অন্টারিওর ৮৫% নার্সিং হোম বারবার আইন লংঘন করলেও তেমন কোনও শাস্তি হয় না

গোপন ক্যামেরায় দেখা যায়, নার্সিং হোমের স্টাফরা আবাসিক রোগীদের আঘাত করে, তাদের ওপর হম্বিতম্বি করে এমনকি অসদাচরণের মত অপরাধও বারবার ঘটায়

ডিসেম্বর ৩, ২০২০

এলডার এবিউজের শিকার এই সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম হলো একটি উপযুক্ত স্থান। কিন্তু দেখা গেছে সেখানেও নির্যাতিত হচ্ছেন সিনিয়র সিটিজেনরা। ছবি : সিটিভি নিউজ

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ২৩ অক্টোবর ২০২০ : এলডার এবিউজ অন্টারিও এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, কানাডায় এলডার এবিউজ একটি গুরুতর এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যা। কিন্তু এর প্রয়োজনীয় ও প্রকৃত চিত্রটি ফুটে উঠছে না কারণ, অনেক এবিউজের ঘটনা পরিবারের সদস্যরা বা এবিউজের শিকার ব্যক্তি নিজেই গোপন রাখেন। এলডার এবিউজের শিকার এই সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম হলো একটি উপযুক্ত স্থান। কিন্তু দেখা গেছে সেখানেও নির্যাতিত হচ্ছেন সিনিয়র সিটিজেনরা। সিবিসি নিউজের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য।

স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাব (২০১৬) অনুযায়ী অন্টারিওতে সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা ২২ লাখ ৯০ হাজার যাদের বয়স ৬৫ বা তারো উপরে। এরা অন্টারিও প্রভিন্সের মোট জনসংখ্যার ১৪.৬%।

এলডার এবিউজের শিকার এই সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম হলো একটি উপযুক্ত স্থান। কিন্তু দেখা গেছে সেখানেও নির্যাতিত হচ্ছেন সিনিয়র সিটিজেনরা। ছবি : সিটিভি নিউজ

সিবিসি’র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভন নামের এক অন্টারিওবাসী যখন তার মাকে নিয়ে স্কারবরোতে ক্রেইগলি নার্সিং হোমে ভর্তি করেন তখন তিনি এবং তার জীবনসঙ্গী ম্যারি ভেবেছিলেন, তারা মায়ের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো কাজটিই করলেন।

কিন্তু ভালোবাসাপূর্ণ সেবার পরিবর্তে ভনের মা কোস্টাডিঙ্কা সেখানে কমপক্ষে চারজন কর্মীর কাছ থেকে শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হন। এসব ঘটনা ধরা পড়েছে মায়ের রুমে ভন ও তার সঙ্গীর পেতে রাখা গোপন ক্যামেরায়। ম্যারি বলেন, “এটা যেন ছিল অনেকটা হরর ফিল্মের মত, সেসব স্মৃতি আমি কখনও ভুলতে পারবো না।”

তখন পর্যন্ত তারা যেটা জানতেন না সেটি হলো, ওই নার্সিং হোমের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নিবাসীদের প্রতি শারীরিক নিগ্রহের পুনঃপৌনিক ও দীর্ঘদিনের ইতিহাস আছে। তারা না জানলেও, সরকার কিন্তু জানতো।

অন্টারিওর দীর্ঘমেয়াদী নার্সিং হোমের নিরাপত্তা আইনের গুরুতর লংঘন সম্পর্কিত উপাত্ত বিশ্লেষণে প্রকাশ পেয়েছে যে, এখানকার প্রতি সাতটি কেয়ার হোমের মধ্যে ছয়টিতেই বারংবার এধরণের অপরাধ ঘটে কিন্তু এই উপর্যুপরি আইন লংঘনের জন্য তাদের কোনওরকম পরিণতি বা শাস্তি ভোগ করতে হয় না।

সিবিসির মার্কেটপ্লেস অনুষ্ঠান ১০ হাজার পরিদর্শন রিপোর্ট পর্যালোচনা করেছে এবং তাতে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে লিপিবদ্ধ করা ৩০ হাজারের বেশি “লিখিত সতর্কীকরণপত্র” বা দীর্ঘমেয়াদী কেয়ার হোমের আইন ও বিধি-বিধান লংঘনের ঘটনা (LTCHA) খুঁজে পেয়েছে। এলটিসিএইচএতে অন্টারিওর কেয়ার হোমগুলোর জন্য অবশ্য পালনীয় ন্যূনতম নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিধিমালা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে।

আইন লংঘনের সবচেয়ে মারাত্মক বা বিপজ্জনক ২১ টি অপরাধের নমুনা আলাদা করেছে মার্কেটপ্লেস। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এসবের মধ্যে রয়েছে অসদাচরণ, সংক্রমণ রোধের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা, অনিরাপদ ওষুধ সংরক্ষণ, অপর্যাপ্ত জলযোজন এবং শরীরের ত্বক ও জখমের বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়া ইত্যাদি। বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, অন্টারিওর ডাটাবেজে যে ৬৩২টি কেয়ার হোম আছে তার মধ্যে ৫৩৮টি বা ৮৫ শতাংশই বারবার আইন লংঘনকারী।

বয়স্ক সুরক্ষা কেন্দ্রের আইনজীবী জেন মিডাস সিবিসিকে বলেন, বারবার এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তির সংখ্যাধিক্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, কেয়ার হোমগুলোতে আইন না মানার বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।

মিজ. মিডাস বলেন, যথাযথ সেবার ঘাটতি থাকলে কেয়ার হোমের নিবাসীদের কেউ কেউ বেডসোর বা শয্যাক্ষতের শিকার হতে পারেন।

উল্লেখ্য যে, হাঁটাচলা করার ক্ষমতা হারিয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে অনেকের দেহে দেখা যায় বেডসোর বা শয্যাক্ষত। দীর্ঘসময় একইভাবে থাকতে থাকতে ত্বকের উপর চাপ পড়ায় বেডসোর হয়। চাপ পড়া অংশে রক্ত চলাচলে সমস্যা দেখা যায়। ফলে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। কনুই, পায়ের গোড়ালি, পশ্চাদ্দেশ ও পিঠে বেডসোর হতে পারে। বেডসোরের কারণে মৃত্যুও হতে পারে।

মিজ. মিডাস বলেন, “কোনও কেয়ার হোমের একজন নিবাসী বেডসোরে আক্রান্ত হলে সেই হোমের মালিক ফৌজদারি অপরাধের দায়ে দোষী হতে পারেন। কিন্তু আমি যেটিকে ফৌজদারি অপরাধমূলক আচরণ মনে করি তেমন কারণে কোনও হোমকে কখনই অভিযুক্ত করা হয়নি।”

আমরা যা দেখেছি তা বিশ্বাস করতে পারিনি

ক্রেইগলি নার্সিং হোম অন্তত ২৪৮টি হোমের মধ্যে একটি যেগুলির বিরুদ্ধে দুবার বা তারও বেশি বার লিখিত সতর্কীকরণ দেওয়া হয়েছে। আর এটি এমন ১০১টি হোমের একটি যেগুলি নিবাসীদের ওপর নিগ্রহের বিষয়ে রিপোর্ট করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

ক্রেইগলির বিরুদ্ধে নিবাসীদের প্রতি অবহেলা, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, ওষুধ সংরক্ষণে অনিয়ম এবং ত্বক ও জখমের যত্নে শৈথিল্যের মত আইন বারবার লংঘনের দৃষ্টান্ত রয়েছে।

সিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই হোমের ইতিহাস না জানার কারণে ভন ও ম্যারি ২০১৭ সালে এটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন ভনের মা কোস্টাডিঙ্কার যত্নের বিষয়ে। কারণ তখন তার যত্নের বিষয়টি দুজনের পক্ষে সামলানো সম্ভব ছিলো না।

ভন ও ম্যারির কাহিনী বলতে সিবিসি’র মার্কেটপ্লেস রাজি হয় কেবল তাদের নামের প্রথম অংশ উল্লেখ করার শর্তে। কারণ তারা তাদের এবং তাদের ব্যবসার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া হতে পারে বলে ভয় পাচ্ছিলেন।

তারা যখন দেখলেন কোস্টাডিঙ্কার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ছে তখন ২০১৯ সালের এপ্রিলে তারা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ভনের মায়ের রুমে একটি ক্যামেরা স্থাপন করেন। তারা কোনওরকম সমস্যা দেখতে পাবেন এমন আশা করে সেটা বসাননি। কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা জানতেও পারেননি ক্যামেরা কী ধারণ করেছে। ভন বলেন, “আমরা যা দেখেছি তা বিশ্বাসও করতে পারছিলাম না। নিগ্রহ, নির্যাতন, প্রিয় জীবনের জন্য তার বিছানার রেলিং ধরে ঝুলে থাকা!”

ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন কর্মচারী কোস্টাডিঙ্কার হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে টানছে, তার হাতে ঘাম ঝরে পড়ছে, তার মুখে খাবার ঘষে দিচ্ছে। ভিডিওতে কোনও শব্দ না থাকলেও বোঝা যায়, তাদের সাহায্য ছাড়া নড়াচড়া করতে না পেরে বিছানায় শুয়ে থাকা কোস্টাডিঙ্কাকে বকাঝকা করছে কিছু কর্মচারী।

ওই ভিডিও মন্ত্রণালয়ে পেশ করার পর আরও নিবাসী নিগৃহীত হন

ভন ও ম্যারি নিগ্রহের স্বরূপ দেখার পর পুলিশ ডাকেন। একজন ব্যক্তিগত সহায়তাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত সে পরবর্তী তিন বছর আর কোনও দুঃস্থ মানুষের সেবা করবে না মর্মে সম্মতি দিয়ে মুচলেকা দিতে বাধ্য হয়। কোস্টাডিঙ্কাকে অন্য একটি হোমে সরিয়ে নেয়া হয় যেখানে গত বছরের শেষের দিকে তিনি মারা যান।

নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ সিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ক্রেইগলির মূল কোম্পানি সাউথব্রিজ কেয়ার হোমসের মিজ. ক্যানডেস শার্টিয়ার একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে শার্টিয়ার বলেন, “ঘটনার সঙ্গে যেসব লোক জড়িত আমরা তাদের কঠোর নিন্দা জানাই।” তিনি বলেন, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে তারা কোস্টাডিঙ্কার প্রতি নিগ্রহের বিষয়টি তদন্ত করেছেন এবং এ বিষয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেছেন। এর পর হোমের স্টাফদের একজনকে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত করা হয় এবং “অন্য কয়েকজনকে বরখাস্ত করা হয়।”

শার্টিয়ার আরও বলেন, তারা “নিগ্রহের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি সম্পর্কে সব স্টাফকে নতুন করে অনুশীলন দিয়েছেন এবং তাদের প্রশিক্ষণ বাড়িয়েছেন।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে কোস্টাডিঙ্কার প্রতি নিগ্রহের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনাসহ অন্টারিওর দীর্ঘমেয়াদী প্রযত্ন বিষয়ক পরিদর্শন রিপোর্টে প্রকাশ পায় যে, অসদাচরণ বিষয়ে স্টাফদের প্রশিক্ষণের অভাব আছে। তদুপরি, চার মাস পর আরেক রিপোর্টে জানা যায়, সক্রিয়ভাবে কর্মরত স্টাফদের মধ্যে ৯.২ শতাংশ তখন পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেনি। ছয় মাস পর আরেকটি রিপোর্টে স্টাফদের হাতে নিবাসীর নিগ্রহের ঘটনা তুলে ধরা হয়। এছাড়াও হোমগুলোতে অর্থনৈতিক অসদাচরণ এবং নিবাসীদের পরস্পরের মধ্যে অসদাচরণের দৃষ্টান্তও আছে।

ভন বলেন, তিনি তার মায়ের ওপর নিগ্রহের ভিডিও প্রমাণ মন্ত্রণালয়ে জমা দেবার পরও ক্রেইগলি হোমে নিগ্রহের বিষয়ে আরও কিছু লিখিত অভিযোগ উঠেছে বলে জেনে তিনি রীতিমত “বীতশ্রদ্ধ” হয়ে উঠেছেন।

ভন বলেন, “এতে কী কাজ হলো? আমরা এবিষয়ে মন্ত্রণালয় ও সেবা বিষয়ক পরিচালকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছি, কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু আমার মাকে যা কিছু সহ্য করতে হয়েছে তার কোনই সুরাহা হয়নি।”

নার্সিং হোমের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনতে পরিবারের লড়াই

সিবিসি আরো জানায়, শারীরিক নিগ্রহ স্পষ্ট হলেও অবহেলার বিষয়টি নানা আকারেই ঘটতে পারে যেমন, হাইড্রেশন বা পানির চাহিদা পূরণে ঘাটতি বা সময়মত গোসল না করানো ইত্যাদি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা তার স্টাফদের কাছ থেকে একজন নিবাসী যেন অবহেলার শিকার না হন এটি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উপর্যুপরি ব্যর্থ হয়েছে ২২৬টি হোম। তবে নানা ধরণের অবহেলার বিষয়ে আইনের নির্দিষ্ট ধারায় আরও বহু সংখ্যক অভিযোগ নথিবদ্ধ করা হয়েছে যেমন, ত্বকের পরিচর্যা ও জখমের যত্ন নেয়া ইত্যাদি। এসব বিষয়ে বারবার অপরাধের ঘটনা ঘটেছে ২৭৮টি হোমে।

চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে বেভারলি হেইন্স নামে একজন নিবাসীকে অন্টারিওর পোর্ট হোপ-এর হোপ স্ট্রিট টেরেস-এ ভর্তি করার মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে মারা যান। ওই হোমে শয্যাশায়ী থাকার ফলে সৃষ্ট আলসারে তার মৃত্যু হয়। হেইন্স-এর ভাতিজা-ভাতিজি স্পার্কি জনসন ও শেরি শার্নিটজস্কি এখন ওই হোম কর্তৃপক্ষকে হেইন্স-এর মৃত্যুর জন্য ফৌজদারি অপরাধের দায়ে শাস্তির আওতায় আনার জন্য লড়াই করছেন।

বর্তমানে বিচ্ছিন্ন এই জুটি সিবিসিকে বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে যেদিন হেইন্সকে একটি হাসপাতাল থেকে ওই হোমে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন হোমের স্টাফরা তার শরীরে একটি ‘হট স্পট’ বা ত্বকের লাল হয়ে থাকা একটি জায়গা চিহ্নিত করেন। এ বিষয়টি অবশ্যই পর্যবেক্ষণে রাখা এবং চিকিৎসা করা হবে যাতে তা আরও খারাপ হতে না পারে। এমন কথা শোনার পর ওই জুটি স্টাফদের প্রতি আস্থা নিয়ে ফিরে যান।

কিন্তু সেই স্পটটি যে শয্যাগত থাকাজনিত প্রকাশ্য একটি ক্ষতে পরিণত হয়েছে সেই তথ্যটি স্টাফরা ওই জুটিকে জানাননি পরের ২৩ দিনের মধ্যেও। ততদিনে এটি পিরিচ আকারের ক্ষতে পরিণত হয়েছে এবং শরীরের হাড় দেখা যাচ্ছে।

“ক্ষতটি যখন ছোট ছিল তখন চিকিৎসা শুরু করা হলে এটি কখনই ওই আকার ধারণ করতো না,” বলেন শেরনিটজস্কি।

জনসন বলেন, “এটি ভয়ানক ঘটনা, এটি দণ্ডনীয় অপরাধ।”

এই হোমটিকে জখমের যথাযথ যত্ন না নেয়ার জন্য এর আগে নোটিস জারি করা হয়। ২০১৬ এবং ২০১৮ দুই বছরেরই রিপোর্টে দেখা যায়, এখানে নিবাসীদের ত্বকের সমস্যার যত্নের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।

হেইন্স-এর প্রতি অবহেরার বিষয়ে রিপোর্ট করার জন্য জনসন মন্ত্রণালয়ে ফোন করলে তাকে বলা হয়, এ বিষয়ে পরিদর্শন করতে কিছু সময় লাগবে। এরপর তিনি পুলিশে রিপোর্ট করেন এবং তদন্ত করা হয়।

এরপর তিনি ওই হোমে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর ওপর প্রামাণ্য তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এর মধ্যে এমন ঘটনা ছিল যে, হেইন্সকে সারাদিন ধরে বিছানায় ফেলে রাখা হয়েছে এবং তা ঘটেছে

বেশ কয়েক বার। শরীরের উন্মুক্ত ঘা রেখেই তাকে সারাদিন শুইয়ে রাখা হয়েছে।

জুন মাসে মন্ত্রণালয় একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে ওই হোমের রেকর্ডপত্র অনুযায়ী ঘায়ের যথাযথ যত্ন নেয়া হয়নি এমন তথ্য উঠে আসে। কোনও নিবাসীকে যেন তার শরীরে জখমের ওপরই দীর্ঘ সময় শুয়ে থাকতে না হয় সেটি নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেক নিবাসীর শোয়ার ধরণ বা অবস্থান প্রতি দুই ঘণ্টায় একবার করে পাল্টে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।

শেরনিটজস্কি বলেন, “এটি একটি চমৎকার রিপোর্ট। কিন্তু এখন কি হচ্ছে? কে পরবর্তী ঘটনাবলি খতিয়ে দেখছে? তাদের কোনও পরিণতি ভোগ করতে হয়নি।”

রিপোর্ট যখন প্রকাশ করা হয় তখন এতই দেরি হয়ে গেছে যে, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর সমাধানের আর কোনও সুযোগ নেই। ২৯ ফেব্রুয়ারি হেইন্স পরপারে পাড়ি জমান।

তার পরিবার বলেছে যে, মৃতদেহ পরীক্ষাকারী তাদের জানিয়েছেন যে, শরীরের ঘায়ের পচন থেকেই তার মৃত্যু হয়।

তারা দৃঢ়ভাবে মনে করেন, এ ক্ষেত্রে হোমের উদাসীনতা ছিলো গুরুতর অপরাধ। কিন্তু হেইন্স-এর মৃত্যুর পর পুলিশ তদন্ত বন্ধ করে দেয় এবং হোমের বিরুদ্ধে কোনওরকম অভিযোগও আনেনি।

তারা লড়াই অব্যাহত রাখেন এবং পুলিশের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত স্বতন্ত্র পরিচালকের অফিসে অভিযোগ পেশ করেন। এটি একটি বেসামরিক দপ্তর যা টরন্টোর পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখে। এরপর হেইন্স-এর মামলাটি নতুন করে শুরু হয়।

হোমের পক্ষ থেকে বলা হয়, “তাদের একজন নিবাসীর চলে যাওয়ার ঘটনায় তারা গভীরভাবে দুঃখিত” এবং তারা নিবাসীদের “নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাই তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।”

মন্ত্রী বললেন, দুর্ব্যবহারের ব্যাপরে নো টলারেন্স

আইন না মানার কারণে বেশিরভাগ হোমের কোনও শাস্তি হয়নি। গত এক দশকে অন্টারিওর মাত্র দুটি হোম বন্ধ করা হয়েছে বারবার নিরাপত্তার মান পূরণ করতে না পারায়। উপর্যুপরি এ ধরণের অপরাধ রোধের জন্য মন্ত্রণালয়ের অন্য যেসব অবরোধমূলক ব্যবস্থা আছে সেগুলি দৃশ্যত অকার্যকর রয়ে গেছে।

সিবিসি’র মার্কেটপ্লেস-এর উপস্তাপক ডেভিড কমন গত সপ্তাহে লং-টার্ম কেয়ার বিষয়ক মন্ত্রী মেরিলি ফুলারটনকে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিদর্শকদের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠানোর পরও হোমগুলি কীভাবে একই আচরণ বারবার করতে পারে সে বিষয়ে বক্তব্য রাখার অনুরোধ জানান।

ফুলারটন বলেন, “অবহেলা বা দুর্ব্যবহারের বিষয়ে কোনওরকম সহনশীলতা দেখানো হয় না। এগুলোর ব্যাপারেও নিখুঁতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি উল্লেখ করেন যে, তার সরকার পরিদর্শনের ক্ষেত্রে গুরুতর অপরাধগুলির বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

সাবেক পরিদর্শক বললেন, ‘কোনও শাস্তি হয় না

কিন্তু সাবেক এজন পরিদর্শক সিবিসিকে বললেন, অভিযোগগুলোর বিষয়ে নিখুঁতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সেজন্যেই তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

রেবেকো ডি উইট্টি নামের ওই পরিদর্শক ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত তিন বছর পরিদর্শক হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, হোমগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় না।

তার ভাষায়, “ওখানে গেলে মনে হবে সবকিছু সত্যিই খুব ভালো। আর যতই সময় যাবে তাদের পুরনো স্বভাব বেরিয়ে আসতে থাকবে।”

তিনি বলেন, তিনি একটি হোম পরিদর্শনের সময় ঠিক সেই সমস্যাই আবারও দেখতে পান যেটি আগের পরিদর্শনের সময় দেখেছিলেন।

তিনি বলেন, “যে সমস্যাই উদ্ঘাটন করা হোক না কেন তারা যদিসবগুলোই পুরোপুরি উপেক্ষা করে তবুও তাদের কোনও শাস্তি পেতে হয় না।”

কেন্দ্রীয় সরকার নতুন বিধির প্রস্তাব করছে

গত অক্টোবরে কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘমেয়াদি প্রযত্ন বিষয়ে একটি জাতীয় মান নির্ধারণের জন্য রাজ্য ও টেরিটোরিগুলোর সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে। কেয়ার হোমে বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকেদের প্রতি অবহেলাকারীদের শাস্তির সুস্পষ্ট ব্যবস্থা রাখার জন্য দণ্ডবিধি সংশোধনের কথাও বলা হয়েছে।

ডি উইট্টির মতে, সাময়িক সমাধানের পরিবর্তে সরকারগুলির উচিৎ সমস্যার সার্বিক চিত্রের দিকে মনোযোগ দেওয়া। তিনি বলেন, “শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য অর্থ বরাদ্দ করলে কাজ হবে না। পুরো ভবনটিই পাল্টে ফেললে কাজ হবে। মহামারিকালীন বরাদ্দ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রযত্ন কেন্দ্রের কোনও উপকার হবে না, বরং অর্থ বরাদ্দের পুরো মডেলটি পাল্টাতে হবে।”

মিডাস চান অবহেলাকারী এবং বারবার একই ধরণের অপরাধকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের এবং অর্থদণ্ডের বিধান করা হোক। তিনি বলেন, “হোমগুলি যদি নিরাপদ সেবা দিতে না পারে তাহলে তাদের ব্যবসায় থাকার দরকার নেই।”

উল্লেখ্য যে, করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর অন্টারিওতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী দেখা দিয়েছে এই লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে। স্থানীয় বিভিন্ন মিডিয়ার খবর থেকে জানা যায়, অন্টারিওতে তিন হাজারেরও বেশী লোক মৃত্যুবরণ করেন কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে। এর মধ্যে ১৯৬১ জনই লং-টার্ম কেয়ার হোমের বাসিন্দা ছিলেন। গত ১০ অক্টোবরে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে এই তথ্য জানা যায়।

অন্টারিওতে লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে করোনার হামলা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি যথাযথভাবে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ড্যাগ ফোর্ডের সরকার। লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে আগে থেকেই প্রচুর অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান ছিল। জীবন যাপনের অবস্থা ছিল খারাপ। কর্মী স্বল্পতা ছিল প্রকট। করোনার হামলা শুরু হওয়ার পর এই অব্যবস্থাপনা ও কর্মী সংকটের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে যখন প্রতিদিনই লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। অবস্থা বেগতিক হয়ে দাঁড়ালে সেখানে জরুরী ভিত্তিতে সেনা মোতায়েন করা হয়। সেনা মোতায়েনের কয়েক সপ্তাহ পরে বেরিয়ে আসে আরেক নির্মম চিত্র। লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে লিভিং কন্ডিশন খুব খারাপ অবস্থায় আছে এমন এক রিপোর্ট প্রকাশ করে নিয়োজিত ঐ সেনারা।