সে যে মা
মার্চ ৯, ২০১৫
উ. কমান্ডার আব্দুল জলিল (অব:)
যোজন যোজন মাইল দূর থেকে মা’র কাছে যাওয়া সর্বদাই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
সদ্য নব্বুই ছুঁই ছুঁই মার অপারেশন হয়েছে। তিনি অচল অবস্থায় তাঁর ছোট কন্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের অধ্যাপক ড. আফরোজার বাসায় সুস্থ হবার অপেক্ষায়। এ বয়সে সুস্থ হওয়া সময় সাপেক্ষ। তাঁর সেবা চলছে দিন রাত। তাঁর পাশে তাঁর মেয়েরা, ছেলের বউরা, নাতি-নাতনী ও কাজের লোক সবাই সেবায় ব্যস্ত। ইতিমধ্যে অমি গিয়ে মা’র কাছে হাজির হলাম। আমাকে কাছে পেয়েই তাঁর প্রশ্ন, কবে তাঁকে আমি গ্রামের বাড়ী পৌঁছে দিতে পারবো।
আমার মা গ্রামের মানুষ। জন্ম, বড় হওয়া, বিয়ে, সংসার সবই গ্রামে। গ্রামের মুক্ত হাওয়া ও মাটির কাছে থাকা তাঁর বরাবরই পছন্দ। আমার বোনের বাসায় আধুনিক জগতের সকল সুবিধা পাওয়া, খাওয়া-দাওয়া এসব কিছুই তাঁকে তাঁর গ্রামের কথা ভুলিয়ে দিতে পারেনি। সকলের সামনে সর্বদা বলে থাকেন – অপরের বাড়ী কতদিন থাকা যায়?
যে মা নিজে থেকে উঠতে, বসতে, চলতে পারছেন না তাঁকে সেবা দিয়ে সুস্থ করা প্রয়োজন। আমার সামনে দেখতে পেলাম বাংলাদেশী এক মায়ের নজীরবিহীন সেবা। এটি দেখে অনুধাবন করা যায় কিন্তু লেখায় প্রকাশ করা দুরূহ। কিন্তু এত সেবা পেয়েও মা খুশি নন। তাঁকে গ্রামের বাড়ী কেন নেয়া হচ্ছে না এটাই তাঁর ক্ষোভ। প্রায় সময়ই চলে অনশনের হুমকী, ওষধ না খাওয়ার হুমকী ইত্যাদি। তাঁর চারপাশে থাকা মেয়েরা, ছেলের বউরা আপ্রাণ চেষ্টা করে করে খাবার পরিবেশন করতে। অনেক সেবার পরও মাকে স্যালাইন এবং রক্ত দিতে হয়। এদিকে মা’র একই হুমকী – তিনি সবকিছু খুলে ফেলবেন।
যথারীতি স্যালাইন ও রক্ত পর্যায়ক্রমে দেয়া হলো। মা’র হুমকির কারণে আমার বোনেরা ঠিক করলো যতক্ষণ স্যালাইন বা রক্ত দেয়া শেষ না হবে, ততক্ষণ পালা করে মা কে পাহাড়া দিতে হবে। যে কথা সেই কাজ। সবাই পালা করে পাহাড়া দিচ্ছেন। আমার বড় বোন রাত ২টা পর্যন্ত পাহাড়া দিলেন। এরপর আমার পালা। চলবে ভোর পর্যন্ত।
মা’র পাশে বসে আছি আর ভাবছি- এই আমার মা – আমি তাঁর বড় ছেলে। আর বড় সন্তানরা মায়েদের যে আদর যতœ পায়, আমিও পেয়েছি সমানভাবে। স্যালাইন খোলা থেকে কয়েকবার রক্ষা করার দায়িত্ব করতে পেরেছি। মা জানেন তখন গভীর রাত এবং আমি তাঁর পাশে বসে আছি। ক্ষণে ক্ষণে মা ঘুম থেকে জেগে উঠছেন এবং খাবার বা পানি চাচ্ছেন। এর পাশাপাশি প্রত্যেকবার বলছেন, বাবা তুই জেগে আছিস কেন, যা ঘুমিয়ে পড়। যে অবস্থায় এবং যে পরিবেশে মা কথাগুলো আমাকে বলছেন তাতে প্রথম আমার মনে এলো, “সে যে মা”।
মা’র বলার কি মমতা। বলার ভঙ্গি ও কন্ঠস্বর। স্বর্গীয় বাণীর মত তা অপূর্ব। একমাত্র মা-ই বলতে পারেন অমন করে- বাবা যা শুয়ে পর। আর বসে থাকিস না। অথচ সত্যই ঐ সময় মা’র সেবা প্রয়োজন। মা পাশ ফিরে জানালেন তিনি পানি পান করবেন। পানি দিতে পারলাম। পানি পান করেই আবার বলছেন, যা শুয়ে পড়। আবার পরমুহুর্তেই বলছেন পানি দে। একবার এমন হল, মা পানি পান করতে চাওয়ার পর আমাকে পাঁচ ফিটের মতো হাঁটতে হল পানি আনার জন্য। ফিরেই দেখি মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। এবার আমি সাবধান। পানি হাতের কাছে নিয়ে বসে আছি যাতে চাওয়ার সাথে সাথে তা দিতে পারি। এবং আমার ধারণা ঠিক হল, ক্ষণিকের মধ্যে মা জেগেই পানি চাইলেন। তৎক্ষনাত মা’র মুখে পানি দিতে পেরেছিলাম। সেই মুহুর্তটি ছিল এক পরম পাওয়া।
সে যে মা, এই অনুভূতি বারে বারে আমার হৃদয়ে বসে গিয়েছে। মা’র কাছে বসে আছি। দেখি মা কোন কথা বলছেন না কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কিছু বলতে চান কি না। মা বললেন, কিছু বলার নেই। পরমূহুর্তে বললেন, প্রাণভরে তিনি আমাকে দেখছেন। বিশেষ করে মা জানেন আমি আর কয়েকটা দিন পরে ফিরে যাব আমার বাসস্থান কানাডায়।
মা একবারও বলেননি তাঁর কাছে থেকে যেতে। কোন অনুযোগও নেই। তাঁর না বলা ভাষার মধ্যে একটি কামনা – বাবা ভাল থাকিস যেখানেই থাকিস। সারা পৃথিবীর মায়েরা এমনি হয়। আমাদের বাংলাদেশী মায়েরা আরও একধাপ এগিয়ে। তাই আমি বলি, ‘মা-বাবা যতদিন বেঁচে থাকেন ততদিনই তা সন্তানের জন্য এক স্বর্গীয় আশীর্বাদ’।