনুশোচনাবোধ (survivor guilt)।

————

লেখক পরিচিতি: ড. গোলাম দস্তগীর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক। বর্তমানে তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে গবেষণা করেন এবং সেনেকা কলেজে খ-কালীণ অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তিনি একাডেমি অব লার্নিং কলেজের ওয়ার্ডেন/শেপার্ড শাখায় কমিউনিটি সার্ভিস ওয়ার্কার ডিপ্লোমা প্রোগ্রামের বিশেষকরে “মানসিক স্বাস্থ্য ও আসক্তি” (গবহঃধষ ঐবধষঃয ধহফ অফফরপঃরড়হং) বিষয়ের  পূর্ণকালীণ শিক্ষক। তাঁর একাধিক গ্রন্থ টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংকলিত আছে।