এ যুদ্ধে জয়ী হব আমরা

COVID-19 : আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

প্রবাসী কণ্ঠ, এপ্রিল ৭, ২০২০ : বিশ্বে মাহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস (COVID-19)। প্রতিদিনই বাড়ছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে মৃতের সংখ্যা। করোনা মানুষকে করে ফেলেছে ঘরবন্দী। ভয় আর আতঙ্কে সবাই এখন দিশেহারা।

করোনা রাজা প্রজা কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। তার কাছে সবাই সমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগেই। বিশ্বের প্রচন্ড ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো আজ কুপকাত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই অণুজীব করোনার আগ্রাসনের মুখে। খালি চোখে দেখা যায় না, অথচ কি ভয়াবহ শক্তি নিয়ে গোটা মানবজাতিকে লকডাউন করে দিয়েছে।

বিশ্বের সবকিছু হঠাৎ করেই থমকে গেছে এই করোনার প্রভাবে। কোয়ারেন্টাইনে আছে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ। সারা বিশ্বে উদ্বেগজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন এই করোনাভাইরাস। লকডাউন, আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি প্রভৃতি নানা উপায়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। মরিয়া হয়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশের সরকার। ঘুম হারাম হয়ে গেছে সরকার প্রধানদের।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো প্রতিদিনই মিডিয়ার মুখমুখি হয়ে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন। জবাব দিচ্ছেন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের। পিছিয়ে নেই অন্টারিও প্রভিন্সের প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডও। আর সবারই এক কথা – বজায় রাখুন সামাজিক দূরত্ব। জরুরী প্রয়োজন না হলে কেউ যেন বাইরে না যান সে ব্যাপারেও বার বার আহ্বান জানানো হচ্ছে সকল নাগরিকের প্রতি। আর যারা সিনিয়র সিটিজেন, বিশেষ করে যারা ৭০ পেরিয়েছেন তারা যাতে কোন অবস্থায়ই ঘরের বাইরে না যান সে ব্যাপারে বার বার সতর্কবানী প্রচার করা হচ্ছে। গ্রোসারী বা ঔষধের জন্য অন্যের সাহায্য নিতে বলা হয়েছে তাদেরকে।

আতঙ্কিত না হয়ে সজাগ থাকলে, ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হব আমরা। ছবি : প্রবাসী কণ্ঠ

এদিকে গত ৩ এপ্রিল অন্টারিওর চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এক ভবিষ্যতবাণীতে বলেছেন, অন্টারিও প্রভিন্সে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে। পাবলিক হেলথ অন্টারিও’র প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী ড. পিটার ডনেলী বলেন, ‘আর যদি প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তবে মৃত্যুর সংখ্যা লাখে পৌঁছাতে পারে। এটি একটি আতঙ্কজনক সংখ্যা। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমরা সেই পরিস্থিতিতে নেই।’

ড. পিটার জানান অন্টারিওতে প্রতি বছর ১৩৫০ জন মারা যান স্বাভাবিক ফ্লু সিজনে। আর যে বছর ফ্লু সিজনটা খুব খারাপ থাকে সেই বছর মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় প্রায় ১৫০০তে। কিন্তু যখন কোন কারণে মৃতের সংখ্যা এর দশ গুন বেশী হয় এবং আমরা যখন জানি এর কোন ভেকসিন নেই, বিশেষ কোন চিকিৎসা নেই তখন ১৫০০ এর জায়গায় ১৫০০০ সংখ্যাটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং বোধগম্য হয়ে ওঠে। তবে অন্টারিওবাসী এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন যদি তারা সামাজিক দূরত্ব বাজায় রাখতে পারেন সঠিকভাবে। খবর সিবিসি নিউজের।

ড. পিটার আরো বলেন, অন্টারিওতে যাদের বয়স ৮০ বা তারো বেশী, তারা বেশী মাত্রায় ঝুঁকিতে আছেন। তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ১৬%। আর বয়স্কদের বেলায় বিশ্বব্যাপী এই হার ২০%। অন্যদিকে যাদের বয়স ৭০ বা তারো বেশী তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ১০%।

অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড বলেন, মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কোন জিনিষ নেই। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যতবাণীর বিষয়টিকে তিনি সঠিক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য যে, অধিকাংশ ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট বেড এখন ফুল। বর্তমানে (৩ এপ্রিল) অন্টারিওতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য ৪১০টি ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট বেড এভেইলএবল আছে। তবে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরো ৯০০টি ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট বেড যোগ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু যদি পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায় এবং হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন করার কিছুই থাকবে না। এ কথা বলেন অন্টারিও হেলথ এর প্রধান ম্যাথিও এন্ডারসন। আর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যদি অন্টারিওবাসী সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখেন এই সংকটের মুহুর্তে।

আর এই করোনা নিয়ে অন্টারিও সরকারকে হয়তো আগামী ১৮ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হতে পারে।

সিবিসি নিউজের আরেক খবরে বলা হয়, ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে এখনো করোনা নিয়ে কোন ভবিষ্যতবাণী করা হয়নি যেমনটা করা হয়েছে অন্টারিতে। তবে কানাডার চীফ পাবলিক হেলথ অফিসার ড. টেরেসা টাম বলেন, এই ধরণের ভবিষ্যতবাণী হুবহু মিলে যাবে এমনটা নয়। বরং আমাদেরকে গুরুত্ব দিতে হবে রিয়েল টাইমে কি ঘটছে তাকে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য আমাদেরকে এখন কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, সেলফ আইসোলেশনে যেতে হবে, ঘন ঘন হাত ধুতে হবে সাবান দিয়ে। করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এখন আমাদেরকে এই কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে। 

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বয়স্কদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বয়স্কদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করা প্রায় প্রতিটি দেশ ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের সেলফ কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।

আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। পাশাপাশি শরীরে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারসহ নানা রোগ বাসা বাঁধে।

এ কারণে শুধু করোনাভাইরাস নয়, যে কোনো ধরনের সংক্রমণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন বয়স্করা। তাদের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে তার সঙ্গে লড়াই করে সফল হতে পারে না রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলো।

এ সময় শরীরে এক ধরনের আলোড়ন তৈরি হয়; যা সংক্রমণের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় অতিরিক্ত পরিমাণে কেমিক্যাল উৎপাদন করে। এমন লড়াই চালাতে গিয়ে শরীরে বিভিন্ন ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যায়। যে কারণে তা বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা তৈরি করে।

ইতালিতে বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় দেশটিতে করোনায় মৃত্যুহার বিশ্বে সর্বোচ্চ। দেশটিতে এই ভাইরাসে যারা মারা গেছেন, তাদের গড় বয়স ৭৮ বছর।

আলজাজিরার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন হৃদযন্ত্রের রোগে আক্রান্তরা। এখন পর্যন্ত করোনায় তাদের মৃত্যুর হার সাড়ে ১০ শতাংশ।

অন্যদিকে ডায়াবেটিসের মতো যারা অন্যান্য গুরুতর রোগে আক্রান্ত তাদের মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে ডায়াবেটিস। যে কারণে কোনো ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে সেটির সঙ্গে লড়াই চালাতে পারেন না ডায়াবেটিস আক্রান্তরা।

ফুসফুসের সমস্যা কিংবা অ্যাজমা রোগীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সমস্যা তৈরি করে করোনাভাইরাস। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ৬ এবং ক্যানসার রোগীদের মৃত্যুর হার ৫.৬ শতাংশ। বলা হচ্ছে, ৮০ বছরের বেশি বয়সী যারা আগে থেকেই অন্যান্য রোগে আক্রান্ত, তারা এই ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। ৮০ বছরের ঊর্ধ্বের বয়সীরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা প্রায় ১৫ শতাংশ।

৫০-এর নিচে যারা করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের মৃত্যুর হার মাত্র ০.২ থেকে ০.৪ শতাংশ। ৫০-৫৯ বছর বয়সীদের প্রাণহানির হার ১.৩ শতাংশ।

এ ছাড়া ৬০-৬৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর এই হার ৩.৬ শতাংশ এবং ৭০-৭৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর হার ৮ শতাংশ।

করোনা নিয়ন্ত্রণে আসবে কবে?

এ প্রশ্ন এখন সবার। বিশ্বের প্রতিটি মানুষের এই একটিই প্রশ্ন এখন, ভয়াবহ এই ভাইরাসের হাত থেকে কবে মানুষের মুক্তি মিলবে? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো কেউ দিতে পারছেন না। এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে তখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার বিস্তার প্রতিদিনই বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি মহামারী তখনই শেষ হয় যখন নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার মতো সংবেদনশীল মানুষের সংখ্যা কমে আসে। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর সময় বিশ্বব্যাপী ৫০ কোটি মানুষ তাতে আক্রান্ত হয়েছিল। এক পর্যায়ে নিজের থেকেই স্প্যানিশ ফ্লুর বিস্তার কমে যায়। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগের আগেও কোটি কোটি মানুষ মহামারীতে মৃত্যুবরণ করেছে। মাত্র এক দশকের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই পূর্ব এশিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপে মহামারী প্লেগের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি থেকে ২০ কোটি মানুষ মারা যায়, যা সমগ্র ইউরোশিয়ার জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি ছিল। কিন্তু তাও একসময় কমে যায়। কারণ যারা এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েও বেঁচে ছিল তাদের মধ্যে ওই রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা জন্মায়। ফলে ভাইরাসটি শুরুতে যেভাবে ছড়াচ্ছিল, পরে আর তা হয়নি। ভাইরাসটি যখন এই চক্রে এগোতে গিয়ে একজনকে আর আক্রান্ত করতে পারে না তখন সেই চক্রটি ভেঙে যায়। তবে এই প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। অবশ্য একশ বছর আগে কোন মহামারী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষের যতটুকু ছিল, বর্তমান যুগে তার চেয়ে অনেক বেশী ক্ষমতা রয়েছে সন্দেহ নেই। তবে ভাইরাসজনিত মহামারী ঠেকাতে হলে মানুষের জীবনযাত্রায় আচরণগত পরিবর্তন আনতে হবে। আর ইতিমধ্যে মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছেও। ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের সংক্রামক রোগতত্তে¡র অধ্যাপক মার্ক উলহাউস বলছেন, ‘নিজেদের জীবনাচরণ, আচরণ ও অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। এর মাধ্যমে নতুন করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার হার কমিয়ে আনা যেতে পারে। মানুষজন হাইজেনিক জীবনযাপন শুরুও করেছে।’

ডাক্তারগণ অনবরত পরামর্শ দিয়ে আসছেন এই বলে যে, হাঁচি-কাশি দিলে যে টিস্যু ব্যবহার করবেন তা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। ভাইরাস যাতে না ছড়াতে পারে সেদিকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। তাই সবসময় সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে দুই হাত ধুয়ে নেবেন অথবা চাইলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন। জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে এখন সবাইকে। ঘরে বা বাড়িতে থাকতে হবে সবার। তাহলেই আমরা এ প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে পারব। আতঙ্কিত না হয়ে সবার উচিত সাবধানতা অবলম্বন করা।

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে ভয় পাবেন না, আতঙ্কিত হবেন না। ভয়ের পরিবর্তে মানুষ যদি অধিকতর সচেতন থাকে, তাহলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা কঠিন কিছু নয়। এ ভাইরাস একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রমণের সুযোগ যদি না পায়, তাহলে তা ছড়াবে না। আবার দ্রুত সময়ের মধ্যে শনাক্ত করা গেলে ব্যবস্থাপনা কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। নতুন এ করোনাভাইরাসের জন্য এখনো কোনো টিকা বা চিকিৎসা উদ্ভাবন না হলেও আনুষঙ্গিক অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি আছে এমন কিছু ওষুধকে নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে কার্যকরী বলে ভাবা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে এমন বেশ কিছু ওষুধ শনাক্ত করা হয়েছে। এদিকে আমাদের সবাইকে গুজব থেকেও সাবধান থাকতে হবে। ডিজিটাল যুগে যে কোনো ভুল তথ্য আগের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়। গুজবের কারণে চিকিৎসা ব্যাহত হতে পারে। এদিকে বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবেই গোপন জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচির কথা বারবার সামনে আসে। একইভাবে এবার ষড়যন্ত্রতত্ত¡প্রেমীদের দাবি নভেল করোনাভাইরাস পৃথিবীর কোনো গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়েছে। যদিও এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।

করোনা প্রতিহত করার জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে

করোনা প্রতিহত করার জন্য আমরা খুব সহজেই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারি। প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে করোনাসহ যে কোনো ভাইরাসজাতীয় অসুস্থতা থেকেই আমরা মুক্ত থাকতে পারি বা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। পুষ্টিবিদ চৌধুরী তাসনীম হাসিন জানান, ভিটামিন এ, সি, কে এবং ফলই সমৃদ্ধ খাবার বাড়াতে পারে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। অর্থাৎ দৃঢ় করবে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেম)। রঙিন শাকসবজি এবং টক জাতীয় বেশি ফল যার অন্যতম উৎস। বেদানায় আছে ক্ষমতাসম্পন্ন anthocyanin যা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করে।

আতঙ্কিত হলে বিপদ বাড়বে

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ানো নতুন করোনাভাইরাসে (কভিড-১৯) মৃত্যুহার বৈশ্বিকভাবে মাত্র ০.৭ শতাংশ। নতুন করোনাভাইরাসের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে মানুষের ভিতরও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কেউ কেউ আবার বলছেন, পৃথিবী ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছে। চীনের এই ভাইরাস প্রতিরোধে যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার পরিণতিতেই বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা আতঙ্কিত না হয়ে এই ভাইরাস প্রতিরোধে সবাইকেই সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। সবাইকে এ সময়টাতে সাবধান থাকতে হবে সব পর্যায়ে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অন্যান্য প্রাণীর মাঝেও থাকতে পারে করোনাভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একটি রোগ পৃথিবীর বুক থেকে পুরোপুরি নির্মূল করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। মানুষের বা অন্য প্রাণীর দেহে কোনো না কোনোভাবে যে কোনো ভাইরাস থেকে যেতে পারে। যা পরবর্তীতে আবার ছড়িয়ে পড়তে পারে। টেনেসির ভ্যানডারবিল্ট ইউনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম স্ক্যাফনার মনে করেন, নতুন করোনাভাইরাস যেহেতু অত্যন্ত সংক্রামক, সেহেতু এটি কখনই পুরোপুরি অদৃশ্য হবে না।

ভয়াবহ এই করোনার বিস্তার কমে যেতে পারে এপ্রিলের শেষে

চীনের শীর্ষস্থানীয় একজন শ্বাসতন্ত্রের রোগবিশেষজ্ঞ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ এই মহামারির বিস্তার কমতে শুরু করবে। হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, চীনের শীর্ষ শ্বাসতন্ত্রের রোগবিশেষজ্ঞ ঝং নানশান বলেছেন, ‘সব দেশই যেহেতু জোরদার ও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে, কাজেই আমার বিশ্বাস, এপ্রিলের শেষ নাগাদ করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসবে।’ করোনা মহামারি মোকাবিলায় চীনের সরকারকে পরামর্শদাতা বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ঝং নানশান। চীনের শেনজেন টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই আশাবাদের কথা জানান। তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এপ্রিলের পর কী ঘটবে, তা কেউ বলতে পারে না। হতে পারে আগামী বসন্তে আরেক দফায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতে পারে, অথবা পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে।

অন্যান্য গবেষকদের কেউ কেউ বলছেন উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের রাশ টেনে ধরতে পারে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষক কাশিম বুখারিসহ বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং আবহাওয়ার দুটি মানদন্ড তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ভিত্তিতে পরিস্থিতি যাচাই করেছেন।

এসএসআরএনএ এই গবেষণার যে ফলাফল পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২২ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের যে যে অঞ্চলে সার্স-কোভ-২ ছড়িয়েছে, সেসব অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল ৩ থেকে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। গবেষকেরা আরও বলছেন, ওই অঞ্চলে প্রতি ঘনমিটারে ওই আবহাওয়ায় আর্দ্রতা ছিল ৪ থেকে ৯ গ্রাম। এমআইটির বিজ্ঞানীরা বলছেন, আক্রান্ত দেশগুলোর গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এশিয়ার যে দেশগুলোয় বর্ষা মৌসুম আছে, সে দেশগুলোয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়তো কম হবে। কারণ এই অঞ্চলগুলোয় প্রতি ঘনমিটারে আর্দ্রতার পরিমাণ ১০ গ্রাম পর্যন্ত। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত মত দেওয়ার সময় আসেনি।

এদিকে বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানী গবেষণা করে এখনো এর ক‚লকিনারা খুঁজে পাননি।

তবে অনেক গবেষক দাবি করছেন, তাঁরা ওষুধ বের করে ফেলেছেন। প্রাথমিক পরীক্ষায়ও পাস। এখন কোনো কোনো রোগীর ওপর পরীক্ষা চলছে। ওষুধ বা টিকা এসে গেল বলে। আর টিকা আবিষ্কার হলেই তো করোনার দিন শেষ। অবশ্য কিছু সময় লাগবে। সেটার জন্য এক বছর বা দুই বছর অথবা তারচেয়েও বেশী সময় লাগতে পারে! এটাই নিয়ম। কারণ মানুষের ওপর কোনো ওষুধ বা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাই না করে তো বাজারে ছাড়া যায় না।

জেনে নিন করোনার সত্য-মিথ্যা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এই সুযোগে অনেক ভুল তথ্যও ছড়াচ্ছে। মনে রাখতে হবে, করোনা প্রতিরোধে সচেতনতাই সবচেয়ে জরুরি। করোনা নিয়ে ছড়ানো ভুল তথ্যগুলোর ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। ভাইরাসটি নতুন। এ নিয়ে এখন গবেষণা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিডিসি করোনা বিষয়ে কী করবেন, কী করবেন না, তা তুলে ধরেছে। জানিয়েছেন ডা. তানজিনা হোসেন

– একটু পরপর পানি, লবণ বা ভিনেগার মিশ্রিত পানি বা গরম পানি পান করলে কিংবা গলা ভেজালে অথবা রসুন মুখে রাখলে করোনা গলা থেকে ফুসফুসে যায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের একটি তথ্য ঘুরছে। এই তথ্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

– থার্মাল স্ক্যানার কেবল শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয় করে। এর মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কাজেই থার্মাল স্ক্যানারে ধরা না পড়লে করোনা হয়নি, এমন মনে করা ঠিক নয়। সাধারণত উপসর্গ দেখা দিতে ২ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্তত ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।

– করোনার প্রতিষেধক: মানুষের ব্যবহারের জন্য স্বীকৃত ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক তৈরি হতে বেশ সময় লাগে। ২০০৩ সালে ছড়ানো সার্সের প্রতিষেধক তৈরি করতে ২০ মাস এবং আফ্রিকার দেশগুলোয় ছড়ানো ইবোলার প্রতিষেধক তৈরি করতে ৭ বছরের বেশি সময় লেগেছে। করোনার প্রতিষেধক তৈরির জোর চেষ্টা চলছে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষেধক তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগবে অবশ্যই।

– ফেস মাস্কে করোনা প্রতিরোধ করা যায়, এটিও একটি ভুল ধারণা। সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পরার পর মুখ ও মাস্কের মধ্যে বেশ খানিকটা ফাঁকা থাকে, যা ড্রপলেট (মুখ নিঃসৃত ক্ষুদ্র তরল কণা) প্রবেশের জন্য যথেষ্ট। এন-৯৫ মাস্ক বাতাসের ৯৫ শতাংশ শূন্য দশমিক ৩ মাইক্রন বা তার চেয়ে বড় কণা আটকাতে পারে। তার মানে এই নয় যে এটি পরলে করোনা প্রতিরোধ করা যাবে। কোভিড-১৯ রোগী এবং রোগীর পরিচর্যাকারী, সেবাদানকারী, হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সদের মাস্ক পরা জরুরি।

করোনা নিয়ে আরো কিছু ভুল ধারণা

– উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতেও কোভিড-১৯ ছড়ায় না-ভুল

নতুন করোনাভাইরাস উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় সংক্রমিত হয় না বলে একটি তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চারিত হতে শোনা যায়। তথ্যটি ভুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এখন পর্যন্ত উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াসহ সব ধরনের পরিবেশ এবং এলাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জলবায়ু ও আবহাওয়া যেমনই হোক, সতর্ক থাকুন। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে এমন এলাকা ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন। মনে রাখবেন, কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হচ্ছে একটু পরপরই সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। একই সঙ্গে হাত দিয়ে নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

– তুষার ও ঠান্ডা আবহাওয়া করোনা ভাইরাসকে মারতে পারে-ভুল

করোনাভাইরাস বা অন্য কোনো রোগ প্রতিরোধে ঠান্ডা আবহাওয়া কার্যকর—এমনটি ভাবার কোনো কারণই নেই। কারণ, বাইরের তাপমাত্রা যা-ই হোক না কেন, মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৯৭-৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) মধ্যেই থাকে।

– গরম পানিতে গোসল করোনা ভাইরাস রোধে কার্যকর-ভুল

নতুন করোনাভাইরাস থেকে প্রতিরোধের উপায় হিসেবে অনেকে গরম পানিতে গোসলের কথা বলছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গরম পানিতে গোসলের মাধ্যমে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা যাবে না। কারণ, বাইরের তাপমাত্রা যা-ই হোক না কেন, মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৯৭-৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) থাকে। মনে রাখবেন, কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হচ্ছে একটু পরপরই সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। এর মাধ্যমেই আপনার হাতে থাকা জীবাণু অপসারিত হবে। একই সঙ্গে হাত দিয়ে নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

– করোনা ভাইরাস মারতে হ্যান্ড ড্রায়ার কার্যকর-ভুল

হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে হাত শুষ্ক করার মাধ্যমে নতুন করোনাভাইরাসকে মারা যায় না। কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হচ্ছে একটু পরপরই সাবান-পানি বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। হাত ধোয়ার পরপরই টিস্যু পেপার বা উষ্ণ বাতাস বা হ্যান্ড ড্রায়ার দিয়ে হাত শুকিয়ে নিন। একই সঙ্গে হাত দিয়ে নাক-চোখ-মুখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

– সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন ছিটিয়ে করোনামুক্ত থাকা যায়-ভুল

এককথায় উত্তর, ‘না’। পশ্চিমা দেশে এ ধরনের কিছু বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যে ভাইরাস এরই মধ্যে শরীরে প্রবেশ করেছে, তাকে মারতে সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন বা বিøচিং ছড়িয়ে কোনো লাভ নেই। এ ধরনের রাসায়নিকের সংস্পর্শ চোখ ও মুখের ত্বক ও ঝিল্লি (মিউকাস মেমব্রেন) ক্ষতি করে। এ দুটি রাসায়নিকই ঘরদোর পরিষ্কারের কাজে লাগে। তবে ব্যবহারের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ মেনে ব্যবহার করতে হবে।

– নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন করোনা থেকে সুরক্ষা দেবে- ভুল

না। নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন বা হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি ভ্যাকসিনসহ নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন শুধু নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধেই কার্যকর। এগুলো নতুন করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেবে না। এই ভাইরাস একেবারেই নতুন এবং আগেরগুলোর চেয়ে আলাদা যে এর প্রতিরোধে একেবারে নতুন ভ্যাকসিনেরই প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের গবেষকেরা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন, যেখানে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিদ্যমান ভ্যাকসিনগুলো কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর না হলেও শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা রোধে বিদ্যমান ভ্যাকসিন যেকোনো মানুষেরই গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

বারবার হাত ধোয়া ও হাত নাকে-মুখে-চোখে না লাগানোই সবচেয়ে ভালো প্রতিরোধ। হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে সাবান-পানি সবচেয়ে কার্যকর। করোনাভাইরাসের বাইরের আবরণটি চর্বির। কাজেই ক্ষারযুক্ত যেকোনো সাধারণ সাবান এ ক্ষেত্রে কার্যকর। কারণ, ক্ষারে চর্বির আবরণটি ভেঙে যায়, হাত ভাইরাসমুক্ত হয়। সাবান-পানি না থাকলে অ্যান্টিসেপটিক হ্যান্ডওয়াশ বা অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে পারেন।

করোনা ছড়ায় যেভাবে: সংক্রমিত ব্যক্তির শ্বাসপ্রশ্বাস, হাঁচি-কাশি কিংবা কথা বলার সময় মুখ থেকে নিঃসৃত তরল কণা বা ড্রপলেটের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে যেকোনো বস্তু বা তলে লেগে যায় করোনাভাইরাস। সে জায়গা স্পর্শ করলে হাত থেকে ভাইরাসটি নাক-চোখ-মুখ দিয়ে সুস্থ ব্যক্তিও আক্রান্ত হতে পারে। তাই পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। অন্তত তিন ফুট দূরে থাকতে হবে।

আশার আলো

চীন সরকারের দেওয়া তথ্যমতে, মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে গোটা দেশে স্থানীয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে। কিন্তু বিদেশফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে এখন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চীনা কর্তৃপক্ষ বিদেশি নাগরিকদের দেশটিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। বিদেশফেরত চীনা নাগরিকদেরও বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নেচার সাময়িকীর অনলাইনে গত সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে সংক্রমণ কমে আসায় এখন চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে, কাজে যোগ দিচ্ছে। এই অবস্থায় হংকংয়ের ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ গ্যাব্রিয়েল লিউং মনে করেন, একবার লকডাউন বা অবরুদ্ধ করে এই ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা হয়তো সম্ভব নয়। করোনা রুখতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের চেষ্টা চালাতে হবে। তিনি বলেন, একটা দেশের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হলে তাঁদের শরীরে এই ভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার কথা। এমনটা হলে ভাইরাসটি আবার ছড়িয়ে পড়া কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু যে উহানে বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেন, সেখানে কিন্তু সেরে ওঠা রোগীদের ৯০ শতাংশের বেশি আবার সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন। তার মানে, করোনা ঠেকাতে প্রতিষেধকই অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু প্রতিষেধক উদ্ভাবনে আরও এক বছরের মতো সময় লাগতে পারে।

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের রোগবিশেষজ্ঞ এন্ড্রু টাটেম বলেন, কড়াকড়ি শিথিল করলে কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তা বুঝতে হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের রোগতত্ত¡বিদ বেন কাওলিং বলেন, চীন সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে কড়াকড়ি আরোপ করেছিল। দ্রুততর সময়ে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল নির্মাণ করেছে। এতেই থেমে থাকেনি তারা। ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করেছে তারা। চিকিৎসাকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করেছেন। কারও জ্বর পেলেই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলেছেন। তিনি বলেন, এই অতি তৎপরতার কারণেই তাঁরা ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছেন। অন্য দেশগুলোও এখন চীনকে অনুসরণ করছে। তবে চীন যেভাবে কাজটা করেছে, তারা সেভাবে পারছে না। কাওলিং বলেন, ‘আমাদের দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে।’

এদিকে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনার প্রকোপ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও ইউরোপের ইটালি ও স্পেনে সংক্রমনের মাত্রা কমে আসছে। সংক্রমনের মাত্রা কমে আসছে কানাডার পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রভিন্স ব্রিটিশ কলম্বিয়তেও। তার অর্থ হলো আশার আলো দেখা যাচ্ছে। আমরা আতঙ্কিত না হয়ে সজাগ থাকলে, ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হব আমরা।