কানাডার জীবন অভিবাসীদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করে?
মার্চ ১৪, ২০২০
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ২০১৮ সালে কানাডা অভিবাসীদের জন্য সেরা দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউএস নিউজ এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট’ এর এক জরিপ তথ্য ছিল এটি। দ্বিতীয় স্থানে ছিল সুইজারল্যান্ড এবং তৃতীয় স্থানে সুইডেন। ২০১৭ সালে কানাডার অবস্থান ছিল দ্বিতীয় স্থানে।
শুধু ইউএস নিউজ এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট নয়, এর প্রতিফলন দেখা যায় ওয়াশিংটন ভিত্তিক পিউ রিসার্স সেন্টারের এক সমীক্ষায়ও। ওতে বলা হয় বিশ্বের প্রথম সারির দশটি দেশের মধ্যে অভিবাসীদের প্রতি সবচেয়ে বেশী ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে কানাডিয়ানদের। নতুন অভিবাসীদেরকে তারা বোঝা মনে না করে একটা শক্তি হিসাবে বিবেচনা করেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সত্যিকার অর্থে কানাডার জীবন অভিবাসীদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করছে? এ নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা বা গবেষণা কম হয়নি। গত দুই দশকে বা তারও কিছুটা বেশী সময় ধরে কানাডায় আসা অভিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা এখানকার মূলধারার মিডিয়া এবং গবেষকদের কাছে যথেষ্ট মনোযোগ পেয়েছে সন্দেহ নেই।
এই মনোনিবেশের বেশিরভাগ শ্রমবাজার এবং অভিবাসীদের আর্থিক ফলাফলগুলির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। অভিবাসীরা তাদের নিজ নিজ পেশায় চাকরী পেয়েছেন কি না, পেয়ে থাকলে শতকরা কতজন পেয়েছেন, তাদের আয় কেমন বা তাদের আয় কি দারিদ্র সীমার উপরে কি না এই বিষয়গুলো নিয়ে বেশ আলোচনা ও গবেষণা হয়েছে।
তবে গবেষণার ফলাফল হলো, গত শতকের শেষ দশকে এবং চলতি শতকের প্রথম দশকে, অর্থাৎ গত প্রায় বিশ বছরে কানাডায় আসা অভিবাসীদের সাফল্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয় যেমনটা ছিল তারো আগে আসা অভিবাসীদের বেলায়।
অথচ গত দুই দশকে আসা অভিবাসীদের মধ্য আগের আসা অভিবাসীদের তুলনায় উচ্চ শিক্ষিতের হার অনেক বেশী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী যেসব অভিবাসী সম্প্রতি কানাডায় আসছেন তারা চাকরির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে আসা অভিবাসীদের চেয়েও বেশি শিক্ষিত। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার এক নতুন সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
এমনকি অভিবাসীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতের হার কানাডিয়ানদের চেয়েও বেশী। নতুন আসা অভিবাসীরা শুধু যে নিজেরাই উচ্চ শিক্ষিত তাই নয়, তারা এ দেশে আসার পর তাদের ছেলে-মেয়েদেরকেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন। আর এ কারণেই অভিবাসীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার হার মূলধারার কানাডিয়ানদের তুলনায় বেশী। সম্প্রতি সরকারের এক অভ্যন্তরীন অনুসন্ধানে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। খবর টরস্টার নিউজের।
ঐ অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে অভিবাসী পরিবারের ৩৬% ছেলে-মেয়ের (যাদের বয়স ২৫-৩৫ এর মধ্যে) ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি রয়েছে। আর এই একই বয়সের মূলধারার কানাডিয়ান ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি রয়েছে ২৪% জনের।
অন্য এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে আসা ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী অভিবাসীদের মধ্যে শতকরা ৫৪.২ জনের ব্যাচলর ডিগ্রি রয়েছ। ১৯৯০ এর দশকে এই হার ছিল শতকরা ৩০.৫ ভাগ।
অভিবাসীদের মধ্যে যেখানে শতকরা ৫৪.২ জন এর ব্যাচেলর ডিগ্রি রয়েছে, সেখানে মূলধারার কানাডিয়ানদের মধ্যে এই হার শতকরা ২৭.৯ ভাগ। এই অনুসন্ধানটি চালান এসোসিয়েশন অব কানাডিয়ারন স্টাডিজ এর গবেষক জ্যাক জেকব। পেশায় তিনি কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটির স্যোশলজি এ্যান্ড পাবলিক এ্যাফেয়ার্স এর অধ্যাপক।
কেন্দ্রীয় এই সংস্থা কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত ১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষালাভকারী যেসব অভিবাসী কানাডায় এসেছে তাদের মধ্যে শতকরা ৩৫ ভাগেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা তাদের চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার চেয়ে বেশি। এই ফলাফল এখন এমন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে, কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থাকে এদেশের অর্থনৈতিক চাহিদার সঙ্গে আরও ভালোভাবে সংযুক্ত করা সম্ভব কিনা কিংবা দেশটি তার উচ্চশিক্ষিত কর্মশক্তিকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারছে কিনা। রিপোর্টে বলা হয়, “অতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা মানবসম্পদের অদক্ষ ব্যবহারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং উৎপাদনশীলতার অপচয় ঘটাচ্ছে।”
কানাডার কনফারেন্স বোর্ডের মুখ্য অর্থনীতিবিদ পেড্রো এন্টুনেস বলেন, অভিবাসীদের যোগ্যতা অনুযায়ী আরও ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারলে তা কানাডার অর্থনৈতিক কর্মকুশলতার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। তিনি বলেন, “আমরা যে বিষয় নিয়ে কথা বলছি সেটা হলো, আমরা এমন যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীদের নিয়ে আসছি যাদেরকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। সেজন্যেই আমরা যদি তাদের দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড উন্নততর করতে পারি।”
এখন প্রশ্ন উঠছে, অনেক উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ অভিবাসী থাকা সত্বেও তাদের আয় কেন কম আগের অভিবাসীদের তুলনায়? কেন এমনটা হচ্ছে? সেই প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন। প্রশ্নের মূল বিষয় হলো, যে আশা বা প্রত্যাশা নিয়ে গত দুই দশকে অভিবাসীরা কানাডায় এসেছেন সেই প্রত্যাশা কি তাহলে পূরণ হচ্ছে না?
দেখা গেছে ২০০০ সালের গোড়ার দিকে কানাডায় যে সকল অভিবাসী এসেছেন তাদের মধ্যে দেশটি সম্পর্কে যথেষ্ট ইতিবাচক মনোভাব বিদ্যমান ছিল। তারা কানাডার সামাজিক পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিবেশ, নিরাপত্তা, অধিকার, স্বাধীনতা, শান্তি এবং স্থিতির বিষয়গুলো নিয়ে খুব তৃপ্তি প্রকাশ করতেন। কানাডাকে তাদের নতুন দেশ হিসাবে বেছে নেওয়ার পিছনে এই কারণগুলো যথেষ্ট ভ‚মিকা রেখেছিল। অধিকাংশ অভিবাসী এমনো বলেছেন যে, তারা আর্থিক কারণে কানাডায় আসেননি। এসেছেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য যারা আগে থেকেই এদেশে ছিলেন এবং সেই সাথে এদেশের উন্নত জীবন উপভোগের জন্য।
সিবিসি নিউজের পক্ষে সম্পাদিত এক নতুন জরিপে দেখা গেছে, গত ১০ বছর বা তার কম সময়ের মধ্যে যারা এদেশে আছেন তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। সিবিসি নিউজে প্রকাশিত ঐ জরিপে বলা হয়, অন্য কানাডীয়দের চেয়ে নতুন কানাডীয়রা রাজনীতির ব্যাপারেও একটু বেশি আগ্রহী। আর দেশটি ঠিক পথেই এগুচ্ছে এমন ধারণা তাদের। তারা বলেন যে, কানাডার রাজনীতিতে দুর্নীতিকে তারা কোন সমস্যা বলে মনে করেন না।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নতুন কানাডীয়রা যে তিনটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলি হলো: চাকরি খুঁজে পাওয়া, আগের যোগ্যতার সনদের স্বীকৃতি পাওয়া এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের ক্ষেত্রে অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণের সময় ত্বরান্বিত করা।
তবে অন্য এক জরিপ তথ্য থেকে জানা যায়, দুই দশকের বেশি সময় ধরে কানাডায় বসবাসরত অভিবাসী পরিবারগুলো এই দেশে জন্মগ্রহণকারী কানাডীয়দের চেয়ে বেশি সম্পদশালী। সম্প্রতি প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার নতুন তথ্যে এমনটাই বলা হয়েছে। খবর সিবিসি নিউজের।
সংস্থার তথ্যে দেখা গেছে, গত দুই দশকে সার্বিকভাবে উভয় গ্রুপের লোকেদেরই সম্পদের বড় ধরণের বৃদ্ধি ঘটেছে।
যেসব প্রতিষ্ঠিত অভিবাসী পরিবারের মধ্যে প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তির বয়স ৪৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে এবং যারা অন্ততপক্ষে ২০ বছর আগে এদেশে এসেছেন তাদের সম্পদের পরিমাণ গড়ে ১৯৯৯ সালের ৬ লাখ ২৫ হাজার ডলার থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে ১০ লাখ ৬ হাজার ডলারে দাঁড়িয়েছে অর্থাৎ ৬৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
তুলনায় যেসব পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তিটি কানাডায় জন্মগ্রহণ করেছেন সেইসব পরিবারের সম্পদ কম বেড়েছে যা গড়ে ৫ লাখ ১৯ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে নয় লাখ ৭৯ হাজার ডলারে। বৃদ্ধির পরিমাণ চার লাখ ৬০ হাজার ডলার বা ৮৮ শতাংশের বেশি।
পরিসংখ্যান বিষয়ক সংস্থাটি বলছে, এই পার্থক্যের একটি কারণ এই হতে পারে যে, অভিবাসী পরিবারগুলোর বেশিরভাগেরই অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্র হলো রিয়েল এস্টেট। কানাডায় জন্মগ্রহণকারীদের পরিবারের তুলনায় অভিবাসী পরিবারগুলো সাধারণত সম্পদের বৃহদংশ বিনিয়োগ করে গৃহায়ন খাতে কিন্তু তাদের মোট সম্পদ অপেক্ষাকৃত কম।
অভিবাসন আইন নিয়ে ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হ্যালিফ্যাক্স-এর আইনজীবী লি কোহেন বলেন, সিবিসির জরিপে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা তার মক্কেলদের সঙ্গে যেসব কথোপকথন হয় তার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। তিনি বলেন, অনেক নবাগত কানাডীয়র কাছে কানাডা হলো “বেহেশতের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণের” মতো। সুতরাং বোঝাই যায় যে তারা সাধারণ কানাডীয়দের চেয়ে বেশি আশাবাদী হবেন।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সূত্র উল্লেখ করে কানাডাবাউন্ডইমিগ্রেন্ট.কম জানায়, নিরীক্ষা করে দেখা হয়েছে ২০০০ সালের গোড়ার দিকে আসা অভিবাসীরা কিভাবে তাদের কানাডীয় জীবনকে মূল্যায়ন করেছেন। আরো নির্দিষ্টভাবে বলা যেতে পারে, তারা কি পরিমাণে কানাডার জীবনে সন্তুষ্ট বা পরিতৃপ্ত। তারা যা আশা নিয়ে কানাডায় এসেছিলেন সেই আশা কি পূর্ণ হয়েছে? কোন উপায়ে জীবনটাকে যদি পিছনে ফিরিয়ে নেয়া যেত তবে তারা কি আবারো কানাডায় আসার জন্য সিদ্ধান্ত নিতেন।
যে যে বিষয়গুলো দেখার জন্য কানাডায় অভিবাসীদের জীবন নিয়ে এই নিরীক্ষাগুলো করা হয়েছে তার মধ্যে আছে –
পাবলিক পলিসির মূল লক্ষ্য হলো, সকল কানাডিয়ানদের কল্যান বা মঙ্গল এর প্রতি নজর রাখা। এর মাধ্যমে লোকজনের কর্মসংস্থান, আয় অথবা স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য উঠে আসে।
তাছাড়া অভিবাসীরা যখন তাদের কানাডীয় জীবনের মূল্যায়ণ করেন তার মধ্য দিয়ে এখানকার একটি চিত্র ফুটে উঠে।
অন্যদিকে একটি দেশের অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে দক্ষ অভিবাসীদেরকে আকর্ষণ করা ও তাদেরকে ধরে রাখতে পারার মধ্য দিয়ে।
সম্প্রতি অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) একটি রিপোর্টে কানাডার অর্থনৈতিক অভিবাসন ব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যতম সফল ব্যবস্থা হিসাবে প্রশংসা করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, কানাডাকে ব্যাপকতরভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য “পরম মানদন্ড” হিসাবে গণ্য করা হয়।
তবে আরও উন্নততর করার সুপারিশ তবে রিপোর্টে কিছু কিছু দিকে আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। তাদের সুপারিশগুলি হলো:
– দক্ষ শ্রমিকদের আসার ভিন্ন ভিন্ন উপায় রাখার পরিবর্তে বিদ্যমান র্যাংকিং সিস্টেম সহজ-সরল করা, কেন্দ্রের স্কিলড ট্রেড প্রোগ্রাম বাতিল করা।
– পেশাজীবীদের লাইসেন্স প্রদানের অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি ভিসাদানের ব্যবস্থা রাখা; তাদের ক্রেডেন্সিয়ালের স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তথ্যপ্রবাহ বাড়ানো এবং সমন্বিতকরণ।
– প্রধান নগর এলাকার বাইরে আঞ্চলিক আবাসন সুবিধা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উৎসাহদান; আটলান্টিক ও গ্রামীণ অভিবাসী প্রকল্পের সাফল্যের ধারায় এগুলো গড়ে তোলা।
– যেসব কোম্পানি অস্থায়ী বিদেশি কর্মীদের জন্য বিদ্যমান অভিবাসন কর্মসূচির সর্বোচ্চ ব্যবহার করবে তাদের জন্য একটি আস্থাশীল নিয়োগদাতা প্রকল্প চালু করার বিষয়টি বিবেচনা করা।
রিপোর্টে অভিবাসীদের আগমনের আগেই কানাডার জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্য ও আবাসন এবং কর্মসংস্থান বিষয়ে যেসব সেবা দেয়া হয় সেজন্যে দেশটির প্রশংসা করা হয়েছে। তবে এতে এটাও উল্লেখ করা হয় যে, এসব সেবা লাভের যোগ্য অর্থনৈতিক শ্রেণির অভিবাসীদের মাত্র ৮.৫ ভাগ বাস্তবে ওই সেবা লাভ করেছে।
উল্লেখ্য যে, পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল উপকরণ হিসাবে এখন দেখা হচ্ছে এই দক্ষ অভিবাসীদেরকে। কিন্তু যদি এই অভিবাসীরা কোন দেশে কোন কারণে অসুখী হন বা হতাশ হয়ে পড়েন কিংবা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তখন বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে অভিবাসীদের হোস্ট কান্ট্রিতে ।
বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার পর অনেক তথ্যই উঠে এসেছে। কানাডায় অভিবাসী জনগোষ্ঠির বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন মাত্রার সন্তোষ বা পরিতৃপ্তি দেখা গেছে। কোন কোন অভিবাসী জনগোষ্ঠির মধ্যে কানাডার জীবন সম্পর্কে উচ্চ মাত্রার সন্তোষ দেখা গেছে আবার কোন কোন অভিবাসী জনগোষ্ঠির মধ্যে অল্পমাত্রার সন্তোষ লক্ষ্য করা গেছে। যারা বিবাহিত তাদের মধ্যে উচ্চমাত্রার সন্তোষ লক্ষ্য করা গেছে কানাডার জীবনে। তবে যাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে অথবা পৃথক অবস্থায় আছেন তাদের মধ্যে সন্তোষের মাত্রা কম দেখা গেছে কানাডর জীবনে। আবার পুরুষের তুলনায় মহিলারা কানাডার জীবনে বেশী সুখী এমন তথ্যও উঠে এসেছে গাবেষণায়। দেখা গেছে শিক্ষাগত যোগ্যতাও অনেক ক্ষেত্রে কানাডার জীবন কতটা সন্তুষ্টির বা অসন্তুষ্টির তা নির্ধারণে ভ‚মিকা রাখছে। ২০০৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্য এ দুটো বিষয়ও নির্ভর করে কানাডার জীবনে কে কতটা সুখী বা সন্তুষ্ট।
সেটেলমেন্ট অভিজ্ঞতা
হোস্ট কান্ট্রিতে অভিবাসীদের গ্রহণযোগ্যতা কি রকম এবং তাদেরকে স্বাগত জানানোর মনোবৃত্তি মূলধারার জনগণের মধ্যে কি রকম এগুলোও নির্ভর করে অভিবাসীদের সন্তুষ্টি কতটা হবে বা হবে না। বিশেষ করে বৈষম্যের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে যা গবেষকদের নজরে এসেছে।
অভিবাসীরা নতুন দেশে এসে স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও নিয়ম-কানুন এর সঙ্গে নিজেদের কতটা খাপ খাওয়াতে পারে তার উপরও নির্ভর করে তাদের সন্তুষ্টির মাত্রা কি হবে। তারা যে দেশ থেকে আসেন সে দেশের সঙ্গে নতুন দেশের অনেক কিছুরই মিল থাকে না। এই বিষয়টি অনেকের ক্ষেত্রেই বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে।
বস্তুগত কল্যাণ বা সমৃদ্ধি
গবেষণায় দেখা গেছে অভিবাসীদের আয় কমে যাওয়া এবং জীবনের তৃপ্তি হ্রাস পাওয়ার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বেশী। কিন্তু অপর দিকে আয় বৃদ্ধি পাওয়া এবং জীবনের তৃপ্তি বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ততটা বিদ্যমান নয়।
কানাডিয়ান জীবনে অভিবাসীরা কতটা তৃপ্ত সেটি তুলনা করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন বিষয়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারেন। এর মধ্যে আছে- তারা কি চান, ফেলে আসা দেশে তাদের কি ছিল, অন্যদের তুলনায় তাদের কি কি আছে, তারা তাদের প্রাপ্য কি বলে মনে করেন।
এক সমীক্ষায় অভিবাসীদের প্রশ্ন করা হয় কানাডায় তাদের জীবন এর পরিতৃপ্তি নিয়ে। তারা কি সম্পূর্ণভাবে অতৃপ্ত না সম্পূর্ণভাবে তৃপ্ত এ প্রশ্নের উত্তর দেন ‘ফাইভ পয়েন্ট স্কেল’ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে।
এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ছিলেন যারা অভিবাসী হয়ে আসার আগেও স্টুডেন্ট বা ওয়ার্ক ভিসায় কানাডায় ছিলেন। এই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে কানাডার জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব বিদ্যমান। যারা অভিবাসন নিয়ে কানাডায় এসেছেন এবং আগে কানাডায় থাকার অভিজ্ঞতা নেই, তাদের তুলনায় কানাডার জীবন সম্পর্কে আগে উল্লেখিত গ্রুপের সদস্যদের প্রত্যাশা অধিকতর বাস্তবধর্মী।
সমীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১২০৪০ জন অভিবাসী। এরা প্রথম দফায় কানাডায় আসার ছয় মাস পর কানাডা সম্পর্কে তাদের সন্তুষ্টির মাত্রা কি ছিল তার উত্তর দেন। চার বছর পর এই একই অভিসাসীদের দ্বিতীয় দফায় একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। তবে চার বছর পর ৪৩২৪ জনকে পাওয়া যায়নি প্রশ্ন করার জন্য। ধারণা করা হয় তারা হয় কানাডার অন্যত্র চলে গেছেন বা কানাডা ছেড়ে স্বদেশে বা অন্যকোন দেশে চলে গেছেন চাকরীর খোঁজে। অথবা সমীক্ষায় অংশ নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন।
কানাডীয় জীবনের মূল্যায়ন
কানাডার জীবন সম্পর্কে সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ অভিবাসীর ইতিবাচক মূল্যায়ন ছিল। প্রথম ছয় মাস পর বা পরবর্তী চার বছর পরও তারা তাদের কানাডিয়ান জীবন নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এদের হার ছিল শতকরা ৫৪.২ ভাগ। এদের মধ্যে ১৯ % বলেছেন কানাডার জীবন নিয়ে তারা খুবই অথবা সম্পূর্ণভাবে সুখী বা সন্তুষ্ট। আর সম্মিলিতভাবে সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৭৩% অভিবাসী বলেছেন তারা সুখী, ১৭.৭% বলেছেন তারা নিরপেক্ষ অর্থাৎ সুখীও নন আবার অসুখীও নন। ৯.৪% বলেছেন তারা হয় অসুখী অথবা খুবই অসুখী কানাডীয় জীবনে। আর সিংহভাগ অংশগ্রহণকারী (৮৭ – ৯১%) বলেছেন, তাদেরকে যদি নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয় কানাডায় আসার ব্যাপারে তবে তারা আবারো আসবেন।
আমরা জানি কানাডা পৃথিবীর অন্যতম শান্তির দেশ হিসাবেও বিবেচিত। ইতিপূর্বের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রথম দশটি শান্তির দেশের তালিকায় কানাডার অবস্থান অষ্টম। গ্লোবাল পিস ইন্ডেক্স এই রিপোর্টটি প্রকাশ করে ইতিপূর্বে। তাদের রিপোর্টে আরো দেখা যায় কানাডা ইউরোপের বাইরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে শান্তি ও নিরাপত্তার বিচারে। আর উত্তর আমেরিকায় কানাডার অবস্থান সর্বোচ্চ। সুতরাং এ কথা বলাই যায় সার্বিক বিচারে কানাডার জীবন অভিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করে।