‘বাবা’ : কানাডায় নির্মিত এক পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র

আগস্ট ১০, ২০১৬

মনিস রফিক

বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে চলচ্চিত্রের আবিস্কার পৃথিবীর মানুষের চিন্তা-চেতনা আর বিনোদনের জগতে এক আমুল পরিবর্তন আনে। চলচ্চিত্র এমন এক শিল্প মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় যাতে মানুষ নিজের জগতকে চোখের সামনে দেখতে পায় অনেকটা বাস্তবতার নিরিখে। সত্যি কথা বলতে কী, মানুষ ও তার আশেপাশের জগতকে চলচ্চিত্র যত সুন্দর ও সুক্ষ্মভাবে উপস্থাপিত করতে পারে তা অন্য কোনো মাধ্যমের পক্ষে কখনো এমনভাবে সম্ভব নয়। কানাডায় নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র ‘বাবা’ দেখে চলচ্চিত্রের এই অপার ক্ষমতার কথা বারবার মনে পড়ে যায়।

অভিবাসীদের দেশ এই কানাডাকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠী নিজেদের একান্ত বাসভূমি করে নিয়েছে।এই সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বাংগালীদের স্থান এক বিশেষ পর্যায়ে এসে গেছে। অভিবাসী দিয়ে গড়ে উঠা একটি দেশে প্রায় সব জাতিগোষ্ঠীই সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধ জনিত এক গভীর দ্বন্দ্বে পড়ে যা এক গভীর টানপোড়নের পরিস্থিতি তৈরী করে পূর্বসূরী ও উত্তরসূরীদের মধ্যে। টরন্টোতে কয়েক দশক ধরে বাস করা রাফি খান ইমরান এর মধ্যে অভিবাসী মানুষের জীবনের এক সংকট বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে বলেই হয়তো তিনি নির্মাণ করেছেন তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা কাহিনীচিত্র ‘বাবা’

‘বাবা’ ছবিটি মূলত গড়ে উঠেছে দুই পরিবারে গল্প নিয়ে। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাবা তার সারা জীবন ব্যয় করেছেন মানুষের সুন্দর ও মংগল চিন্তায়। আদর্শবান নরম মনের এই মানুষটার মনে নিরন্তরভাবে বয়ে চলে এক সুন্দর সভ্যতার চিন্তা, যে চিন্তায় আছে মানুষের প্রতি মানুষের পরম প্রেম, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের প্রগাঢ় মূল্যবোধ আর একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা। এক পুত্র আর এক কন্যার জনক বাবা সব সময়ই চেয়েছেন তার সন্তানরা সত্যিকারের মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠুক, হয়ে উঠুক একেবারে মানবিক গুণাবলীর মানুষ। কিন্তু যে সৎ মানুষটি এমন স্বপ্ন ও প্রত্যাশায় বিভোর থেকে দিনাতিপাত করতে চান, তার পারিবারিক জীবনে নেমে আসে এক গভীর সংকট। আর এ সংকটের সূত্রপাত শুরু হয় তার একমাত্র পুত্রের বিপথে যাবার মাধ্যমে। পুত্র শোভন কানাডার নতুন প্রজন্মের সন্তান, কানাডার জৌলুষপূর্ণ জীবনে বাবার মত আদর্শ ধারণ করে সে অন্যদের চেয়ে বিত্ত ও প্রতিপত্তিতে পিছিয়ে থাকতে চায় না। সে চায় অর্থ আর আয়েসপূর্ণ জীবন যার ফলে উচ্চাভিলাসী খালাতো বোন জুলির সাথে তার প্রেম হলে সে চায় সমাজের সেই কাতারে থাকতে যেখানে আদর্শ বা সততার কোনো মূল্য নেই আর যেখানে মানুষকে বিচার করা হয় তার বাহ্যিকতা দেখে। জুলির বাবা রায়হান সমাজের সেই ধরনের মানুষ যিনি শোভনের অধ্যাপক বাবার একেবারে বিপরীতধর্মী। শোভনের হবু শ্বশুড় রায়হান সাহেব শোভনকেই মনে করে তার একমাত্র কন্যার স্বামী হবার উপযুক্ত ছেলে সে কারণে তিনি তাকে চিনিয়ে দেন অর্থ উপার্জনের সহজ ও কলুষিত উপায়। যুবক শোভন জীবনের জৌলুষতার প্রলোভনে নিজ আদর্শবান বাবার আদর্শকে পায়ে মাড়িয়ে সামনে এগুতে থাকে খালু বা হবু শ্বশুড়ের অসৎ পথে।

চলচ্চিত্র নির্মাতা রাফি খান ইমরান

একমাত্র পুত্রের এমন অসৎ পথে উপার্জনকে মা সমর্থন করলেও বাবা মূষঢ়ে পড়েন প্রচন্ডভাবে। নতুন প্রজন্মের তথাকথিত জীবন দর্শন আর বিত্তের পেছনে ছুটোছুটি তিনি কোনোভাবেই মানতে পারেন না। অধ্যাপক বাবার পারিবারিক এই সংকটে তার পাশে থাকে তার কন্যা মুনিরা। সুন্দর মন, সুন্দর চিন্তা ও বাবার চেতনা ধারণ করা কন্যা সব সময় বাবার পাশে বাবার জীবনের এই চরম হতাশায় একটু আশার আলো হয়ে থাকতে চায়। মুনিরা যেমন মানতে পারে না শোভনের এই বেপরোয়া জীবন, তেমনি সে মানতে পারে না শোভনের সাথে জুলির সম্পর্ক। জুলির বাবা এমনিইতে সবার কাছে একজন অসৎ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত তার ওপরে মুনিরা তার প্রেমিকের মাধ্যমে জুলির আমেরিকায় পড়াকালীন বেপরোয়া জীবনের যে চিত্র পাই তাতে কোনোভাবেই মুনিরা মেনে নিতে পারে না এমন এক বাবার এমন এক মেয়ের সাথে তার ভাই সংসার জীবনে জড়িয়ে পড়ুক।

নিজ পরিবারে এমন সংকটে বাবা বেদনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন। নিজ পরিবারে নিজের স্বপ্ন ও আদর্শের এই মৃত্যু তাকে গভীরভাবে হতাশ করে দেয়। তার বারবার মনে হয় জীবন সায়াহ্নে তিনি এক পরাজিত যোদ্ধা। ফলে নিজের সাথে নিজের এক অন্তর্দ্বন্দ্বে হঠাৎ করেই সবাইকে ছেড়ে কয়েকদিনের জন্য হারিয়ে যান তিনি। এই হারিয়ে যাওয়ায় তিনি স্থান নেন নিজের কাছে আর প্রকৃতির কাছে।

শেষ পর্যন্ত বাবা হেরে যান না। নিজ পুত্রের হবু বধু জুলি বাবার সংস্পর্শে বদলে যায়। বাবার আদর্শের পরশ তাকে প্রবলভাবে স্বাপ্নিক করে আর সুন্দর সম্মানের সাথে বাচতে শেখায় যার ফলে সে সিদ্ধান্ত নেয় সত্যিকারভাবে পড়াশুনা করে তার জীবনটাকে সুন্দরভাবে সাজাবে, যে জীবনে শোভন থাকবে একজন সৎ ও আদর্শবান মানুষ যেমনটি বাবা প্রত্যাশা করেন।

চলচ্চিত্রের শেষে বাবা পরাজিত হন না, বরং পরাজিত হয় অশুভ সব শক্তি। বাবা আমাদের সবাইকে জানিয়ে দেন, সত্যই সুন্দর-আর সুন্দরই সত্য।

টরন্টোতে তিন বছর ধরে চেষ্টা করে রাফি খান ইমরান নির্মাণ করেছেন এই চলচ্চিত্রটি। বাবা চলচ্চিত্রে টরন্টোতে বাংগালী অভিবাসনে এক টুকরো চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। টরন্টোতে অভিবাসনকারী অনেক পরিবারের চিত্রের সাথেই মিলেমিশে একেকার হয়ে যাবে ‘বাবা’ চলচ্চিত্রের গোটা কাহিনী। সেক্ষেত্রে স্বীকার করতে হবে, রাফি খান ইমরান টরন্টোতে বসে বাংগালি অভিবাসন জীবনের এক সুষ্ঠূ ও সুক্ষ্ম চিত্র তুলে ধরেছেন।

‘বাবা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে পুনাম ও মেহেরাব

টরন্টো বসে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া সহজসাধ্য কোনো বিষয় নয়। চলচ্চিত্র নির্মাণে বহুবিধ কারিগরী ও আর্থিক সমস্যা এখানে আছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যে একটি দক্ষ ও যোগ্য দলের প্রয়োজন সেটা বাংগালী সমাজে খুবই দুষ্প্রাপ্য। তারপরও একজন সৃষ্টিশীল মানুষ রাফি খান ইমরান থেমে যান নি। এ চলচ্চিত্রের পরিচালনা ছাড়াও তিনি নিজেই নিজের কাধে ক্যামেরা তুলে নিয়েছেন আর শ্যুটিং এর শেষে ছবির সম্পাদনায় বসে গেছেন। এই চলচ্চিত্র নির্মাণে রাফি খান ইমরানের এক বিশেষ কৃতিত্ব যে, তিনি   একেবারেই এক অপেশাদার দল নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের সাহস দেখিয়ে মাঠে নেমেছেন এবং তা সম্পূর্ণ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

‘বাবা’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরী করেছেন বাবার চরিত্রে অভিনয়কারী সিরাজুল কাদের ও পরিচালক রাফি খান ইমরান। এ ছবির সংলাপ লিখেছেন অভিনেতা সিরাজুল কাদের। রাফি খান ইমরানের ভাবনায় তৈরী হয়েছে এ ছবির সংগীত ভাবনা। ছবিতে ব্যবহৃত দুটি গানেও কন্ঠ দিয়েছেন তিনি। উল্লে­খ্য, টরন্টোর সাংস্কৃতিক জগতে রাফি ইমরানের প্রবেশ ঘটে সংগীতের মাধ্যমে। দুই দশক আগে টরন্টো থেকে বের হওয়া তার সংগীতের ভিডিও এলবাম এখনো দর্শকদের মন ছুয়ে যায়।

একেবারে অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও তাদের অভিনয় দর্শকদের মন ছুয়ে যায়। অভিনয়ে সবচেয়ে সাবলীলতা দেখিয়েছেন মুনিরা চরিত্রে অভিনয় করা তুলি করিম। এ ছাড়া বাবা চরিত্রের সিরাজুল কাদের, রায়হান সাহেবের চরিত্রে আরমান, জুলি চরিত্রে পুনাম ও শোভন চরিত্রে মেহেরাব এর অভিনয় বিশেষভাবে প্রশংসার দাবী রাখে।

‘বাবা’ চলচ্চিত্রের শ্যুটিং চলেছে তিন বছর ধরে, আর এর আউটডোর শুটিং হয়েছে টরন্টোর ডাউন-টাউন, বিভিন্ন পার্ক ও নায়েগ্রা ফলস এ। ‘বাবা’ রাফি খান ইমরানের প্রথম চলচ্চিত্র। প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে তিনি যে দক্ষতা ও ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন তাতে আমরা আশা করতেই পারি, আগামীতে তিনি আরো সুন্দর সুন্দর চলচ্চিত্র নির্মাণ করে কানাডার অভিবাসী জীবনে আমাদেরকে চরম সত্যের মুখোমুখি দাড় করাবেন।

রাফি ইমরান সহ এই চলচ্চিত্রের  অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সকল কলাকুশলীদের প্রতি রইল অশেষ শুভেচ্ছা। সেই সাথে অপার অপেক্ষায় থাকলাম তারা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আগামীতে আরো সুন্দর সুন্দর চলচ্চিত্র উপহার দিবেন।

-মনিস রফিক, টরন্টো