জীর্ণ শীর্ণ হাত
সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৪
উইং কমান্ডার আব্দুল জলিল (অব.)
আপনি কি এক জোড়া জীর্ণ শীর্ণ হাত দেখেছেন যে হাত একদিন কর্মঠ ছিল, ছিল বলিষ্ঠ এবং যে হাত শৈশবে আপনার পরিচর্যা করেছে? আপনার কি কখনো সময় হয়েছে খুব কাছে থেকে সেরকম জীর্ণ শীর্ণ হাত ধরে বসে থাকার? আমরা জানি, প্রবাসে আমাদের সে সময় সাধারণত কারো হয় না।
আমি যুবা, আমি মধ্য বয়সী, আমার ব্যস্ত কর্মজীবন, আমার কি কখনো একটি জীর্ণ শীর্ণ হাত নিয়ে ভাববার সময় আছে? বেঁচে থাকলে একদিন আমরাও বয়োবৃদ্ধ হব, তখন নিজের জীর্ণ শীর্ণ হাত দেখার শুধু সম্ভাবনাই নয়, দেখতেই হবে। জীর্ণ শীর্ণ হাতে শক্তি থাকে না, সেই হাত কোন কাজ করতে পারে না, এমনকি নিজের কাজটুকুও করতে পারে না। অথচ দেশে ফেলে আসা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জীর্ণ শীর্ণ হাতের হাতছানি কত দুর্বার, যার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারি না আমরা প্রবাসীরা। এ হাতছানিতে মানুষ যোজন যোজন মাইল দুর থেকে যাত্রাপথের সকল গ্লানি অবজ্ঞা করে হাজির হয়ে বলে ‘মা’ তুমি কেমন আছ? বাবা তুমি কেমন আছ?
একটি শিশুর হাত দেখে প্রায়ই বলতে শোনা যায় আহা কি নরম তুলতুলে হাত। হাত নাড়লে সবাই বলে কি সুন্দর হাত নাড়ছে শিশুটি। এ হাত নাড়া মূলত শিশু কর্তৃক মাকে ডাকার নামান্তর। একটি শিশু মাকে চিনে সবার আগে। ক্ষুধা পেলে হাত নেড়ে নেড়ে চিৎকার করে কান্নার মাধ্যমে মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ হাত বয়স বাড়ার সাথে সাথে তুলতুলে থাকে না। বাল্যকাল, শৈশব, কৈশর পেরিয়ে হয়ে উঠে বলিষ্ঠ হাত।
বাবা-মার বড় সন্তান হলে, আমরা তাদের বলিষ্ঠ হাত দেখতে পাই। আর সে হাত যদি কিষান-কিষানীর হয় তাহলে তাতে বলিষ্ঠতার ছাপটুকু থাকে আরো বেশী। ছোট বেলায় মাঝে মাঝে কল্পনায় আসতো কবে আমার হাত বাবার মত বলিষ্ঠ হবে। বাবার সে বলিষ্ঠ হাত মাঠে মাঠে ফসল ফলিয়েছে। মার কর্মঠ হাত সে ফসল ঘরে এলে যতœ করে গোলায় তুলেছে।
মার কর্মঠ হাতকে দেখেছি ধানের কাজ করতে। মাঠ থেকে ধান বাড়ীর উঠানে এলে সবকাজ মার। ধান মড়াই করা, সিদ্ধ করা, শুকানো, ঢেকিতে ধান বানা, সারা বছরের জন্য চাল মজুত করে রাখা ইত্যাদি। কাজ এখানেই শেষ নয়। গুরুত্বপূর্ণ কাজ – প্রতিদিন ভাত রান্না করে বাড়ীর সকলের সামনে পরিবেশন করা। শুধু ভাত পরিবেশনই নয়, মার কর্মঠ হাত প্রতি বেলায় খাবার জন্য নানা রকম তরকারী প্রস্তুত করে পরিবেশন করত। মা সব কাজ করত অসীম ধৈর্যের সঙ্গে। মার কাছে সব সন্তান সমান। মা সতেজ হাতে সবার জন্য সমানভাবে কাজ করতো।
একদিন একটি ওয়েবসাইট দেখলাম farmersfeedcities.com নামে। কথাটা চিরকালের জন্য মনে গেঁথে গিয়েছে। শহরে আমরা যত কাজই করিনা কেন, আমাদের খাবার যোগায় একজন কৃষক তার রক্ত ক্ষয় করে বা ঘাম ঝড়িয়ে। বাবা ফসল উৎপাদন করে ক্ষেতের সেরা ফসল বাজারে ছেড়েছে। সে ফসল বিক্রি করে মিটিয়েছে জীবনের অন্যান্য চাহিদা। ঈদে ছেলে-মেয়েদের কিনে দিয়েছে নতুন জামা। আবার দিয়েছে খাজনা দখলকৃত জমির শর্ত বজায় রাখার জন্য। খাজনা দিয়েছে জমিদারদের, খাজনা দিয়েছে সরকারকে। জমিদারকে খাজনা দেয়া যত সহজ ছিল, সরকারকে খাজনা দেয়া অত সহজ নয়। কঠিন হাতে পরিশ্রম করে টাকা উপার্যন করে খাজনা দেবার ধকল সাধারণ কৃষকের জন্য অসামান্য বিড়ম্বনা। খাজনা আদায়কারী তহশীলদার কত ভাবেই না ঠকায় আমার বাবার মত সাধারণ কৃষকদেরকে। জমিজমা সংক্রান্ত কোন কাজ ঘুষ বা উৎকোচ ছাড়া হয় না। কৃষক তার বলিষ্ঠ হাতে ফসল ফলিয়ে ধাপ্পাবাজদের খরচ যুগিয়ে জীবন পার করে।
কিষাণ-কিষাণীর বলিষ্ঠ হাতে ফলানো ফসল ছড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে। বাবাকে পাট আবাদ করতে দেখেছি। এক কালে এ পাট কে বলা হতো সোনালী আঁশ। মাঠে ফলানো সোনালী আঁশ ব্যবহৃত হয়েছে সারা পৃথিবীতে। পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন ভাবে সে সোনালী আঁশ থেকে উপকৃত হয়েছে। আমরা দেখেছি কৃষকের বলিষ্ঠ হাতে ফলানো সোনালী আঁশের সুফল ভোগ করেছে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান। তারা সোনালী আঁশের বদলৌতে বড় বড় শহর গড়েছে। রাস্তা বানিয়েছে নতুন নতুন। তারা বানিয়েছে ইসলামাবাদের মত একটি নতুন শহর যা বাংলাদেশী কৃষকদের শক্ত হাতে ফলানো সোনালী আঁশেরই অবদান।
সকল কৃষাণ কৃষাণী বাবা মায়ের বলিষ্ঠতম হাত থাকে জীবনের একটি সময় পর্যন্ত। সে সময়ে তারা ফসল ফলিয়ে মানবজাতির মুখে খাবার তুলে দেয়। ফলস ফলিয়ে উপার্যন করে সন্তানদের যেমন খাবার যোগায়, তেমনি তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য শিক্ষার খরচ যোগায়। সন্তানদের বারে বারে বলে-লেখাপড়া শিখে তোরা প্রতিষ্ঠিত হ। তখন হয়তো এ বাবা -মার ভাববার সময় থাকে না, তাদের কর্মঠ হাত একদিন শক্তিহীন জীর্ণ শীর্ণ হয়ে পড়বে। আমাদেরও হয়তো ভাববার সময় নেই যে এই প্রবাসে আমাদেরও হাত জীর্ণ শীর্ণ হয়ে যাবে এক সময়। জীবন চক্রে এটাই সত্য। প্রবাসে বসে আমরা অনুভব করতে পরি, বাবা-মায়ের এই জীর্ণ শীর্ণ হাতের হাতছানির কত শক্তি। আমার মত যাদের মা আছে বা ছিল তারা যোজন যোজন মাইল পেরিয়ে, ঘন্টার পর ঘণ্টা উড়োজাহাজে ঠায় বসে থেকেও ক্লান্তি বোধ করেনা যখন মায়ের হাতছানি পেয়ে ছুটতে থাকে। সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যখন আমরা প্রবাসীরা মায়ের পাশে গিয়ে দুদন্ড বসে থাকার সুযোগ পাই তখন ভ্রমনের সব ক্লেশ দুর হয়, মন পরিতৃপ্ত হয়ে উঠে মায়ের জীর্ণ শীর্ণ হাতদুটি ধরে বসে থাকলে। তখন দেখি, সত্তর বছর বয়সী ছেলে আজো মার কাছে সেদিনের খোকা। মার কাছে পৌঁছালে বোঝা যায় শক্তিহীন শরীরের মহা শক্তির ঝলক। ছেলের বিদায়ের সময়ে আবার তার শক্তির ঝলক ফুরিয়ে আসে। তবু মা বলেনা,আর কটা দিন থেকে যাও। বিদায় কালে মা শুধু বলে, বাবা ভাল থেকো।