ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার নাম পরিবর্তন?
জনগণ বহু বছর ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কানাডার পশ্চিম উপকূলের প্রদেশটির নামে এখনও ঔপনিবেশিকতার ছাপ রয়েছে। কিন্তু সেটি পাল্টানোর সময় এসেছি কি?
আগস্ট 7, 2020
ম্যালানি উডস : প্রতিদিনই মনে হয়, আরেকটি মূর্তি উপড়ে ফেলা হলো। যুক্তরাষ্ট্রে জনতার হাতে কনফেডারেট নেতাদের মূর্তি উপড়ে ফেলা থেকে শুরু করে এখানে এই কানাডায় জন এ ম্যাকডোনাল্ডের মূর্তিতে লাল রঙ ঢেলে দেয়া পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার পেছনে অতীতের সব বিতর্কিত (Problematic figures) ব্যক্তিত্ব এবং তাদের নামে চিহ্ণিত সব জায়গা ও তাদের সম্মানে তৈরি স্থাপনার ক্ষেত্রে এক ধরণের হিসাব চুকিয়ে দেয়ার ব্যাপার আছে। এসব ঘটনা বিভিন্ন স্থানের নাম এবং যাদের নামে স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে হিসাব চুকিয়ে দেয়ার বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করেছে।
এখানে, কানাডায়, অনেক প্রদেশের (এবং খোদ কানাডাও) নামকরণ হয়েছে আদিবাসী শব্দের ভুল বানান বা বিচ্যুতি থেকে যেমন, সাসকাচুয়ান, অন্টারিও, ম্যানিটোবা কুইবেক। অন্যগুলোর নামকরণ হয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানের নামের “নতুন সংস্করণ” থেকে – যেমন নিউ ব্রুন্সউইক এবং নোভা স্কশিয়া। এরপর কিছু নাম আছে যেগুলি রাজকীয় ব্যক্তিত্বের নামে, যেমন, আলবার্টা, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড।
এছাড়াও আছে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া নামটি।
সাম্প্রতিকালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার উত্তরাঞ্চলে ওয়েটসুওয়েটএন ভূখণ্ড নিয়ে বিরোধ আদিবাসী ভূমি ও সেগুলোর নাম নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া নামের ভূখণ্ডটির ওপর দাবি করার অধিকার কাদের আছে এবং এর নামকরণের অধিকার কাদের সেই বিষয়টিও আলোচনায় আসে।
ভিক্টোরিয়া টাইমস কলোনিস্ট পত্রিকায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত কলামে নিকোলাস জেমটোল্টো ক্লাক্সটন (Nicholas XEMŦOLTW̱ Claxton) এবং জন প্রাইস যুক্তি দেখান যে, আদিবাসীদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আন্দোলনের পুনর্জাগরণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার নাম পাল্টানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।
তারা যুক্তি দেন যে, “ওয়েটসুওয়েট্এন-এর বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব তাদের ভূমির ওপর যে সার্বভৌমত্ব দাবি করছেন তা এই জরুরী বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে যে, কেবল ‘ব্রিটিশ কলাম্বিয়া’ নাম থেকে পরিত্রাণ পাওয়া নয় বরং এই প্রদেশে বসতি স্থাপনকারীদেরও স্বীকার করতে হবে যে, যে ভূখণ্ডে তারা কাজ করছেন এবং হেসেখেলে বেড়াচ্ছেন তা এখনও আদিবাসী ভূখণ্ডই আছে এবং তা কখনই সমর্পণ করা হয়নি বা কেউ তা জয়ও করেনি।”
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মত বিতর্কিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কিত আলোচনা থেকে নতুন নামকরণের দাবি উঠেছে। টাইই (Tyee) পত্রিকায় ১৬ জুন প্রকাশিত নিবন্ধে ক্রফোর্ড কিলিয়ান বলেন, নতুন নামকরণের সময় যদি আদৌ এসে থাকে তবে তা “এখনই”। তিনি লিখেছেন, “এই নামের মধ্যে ইউরোপীয়দের আগমনের আগে থেকে এখানে বসবাসরত আদিবাসী জনগণের স্বীকৃতি নেই বরং এতে পরোক্ষে ইংল্যান্ডের বর্ণবাদী উপনিবেশবাদীদের সম্মান জানানো হয়েছে এবং স্পষ্টতই কলম্বাসকে নৃ-সিংহের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।”
কানাডার সবচেয়ে ঔপনিবেশিক ধারার প্রদেশগুলোর নাম পুনর্বিবেচনার এখনই সময়।
বি.সি. নামটি কীভাবে এলো
প্রথম ধারণাটি – বি.সি. মানে ব্রিটিশ কলোনি ঠিকই আছে। এই ভূখণ্ডটি ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ ও আমেরিকা সরকারের মধ্যে সম্পাদিত অরেগন চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশের অধীনে আসে। যদিও আদিবাসীদের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা করা হয়নি। চুক্তির বিষয়ে আলোচনার সময় ব্রিটিশরা যুক্তি দেখায় যে, বি.সি ভূখণ্ডটি আবিষ্কার করেছেন ক্যাপ্টেন কুক ও ক্যাপ্টেন ভ্যাঙ্কুভার। এটা ঠিক কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতই। অভিযাত্রী সিমন ফ্র্যাসার বি.সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নামকরণ করেছিলেন “নিউ ক্যালেডোনিয়া”। কিন্তু ১৮৫৮ সালে এটি যখন ব্রিটেনের উপনিবেশে পরিণত হয় তখন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ নিউ ক্যালেডোনিয়ার সঙ্গে সংশয় এড়ানোর জন্য রাণী ভিক্টোরিয়া এটির নামকরণ করেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া।
এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে কলাম্বিয়া নদীর নামকরণ করেছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। নির্দিষ্ট করে বললে, নামটি রাখা হয়েছিলো এই নদীপথে ভ্রমণকারী ক্যাপ্টেন রবার্ট গ্রে-এর আমেরিকান জাহাজের নামে। কলম্বিয়া রেডিভিভা নামের ওই জাহাজের নাম রাখা হয় ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নামেই।
আর হ্যাঁ, ইনিই সেই ব্যক্তি যার মূর্তি উপড়ে ফেলা হচ্ছে আমেরিকাজুড়ে। কলম্বাসের মূর্তির বিরোধীরা বলছেন, এই অভিযাত্রী যে সহিংসতার সঙ্গে আদিবাসী মানুষকে শোষণ করেছেন এবং উপনিবেশে পরিণত করেছেন সেটি কোনও উদযাপন করার মত কোনও বিষয় হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধিবদ্ধ ছুটির দিন কলম্বাস দিবসের নাম পাল্টে সম্প্রতি আদিবাসী জনদিবস করা হয়েছে। কলম্বাস ও অন্য অভিযাত্রীদের দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী মানুষেরা যে বেদনাদায়ক নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন এবং তাদের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তারই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে কলম্বাস দিবসের নাম পাল্টানোর মধ্য দিয়ে।
প্রদেশের নতুন নামকরণের যে দাবি আগে উঠেছে
বি.সি.র নাম পাল্টানোর দাবি জানানো কোনওভাবেই সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত কোন বিষয় নয় – প্রতি বছর নানা কারণে কানাডার হাজারও ভৌগোলিক অবস্থানের নাম পাল্টানো হয়ে থাকে। অন্টারিওর কিচনার সিটি যেমন পরিচিত ছিল বার্লিন নামে। বি.সি.র উপকূলীয় দ্বীপ কুইন শার্লটির নতুন নামকরণ করা হয়েছে ২০০৯ সালে। আদিবাসী এলাকা হিসাবে এর পরিচিতি ধরে রাখার লক্ষ্যে নতুন নাম দেওয়া হয়েছে হেইদা গওয়াই (Haida Gwaii)।
২০০৮ সালে ভিক্টোরিয়ার বাসিন্দা বেন পিরেজ বি.সি.র তৎকালীন প্রিমিয়ার গর্ডন ক্যাম্পবেল ও বি.সি.র আইনপরিষদে প্রদেশের নাম পাল্টানোর ধারণা প্রথম পেশ করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, নামটি ঐতিহাসিকভাবে যথার্থ নয় কিংবা এই প্রদেশের জন্য শুদ্ধও নয়।
২০১৬ সালে “অসমর্পিত ভূখণ্ডসমূহ” শিরোনামে আয়োজিত এক চিত্র প্রদর্শনীতে লরেন্স পল ইয়ুক্সওয়েলুপটুন (Lawrence Paul Yuxweluptun) বি.সি.র নতুন নামকরণের আহবান জানান।
ইয়ুক্সওয়েলুপটুন তার প্রকল্পের বিষয় তুলে ধরতে গিয়ে প্রশ্ন করেন, “কেন আমরা ব্রিটিশ কলাম্বিয়া নাম রেখে দিয়েছি? তারা কখনই এর কোনও মূল্য পরিশোধ করেনি, তাহলে কেন আমরা এসব নাম রেখে দেবো? এটা আমাদের ভূমি। এটি আমাদের প্রথম জাতির (আদিবাসীদের) ভৌগোলিক অঞ্চল।”
তিনি আরও বলেন, “এটি হলো ঐতিহ্যগতভাবেই স্থানীয় জনগণের ভূখণ্ড। এই প্রদেশের মালিক স্থানীয় জনগণ। কিন্তু আমরা রক্ষণশীল মনোভাবের কাছে জিম্মি হয়ে আছি।”
নতুন বিভিন্ন নাম
বি.সি.র নাম পাল্টানোর বিষয়টি যখনই সামনে এসেছে তখনই অপেক্ষাকৃত কম বিতর্কিত হবে এমন নতুন নাম নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বারবার উঠে এসেছে এমন নতুন বিকল্প নামের মধ্যে রয়েছে ক্যাসকেডিয়া বা নিউ ক্যাসকেডিয়ার কোনও একটি। ক্যাসকেডিয়া দিয়ে বোঝানো হয় উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় বায়োরিজিয়ন বলে চিহ্ণিত অঞ্চলটিকে। পশ্চিমাঞ্চলের কিছু সংখ্যক স্বাধীনতাকামী আন্দোলন যারা বি.সি, ওয়াশিংটন এবং
অরেগন অঞ্চল নিয়ে একটি স্বায়ত্বশাসিত দেশ গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে তারাই এই দেশের জন্য ক্যাসকেডিয়া নামটি বেছে নিয়েছে।
২০১৮ সালে ভ্যাঙ্কুভার কুরিয়ার সংবাদপত্র বি.সির জন্য নতুন নাম চেয়েছিলো পাঠকদের কাছে। তাতে যেসব নাম এসেছিলো তার মধ্যে সাসকুয়াচিনা থেকে শুরু করে দক্ষিণ আলাস্কা, চিনুক এবং প্যাসিফিকা পর্যন্ত নানা নাম ছিল।
জনগণের মধ্যে অনেকেই বি.সি. নামে পরিচিত অঞ্চলের জন্য আদিবাসী নাম প্রস্তাব করেন যাতে এর অসমর্পিত চরিত্রের প্রতিফলন ঘটবে। বি.সি.র বেশিরভাগ এলাকা চুক্তির আওতায় আসেনি।
কীভাবে নাম পরিবর্তন করা যায়?
এমন নয় যে কোনও প্রদেশের নাম পরিবর্তনের কোনও উদাহরণ নেই। ১৯৯৬ সালে উত্তর পশ্চিম টেরিটোরি নাম পাল্টানোর উপায় খুঁজতে শুরু করে। কিন্তু সেই চেষ্টাটি ছিনতাই করে নিয়ে যায় প্রাঙ্কস্টার বা রঙ-তামাশাকারীরা। তারা বিভিন্ন ধরণের স্থানীয় ও আদিবাসী নামের প্রস্তাব ছাড়িয়ে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে তুলে দেয় “বব” নামটিকে।
২০০২ সালে টেরিটোরির সরকার আবারও নতুন নামকরণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেই প্রয়াসও শিগগিরই ব্যর্থ হয়ে যায়।
বি.সি.র নাম পরিবর্তনের বিষয়টি উত্থাপন করতে হবে আইনপরিষদে এবং রেফারেন্ডামে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে অনুমোদন করাতে হবে।
-সৌজন্যে : হাফিংটন পোস্ট