কানাডার মেইনস্ট্রিম গ্রোসারীতে বেস্ট বিফোর ডেট আর আরগ্যানিক ফুড নিয়ে জালিয়াতি!
ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
॥ খুরশিদ আলম ॥
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা দিয়ে শুরু করছি। আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে আমার বাসার কাছাকাছি একটি মেইনস্ট্রিম গ্রোসারী থেকে ২ লিটারের একটি সয়ামিল্কের প্যাকেট কিনে এনে ফ্রিজে রেখেছিলাম। পরের দিন সকালে নাস্তা খাওয়ার জন্য প্যাকেঁটি ফ্রিজ থেকে বের করে আনি। কিন্তু প্যাকেটের সিল করা মুখটি খোলার পর কেমন একটা অপরিচিত গন্ধ এসে নাকে লাগলো। তার আগে খেয়াল করেছিলাম প্যাকেটের আকৃতিটিও স্বাভাবিক নয়। পেটের দিকে একটু ফুলে আছে। ওটমিলের সঙ্গে মিশানোর আগে চামিচে করে একটু মুখে নিলাম টেস্ট করার জন্য।
সেই সকালে আমার আর নাস্তা খাওয়া হয়নি। গন্ধ শুকেই বোঝা উচিৎ ছিল কি মুখে দিতে যাচ্ছি। পরে বেস্ট বিফোর ডেট পরীক্ষা করে যা দেখেছিলাম তাতে স্তম্বিত না হয়ে পারিনি। এক বছর আগেই এর মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। গ্যাস তৈরী হয়েছিল ভিতরের সয়া মিল্ক পচে গিয়ে। সে কারণেই প্যাকেটটি কিছুটা ফুলে গিয়েছিলো। কেনার সময় বিষয়টি ভাল করে খেয়াল করিনি। আর মেইনস্ট্রিমের এতবড় একটি গ্রোসারী দোকানে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে সেরকম সন্দেহও হয়নি মনে!
গ্রোসারীটির নাম উল্লেখ করলাম না এখানে। কারণ, এখন সেটি প্রমাণ করার কোন উপায় নেই আমার হাতে। সেদিন সকালে অনেক খোঁজা খুঁজি করেও রিসিটটি পাইনি। তবে ঐ ঘটনায় যে শিক্ষা আমার হয়েছিল তার পর থেকে আর কখনো বেস্ট বিফোর ডেট এবং এক্সপায়ারী ডেট ভাল করে পরীক্ষা না করে খাবার কিনি না। সন্দেহ নেই, একটা মারাত্মক রকমের দুর্ঘটনার হাত থেকে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম ।
উপরে বর্ণিত ঘটনাটি একটি বিরল অভিজ্ঞতাই বলতে হবে। কারণ, এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটতে শুনা যায় না। বেস্ট বিফোর ডেট এর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তরল সয়ামিল্কের প্যাকেটটি পুরো এক বছর দোকানের স্টোররূমে মজুদ ছিল! অথবা ব্যাপারটি এমনও হতে পারে যে সয়ামিল্ক ফ্যাক্টরী থেকেই কোনভাবে পুরনো ঐ প্যাকেটটি চলে এসেছিল অন্যান্য প্যাকেটের সঙ্গে। আমার একুশ বছরের প্রবাস জীবনে কখনো এরকম ঘটনা ঘটতে শুনিনি। আর সকলের নজর এড়িয়ে দোকানের সেল্ফ পর্যন্ত ঐ প্যাকেটটি চলে এসেছিল? এটি কি করে সম্ভব? তাও আবার কানাডার মতো দেশে?
বেস্ট বিফোর ডেট নিয়ে এতো গেল একটি বিরল ঘটনার বর্ণনা এবং এটি কারো না কারো ভুল অথবা গাফিলতির কারণেই ঘটেছে। গাফিলতি আমারও ছিল। আমি ডেট পরীক্ষা না করেই সয়া মিল্কের প্যাকেটটি ঘর পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলাম এবং রিসিটটি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু যদি এই বেস্ট বিফোর ডেট কোন মেইনস্ট্রিম গ্রোসারীতে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করা হয় তখন এই ঘটনাকে কি বলা যায়? জালিয়াতি না দুষ্কর্ম নাকি দুবৃত্তপনা?
যেভাবেই এটিকে বর্ণনা করি না কেন, এই ঘটনা এখানে অহরহই ঘটছে! আর তা ঘটছে এখানকার কিছু মেইনস্ট্রিম গ্রোসারীতেই! এই তালিকায় আছে লবলজ আর আইজিএ’র মতো বড়মাপের গ্রোসারীগুলো। টরন্টোতে আইজিএ নেই এখন। বর্তমানে ফ্রেশকো নামের গ্রোসারীগুলো আগে আইজিএ নামে চালু ছিল। মন্ট্রিয়লে এখনো আইজিএ নামে চালু রয়েছে। মূলত Sobeys Inc. নামের ন্যাশনাল গ্রোসারী রিটেইলার বিভিন্ন নামে কানাডায় গ্রোসারী ব্যবসা পরিচালনা করে। এর মধ্যে রয়েছে Sobeys, Safeway, IGA, Foodland, FreshCo, Price Chopper, Thrifty Foods প্রভৃতি। প্রায় দেড় হাজার গ্রোসারী স্টোর রয়েছে এই রিটেইল জায়েন্টের। এক শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে এটি কানাডায় ব্যবসা করে আসছে। লবলজেরও রয়েছে বিশাল মাপের গ্রোসারী ব্যবসা। কেবল অন্টারিওতেই রয়েছে ৭০টিরও বেশী গ্রোসারী স্টোর। মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের বিভিন্ন স্টেটেও রয়েছে এদের অনেকগুলো গ্রোসারী স্টোর। আর এই স্টোরগুলোর কোন কোনটাতে ঘটছে এরকম জালিয়াতির ঘটনা!
শুধু যে বেস্ট বিফোর ডেট নিয়ে জালিয়াতি করা হচ্ছে তা কিন্তু নয়, চায়নার তৈরী পন্য মেইড ইন আমেরিকা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে আথবা জেনিটিক্যালী মডিফাইড ফুড’কে অরগ্যানিক ফুড হিসেবেও চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এ সকল গ্রোসারীর কোন কোনটিতে!
এইতো মাত্র কিছুদিন আগে বর্তমান বিশ্বের এক মহা জায়েন্ট ব্যবসায়ী ওয়ালমার্ট ‘মেইড ইন’ জালিয়াতিতে ধরা পরে। চায়নাতে তৈরী পন্য তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী বলে চালিয়ে দিচ্ছিল নিজেদের ওয়েবসাইটে আপলোড করা বিজ্ঞাপনে। বিষয়টি প্রথমে নজরে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠান ট্রুথ ইন এ্যাডভার্টাইজিং সংস্থার। তারা দেখতে পায় ওয়ালমার্ট তাদের ওয়েবসাইটে শত শত পন্যকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী বলে দাবী করে আসছিল। অথচ এগুলো কোনটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী নয়। তদন্তে দেখা গেছে চায়নায় তৈরী প্লাষ্টিক কাটলারীকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী বলে দাবী করা হচ্ছে, মেক্সিকোতে তৈরী লোশনকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী বলে দাবী করা হচ্ছে। এরকম আরো অনেকগুলো পন্যের বিষয়ে জালিয়াতি করা হচ্ছে। সিবিসি নিউজে বলা হয় ট্রুথ ইন এ্যাডভার্টাইজিং সংস্থার অভিযোগের পর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে এবং জালিয়াতির ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই জালিয়াতির জন্য ওয়ালমার্টের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি! আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এই যুক্তিতে যে, ওয়ালমার্ট রাজী হয়েছে তারা তাদের ওয়েবসাইট থেকে মেইড ইন ইউএসএ লেবেল বা স্টিকার সরিয়ে ফেলবে। পাঠক একবার ভাবুন, এই জালিয়াতি যদি ছোটখাট কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতো তবে তাকে কি এত সহজে ছেড়ে দেওয়া হতো?
জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে অরগ্যানিক ফুড নিয়েও। সিবিসি নিউজের এক খবরে বলা হয় লবলজ, সোবেজ এবং কোস্টকো‘তে অরগ্যানিক ফুড বলে যে সকল পন্য বিক্রি করা হচ্ছে সেগুলো যারা সাল্পাই দেয় সেরকম একটি প্রতিষ্ঠানের সাবেক ম্যানেজার নিজেই মিডিয়ার কাছে বলেছেন তাকে বাধ্য করা হতো সাধারণ চিকেন প্রোডাক্টকে অরগ্যানিক চিকেন হিসেবে চালিয়ে দিতে। অন্টারিও’র বেডফোর্ডে অবস্থিত সিরিকোলা ফার্মের সাবেক ঐ ম্যানেজার ভাসতি ডালিপসিং গত জুন মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিষয়টি তার নজরে আসে গত জানুয়ারীতে। পরে কোম্পানীর ফাইলপত্র ঘেটে তিনি দেখেন এই জালিয়াতি চলে আসছে গত আট মাস ধরেই। সিরিকোলা ফার্মটি লবলজ, সোবেজ ও কস্টকো’র মত বড় বড় গ্রোসারী স্টোরে পল্ট্রি প্রোডাক্ট প্রসেস ও প্যাকেজ করে সাপ্লাই দিয়ে থাকে।
ভাসতি‘র আইনজীবী ডরেইন পারসাউদ জানান, নথিপত্রে জালিয়াতির প্রমান রয়েছে এবং কোড স্টিকারেও পরিবর্তন আনা হতো যাতে দাবী করা হতো প্রসেসিং প্লান্টে আনা চিকেনগুলো অরগ্যানিক। আইনজীবী পারসাউদ সিবিসিকে আরো বলেন, কানাডিয়ান ফুড ইন্সপেকশন এজেন্সির একজন পরিদর্শক ঐ প্রসেসিং প্লান্টে পরিদর্শনের দায়িত্বে ছিলেন। তার চোখ এড়িয়ে এ জালিয়াতির কাজগুলো কি ভাবে সম্পন্ন হয়ে আসছিল সেটি তদন্ত করে দেখা উচিৎ। যে কাজ পরিদর্শকের করা উচিৎ সে কাজ করছেন প্লান্টের ম্যানেজার ভাসতি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ফুড ইন্সপেকশনের কর্মকর্তা কি ভাবে এই জালিয়াতির ঘটনা ধরতে ব্যর্থ হলেন?
ভাসতি ডালিপসিং চিকেন প্রসেসিং ফার্ম থেকে চাকুরীচ্যুত হন গত এপ্রিল মাসে। পরে তিনি ঐ ফর্মের বিরুদ্ধে সুপরিয়র কোর্টে মামলা দায়ের করেন। ভাসতি বলেন, আমাকে হুমকী দেয়া হতো এই বলে যে, যদি আমি এই অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলি তবে তারা কৌশলে আমাকেই দায়ী করবে এ জালিয়াতির জন্য।
লবলজের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন গ্রো সিবিসির কাছে পাঠানো এক ইমেইল বার্তায় বলেন, “আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় থার্ডপার্টির সার্টিফিকেশনের উপর। কানাডিয়ান ফুড ইন্সপেকশন এজেন্সি বর্তমানে বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। তদন্তের ফলাফল হাতে পেলে আমরা এ বিষয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নিব।”
শুরুতে যে প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলাম সেই প্রসঙ্গেই আবার ফিরে আসি। খাদ্যের বেস্ট বিফোর ডেট নিয়ে কানাডায়ও যে জালিয়াতি হয় সেটি হয়তো অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই প্রতারণাটি এখানেও হচ্ছে। আর এই জালিয়াতির খবর এখানকার মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেই প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে সিবিসি নিউজের একটি প্রতিবেদনের কথা বলা যেতে পারে যেটি প্রচারিত হয়েছিল নভেম্বর মাসের ৬ তারিখে। ঐ প্রতিবেদনে দেখা যায় মন্ট্রিয়লের লবলজ গ্রোসারীর একটি স্টোরে কর্মরত মোহাম্মদ সাফারি নামের এক কর্মী সিবিসির কাছে অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। তিনি জানান, তার সুপারভাইজার তাকে বিভিন্ন ফ্রোজেন বেকারী আইটেম যেমন চীজ কেক, মাফিন বা পেসট্রির বেস্ট বিফোর ডেট এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর সেগুলোর স্টিকার বদলে নতুন করে তারিখ বাসানোর নির্দেশ দিতেন নিয়মিত। এক সপ্তাহ বা এক মাস আগে বেস্ট বিফোর ডেট এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে এমন বেকারী আইটেম ফেলে না দিয়ে সেগুলোতেও নতুন করে মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিক বসানোর নির্দেশ দেয়া হতো মোহাম্মদ সাফারিকে। তাকে আরো বলা হতো বেস্ট বিফোর ডেট এর মেয়াদ উত্তীর্ণ চীজ কেক এর উপর নতুন টপিংস বাসাতে যাতে করে সেগুলো দেখতে ফ্রেস বলে মনে হয়।
সাফারি সিবিসিকে জানান, “কর্তৃপক্ষের চাপে এই অপকর্ম করতে গিয়ে একপর্যায়ে আমি মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ি। পরে আমি সিক লিভে চলে যাই কয়েকমাসের জন্য।”
সাফারি অবশ্য পরে সিদ্ধান্ত নেন বিষয়টি গনমাধ্যমে তুলে ধরার জন্য। তিনি গোপনে তার সুপারভাইজারের নির্দেশগুলো রেকর্ড করেন। ঐ রেকর্ডে সুপারভাইজারকে বলতে শুনা গেছে “সব স্টোরেই এগুলো হয়ে থাকে। তুমি কি মনে কর এগুলো আর কেউ করছে না?”
সিবিসির পক্ষ থেকে এ বিষয়টি সম্পর্কে লবলজের মতামত জানতে চাওয়া হলে সিনিয়র ডিরেক্টর জোহানি হেরোক্স বলেন, “আমরা সর্বদাই চেষ্টা করি আমাদের পন্যের মান ও নিরাপত্তা সর্বোচ্চ মানে বজায় রাখতে। এ ব্যাপারে আমাদের নীতি অত্যন্ত কঠোর। মন্ট্রিয়লের নির্দিষ্ট একটি স্টোর সম্পর্কে যে অনিয়মের অভিযোগ আমরা জানতে পেরেছি সে ব্যাপারে আমরা তাৎক্ষনিকভাবে তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তদন্ত শেষে আমরা এই ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবো।”
লবলজের পক্ষ থেকে সিনিয়র ডিরক্টর যে বক্তব্য প্রদান করেছেন সেটি একটি ফরমালিটিজ। এরকম ক্ষেত্রে সব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা মালিকের প্রতিনিধিগণ একই বক্তব্য দিবেন। তদের বক্তব্যে ভাষাও হুবহু একই রকম হবে। কিন্তু কথা হলো, একটি নামজাদা প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার লেভেলের একজন কর্মকর্তা এ জাতীয় অপকর্ম বা জালিয়াতি করবেন কেন বা কি উদ্দেশ্যে? এ ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত স্বার্থইবা কি? বিষয়টি জানাজানি হলে একটি প্রতিষ্ঠানের সুনাম কতটা ক্ষুন্ন হবে সেটা কি একজন সুপারভাইজার জানেন না? নিশ্চই জানেন। যে লোক সুপারভাইজার লেভেলে প্রমোশন বা নিয়োগ পান তার কিছু না কিছু গুনাবলী অবশ্যই থাকে। তিনি জ্ঞানত এ ধরনের কাজ করতে পারেন না। তাহলে কি ধরে নেয়া যায় যে মালিকপক্ষের অঘোষিত নীতি বাস্তাবায়ন করতে গিয়েই তারা এ জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহন করে থাকেন?
মন্ট্রিয়লের আলোচিত সেই লবলজের সুপারভাইজার বেস্ট বিফোর ডেট সম্পর্কে যা বলেছেন তা কিন্তু রাগের মাথায় বলেননি বা মোহাম্মদ সাফারিকে ভয় দেখানোর জন্যও বলেন নি। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ঐ কথাগুলো বলেছেন। তার ঐ কথার প্রতিফন আমরা দেখতে পাই সিবিসির রিপোর্ট থেকেই। ঐ রিপোর্টে মোহাম্মদ সাফারি একাই নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আরো অনেকেই বলেছেন তাদের অভিজ্ঞাতার কথা যেখানে ফুটে উঠেছে কি ভাবে এবং কি কৌশলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেস্ট বিফোর ডেটের তারিখ নিয়ে জালিয়াতি করা হয়। নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তাদের অনেকেই জানিয়েছেন মাংস, চীজ, কেকসহ আরো নানান রকম পণ্যের বেলায় কি কৌশলে এই জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়।
কেউ কেউ জানিয়েছেন যে সকল প্যাকেটজাত মাংসের বেস্ট বিফোর ডেট উত্তীর্ণ হয়ে যায় সেগুলো আচার বা টক জাতীয় (সস) দ্রব্য দিয়ে মেরিনেট করা হয় দুর্গন্ধ দূর করার জন্য। আবার পুরাতন মাংসের সঙ্গে কিছু নতুন মাংস মিশিয়ে কিমা তৈরী করা হয়। এতে করে পুরাতন মাংস পার পেয়ে যায়। অর্থাৎ গ্রাহক বুঝতে পারেন না যে তিনি নতুন মাংসের সঙ্গে পুরাতন মাংসও কিনছেন। আবার এমনো অভিযোগ রয়েছে যে, খাদ্যের যে অংশে ছত্রাক বা ছাতা জন্মায় সে অংশ কেটে বাকী অংশ বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা হয়। কেউ কেউ জানিয়েছেন দোকানে সাজিয়ে রাখা মাংস কয়েকদিন পার হয়ে গেলে যখন বাদামী রং ধরে তখন সেগুলো রক্তের মধ্যে চুবিয়ে লাল করে আবার শোকেসে সাজিয়ে রাখা হয়। এতে করে পুরানো মাংস আবার টাটকা বা তাজা লাগে দেখতে। আর এগুলোর প্রায় সব ক্ষেত্রেই বেস্ট বিফোর ডেট পরিবর্তন করা হয়।
রেডিও কানাডার এক অনুসন্ধানী রিপোর্টেও বেস্ট বিফোর ডেট নিয়ে যে জালিয়াতি হয়ে থাকে তা ধরা পড়েছে গোপন ক্যামেরাতে। ঐ অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা যায়, পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মন্ট্রিয়লের একটি আইজিএ স্টোরের এক কর্মী জানান – প্রতিদিন সকালে ঐ গ্রোসারী খোলার আগেই শেলফ থেকে প্যাকেটজাত মাংস সরিয়ে নিয়ে নতুন করে প্যাকেট করা হয় এবং বেস্ট বিফোর ডেট উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া মাংসের প্যাকেটে নতুন করে তারিখ বসানো হয়।
আরেক গ্রোসারীর এক কর্মী জানান, শুধু আইজিএ এমনটি করে তা নয়। অন্যান্য অনেক গ্রোসারীই এই কাজটি করে থাকে। তিনিও পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, আমি আমার কর্ম জীবনে যে কটি গ্রোসারীতে কাজ করেছি তার সবকটিতেই দেখেছি এই অনৈতিক পদ্ধতিটি চালু রয়েছে।
কানাডার আইনে প্যাকেটকৃত মাংসের মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য রিপ্যাকেট করা আইনবিরুদ্ধ কাজ। প্যাকেটের গায়ে অরিজিন্যাল বেস্ট বিফোর ডেট থাকতে হবে। সেটি পরিবর্তন করা যাবে না। আর কুইবেকের মিনিষ্ট্রি অব এগ্রিকালচার, ফিশারিজ এ্যান্ড ফুড এর রিকমেন্ডেশন হলো, প্যাকেটজাত মাংস দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে কনজ্যুম করতে হবে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সাইন্টিফিক রিসার্সের অধ্যাপক মনিক ল্যাকরইস্ক রেডিও কানাডার প্রতিনিধিকে বলেন, রিপ্যাকেট করা বা বেস্ট বিফোর ডেট পরিবর্তন করার মধ্যে বিপদ হলো মাংসের মধ্যে বিরজমান ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া। এই ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া কখনো কখনো মাংসের মধ্যে অধিকমাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন এই মাংস যদি যথাযথভাবে রান্না না করে খাওয়া হয় তাহলে ফুড পয়জনিং হতে পারে।
কুইবেকের মিনিষ্ট্রি অব এগ্রিকালচার, ফিশারিজ এ্যান্ড ফুড এর পক্ষ থেকে বলা হয়, “ এটি খুবই পরিতাপের বিষয় যে কোন কোন প্রতিষ্ঠান মাংসের
প্যাকেটে রিলেবেলিং করে থাকে। আর এই অনৈতিক কাজটি সনাক্ত করাও সহজ কাজ নয়।”
খাবারের প্যাকেটের গায়ে লেখা বেস্ট বিফোর ডেট নিয়ে আমাদের একেকজনের মধ্যে একেক রকম ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। কেউ মনে করেন নির্দিষ্ট ঐ ডেটের পর খাবার ফেলে দেওয়া উচিৎ। কেউ মনে করেন ডেট পার হয়ে যাওয়ার পরও কিছু কিছু খাবার খাওয়া যেতে পারে। আবার কেউ কেউ আছেন এগুলো নিয়ে মোটেও মাথা ঘামান না। তাছাড়া বাজারে অনেক খাবার আছে যেগুলোর প্যাকেটের গায়ে বেস্ট বিফোর ডেট এবং এক্সপায়ারী ডেট লেখা থাকে না। আবার কিছু কিছু খাবারের প্যাকেটের গায়ে বেস্ট বিফোর ডেট এমনভাবে লেখা থাকে যে সেগুলো বিভ্রান্তকর বা গোমেলে ঠেকে অনেকের কাছে। আবার কোন কোন খাবারের প্যাকেটের গায়ে শুধু লেখা থাকে কবে প্যাকেট করা হয়েছে সেই তারিখ।
তবে ক্রেতাদের উচিত বিশেষ কতগুলো খাবার যেমন চীজ, রুটি, প্যাকেটজাত মাংস, দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদি ক্রয় করার আগে বেস্ট বিফোর ডেট বা এক্সপায়ারী ডেট পরীক্ষা করা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই বেস্ট বিফোর ডেট বা এক্সপায়ারী ডেট মূলত কি অর্থ প্রকাশ করে? এ দুটির মধ্যে পার্থক্য কি বা এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? এই তারিখ অনুসরণ না করলে কি বিপদ হতে পারে?
প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, বেস্ট বিফোর ডেট এবং এক্সপায়ারী ডেট এক জিনিষ নয়। এটি নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে।
কানাডার আইন অনুযায়ী যে সকল খাদ্য ৯০ দিন বা তারো কম সময়ের জন্য তাজা থাকবে সেগুলোর প্যাকেটের গায়ে বেস্ট বিফোর ডেট থাকতে হবে। প্যাকেটজাত মাছ ও মাংসের ফালি, ডিম, ক্যান সুপ, সবধরণের প্যাকেটজাত ফ্রীজড আইটেম ও কাঁচা পন্যের প্যাকেটের গায়ে বেস্ট বিফোর ডেট লেখা থাকে। এই বেস্ট বিফোর ডেটের সঙ্গে এক্সপায়ারী ডেটের কোন সম্পর্ক নেই।
বেস্ট বিফোর ডেট এবং এক্সপায়ারী ডেটের মধ্যে পার্থক্য:
বেস্ট বিফোর ডেট এর সঙ্গে খাবারের সেফটি বা নিরাপত্তার কোন সম্পর্ক নেই। এই ডেট এর সম্পর্ক খাবারের স্বাদের সঙ্গে। প্রতিটি খাবারের নিজস্ব একটি স্বাদ আছে। খাবার প্রস্তুতের পর সেই স্বাদ কতদিন বজায় থাকবে সেটিই বলা হয় বেস্ট বিফোর ডেটে। অর্থাৎ বেস্ট বিফোর ডেট পার হয়ে গেলে প্যাকেটজাত ঐ খাবারের আসল স্বাদটুকু নাও পাওয়া যেতে পারে। এর সঙ্গে আরো নির্ভর করে খাবারের জন্য প্যাকেটটি কবে খোলা হয়েছে এবং তার আগে সেটি ঠিকমত স্টোর করা ছিল কিনা অর্থাৎ ঘরে দোকানে বা রেস্টুরেন্টে কোন তাপমাত্রায় রাখা হয়েছিল। আর কিছু কিছু খাবার বেস্ট বিফোর ডেট পার হয়ে গেলেও খাওয়া যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রেও দ্বিমত রয়েছে। বেস্ট বিফোর ডেট পার হয়ে গেলেও সব খাবার যে নিরাপদ সেটি মনে করে না হেলথ কানাডা। সরকারের এই সংস্থাটি মনে করে কোন খাবারের বেস্ট বিফোর ডেট পার হয়ে গেলে সেটি না খাওয়াই উচিৎ। তাদের মতে বেস্ট বিফোর ডেট পার হয়ে যাওয়ার পর কোন কোন খাবারের গন্ধ ও স্বাদ মনে হতে পারে ঠিক রয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সেটি নিরাপদ। এক্ষেত্রে নিজের বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু কানাডা ফুড ইন্সপেকশন এজেন্সি এ ব্যাপারে কিছুটা নমনিয়।
তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত হলো বেস্ট বিফোর ডেট পার হয়ে যাওয়া কোন খাবার সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে সেটি ফেলে দেওয়া। মনে রাখতে হবে কোন খাবারের রং বা বর্ণ যখন বদলে যায় বা বাহ্যিক রূপটা পরিবর্তন হয়ে যায় অথবা খারাপ গন্ধ বের হতে থাকে তখন সেটি খাওয়া মোটেও নিরাপদ নয়।
অন্যদিকে এক্সপায়ারী ডেট এর সঙ্গে খাদ্যের সেফটি বা নিরাপত্তা সম্পর্কিত। যে সকল খাদ্যের প্যাকেটে এক্সপায়ারী ডেট লেখা থাকে সে সকল খাবার ঐ নির্ধারিত ডেট পার হয়ে গেলে আর খাওয়া যাবে না। কানাডিয়ান ফুড ইন্সপেকশন এজেন্সির অনুশাসন হলো, পাঁচ ধরণের খাবারে প্যাকেটের গায়ে এক্সপায়ারী ডেট লেখা থাকতে হবে। এই খাবারগুলো হলো : –
– বেবী ফরমুলা এবং মাতৃদুগ্ধের বিকল্প অন্যান্য খাবার।
– নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্টস (উদাহরণ- মাল্টি ভিটামিন, মিনারেলস ইত্যাদি)।
– মিল রিপ্লেসমেন্ট (উদাহরণ – এনশিওর)।
– ডাক্তারের পরামর্শে ফার্মেসীতে বিক্রি হয় এমন খুব লো-এনার্জি ডায়েট (উদাহরণ – এনার্জি ডায়েট পিল)।
– ফরমুলেটেড লিকুইড ডায়েটস (উদাহরণ – কোন খাবার যেগুলো তরল আকারে বিক্রি হয়ে থাকে যেমন বুস্ট)।
তথ্য সূত্র : কানাডিয়ান ফুড ইন্সপেকশন এসেন্সি।
পরিশেষে বলা যায় দোকান থেকে রেডিমেড বা তৈরী খাবার কিংবা প্যাকেটজাত কাঁচা খাবার কিনতে গেলে একটু সতর্কতা অবলম্বন করাই শ্রেয়। কানাডার মতো এরকম একটি উন্নত দেশে থাকি বলে যে এখানকার সবকিছুই বিনা প্রশ্নে বা বিনা সন্দেহে মেনে নিতে হবে তার কোন যৌক্তিকতা নেই। আমরা উপরে দেখেছি বিশাল এবং স্বনামধণ্য কোন কোন প্রতিষ্ঠানেও কিছু অনিয়ম ঘটে। কোথাও ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হয় আবার কোথাও কোথাও কিছু অসাধু কর্মকর্তার অসৎ আচরণের কারনেও খাদ্যের মান ও নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে যা গ্রাহকের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয় এবং ক্ষেত্রবিশেষ নিরাপদও নয়।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কন্ঠ