বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের প্রতি আমরা কতোটা সদয়
প্রবাসে আসা আমাদের বাবা-মায়েরা নিগ্রহের শিকার যেন না হন
ডিসেম্বর ২০, ২০১৫
সেরীন ফেরদৌস
[বাংলাদেশ সেন্টার এন্ড কমিউনিটি সার্ভিসেস (বিসিসিএস) টরন্টোতে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটি সদস্যদের মধ্যে এল্ডার এবিউজ সম্পর্কিত সচেনতা বৃদ্ধির লক্ষে একটি প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছে। তারই ৭ম অংশ আজকের এই প্রবন্ধ। বিসিসিএস এভাবে আরও ৩টি প্রবন্ধ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করবে। সবাইকে প্রবন্ধগুলো পড়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।]
শীতের সকাল। বৃদ্ধ বাবা আর তরুণ ছেলে সকালের রোদে বাড়ির সামনের লনে বসে আছে। ছেলের মুখের উপর সেদিনের তরতাজা পত্রিকা। গভীর মনোযোগ দিয়ে সে পত্রিকা পড়ছে। বাবা তাকিয়ে আছে সামনের ঘাসের উপর নেচে বেড়ানো একটি পাখির দিকে। পাখিটির কি নাম বোঝার চেষ্টা করছে বহুক্ষণ ধরে। এক পর্যায়ে ছেলের কাছে জানতে চায়, “বাবা, এ পাখিটার নাম কি?” ছেলে পত্রিকা থেকে চোখ নামিয়ে বিরক্তিভরে জবাব দেয়, চড়ুই পাখি। বাবা এমন চড়ুইপাখি আগে দেখেননি। তাই খানিকটা সন্দিহান হয়ে কিছুক্ষণ পরে আবারো জানতে চান, এটা কি পাখি? ছেলে যে ভঙ্গিতে পত্রিকা বন্ধ করলো তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে। সে অবজ্ঞাভরে উত্তর দেয়, বলেছি তো এটা একটা চড়ুই। বৃদ্ধ বাবার বৃদ্ধ চোখে তাও সে বুঝতে পারে না তার ছেলে ঠিক বলছে কি না অথবা তার ছেলে ভালো করে পাখিটার দিকে তাকিয়েই উত্তরটা দিচ্ছে কি না। কিছুক্ষণ আবারো সময় নিয়ে তিনি জানতে চান, বাবা, ভালো করে দেখে বলতো এটা চড়ুই-ই কি না। ব্যাস, আর যায় কোথা! যথেষ্ট হয়েছে! ছেলের মেজাজ একলাফে তুঙ্গে উঠে যায়! তা প্রকাশ করতে হাতের পত্রিকা দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দিয়ে বাবার প্রতি চিতকার করে ওঠে, “তোমাকে একশো বার বলেছি এটা একটা চড়ুই পাখি, তারপরও সেই থেকে প্রশ্ন করেই চলেছো? পেপারটাও ঠিকমতো পড়তে দিচ্ছো না। যত্তোসব! সকালবেলার মুডটাই মাটি করে দিলে!”
বাবা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর ছেলের পাশ থেকে ধীরে ধীরে উঠে চলে যায় বাড়ির ভেতর। ছেলে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে হাত-পা ছড়িয়ে পত্রিকায় মনোযোগ দেয়। কিছুক্ষণ পরেই বাড়ির ভেতর থেকে বাবা বেরিয়ে আসে। তার হাতে একটা পুরোনো ডায়েরি, রং-চটা। কোনো কথা না বলে ডায়রিটির একটি পাতা খুঁজে বের করে ছেলের চোখের উপর তুলে ধরেন তিনি। ছেলে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও সেখানে চোখ বুলায়। পচিঁশ বছর আগের তারিখ সেখানে। ছোট ছোট হাতের লেখায় বাবা ভরে তুলেছেন ডায়রির পাতা। “…আজ আমি আমার ছোট্ট বাবাসোনাকে নিয়ে মাঠে গিয়েছিলাম। মাঠের কোণার গাছের ডালে একটি পাখির বাসা দেখিয়ে সে জানতে চায়, এটা কিসের বাসা বাবা। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে তার ছোট্ট গালে চুমু দিয়ে বলি, এটা একটা পাখির বাসা। তারপরও তার মনের কৌতুহল কিছুতেই মেটেনা। একই প্রশ্ন সে আমাকে প্রায় তিরিশ থেকে চল্লিশবার করে। তাকে নিরাশ না করে এই চল্লিশবারই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে উত্তর দেই, এটা একটা পাখির বাসা, ছোট্টসোনা।…“
অনলাইনে বহুল প্রচার পাওয়া একটি ভিডিওচিত্রের বিবরন এটি। ভিডিও চিত্রটি ঠিক এখানেই শেষ হয়ে যায় নি। পাঠক, আপনারা অনুমান করতে পারছেন এ লেখা পড়ার পর ছেলের মনোভাব কি হতে পারে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ডায়রি হাতে নিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরে তরুণ ছেলেটি। বারবার ক্ষমা চায় তার রাগী ব্যবহারের জন্য। ভিডিওচিত্রের এই পর্যায়ে চোখে পানি ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পরে দর্শকের। আজ, এই মুহূর্তে আর মনে করতে পারছি না ভিডিওটি করা হয়েছিলো ঠিক কি উ্দ্দেশ্যে। কাহিনীর মূল মানবিক আবেদনটুকুই শুধু মনে আছে। যেকথা লিখতে এ গল্পের অবতারনা, তা ইতিমধ্যেই খানিকটা প্রকাশ করে ফেলেছি বলা চলে। হ্যাঁ, আমার এ লেখার বিষয়বস্তু বৃদ্ধদের প্রতি আমাদের অবহেলামূলক আচরণ যা অনেক সময়ই আমরা বুঝতে পারি না যে এটাও এক ধরনের নির্যাতন তাদের প্রতি। এই না-বুঝতে পারার জায়গাটির নাম মানসিক নির্যাতন যেটার দিকে অঙ্গুলি হেলনই বোধকরি ভিডিওচিত্রটির নির্মাতার উদ্দেশ্য ছিলো।
ফিরে আসি প্রসঙ্গে, কানাডার পটভূমিতে এবং বাঙালি কমিউনিটির আঙ্গিকে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রতি অবহেলার বিষয়টি কানাডিয়ান মূলধারার সোসাইটিতে বিস্তারিতভাবে আলোচনায় উঠে এসেছে, তা খুব বেশিদিনের কথা নয়। সঙ্গতকারণেই, বাঙালি কমিউনিটিতেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো আলোচনা হবার কথা নয়। অনেক দিন আগে ড: মীজান রহমানের একটি লেখা পড়েছিলাম ইমিগ্র্যান্ট পরিবারগুলোতে বেড়াতে আসা বাবা-মায়েদের প্রতি উপেক্ষা-অবহেলা নিয়ে। তিনি দু’একটি কেস-স্টাডি নিয়ে আলোচনা করে বলতে চেয়েছিলেন যে, বাবা-মায়েদের যেন আমরা আমাদের সুবিধার জন্য বিদেশ-বিভূঁইয়ে এনে আদরের চেয়ে অত্যাচার বেশি না করি। আমরা যেন নিজের স্ট্যাটাস বজায় রাখতে গিয়ে পরিবারের ভেতর তাঁদের স্ট্যাটাসের বারোটা না বাজাই। তাঁদের চিকিতসা, ভাষার সীমাবদ্ধতা, নতুন পরিবেশের অস্বস্তি, খাবারের ভিন্নতা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো যেন আমাদের বিবেচনার ভেতরে থাকে। তাঁরা যেন শুধুই আমাদের সন্তান পালনের অথবা কন্যা-পুত্রের বাসার রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত হতে এখানে না আসেন। এ প্রসঙ্গে একটি জানা গল্প বলি। এক মাকে বাংলাদেশ থেকে আনা হয়েছে বেড়ানোর নাম করে। তাঁর কন্যা এবং পুত্র উভয়েই কানাডায় থাকেন। কন্যার স্বামী বাংলাদেশী কিন্তু পুত্রের স্ত্রী এদেশীয়। এই মা’টিকে সামারের প্রায় দিনই দেখা যায় বিকেলে দিকে তিন নাতি-নাতনিকে নিয়ে মাঠে আসেন। সবচেয়ে ছোটটির বয়স মাত্র এক কি দুই, সেটার পিছনে হন্যে হয়ে তিনি ছুটে বেড়ান প্রতিটি বিকেল। প্রায়শ:ই তিনি মনমরা হয়ে থাকেন। অত:পর একদিন সতীর্থ একজনের সঙ্গে গল্পচ্ছলে তিনি জানান, তিনি কন্যার বাসায় থাকার চেয়ে পুত্রের বাসায় থাকতে বেশি পছন্দ করেন যদিও পুত্রবধুর ভাষা তিনি বুঝতে পারেন না। কারণ হিসেবে তিনি জানান যে, পুত্রবধু অফিস থেকে এসে শাশুড়িকে বলেন যে, আপনি তো সারাদিন একা একা বাসায় ছিলেন, বাচ্চাদেরও দেখাশোনা করেছেন, খুব খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই, এখন আপনি আপনার ইচ্ছেমতো বাইরে ঘুরে আসতে পারেন বা কোথাও যেতে চাইলে আমরা নিয়ে যেতে পারি। আর কন্যার বাসায় কন্যা ডে-কেয়ার থেকে বাচ্চা ছাড়িয়ে মায়ের উপরই ফেলে রেখে অফিসে তো যানই, উপরন্তু, অফিস থেকে ফিরেই নিজে রেস্ট নিতে বিছানায় শুয়ে পরেন মাকে বাচ্চাসহ মাঠে পাঠিয়ে দিয়ে। তার উপর কন্যার নিত্য আবদার থাকে নানাপদের দেশীরান্না মা যেন রান্না করে খাওয়ান। এ উদাহরণের পর আর কি বলার দরকার আছে নিগ্রহের রকমফের কি!
শুধু পরিবারের ভেতরই নয়, বৃদ্ধদের প্রতি রাষ্ট্রও বৈষম্যমূলক ব্যবহার করে থাকে যা নজরে আনার দরকার আছে বলে মনে করি। এমন ঘটনা বিরল নয় যে, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় বেড়াতে আসা বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা নানারকম সরকারি ব্যবস্থার অপ্রতুলতাবিষয়ক নির্যাতনের শিকার হন।
বৃদ্ধদের প্রতি নির্যাতন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা একেবারেই নতুন বিধায় আমাদের এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও সচেতনতা বাড়ানোর দরকার আছে। রেজিস্টার্ড নার্সেস এসোসিয়েশন অব অন্টারিও এ ব্যাপারে তাদের গবেষণামূলক গাইডলাইন প্রকাশ করেছে ওয়েবসাইটে (http://rnao.ca/bpg/initiatives/abuse-and-neglect-older-adults-pan-canadian-best-practice-guideline-initiative). সেখানে বৃদ্ধদের নির্যাতনকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে যে, এমন কোনো আচরণ বা কটুক্তি অথবা অবহেলা যদি বৃদ্ধদের প্রতি করা হয় যেখানে তাঁদের বিশ্বাসের প্রতি আমাদের অবমাননা প্রকাশ পায়, তবে তার নামই বৃদ্ধ-নির্যাতন। নির্যাতনের নানা ধরনের মধ্যে পরে শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, টাকা-পয়সাসংক্রান্ত নির্যাতন, সরকারি সিস্টেমের নির্যাতন, ধর্মীয় অনুভূতির আঘাত ইত্যাদি। অনেক সময় বৃদ্ধরা নিজেরাও নিজেদের প্রতি অবহেলা দেখিয়ে থাকেন অথবা তাঁরা ধরেই নেন যে, জীবনের বাদবাকি সময়টা উপভোগের যোগ্য তাঁরা নন। বৃদ্ধদের যত্ন নেবার জন্য তাই এই নানারকম ধারনাগুলো নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে বলেই মনে হয়।
কানাডায় বেড়াতে আসা অথবা প্রবাসী সন্তানের সঙ্গে জীবনের শেষদিনগুলো পার করতে আসা বাবা-মায়েরা কতটুকু ভালো আছেন বা তাঁরা যতটুকু সুখের কল্পনা করছেন সেই সুখটুকু পাচ্ছেন কি না অথবা নানা উপায়ে তাঁরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন কি না তা বুঝতে হলে আরো একটু গভীরে চিন্তা করতে হবে। তার আগে বলা দরকার কিভাবে বুঝতে পারি যে বৃদ্ধরা নিগৃহীত হচ্ছেন? সবচেয়ে প্রধান ও বড় কারণ হচ্ছে তাঁরা নানাভাবে অবহেলার শিকার হন। শারীরিক পরিবর্তন যেমন হঠাত পরে গিয়ে জখম হওয়া, ভুল ওষুধ খেয়ে ফেলা, পরিবারের ভেতর কোনো অ্যাক্সিডেন্টের শিকার হওয়া এগুলো যেমন বড় আকারের অবহেলার শিকার তেমনি ছোট আকারের অবহেলাও রয়েছে। যেমন, তাদেঁর নানা বিষয়ে দেখা যায়, তাঁদের মতামত আর গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না পরিবারের সদস্যরা। তাদের চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দু:খ প্রতিনিয়তই অগ্রাহ্য হতে থাকে। উদাহরণ দিলে বিষয়টি একটু পরিষ্কার হতে পারে। যেমন, সকালবেলার খাবারের টেবিলে বাবা-মায়ের প্লেটে খাবার তুলে দেবার সময় আমরা যদি ধৈর্য্য নিয়ে জানতে না চাই যে তিনি কি খেতে পছন্দ করেন, যদি ধরেই নেই যে তিনি আমি যা খাচ্ছি তাই খেতে পছন্দ করবেন, এবং সে অনুযায়ী আমি তাকেঁ প্রতিদিনই তাই খেতে দিই, তাহলে তিনি অবশ্যই অবহেলার শিকার হলেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি যেহেতু আমাদের উপর নির্ভরশীল, তিনি যেহেতু নানারকম চুক্তির ভেতরে আঁটোসাটো হয়ে বিদেশে এসেছেন, তিনি যেহেতু এদেশের নিয়মকানুন জানেন না, ইংরেজি বলতে পারেন না ভালো, তাই তাঁকে আমাদের খেয়ালখুশি মতোই চলতে হবে, এই ধারনাই তো অমানবিক। কমিউনিটির ভেতরে পত্রিকার সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে জেনেছি, কিছু কিছু পরিবার কানাডা সরকারের যথাযথ নিয়ম না মেনে, হেলথ ইন্সুরেন্স-এ জালিয়াতি করে পিতা-মাতাকে নিয়ে আসেন। তারা ধরে নেন, বাবা-মায়েরা হয়তো অসুস্থ হবেনই না, তাহলে মিছেমিছি ইন্সুরেন্সের টাকা খরচ করে কি লাভ? কিন্তু খরচ কমানোর এই প্রক্রিয়ায় অপরাধ হয় দুটো। এক. কানাডা সরকারের আইন অমান্য, আর দুই. বাবা-মায়েরা হয়ে যান গাফিলতির শিকার। তাঁরা অসুস্থ হলেও চেপে যান সন্তানের কথা ভেবে অথবা সন্তান অসুখ চাপাতে চাপ দেন, ঘরে বসে উল্টা-পাল্টা ওষুধ কিনে খাওয়ান ইত্যাদি ইত্যাদি।
বৃদ্ধদের প্রতি যে অবহেলা করা হচ্ছে সেটা বুঝতে পারাটাই একটা প্রধান কাজ। যদিও কমিউনিটি, স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে এবং মানসিক মানদন্ডে নানারকম উপকরণ ব্যবহার করার উপায় আছে নিগ্রহের ধরণ ও তীব্রতা বোঝার জন্য, তারপরও সাধারনের চোখ দিয়ে নয়, আমরা যদি বৃদ্ধদের তাঁদের মতো করে দেখার চোখ দিয়ে দেখতে পারি, তাহলে অনেকভাবেই বুঝতে পারবো কোনটা নিগ্রহ আর কোনটা নিগ্রহ নয়।
বৃদ্ধদের প্রতি নিগ্রহের নানা প্রকারের মধ্যে রয়েছে শারীরিক নির্যাতন, অবহেলা এবং আর্থিক নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতন বোঝার উপায় হল যদি শরীরের নানা স্থানে জমাট রক্ত বা দাগ দেখা যায় যেগুলোর যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা নাই।অথবা অনেকে মিথ্যা করে দুর্ঘটনার নাম দেন এসব ক্ষতের। অনেক সময় তাঁরা আঘাতের জায়গাগুলো ঢেকে রাখতেই ততপর থাকেন যাতে সামাজিকভাবে তাঁদের সন্তানদের সম্মানের হানি না হয় বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে না হয়। আবার স্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থা অর্থাত দুর্বলতা, ওজন কমে যাওয়া, ক্রমাগত অসুস্থ থাকা, অপুষ্টি, রুচি কমে যাওয়া ইত্যাদি খাবার-দাবারের ব্যাপারে তাঁদের প্রতি অবহেলার ইঙ্গিত দেয়। অনেকের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলোচনা করলেই বেরিয়ে আসে তাঁদের দুর্দশার কাহিনী। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিদেশ সম্পর্কে তাঁদের মোহভঙ্গের গল্প। তাঁরা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে থাকেন যে, কি ভেবে এসেছিলেন আর কি দেখছেন। এমনও গল্প শোনা যায় যে, তাঁদেরকে আনার আগে বিদেশ সম্পর্কে নানারকম ইলিউশন তৈরি করে থাকে সন্তানেরা। দেশের চেয়ে কত আরামে তাঁরা থাকবে তার বিস্তারিত ফর্দ তুলে ধরে ছেলেমেয়েরা। তাঁরা সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাসপোর্ট হাতে প্লেনের সিঁড়িতে পা রাখেন দেশ ছাড়বেন বলে। এখানে আসার পরপর সেই স্বপ্ন উবে যেতে সময় নেয় না বরং ফিরে যাবার ব্যাপারে অনেক সময় তাঁদের উপর বড় ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করা হয়। এগুলো অতি অবশ্যই মানসির প্রতারণার অংশ। কেউ কেউ পিতামাতাকে আর্থিকভাবে দেউলিয়া করতে পিছ-পা হন না। এসব পিতামাতার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট থেকে মোটা অংকের টাকা বেরিয়ে যায় সন্তানের চাপে। এমনও দু’একটি ঘটনা বিরল নয় যে, নানারকম অশান্তির চাপে বাবা-মা সামাজিকভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেন এবং অবসাদ(ডিপ্রেশন), ভয় আর আতংকে সময় পার করছেন। দৈনন্দিন কাজে তাঁরা অনীহা বোধ করেন, একই কথা বারবার বলেন, অথবা পোশাক-আশাকে অবিন্যস্ত হয়ে থাকেন। জীবন সম্পর্কে যাবতীয় আগ্রহ কমে যেতে পারে এইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিজের অথবা অন্যের ক্ষতিও করে বসতে পারেন এঁরা। সার্বিকভাবে এই ধরনের উপসর্গগুলো এড়িয়ে চলার চেয়ে মোকাবেলা করলে আমরা সম্ভবত আমাদের বৃদ্ধদের প্রতি ন্যয়বিচার করতে পারবো।
কথা উঠতে পারে কিভাবে ন্যয়বিচার করা যেতে পারে? এজন্যে প্রথমে দরকার নিগ্রহ যে হচ্ছে, সেই কথাটি স্বীকার করার প্রবণতা। তারপর দরকার সচেতনতা বা সেনসিটিভিটি বাড়ানো। এ যেন বিশেষ কোনো লেণ্সের ভেতর দিয়ে তাদেঁরকে বোঝার চেষ্টা করা। আমরা সবাই জানি, বৃদ্ধদের পায়খানা-প্রস্রাব করার সুবিধা-অসুবিধা শিশুদের মতোই প্রায়। যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। তাই ওয়াশরুমের সুবিধাজনক বন্দোবস্তই হতে পারে তাদেঁর প্রতি সেনসিটিভ আচরনের একটি উদাহরণ। নানা অসুখ-বিসুখ তাদেরকে অবশ্যই নানাভাবে আমাদের উপর নির্ভরশীল করে তোলে। বিশেষ করে ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমারে আক্রান্ত বৃদ্ধরা প্রায়শ:ই অসুখটি সম্পর্কে আমাদের কম জানার সুবাদে নানা নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। তাঁরা বিশেষ করে নানাকরম কটুক্তির শিকার হতে পারেন সহজেই ভুল বোঝাবুঝির কারণে। বস্তুত: এসব আক্রান্ত বৃদ্ধদের যত্ন নেয়াও চাট্টিখানি কথা নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকারিভাবে নানারকম সাপোর্ট আছে সেগুলোও ব্যবহার করা যেতে পারে। কাজেই, বৃদ্ধদের নিগ্রহের ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে তাঁদের প্রতি অবহেলার ধরন-ধারনগুলো কেমন। প্রতিটি কমিউনিটিরই একেকটা নিজস্ব ধরণ-ধারন থাকে, থাকে নিজস্ব বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি আর অভ্যাস । কাজেই, সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই বৃদ্ধদের সমস্যা নিয়ে আমাদের আগাতে হবে। আমাদের বুঝতে পারতে হবে কোন কোন পদক্ষেপগুলো বা আচরণগুলো আমরা তাদেঁর সাথে করতে পারি, কোন কোনগুলো পারি না। পাশাপাশি আইনি সচেতনতাও বিরাট ব্যাপার অন্তত: কানাডার পরিবেশে। মানবাধিকারের দেশ কানাডা, আমাদের নিজেদেরকে সবসময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, বৃদ্ধদের অধিকার মানবাধিকার তা তিনি আমার যতো কাছের মানুষই হন না কেন! যেখানে, যখনই দেখা যাবে বা বোঝা যাবে যে বৃদ্ধরা অবহেলার শিকার হচ্ছেন, তখনই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা বা হস্তক্ষেপের দরকার আছে। কমিউনিটির স্বার্থেই বিষয়টি জরুরি। কারণ, পরিবারের ভেতর বৃদ্ধদের সম্মান করার, কটুক্তি না করার, যত্ন নেবার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলে তা আমাদেরকে আরো একধাপ সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।