রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ
২০২০ সালের মুখ্য কুশীলব যারা
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০
সবারই দৃষ্টি ২০২০ সালের রাজনীতির দিকে। এই সময়ের মধ্যে কানাডার রাজনীতিতে কোন কোন নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবেন বা কারা রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কুশিলব হয়ে উঠবেন তা নিয়ে কৌতুহল অনেকেরই। ছবি: সংগৃহীত
খুরশিদ আলম : রাজনীতি এমনই এক বিষয় যা কখনোই আপনার পিছু ছাড়বে না। আপনি রাজনীতি করতে না চাইলেও রাজনীতি আপনাকে ছাড়বে না। আপনি রাজনীতি পছন্দ না করলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আপনার জীবনের প্রায় প্রতিটি বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করবেই। হতে পারে সেটা পারিবারিক বা সামাজিক অথবা আর্থিক বিষয়। এমনকি আপনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ও।
তবে এই প্রভাব খারাপ হবে না ভাল হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে যারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর। আরো নির্ভর করে তারা কতটা জনবান্ধব বা জনগণের সেবায় তারা কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। একজন রাজনীতিক সৎ হতে পারেন অথবা অসৎও হতে পারেন। বিশ্বসাহিত্যের নমস্য লেখক মার্ক টোয়েনের ভাষায় “একজন সৎ মানুষকে অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে রাজনীতিতেই বেশি উজ্জ্বল দেখায়!”
কিন্তু রাজনীতিতে সেরকম সৎ মানুষের অভাব অতীতে যেমন ছিল এখনো তেমনি রয়ে গেছে। তবে আশার কথা এই যে, কানাডার রাজনীতি বিশ্বের অনেক দেশের রাজনীতির তুলনায় অধিকতর বিশুদ্ধ ও স্বচ্ছ। জনগণকে ফাঁকি দিয়ে বা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে এখানে কেউ বেশীদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন না। এখানে জবাবদিহিতার বিষয়টি বেশ প্রাধান্য পায়। মিথ্যা বলে পার পাওয়াও কঠিন। আমরা দেখেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদিনই প্রকাশ্যে মিথ্যা কথা বলেন। ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, তাদের রেকর্ড অনুযায়ী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ পর্যন্ত ৭৬ হাজারবার মিথ্যা বলেছেন বা বিভ্রান্তিমূলক কথা বলেছেন! কানাডায় এ কথা চিন্তাও করা যায় না।
অবশ্য কানাডিয়ান রাজনীতিবিদগণ যে জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন সে কথা খুব জোর দিয়ে বলার অবকাশ নেই। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে ৮৮ শতাংশ কানাডিয়ান মনে করেন, রাজনীতিকরা যথাকর্তব্য সম্পাদনের চেয়ে বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপারে বেশি যত্নবান। অন্যদিকে ৪৭ শতাংশ বলেছেন, কোনও দলই তাদের (জনগণের) আশা-আকাঙ্খার প্রতিনিধিত্ব করে না। অবশ্য প্রথম ভোটার হওয়া কানাডীয়দের মধ্যে এই মনোভাব খুব জেরোলো নয়। বরং ২৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে যাদের বয়স তাদেরই বেশিরভাগ মনে করেন কোনও রাজনৈতিক দলই তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মনোযোগী নয়।
যারা দেশ পরিচালনা করে তাদের সঙ্গে অন্য সবার দূরত্বের যে অনুভূতি সেটাই জনগণের রাজনীতি নিয়ে মোহমুক্তির অন্যতম কারণ বলে মনে হয়। ৭৮ শতাংশ মানুষ বলেন, তাদের বিশ্বাস, দেশ “সাধারণ মানুষ” এবং “অভিজাত শ্রেণী”র মধ্যে বিভক্ত। সিবিসি নিউজের পক্ষে জরিপটি পরিচালনা করে Public Square Research and Maru/Blue.
জরিপে ব্যক্তিগত ও বৈশ্বিক নানা কারণে সৃষ্ট গভীর উদ্বেগের বিষয়টি উঠে এসেছে। যেসব বিষয়ে কানাডীয়রা উদ্বিগ্ন তার তালিকার শীর্ষে রয়েছে খাদ্য ও গ্যাসের মতো মৌলিক ভোগ্যপণ্যের মূল্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মতো বিষয়গুলো। জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন নাগরিকদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ৮৩ শতাংশ বলেছেন, তারা নিত্যদ্রব্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো পণ্যের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে অর্ধেকের বেশি সংখ্যক বলেন, তারা আবাসন বা অবসরের পর তেমন কোনও সঞ্চয় থাকবে কিনা সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।
এর পরও কানাডীয়রা মনে করেন, গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জরিপে অংশ নেওয়াদের এক বিরাট অংশ (৯৫ শতাংশ) বলেন, ভোট দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য এই বক্তব্যের ব্যাপারে তারা জোরালোভাবে কিংবা অনেকটাই একমত। ৭৫ শতাংশ বলেন, তারা এব্যাপারে জোরালোভাবে একমত। এই বিষয়ে এমন সর্বসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি আদিবাসী জনগণ এবং প্রথম ভোটার হওয়া লোকজনসহ সব অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান।
সামনে আপাতত কোন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন নেই। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে গত ২১ অক্টোবর। ঐ নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন লিবারেল পার্টি আবারো জয়ী হয়েছে। তবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচনে মোট ৩৩৮ টি আসনের মধ্যে লিবারেল পার্টি পেয়েছে ১৫৭ টি আসন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল ১৭০টি আসনের। নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এন্ড্রু শিয়ার এর নেতৃত্বাধীন কনজার্ভেটিভ পার্টি। ১২১ টি আসন পায় দলটি। তৃতীয় স্থান দখল করে ব্লক কুইবেকো। এই দলটি আসন পায় ৩২টি। আর জাগমিত সিং এর নেতৃত্বাধীন এনডিপি আসন পায় ২৪টি।
তবে এখন সবারই দৃষ্টি ২০২০ সালের রাজনীতির দিকে। এই সময়ের মধ্যে কানাডার রাজনীতিতে কোন কোন নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবেন বা কারা রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কুশিলব হয়ে উঠবেন তা নিয়ে কৌতুহল অনেকেরই। আবার কেউ কেউ মঞ্চ থেকে বিদায়ও নিবেন। এরমধ্যে অন্যতম হলেন কনজার্ভেটিভ পার্টির এন্ড্রু শিয়ার। গত জাতীয় নির্বাচনে তিনি দলের আসন সংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন সত্যি, কিন্তু দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে পারেননি। তিনি দলের প্রধান হিসাবে থাকছেন না। আগামী ২৭ জুন কনজার্ভেটিভ পার্টি তাদের নতুন নেতা নির্বাচন করবে। অন্যদিকে অন্টারিও’র লিবারেল পার্টিও তাদের নতুন নেতা নির্বাচন করবে আগামী ৭ মার্চ। অন্টারিও’র গত পার্লামেন্ট নির্বাচনে দলটি গো-হারা হেরেছে। ক্ষমতা থেকে সিটকে গিয়ে অপজিশন পার্টির মর্যাদাও হারিয়েছে তারা।
এনডিপি’র জাগমিত সিং-কে নিয়েও কৌতুহল আছে অনেকের। কারণ তিনি এখন জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার বিষয়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। পার্লামেন্টে কোন ইস্যুতে প্রধান বিরোধী দল অনাস্থার প্রস্তাব উঠালে তখন এই জাগমিতই ট্রুডোর ভরসা। অবশ্য ব্লক কুইবেকাও এগিয়ে আসতে পারে ট্রুডোকে রক্ষা করার জন্য। তবে এসবই নির্ভর করছে কার কতটা স্বার্থ রক্ষা হবে সে বিষয়ের উপর।
অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড-কে নিয়েও আলোচনা সমালোচনা বিস্তর হচ্ছে। ২০২০ সালে তিনিও থাকবেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। অন্টারিও’র ইতিহাসে তার মতো এত অজনপ্রিয় প্রিমিয়ার আর কেউ আসেননি আগে। কেউ কেউ বলছেন অন্টারিওতে ড্যাগ ফোর্ডের বিজয় এক অর্থে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের বিজয়।
ইতিমধ্যে ২০২০ সালের এক মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তবে কানাডার রাজনীতিতে বড় ধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি এখনো। অচিরেই কিছু ঘটবে তেমন লক্ষণ এই মূহুর্তে দেখা যাচ্ছে না।
২০২০ সালে কানাডার রাজনীতিতে যাদের ভ‚মিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তাদের মধ্য অন্যতম হলেন জাস্টিন ট্রুডো। দলের প্রধান এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে তার রাজনৈতিক ভ‚মিকা সবচেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করবে এটাই স্বাভাবিক।
আমরা দেখেছি, জাস্টিন ট্রুডো গত বছর অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগড়িষ্ঠ আসন পাননি, যেটা পেয়েছিলেন ২০১৫ সালের নির্বাচনে। ২০১৫ সালে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। নির্বাচিত হওয়ার পর শুধু কানাডায় নয়, বিশ্বব্যাপী তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন জনপ্রিয় সরকার প্রধান। তিনি দেশে বিদেশে যেখানেই যেতেন সেখানেই নায়ক বা রকস্টাদের মতো সম্বর্ধনা পেতেন। সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী জাস্টিন ট্রুডোর বয়স তখন ৪৩। কেউ কেউ মজা করে বলেন সেক্সিয়েস্ট প্রাইম মিনিস্টার অন আর্থ। জন্মেছিলেন বিশেষ একটি দিনে। ২৫ ডিসেম্বর। খ্রীস্টানদের বড় দিন। যীশু খ্রীস্টের জন্মদিন।
প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই কানাডার রাজনীতিতে নাটকীয় সব পরিবর্তনের ছোয়া লাগান জাস্টিন ট্রুডো। কৃতিত্বে ছাপিয়ে যান অনেক কিছুতেই। সরকার গঠনের শুরুতেই চমক সৃষ্টি করেন জাস্টিন ট্রুডো। তিনি পাল্টে দেন মন্ত্রীসভার গতানুগতিক চেহারা। মন্ত্রী সভায় তিনি যাদের ডেকে আনেন তাদের অর্ধেকই মহিলা এবং এথনিক কমিউনিটি থেকে নির্বাচিত বেশ কয়েকজনও ঠাই পান তার মন্ত্রী সভায়। এদের কেউ কেউ পান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব। ঐ সময় জরীপ প্রতিষ্ঠান এবাকাস ডাটা’র প্রধান নির্বাহী ডেভিড কলেটো বলেন, নির্বাচনে জাস্টিন ট্রুডো তার সমালোচকদের বোকা বানিয়েছেন এবং ক্ষমতা গ্রহনের পর রাজনীতিকদের প্রতি জনগনের প্রত্যাশাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
কানাডার জনগন চান রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও অবারিত দ্বার। ট্রুডো কানাডার রাজনীতিতে সেই বিষয়গুলোই আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার করেছেন ঠিক তার উল্টোটি। জনগন এমনকি পার্টির লোকদের কাছেও তিনি স্বচ্ছ ছিলেন না। গোপন দ্বার বৈঠকে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে ও চাপিয়ে দিতে ভালবাসতেন।
তবে জাস্টিন ট্রুডো তার এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা গত ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে আর ধরে রাখতে পারেননি। এমনকি, এমনো আশংকা দেখা দিয়েছিল যে, তিনি হয়তো নির্বাচনে পরাজিতও হতে পারেন। নির্বাচনের কয়েকমাস আগে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন এর দুর্নীতি নিয়ে এক লঙ্কাকান্ড ঘটেছিল কানাডার রাজনীতিতে। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডার রাজনীতিতে এমন তুমুল বিতর্ক আর কোন ইস্যু নিয়ে হয়নি। আর এই বিতর্কটি শুরু হয় লিবারেল পার্টির সাবেক ভেটেরান এ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী জোডি উইলসন-রাইবোল্ড এর পদত্যাগের পর। এর আগে তিনি এটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
জোডি উইলসনের অভিযোগ ছিল, তিনি এটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তার উপর অনৈতিকভাবে তীব্র চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তিনি যাতে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন এর বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতি মামলায় সাজা না হওয়ার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন। আর এই চাপ এসেছিল প্রধানন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অফিসে কর্মরত সিনিয়র স্টাফ মেম্বারদের কাছ থেকে। কয়েকজন মন্ত্রীও এই চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।
কিন্তু জোডি উইলসনের এই অভিযোগ অস্বীকার করেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এসএনসি-লাভালিন এর বিষয়ে পক্ষপাতমূলক কিছু বলা হয়নি এবং কোন সুবিধাও চাওয়া হয়নি। আর নিয়ম ভঙ্গ করে কোন চাপও প্রয়োগ করা হয়নি ডোডি উইলসনের উপর।
নির্বাচনের আগে আরেক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন জাস্টিন ট্রুডো তার ব্রাউন ও ব্ল্যাক মাস্ক পড়া নিয়ে। ঘটনাটি ছিল প্রায় দেড় যুগ আগের। তখন স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে ‘কালো মেকআপ’ পরেছিলেন তিনি। মেকআপ এর ঐ ছবিটি মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়। এর পর ওই ঘটনার জন্য অকপটে ক্ষমা চেয়েছেন ট্রুডো। নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ওই ছবিটি টাইম ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়ার পর থেকে কানাডার রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। ছবিটি নিয়ে ‘গভীরভাবে অনুতপ্ত’ ট্রুডো বলেন, ওই মেকআপ নেওয়ার আগে তার বিষয়গুলো সম্পর্কে আরও ‘ভালো করে জানা উচিত ছিল’।
তবে নির্বাচনের ফলাফলে ঐ সব ঘটনার প্রভাব পড়ে থাকলেও তিনি জয়ী হন, যদিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। তবে কৌতুহলের বিষয় হলো, নির্বাচনের পর জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকটা দ্রুত গতিতেই! নির্বাচনের আগে যেখানে সার্বিকভাবে ভোটারদের কাছে জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা যেখান ছিল ৩৪%, তা এখন বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছে ৫০% এ। Ekos Politics poll এর জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। মাত্র তিন মাসেই এই অগ্রগতি! অবশ্য ২০১৬ সালের তুলনায় এই জনপ্রিয়তা অনেকটাই কম। তখন জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তার হার ছিল ৭০%।
অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ইরানে বিমান দুর্ঘটনা ঘটার পর বিষয়টি যে ভাবে শক্ত হাতে মোকাবেলা করেছেন তা সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তিনিই প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন যে, ইরানের আকাশ সীমায় ইউক্রেনিয়ান বিমানটি মিসাইল আক্রমণের শিকার হয়ে ভূপতিত হয়। ঐ দুর্ঘটনায় ৫৭ কানাডিয়ান মৃত্যুবরণ করেন। আর এর জন্য তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও দায়ী করেছেন। অবশ্য ট্রাম্প এর নাম তিনি সরাসরি মুখে আনেননি। তবে তার কথায় এটি স্পষ্ট ছিল যে, ঐ এলাকায় টেনশন তৈরী না হলে এই দুর্ঘটনা ঘটতো না। আর ঐ টেনশন তৈরী হয়েছিল সম্প্রতি ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর। সোলাইমানিকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে ইশ্বর তার পাশে আছেন বলে দাবি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই। এর প্রতিশোধ হিসাবে কদিন পর ইরান বাগদাদে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেনা ঘাটিতে রকেট হামলা চালায়। বিমান দুর্ঘটনাটি ঐ সময়ই ঘটে ইরানের একটি রকেট হামলায়। ইরান অবশ্য প্রথম অস্বীকার করে আসছিল এই বলে যে, এই দুর্ঘটনার পিছনে তাদের হাত ছিল না। ইরানে বিমান দুর্ঘটনার পর জাস্টিন ট্রুডো যেভাবে বিষয়টি মোকালেবা করেছেন হয়তো সে কারণেই তার জনপ্রিয়তা আবারো বৃদ্ধি পেয়ে থাকতে পারে। আর এ কথা বলেছে জরিপ প্রতিষ্ঠান Ekos Politics poll.
এখন অবশ্য জাস্টিন ট্রুডোর সামনে নতুন আরেক চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ খুব কঠিন চ্যালেঞ্জ। আর সেটি হলো – করোনাভাইরাস। এই ভাইরাস কানাডিয়ানদের জন্য কতটা হুমকী সৃষ্টি করবে তা এখনি বলা যাচ্ছে না। চীনের উহান শহর থেকে বিশ্বে আতঙ্ক ছড়ানো করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই সমগ্র বিশ্বকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জরুরি বিভাগের প্রধান ডা. মাইক রায়ান। কানাডাসহ চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, জাপান এবং থাইল্যান্ডসহ অন্তত ১৯টি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে।
এই করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও সজাগ হয়ে উঠেছেন। পহেলা ফেব্রুয়ারি তিনি টরন্টোর স্কারবরোতে চাইনিজ লুনার নিউ ইয়ার উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে ভাষণ দেন। ভষণে তিনি সকল কানাডিয়ানকে করনো ভাইরাস মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। একই সাথে তিনি এই রোগ সম্পর্কে ভুল তথ্যের কারণে কেউ যাতে বৈষম্যের শিকার না হন সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখারও আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় করোনা ভাইরাসের কারণে অনেকেই স্থানীয় চাইনিজ জনগোষ্ঠির সংর্স্প এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন। তাদের দোকান বা অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় চাইনিজ নেতৃবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করার পর প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই আহ্বান জানান। স্বরণ করা যেতে পারে যে ২০০৩ সালে সার্স এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে কানাডার চাইনিজ জনগোষ্ঠি একই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত নির্বাচনের পর জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তা আবারো বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সামনে এই মুহ‚র্তে আরো যে সব চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান সেগুলো তিনি কিভাবে মোকাবেলা করবেন তার উপর নির্ভর করছে এই জনপ্রিয়তা আগামীতে আরো বাড়বে না কমে যাবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মধ্যে আছে : বর্ডার সিকিউরিটি, পাইপলাইন নির্মাণ, হাউজিং ক্রাইসিস ইত্যাদি।
বর্ডার সিকিউরিটি নিয়ে কানাডায় দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা সমালোচনা চলে আসছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন তার পর থেকেই এই ইস্যুটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরই যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ কাগজপত্রহীন বিপুল সংখ্যক শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে কানাডায় আসা শুরু করে। এতে করে কানাডিদের মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে একটি উত্তেজনা লক্ষ্য করা যায়। লেগার-এর এক নতুন জরিপ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কানাডীয়দের ৬৩ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন, যে পরিমাণে অভিবাসী গ্রহণ করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিৎ তা সীমিত করে আনা।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, অভিবাসনের পরিমাণ কমিয়ে আনার পক্ষে রয়েছেন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কনজারভেটিভ দলের ভোটাররা। এর পরেই আছেন গ্রিন পার্টির সমর্থকরা। কনজারভেটিভ দলের ৮১ শতাংশ এবং গ্রিন পার্টির ৫৭ শতাংশ লোক এই মতের পক্ষে বলেছেন। অন্যদিকে, লিবারেল দলের ৪১ শতাংশ এবং এনডিপির ৪৪ শতাংশ সমর্থক অভিবাসন কমানোর পক্ষে রয়েছেন। সুতরাং এ বিষয়টি জাস্টিন ট্রুডো কি ভাবে মোকাবেলা করবেন তার উপরও নির্ভর করছে আগামীতে তার জনপ্রিয়তা কোন দিকে মোড় নেয়।
পাইপলাইন নির্মান এর বিষয়টিও ট্রুডোর জন্য একটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, গত নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর পরই কানাডার পশ্চিমে অবস্থিত সাস্কাচুয়ান ও আলবার্টা প্রভিন্সে Wexit নামের এক আন্দোলন দানা বাধতে থাকে। এই আন্দোলনকারীরা দাবী তোলে কানাডা থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্য। বেশ কয়েক বছরের অর্থনৈতিক মন্দা এবং ফেডারেল সরকারের আচরণের কারণে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দানা বেধে উঠে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন জাস্টিন ট্রুডো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য ট্রান্স মাউন্টেন পাইপলাইন নির্মাণের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। মনোযোগ অবশ্য দিয়েছিলেন ট্রুডো। নির্মাণ কাজ এগিয়েও নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু কয়েকটি আদীবাসী গ্রুপের মামালার মুখে পড়ে নির্মাণ কাজটি স্থগিত ছিল বেশ কিছুদিন। তবে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ফেডারেল কোর্ট অফ এ্যাপিল সেই মামলা খারিজ করে দেন। ফলে নির্মাণ কাজ আবারো শুরু করার পথ সুগম হলো। এই পাইপ নির্মাণের কাজে ব্যয় হবে ৭.৪ বিলিয়ন ডলার। এটি নির্মিত হলে আলবার্টা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ মিলিয়ন ব্যরেল তেল সরবরাহ করা যাবে ভেঙ্গুভারে।
কনজার্ভেটিভ পার্টি ছাড়া আদীবাসীদের পাশাপাশি অন্যান্য বিরোধী দল এই পাইপলাইনের বিরোধীতা করে আসছে পরিবেশ দুষণের এর দোহাই দিয়ে। তবে কনজার্ভেটিভ পার্টির সমর্থন নিয়ে ট্রুডো হয়তো এগিয়ে যেতে পারেন এই পাইপলাইন নির্মাণ কাজে যেটি পশ্চিমের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে প্রশমিত করবে।
এদিকে হাউজিং ক্রাইসিস কানাডায় বিশেষ করে টরন্টো এবং ভেঙ্গুভারে একটা বড় ধরণের সংকট তৈরী করেছে। টরন্টোর রিয়েল এস্টেট বোর্ড (TREB) বলেছে, গত অক্টোবরে নগরীর বাড়ির বিক্রয় মূল্য একবছর আগের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে যদিও তখনও দাম বাড়তিই ছিলো। বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মাইকেল কলিন্স এক বিবৃতিতে বলেন, “আঞ্চলিক অর্থনীতি জোরদার হওয়ায় নিশ্চিতভাবেই এখানে জনসংখ্যা বাড়বে। এই বাড়তি পরিবারগুলোর বসবাসের জন্য জায়গার দরকার হবে এবং অনেক পরিবারেরই বাড়ি কেনার লক্ষ্য থাকবে।” তিনি বলেন, “সমস্যা হলো, বিক্রির জন্য নিবন্ধিত বাড়ির সংখ্যা আসলে কমছে। এর ফলে বাড়ির বাজার পরিস্থিতি কঠিন হবে এবং দামের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে।” কানাডিয়ান প্রেস এর এক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা যায়।
বাড়ির সরবরাহ কম থাকার কারণে বাড়িভাড়ার পরিমাণও বাড়বে। বোর্ড বলছে, চলতি বছর একটি এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া গত বছরের তুলনায় মোটামুটি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,২০৯ ডলারে এবং দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া ৪ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৮৮৮ ডলারে।
অর্থাৎ টরন্টোতে হাউজিং ক্রাইসিস এক বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। ভেঙ্গুভারেও কমবেশী প্রায় একই অবস্থা। জাস্টিন ট্রুডোর সামনে এটিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে তার জনপ্রিয়তায় ঘাটতি দেখা দিবে সন্দেহ নেই।
এনডিপি নেতা জাগমিত সিং
২০২০ সালে এনডিপি নেতা জাগমিত সিং কানাডার রাজনীতিতে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। তবে তার নিজের অবস্থানও যে শক্ত মাটির উপর দাড়িয়ে তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ, দলটি তার নেতৃত্বে গত নির্বাচনে অনেকদূর পিছিয়ে গেছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তৎকালীন দলীয়প্রধান টম মুলকেয়ার এর নেতৃত্বে এনডিপি পার্লামেন্টে আসন পেয়েছিল ৪৪টি। আর ২০১১ সালে জ্যাক লেটনের নেতৃত্বের সময় দলটি পার্লামেন্টে আসন পেয়েছিল ১০৩টি। সেখান থেকে বর্তমান নেতা জাগমিত সিং এর নেতৃত্বে দলটি পার্লামেন্টে আসন পেয়েছে মাত্র ২৪টি। নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক আসন হারিয়ে টম মুলকেয়ারকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল দলীয় প্রধানের পদ থেকে। যদিও তিনি নিজে থেকে পদত্যাগ করতে চাননি। কিন্তু জাগমিত সিং নির্বাচনে প্রায় অর্ধেক সিট হারালেও এখনো পদত্যাগ করেন নি। বা তার পদত্যাগ নিয়ে দলে তেমন উচ্চবাচ্য হচ্ছে না। তবে কানাডার ইতিহাসে তিনিই প্রথম বাদামী ব্যক্তি যিনি কোন ফেডারেল পার্টির প্রধান নেতা নির্বাচিত হন। এটা তার জন্য ছিল একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা। এবং গত নির্বাচনে কানাডার ইয়ং ভোটারদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলন তিনি। জাগমিত সিং এর প্রস্তাবিত ইউনিভার্সাল ফার্মাকেয়ার এবং এ্যাফোর্ডএ্যাবল হাউজিং প্লাটফরম বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। হয়তো লিবারেল পার্টিকে চাপ দিয়ে এ দুটি বিষয় আদায় করে নেয়া খুব কঠিন হবে না। কারণ, পার্লামেন্টে সংখ্যালঘু লিবারেল পার্টিকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে এনডিপি’কে হাতে রাখতে হবে।
ব্লক কুইবেকো নেতা ইয়ভেস-ফ্রাঙ্কোয়েস ব্ল্যানচেট
ব্লক ইজ বেক। অর্থাৎ ব্লক কুইবেকো পার্টি আবার ফিরে এসেছে। দলটি সম্পর্কে এমনটাই বলা হয়ে আসছে গত জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে। কিন্তু ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে এই দলটির তেমন কোন খবরই ছিলনা। ঐ বছর তারা মাত্র ১০ টি আসন পেয়েছিল। তারও আগে ২০১১ সালে আসন পেয়েছিল মাত্র ৪টি। কিন্তু গত নির্বাচনে হঠাৎ করেই তারা ৩২টি আসন দখল করে নেয় এবং তৃতীয় স্থানে চলে আসে। এটি তাদের জন্য একটি বড় ধরণের অপ্রত্যাশিত বিজয়। বিরোধী দল কনজার্ভেটিভ এর পরেই তাদের স্থান এখন। সেই হিসাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ দল হিসাবেই তাদের আগমন ঘটেছে। আর বলা হচ্ছে ব্লক কুইবেকোর কারণেই এবার লিবারেল পার্টি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। অন্যদিকে এনডিপিকে কোনঠাসা করেছে কুইবেকে।
ধারণা করা হচ্ছে ব্লক কুইবেকো ২০২০ সালে পার্লামেন্টে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় বড় ধরণের ভ‚মিকা রাখতে পারে। কিন্তু সেটি সম্ভবত নাও হতে পারে। কারণ, এনডিপি অতি অল্প সংখ্যক আসন পেলেও লিবারেলকে সংকটকালে সমর্থন দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ব্লক কুইবেকোর সমর্থন না পেলেও লিবারেল এর চলবে। লিবারেল এর ১৫৭ টি আসন ও এনডিপি’র ২৪ টি আসন মিলে ১৮১টি আসন হয়ে যায়। পার্লামেন্টে কোন প্রস্তাব পাশ করতে হলে ১৭০টি আসনের সমর্থনই যথেষ্ট।
ব্লক কুইবেকো নেতা ইয়ভেস-ফ্রাঙ্কোয়েস ব্ল্যানচেট নির্বাচনে জয়ী হয়ে বলেছিলেন, আমরা অনেক পিছনের অবস্থান থেকে ফিরে এসেছি। তবে এখানেই শেষ নয়, আমরা সামনে আরো এগিয়ে যেতে চাই।
এখন দেখার পালা এই ব্লক নেতা তার দলকে নিয়ে ২০২০ সালের রাজনীতিতে কি ভ‚মিকা রাখতে পারবেন বা কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন।
এদিকে গত জাতীয় নির্বাচনে দলকে জয়ী করতে না পেরে কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান নেতা এন্ড্রু শিয়ার তার পদ থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছেন। আগামী ২৭ জুন দলের লিডারশীপ ইলেকশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই নির্বাচনের প্রচারও জমে উঠেছে। দলের হেভিওয়েট কয়েকজন নেতা তাদের প্রার্থীতার কথা ঘোষণা করেছেন। এদের মধ্যে কনজার্ভেটিভ পার্টির পিটার ম্যাক্কে ফ্রন্টরানার হিসাবে বিবেচিত হচ্ছেন। কানাডার রাজনীতি তার রিচ ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। তিনি ইতিপূর্বে মিনিস্টার ফর জাস্টিস এ্যান্ড এটির্নি জেনারেল, মিনিস্টার অফ ন্যাশনাল ডিফেন্স, মিনিস্টার অফ ফরেইন এ্যাফেয়ার্স এর দায়িত্ব পালন করেন। কনজার্ভেটিভ পার্টির তিনি ডেপুটি লিডারও ছিলেন। প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি অফ কানাডা’র লিডারও ছিলেন তিনি ২০০৩ সালে যখন দলটি কনজার্ভেটিভ পার্টির সঙ্গে মার্জ করে। পেশায় তিনি ছিলেন একজন আইনজীবী। দলে তার সমর্থনও বেশ দেখা যাচ্ছে। লিডারশীপ প্রতিযোগিতায় পিটার ম্যাক্কে জয়ী হলে জাস্টিন ট্রুডোর জন্য মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়াতে পারেন তিনি।
কে হবেন অন্টারিও’র লিবারেল পার্টির নেতা?
২০১৮ সালের ৭ জুন অন্টারিও’র প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্টের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন ড্যাগ ফোর্ড। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সেদিন সবাইকে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। নির্বাচনে ড্যাগ ফোর্ড এর নেতৃত্বাধিন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি জয়ী হয়েছে মোট ৭৬টি আসনে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে অন্টারিও এনডিপি। তারা জয়ী হয়েছে ৪০টি আসনে। আর অন্টারিও লিবারেল পার্টি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা থেকে নিক্ষিপ্ত হয়। ড্যাগ ফোর্ডের প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি। সেই পার্টিকে তিনি এমন ভাবে ধরাশায়ী করেছিলেন যে, তারা পার্লামেন্টে বিরোধী দলের মর্যাদাও হারায়। পার্লামেন্টে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে হলে অন্তত ৮টি আসনে জয়ী হতে হয়। লিবারেল পার্টি পেয়েছিল মাত্র ৭টি আসন! সেই থেকে অন্টারিও লিবারেল পার্টি রাজনীতির মাঠে একেবারেই নিভু নিভু বাতি হয়ে বিরাজ করছে। এর অন্তর্বর্তীকালীন নেতা জন ফ্রেসার এরও কোন কার্যক্রম গত দেড় বছরে লক্ষ্য করা যায়নি। স্ট্যাটাস না থাকলে যা হয়। কেউ তার কথায় কানও দেয়নি।
আগামী ৭ মার্চ দলটির লিডারশীপ নির্বাচন। ঐ দিন নির্বাচিত হবেন নতুন লিডার। ইতিমধ্যে ছয়জন প্রার্থী দাড়িয়েছেন প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার জন্য। তবে এর মধ্যে ফ্রন্টরানার হিসাবে অন্টারিও’র সাবেক Ministry of Economic and Growth এর মন্ত্রী স্টিভেন ডেল ডুকা’র নামই বেশী উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি ট্রান্সপোর্ট মিনিস্ট্রির মন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন। টরন্টো স্টার জানায়, ফ্রন্টরানারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী এগিয়ে আছেন স্টিভেন ডেল ডুকা।
স্টিভেন ডুকা অন্টারিওর ভন এলাকা থেকে নির্বাচিত এমপি ছিলেন। অন্টারিও লিবারেল পার্টিতে তিনি একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি। আশা করা হচ্ছে পার্টির নেতৃত্ব পেলে তিনি দলকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে পারবেন এবং ২০২০ সালে অন্টারিও’র রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারবেন।
উল্লেখ্য যে, স্টিভেন ডুকা ইমিগ্রেন্টদের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অন্টারিও প্রভিন্সের অর্থনীতি উন্নয়নে ইমিগ্রেন্টদের উল্লেখযোগ্য অবদান সবসময়ই ছিল এবং আগামীতেও থাকবে। ইমিগ্রেন্টরা এদেশে সাথে করে নিয়ে আসেন দক্ষতা, জ্ঞান, শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা যা তাদেরকে ব্যবসায় উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করে এবং আন্টারিওর অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের এই উদ্যোগ কাজে লাগে।
অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড
২০২০ সালে অন্টারিও’র রাজনীতিতে প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডের অবদান কি হতে পারে তার প্রমাণ তিনি নিজেই গত বছর দিয়ে দিয়েছেন। গত বছর প্রকাশিত হাফিংটন পোস্ট এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্টারিও-র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড এর জনপ্রিয়তা নিচের দিকে নামতে নামতে এক বছরের মাথায়ই একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, এই মূহুর্তে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তবে তার দল তৃতীয় স্থান লাভ করবে।
গত প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্টের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন ড্যাগ ফোর্ড। নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়ে সেদিন সবাইকে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
যে দলটি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল লিবারেলকে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল সেই অন্টারিও কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান ও প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডের অবস্থা এখন ঐ লিবারেল পার্টির পরাজিত নেত্রী ক্যাথলিন উইনের চেয়েও খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছে। মেইনস্ট্রিট রিসার্স কর্তৃক পরিচালিত এক জরীপে দেখা গেছে অন্টারিওবাসীদের মধ্যে শতকরা ২০ জন ড্যাগ ফোর্ডকে এখনো পছন্দ করেন। কিন্তু তাকে অপছন্দ করেন এমন অন্টারিওবাসীর সংখ্যা এখন দাড়িয়েছে শতকরা ৭৩ জনে। আর দিন যতই যাচ্ছে ততই ড্যাগ ফোর্ডের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে। এ কথা বলেন, মেইনস্ট্রিট রিসার্সের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিইটো ম্যাজি। তিনি আরো বলেন, আমরা কখনো দেখিনি কোন ক্ষমতাসীন প্রিমিয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে জনগনের এতটা বিরাগভাজন হয়ে উঠেছেন।
ড্যাগ ফোর্ডকে কেউ কেউ ‘এক্সিডেন্টাল প্রিমিয়ার’ হিসাবেও আখ্যায়িত করেন। তিনি এই মূহুর্তে বুদ্বুদের উপর বসে আছেন এবং সেই বুদ্বুদ যে কোন সময়ই ফেটে যেতে পারে এমন ধারণাই করছেন কেউ কেউ। তার প্রশাসনে এক ধরণের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। আর এ অবস্থা অনেকটাই তার প্রয়াত ভাই সাবেক মেয়র রব ফোর্ড এর সাথে মিলে যাচ্ছে। টরন্টোর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘নাউ’ এমনটাই বলছে।
গত নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর থেকে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ড্যাগ ফোর্ড বরাবরই থেকেছেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু এইসব বিতর্কের ফলাফল তার জন্য ইতিবাচক হয়নি। তার জনপ্রিয়তায় বিপুলভাবে নেমেছে ধ্বস।
আসলে ড্যাগ ফোর্ড বরাবরই ছিলেন বিতর্কের মধ্যে। প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনের আগেও তাকে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। তিনি এক সময় ড্রাগ ডিলার ছিলেন এমন খবরও কানাডার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা গ্লোব এন্ড মেইলে প্রকাশিত হয়েছিল ইতিপূর্বে।
সুতরাং এই ড্যাগ ফোর্ড এর কাছ থেকে অন্টারিওবাসী ২০২০ সালে ইতিবাচক কিছু আশা করছে না।